দেশের ৩১৫টি বেসরকারি কলেজের অনার্স-মাস্টার্স স্তরের প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার শিক্ষকের এমপিওভুক্তি দীর্ঘ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। নির্বাচনের পর নতুন সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে তাদের এমপিওভুক্তি। আর নতুন সরকার সিদ্ধান্ত নিলেও জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্তিতেই চলে যাবে দীর্ঘ সময়। এই পরিস্থিতিতে হতাশার মধ্যে পড়েছেন শিক্ষকরা। তারা বলছেন— অনেকে অবসরে গেছেন বেতন-ভাতা না পেয়ে। এমপিওভুক্তি দ্রুত না পেলে আবারও অনেক শিক্ষক অবসরে যাবেন। এভাবেই বছরের পর বছর মানবেতর জীবন-যাপন করছেন শিক্ষকরা। আবারও শুরু হলো দীর্ঘ অনিশ্চয়তা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সালের বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের (স্কুল ও কলেজ) জনবল কাঠামো ও এমপিও নীতিমালা সংশোধন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। কয়েক দফা বৈঠক করে অনেক বিষয় চূড়ান্ত করা হয়েছে। তবে সংশোধনের কোনও পর্যায়ে অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের পদ জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করার কোনও সিদ্ধান্ত নেই।
দীর্ঘ ২৮ বছর ধরে বঞ্চিত অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করতে ২০২০ সালে জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত করার আশ্বাস দিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর শিক্ষা বিষয়ক রিপোর্টারদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি বলেছিলেন, ‘অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষক ও জনবল কাঠামো নিয়ে ভাবছি। এর সঙ্গে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় জড়িত, তাদের সঙ্গে কিছুটা কথা হয়েছে। আমরা বসবো এই বিষয়টি নিয়ে শিগগিরই সমাধান করার জন্য। ’
শিক্ষামন্ত্রীর ডা. দীপু মনির আশ্বাসের পর তিন বছরের বেশি সময় পার হয়ে গেলেও জনবল কাঠামো সংশোধন করা হয়নি। এরই মধ্যে এই সরকারের মেয়াদ শেষ হয়েছে। আগামী ৭ জানুয়ারি জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ক্ষমতা হাতে নেওয়ার পর নতুন সরকারের সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করবে বেসরকারি অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের বেতন-ভাতা পাওয়া-না পাওয়া।
এমপিওভুক্তির বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মশিউর রহমান বলেন, এ বিষয়ে সরকার থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে এখনও কিছু জানানো হয়নি।
বাংলাদেশ বেসরকারি কলেজ অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক ফেডারেশনের আহ্বায়ক হারুন-অর-রশিদ বলেন, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অধিভুক্ত বেসরকারি কলেজগুলোয় অনার্স-মাস্টার্স স্তরের সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষক গত কয়েক বছর শান্তিপূর্ণ ও অহিংস আন্দোলনসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে অনেকবার আবেদন-নিবেদন করেছেন। কিন্তু কোনও লাভ হয়নি। সর্বশেষ জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের চাহিদামতো সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষকের পরিসংখ্যান দিয়েছি। কিন্তু মন্ত্রণালয়ের গঠন করা কমিটি বা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সুনির্দিষ্ট কোনও কিছু জানাতে পারেনি। বিগত ৩০ বছর ধরে নামমাত্র সম্মানী নিয়ে আবার অনেকে বিনাসম্মানীতে শিক্ষকতা পেশায় কাজ করলেও জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় কোনও পদক্ষেপ নেয়নি। এখনও দীর্ঘ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছি। নির্বাচনের পর নতুন সরকার ক্ষমতায় বসলে আমরা আমাদের দাবি তুলে ধরবো। দ্রুত দাবি আদায় না হলে পরবর্তীতে লাগাতার আন্দোলন কর্মসূচিতে যাবেন শিক্ষকরা।
সংগঠনের সদস্য সচিব মো. মোস্তফা কামাল বলেন, ‘কর্মরত শিক্ষকদের এমপিওভুক্ত করা হলে প্রতিমাসে ১২ কোটি অর্থাৎ বছরে ১৪৪ কোটি টাকা বাজেটে ব্যয়বরাদ্দ প্রয়োজন হবে। অথচ বছরে মাত্র ১৪৪ কোটি টাকায় সাড়ে ৫ হাজার পরিবারের বেঁচে যাবে, উচ্চশিক্ষা ক্ষেত্রে দুরবস্থার নিরসন হবে। বিষয়টি আমরা বারবার সরকারের নজরে এনেছি। সংক্ষিপ্ত আন্দোলন কর্মসূচিও পালন করেছে। ভবিষ্যতে আমাদের লাগাতার আন্দোলন-কর্মসূচিতে যেতে হবে বলে মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশ নিগৃহীত অনার্স-মাস্টার্স শিক্ষক পরিষদের সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট নয়ন কান্তি দাস বলেন, আমাদের এমপিওভুক্তির আশ্বাস পেয়েছি, কিন্তু কোনও সুরাহা হয়নি গত তিন বছরেও। নতুন সরকার এলে যে-ই শিক্ষামন্ত্রী হোক না কেন আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি আস্থাশীল। নিশ্চয় তিনি আমাদের জন্য কিছু করবেন।
সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক মিল্টন মণ্ডল বলেন, প্রায় সাড়ে ৫ হাজার শিক্ষক দীর্ঘ ৩০ বছরেও এমপিওভুক্ত হয়নি। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দ্বারস্থ হলে কোনও লাভ হয়নি। শিক্ষকদের পদ জনবল কাঠামোতে অন্তর্ভুক্ত না থাকলেও সরকার চাইলে যেকোনও সময় বিশেষ ব্যবস্থায় এমপিওভুক্ত করতে পারে। জনবল কাঠামো সংশোধন করার সদিচ্ছা থাকলে সমাধান হতে বেশি সময় লাগে না। জনবল কাঠামোতে পদ অন্তর্ভুক্ত না থাকার সুযোগ নিয়ে পাশ কাটানো হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এ বিষয়টি নিয়ে কখনও ভেবেও দেখেন না। এমনকি সর্বশেষ ২০১৮ জনবল সংশোধনীতে এ স্তরের শিক্ষকদের পদ জনবলে অন্তর্ভুক্তিতে জনবল কাঠামো ও নীতিমালা সংশোধন কমিটির প্রথম বৈঠকে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছালেও পরবর্তীতে তা আর আলোর মুখ দেখেনি।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, বেসরকারি কলেজের জনবল কাঠামো অনুযায়ী ডিগ্রিস্তর পর্যন্ত পরিচালিত এমপিওভুক্ত কলেজগুলোয় ১৯৯৩ সালে অনার্স-মাস্টার্স স্তরের অনুমোদন দেয় জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়। কলেজ কর্তৃপক্ষ বিধিবিধান অনুযায়ী নির্ধারিত স্কেলে শিক্ষকদের মূল বেতন দেওয়ার শর্তে অনার্স-মাস্টার্সের বিষয় অনুমোদন নেয়। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট কলেজের টিউশন ফি থেকে শিক্ষকদের বেতনভাতা দেওয়ার নির্দেশনা দেয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে। এই কারণে কলেজগুলোর জনবল কাঠামোতে স্থান পায়নি অনার্স-মাস্টার্স স্তরের শিক্ষকদের পদ। ফলে সরকারি বিধিবিধানের আলোকে এমপিওভুক্ত হওয়ার সুযোগ বঞ্চিত হন তারা। আর বিগত ৩০ বছরেও এই সমস্যার সমাধান হয়নি।