রাজধানী ঢাকার সরকারি সাতটি কলেজকে নিয়ে স্বতন্ত্র পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এখনই করবে না সরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় (ঢাবি) অধিভুক্ত কলেজগুলো হলো—ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ ও সরকারি তিতুমীর কলেজ।
রাজধানী ঢাকার সরকারি এই সাতটি কলেজের দাবি ছিল স্বতন্ত্র একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার। তবে এই দাবির পর নতুন করে সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের একাংশ সরকারি তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি জানিয়ে নতুন করে আন্দোলন শুরু করেন।
সোমবার (১৮ নভেম্বর) বিকালে সচিবালয় গেটের সামনে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি হিসেবে ১৪ জন শিক্ষার্থী সচিবালয়ে যান। তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা সচিবের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে আশানুরূপ সিদ্ধান্ত না পেয়েই সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে শিক্ষার্থীরা সচিবালয় ছাড়েন।
তিতুমীর কলেজে চলমান আন্দোলনে যোগ দেন এই ১৪ জন প্রতিনিধি। সন্ধ্যায় রাস্তা অবরোধও করেন তারা। সেখানে প্রেস ব্রিফিং করে রাত ৯টার দিকে তারা ক্যাম্পাস ছাড়েন।
তিতুমীর কলেজের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী কাওসার বাংলা ট্রিবিউন বলেন, ‘মন্ত্রণালয়ে আমরা যাই সাড়ে তিনটার দিকে। আমরা ১৪ জন শিক্ষার্থী সচিবসহ অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করি। প্রথমে আমাদের আশ্বাস দিয়ে বলা হয় একটি বিজ্ঞপ্তি দেবেন তারা। আমরা অপেক্ষা করি। কিন্তু ওপরের ফোন কলের পর তারা আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার আশ্বাস দেন। আমরা আগামীকাল (মঙ্গলবার) পর্যন্ত অপেক্ষা করবো সিদ্ধান্তের জন্য। তারপর আন্দোলনে যাবো। অন্য কলেজ কী করবে সেটা তাদের বিষয়, আমরা তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর চাই।’
এদিকে, তিতুমীর কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের দাবির সঙ্গে একমত না হয়ে সাত কলেজকে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তরের দাবি জানানো হয়েছে সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর আন্দোলনের পক্ষ থেকে।
সাত কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর আন্দোলনের অন্যতম মুখপাত্র কবি নজরুল সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী জাকারিয়া বারী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা সাত কলেজের সাধারণ শিক্ষার্থীরা স্বতন্ত্র একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠান দাবিতে আন্দোলন করেছি। শিক্ষা উপদেষ্টার আশ্বাস পেয়ে আমরা আন্দোলনের গতি কমিয়ে দিয়েছি। আমাদের সঙ্গে সাতটি কলেজের সব সাধারণ শিক্ষার্থী রয়েছে। কিন্তু আজ তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা কেন কী জন্য আন্দোলন করছে আমরা জানি না। হয়তো রাজনৈতিক বিষয় থাকতে পারে। আজকের এই আন্দোলনের বিপক্ষে আগামীকাল তিতুমীরসহ সাতটি কলেজের শিক্ষার্থীরা নিজ নিজ কলেজে প্রতিবাদ সমাবেশ করবে।
সরকারের সিদ্ধান্ত
সরকারের সিদ্ধান্ত জানতে চাইলে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘সরকারের অবস্থান ক্লিয়ার। এটি একটি ধারাবাহিক ব্যাপার। ঢাকা কলেজসহ সাতটি কলেজের পৃথকীকরণসহ শিক্ষার্থীদের সমস্যা সমাধানে অন্য একটি কমিটি কাজ করছে। এর আগে এই সাতটি কলেজের অধ্যক্ষদের সঙ্গে শিক্ষার্থী প্রতিনিধিদের কথা হয়েছে। যে কমিটি করা হয়েছে সেই কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে অতি শিগগিরই আরেকটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হচ্ছে। এই কমিটির কাজ হবে তিতুমীর কলেজসহ সাতিটি কলেজের প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো ও পরবর্তী পদক্ষেপ সম্পর্কে সুপারিশ করা। এটিই সরকারের অবস্থান।
শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, ‘বিভিন্ন সমস্যা ছিল। অধিভুক্ত করা ছিল অবিবেচনাপ্রসূত সিদ্ধান্ত। তাতে করে প্রথম থেকেই সেশন জট হয়েছিল। তাদের যারা পড়ায় তারা হলেন বিসিএস ক্যাডারের শিক্ষক। আর প্রশ্নপত্র করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা। কাজেই এগুলো তাদের জন্য অসুবিধা ছিল। এজন্য তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। আর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা আন্দোলন করছে অধিভুক্তি বাতিলের জন্য। এটি তো একদিনে হবে না। এই সাতটি কলেজকে পৃথকীকরণ করা হবে। এখন সেটি করার জন্য তো প্রক্রিয়া লাগবে। যে কমিটি করা হয়েছে সেই কমিটি কলেজগুলোর প্রতিষ্ঠানিক কাঠামো এবং পরবর্তী প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিয়ে সুপারিশ করবে। তিতুমীর কলেজও সেখানে অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, শিক্ষা ক্যাডারের শিক্ষকরা সরকারি সাত কলেজে শিক্ষকতা করেন। তারা যে কোনও সময় বদলি হতে পারেন। এই কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করা সহজ বিষয় নয়। আর সাতটি কলেজ ঢাকায় প্রয়োজনও নেই। জগন্নাথ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরের সময় পিএইচডি করা শিক্ষকদেরও আত্তীকরণ করা যায়নি। নানা জটিলতা রয়েছে। এই সাতটি কলেজ রাতারাতি বিশ্ববিদ্যালয় করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। শিক্ষার্থীদের দাবি অযৌক্তিক। ঢাকার সাতটি কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয় করারও কোনও সুযোগ নেই।
সাত কলেজের সমস্যা
শিক্ষার মানোন্নয়নের জন্য ২০১৭ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর ঐতিহ্যবাহী সরকারি সাতটি কলেজকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) অধিভুক্ত করা হয়। তবে সাত বছর পার হলেও দূর হয়নি বৈষম্য, খরচ বাড়লেও দায়িত্বে দেখা গেছে চরম গাফিলতি। এর আগে এসব প্রতিষ্ঠানের স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণির সার্বিক কার্যক্রম জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করতো। ঐতিহ্যবাহী এই কলেজগুলোর শিক্ষার মানোন্নয়নে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্থানান্তর করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত করা হয়।
ঢাবি অধিভুক্ত কলেজগুলো হলো ঢাকা কলেজ, ইডেন মহিলা কলেজ, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলেজ, মিরপুর বাঙলা কলেজ এবং সরকারি তিতুমীর কলেজ।
সংশ্লিষ্টরা জানান, দীর্ঘমেয়াদি কোনও পরিকল্পনা না করেই ঐতিহ্যবাহী এই সাত কলেজকে অনেকটা তড়িঘড়ি করে ঢাবির অধিভুক্ত করে বিগত সরকার। ফলে অধিভুক্তির পর থেকেই প্রশাসনিক ও একাডেমিক বিভিন্ন সমস্যা সামনে আসে। কলেজগুলোর অ্যাকাডেমিক ক্যালেন্ডার না থাকা, সিলেবাস নিয়ে ধোঁয়াশা, তীব্র সেশনজট, ফল প্রকাশে দীর্ঘসূত্রতা, ত্রুটিযুক্ত ফল, রেকর্ড সংখ্যক শিক্ষার্থী অকৃতকার্য হওয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। এসব নিয়ে কয়েক বছর ধরেই রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করেন শিক্ষার্থীরা। সর্বশেষ সাতটি কলেজ নিয়ে আলাদাভাবে ‘স্বতন্ত্র’ বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে আন্দালন করেন শিক্ষার্ধীরা।
স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যলয় প্রতিষ্ঠাসহ আগের সাত দফা দাবি
১. সাত কলেজ নিয়ে একটি স্বায়ত্তশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় করার অভিপ্রায়ে দ্রুত সময়ের মধ্যে একটি সংস্কার কমিটি গঠন করতে হবে।
২. সংস্কার কমিটি অনধিক ৩০ কার্যদিবসের মধ্যে সাত কলেজের শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করে সাত কলেজের সমন্বয়ে শুধু একটি স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার রূপরেখা প্রণয়ন করবেন।
৩. সংস্কার কমিটি বর্তমান কাঠামো সচল রাখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করবেন; যাতে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের সেশন জটিলতার কোনও ধরনের পরিবেশ তৈরি না হয়।
তিতুমীর কলেজের দাবি
তিতুমীর কলেজকে স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করতে হবে।