X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
জন্মদিনে একান্ত আলাপ

এই শীতেই ঢাকা ছাড়বো, গ্রামে স্থায়ী হবো: কনকচাঁপা

কামরুল ইসলাম
১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ১৮:০০আপডেট : ১১ সেপ্টেম্বর ২০২২, ২০:১৬

বাংলা সিনেমার গানে হাতে গোনা যে ক’জন নারী কণ্ঠশিল্পী আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা পেয়েছেন, তাদের একজন কনকচাঁপা। যিনি নিজেকে কণ্ঠশ্রমিক বলে দাবি করেন। তিনি প্রায় চার হাজার গান উপহার দিয়েছেন। এরমধ্যে কালজয়ী গানের সংখ্যাও অনেক। রবিবার (১১ সেপ্টেম্বর) নন্দিত এই গায়িকার জন্মদিন। বিশেষ দিনে তিনি মনের জানালা খুলে কথা বলেছেন বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে। গানের পাশাপাশি উঠে এসেছে তার একান্ত ইচ্ছে, ভাবনা আর ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথা- 

বাংলা ট্রিবিউন: জন্মদিনের শুভেচ্ছা। কেমন আছেন? 

কনকচাঁপা: ধন্যবাদ। আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
 
বাংলা ট্রিবিউন: জন্মদিন এলে কী মনে হয়, বয়স বাড়ে নাকি কমে? 

কনকচাঁপা: বয়স একদিকে বাড়ে, আরেকদিকে আয়ু কমে। তবে এটাকে আমি অন্যভাবে দেখি। গত বছর আমার বয়স ছিলো ৫২, এবার ৫৩-তে পা দিলাম। সে হিসেবে আমার এক বছরের অভিজ্ঞতা বাড়লো। এই অভিজ্ঞতা মানুষের জীবনে বড় অর্জন। এ কারণেই কিন্তু আমরা আমাদের বয়োবৃদ্ধদের সম্মান করি, কেননা তাঁরা অনেক কিছুর সাক্ষী। জন্মের পর থেকেই এক এক করে বছর যাচ্ছে, একইসঙ্গে আমি অনেক অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, জীবনের অনেক রঙ-রূপ দেখেছি। তাই আমার অনুভূতি হলো- বয়স বাড়ে না, কমেও না; শুধু অভিজ্ঞতার পাল্লা ভারি হয়।
 
এই শীতেই ঢাকা ছাড়বো, গ্রামে স্থায়ী হবো: কনকচাঁপা বাংলা ট্রিবিউন: শুনলাম গতকাল (১০ সেপ্টেম্বর) সিনেমা দেখতে গিয়েছিলেন...!

কনকচাঁপা: (খানিক হেসে) ‘হাওয়া’ দেখেছি। অনেক বছর পর হলে গিয়ে দেশের সিনেমা দেখলাম। যতদূর মনে পড়ে, এর আগে সর্বশেষ ‘গেরিলা’ (২০১১) দেখেছিলাম। তো গতকাল আমার মেয়ে আমাকে নিয়ে গেলো। এই সিনেমার একটি গান (সাদা সাদা কালা কালা) এত অদ্ভুত হয়েছে; ইমন চৌধুরীর মিউজিক আমি খুবই পছন্দ করি। আর সিনেমাটি দেখার আগে অনেকের রিভিউ পেয়েছি, কিন্তু আমি নিজে দেখার আগে কারও রিভিউ গ্রহণ করি না। কারণ আমার নিজস্ব একটা চিন্তা-ভাবনা থাকে। 

বাংলা ট্রিবিউন: ‘হাওয়া’ আপনাকে কতটুকু ছুঁতে পেরেছে?

কনকচাঁপা: এই সিনেমার সবকিছু এত বিস্তারিত আর নিখুঁত ছিলো, আমি মুগ্ধ। মৎস্যজীবীদের জীবন এত কাছ থেকে দেখা; পাশাপাশি সিনেমাটির সাউন্ড, মিউজিক এবং কলাকুশলী; সবকিছু দুর্দান্ত। চঞ্চল চৌধুরী অবশ্যই অনেক বড় তারকা। তবে গতকাল টের পেলাম তিনি কত পাকা অভিনেতা। গা কাঁটা দিয়ে উঠছিল তার অভিনয় দেখে। তার চুলের যে রঙ, শার্ট, তার ভুঁড়ি বের হয়ে থাকা, দাঁত, দাঁতের ময়লা, একেবারে আঙুল থেকে শুরু করে মাথার চুল পর্যন্ত সব নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। শুধু চঞ্চল না, অন্যরাও অসাধারণ কাজ করেছেন। আমি খুব অবাক হয়েছি, আমাদের সিনেমা আসলে বিশ্বমানের হচ্ছে।
 
এই শীতেই ঢাকা ছাড়বো, গ্রামে স্থায়ী হবো: কনকচাঁপা বাংলা ট্রিবিউন: এমন কোনও কাজ আছে, যেটা এখনও করতে পারেননি। যার জন্য আক্ষেপ হয়...

কনকচাঁপা: আমি একেবারে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক হতে চাই। কিন্তু সেটা আসলে কতটুকু সম্ভব জানি না। কারণ মধ্যবয়সে চলে এসেছি, কৃষক হওয়া তো শারীরিক সামর্থ্যেরও একটা ব্যাপার। এরপরও সব পরিকল্পনা, কাজ প্রায় শেষ। আমার স্বপ্নের একেবারে দ্বারপ্রান্তে আছি। ঢাকা শহরে আর থাকবোই না। আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা ঢাকায়; কিন্তু এখানে এখন আমার দম আটকে আসে। প্রকৃতির কাছাকাছি না, একেবারে প্রকৃতির ভেতরে চলে যাচ্ছি। বগুড়ায় আমার শ্বশুরবাড়ি, সেখানেই আমি অনেক আগে কিছু জায়গা কিনেছি। বিভিন্ন গাছপালা লাগিয়েছি, বাড়ি বানানোর কাজও শেষ প্রায়। আশা আছে এই শীতেই ঢাকা ছাড়বো, গ্রামে স্থায়ী হবো।
 
বাংলা ট্রিবিউন: শহরেও তো আপনি কৃষির সঙ্গে যুক্ত...

কনকচাঁপা: হ্যাঁ, আমার বাসায় অনেক টব আছে। বিভিন্ন ফল, সবজির গাছ লাগিয়েছি। এমনকি শাপলা-পদ্মও আছে। আসলে আমি যে গাছই রোপণ করি, সেটাই হয়।
 
বাংলা ট্রিবিউন: সিনেমার গানে আপনাকে আর তেমন পাওয়া যায় না। এটা বেদনার ও বিস্ময়কর। কারণ কী?

কনকচাঁপা: (কিছুটা ভেবে) যতদূর মনে পড়ে বছর দুয়েক আগে শেষ গেয়েছি। সিনেমায় আসলে টিমওয়ার্ক ছিলো। আমি ইচ্ছে করলেই গেয়েছি, এমন না। আমাকে ডেকেছে, এরপর গীতিকার-সুরকার সবাই মিলে গান করেছি। আর আমি যাদের সঙ্গে গান করেছি, দুর্ভাগ্যজনকভাবে তারা কেউ নেই আর। আলম ভাই (আলম খান), আলাউদ্দিন ভাই (আলাউদ্দিন আলী), বুলবুল ভাই (আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল), সত্যদা (সত্য সাহা)- ওনাদের সুরেই তো সারাজীবন কাজ করলাম। এরপর আমার সমসাময়িক কিছু সংগীত পরিচালকের সঙ্গে কাজ করেছি। কিন্তু তারাও আগের মতো আর গান করে না। নতুন আরও অনেকেই গানের জন্য ডাকে, কিন্তু আমি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। কারণ তাদের গানের ধরণ কিছুটা আলাদা। আমাদের ঘরের মতো যে শ্রুতি স্টুডিও ছিলো, রেকর্ডিস্ট সাঈদ ভাই ছিলেন, কিছুই নেই এখন। সেই সঙ্গে আমার মনের যে স্পৃহা, পিপাসা- সেটাও কমে গেছে। এটা আমার দোষে কমেনি; পরিবেশ, সময়, কুশীলব সবকিছু মিলিয়েই হয়েছে।

কথার মাঝে কনকচাঁপা কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েন। ভেজাকণ্ঠে বললেন-

আমি সেই শ্রুতি স্টুডিওর জন্য এখনও কাঁদি। আমার রেকর্ডিস্ট সাঈদ ভাইয়ের জন্য কাঁদি। আপনি চিন্তা করতে পারেন, একজন এন্ড্রু কিশোর নেই কিন্তু কনকচাঁপা বেঁচে আছে! কিশোরদা চলে গেছে, আমি ওনার লাশও দেখিনি। করোনা ছিলো বটে, কিন্তু আমার পক্ষে তার লাশ দেখা সম্ভব না। আমি এখনও বিশ্বাসই করি না। সুবীরদার (সুবীর নন্দী) লাশ দেখেছি, কিন্তু আমি চিনতেই পারিনি! তিনি ছিলেন আমার মঞ্চের জোড়া। আমি খুবই সৌভাগ্যবান, হাজার হাজার স্টেজ শো ওনার সঙ্গে করতে পেরেছি। এখন উনি নেই, তাই মঞ্চেও আমার শান্তি নেই। 

এই শীতেই ঢাকা ছাড়বো, গ্রামে স্থায়ী হবো: কনকচাঁপা বাংলা ট্রিবিউন: রেডিও, টিভি, সিনেমা মিলিয়ে আপনার গাওয়া গানের সংখ্যা অগণিত। সঠিক হিসাবটা কি রেখেছেন?
 
কনকচাঁপা: আমি ডায়েরি ব্যবহার করি। গানের তালিকা সেখানে লিখে রাখি। সেই হিসাবে ৩ হাজার ৬০০ বা ৭০০-এর মতো হবে। এরপরে অবশ্য আরও শ’দুয়েক গান করেছি, কিন্তু সেগুলো ডায়েরিতে লিপিবদ্ধ করা হয়নি।
 
বাংলা ট্রিবিউন: মানে আপনার গানের সংখ্যা প্রায় চার হাজার। একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই, গানের সুবাদে বা ব্যক্তিগত কাজে বিদেশে ঘুরেছেন অনেক। বিদেশ থেকে আসলে দেশটাকে কেমন লাগে?

কনকচাঁপা: তখন পুরো দেশটাকে মিস করি। সেই ১৯৯৬ সাল থেকে বিদেশে যাওয়া শুরু হয়েছে। বছরে অন্তত দু-তিনবার যাওয়া হয়। বিদেশে যাওয়া লাগে না, বিমানে ওঠার পর এয়ারপোর্টের যে মাঠ দেখা যায়, সেটা চোখে পড়লেই দেশের জন্য মায়া উথলে ওঠে। দেশ তো আসলে মায়ের সমান, মাকে যেভাবে মিস করি, দেশকেও সেভাবেই মিস করি।

বাংলা ট্রিবিউন: শুরুতেই বলছিলেন এই শীতে গ্রামে চলে যাচ্ছেন। কিন্তু গ্রামের মানুষ বা সমাজের সঙ্গে অ্যাডজাস্ট করতে পারবেন তো! যার জন্ম-বেড়ে ওঠা রাজধানীতে।

কনকচাঁপা: ওই গ্রামের মানুষের সঙ্গে আমি ইতোমধ্যে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে গেছি। তাদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে দেখা করেছি, কথা বলেছি। তারা খুব অবাক হয়েছেন, জানতে চেয়েছেন, ‘আপনি কি আসলেই কনকচাঁপা? নাকি ওনার মতো চেহারা দেখে আপনার বাবা-মা এই নাম রেখেছে!’ তাদের বিস্ময় কাটে না, বলে, কীভাবে সম্ভব! আমি সেখানে গিয়ে ঢেঁকিতে পা দিয়ে চাল গুঁড়া করেছি; সেটা দেখে তারা বিস্মিত হয়ে জানতে চান, কোথায় শিখেছি এসব। আমি তো আমেরিকা থেকে আসিনি। গ্রামে জন্ম না হলেও আমি গ্রাম, দেশের সংস্কৃতি খুব ভালোবাসি। নৌকা চালানো থেকে শুরু করে গোবর দিয়ে ঘর লেপা, সবকিছু পারি আমি।
 
এই শীতেই ঢাকা ছাড়বো, গ্রামে স্থায়ী হবো: কনকচাঁপা বাংলা ট্রিবিউন: আলম খান, আলাউদ্দিন আলী, আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল কিংবা গীতিকবি গাজী মাজহারুল আনোয়ারের মতো গুণী মানুষেরা একে একে চলে যাচ্ছেন। সংগীত জগতের এই অভিভাবকশূন্যতা নিয়ে আপনার উপলব্ধি জানতে চাই...

কনকচাঁপা: হারানোর যে বেদনা, এটা সব মানুষেরই থাকে। যাদের নাম বললেন, তাদের প্রত্যেককে বাবা-চাচা-ভাইয়ের মতো সম্মান করেছি, আপন ভেবেছি। ওনারা এমন পর্যায়ে চলে গেছেন যে, তাদের নামের আগে-পেছনে কোনও উপাধি লাগে না। আমি তো চোখের সামনে দেখেছি, একজন গাজী মাজহারুল আনোয়ার কিংবা আহমেদ ইমতিয়াজ বুলবুল যখন কলম ধরেছেন, কোনও কাটাকুটি নেই। মনে হতো, কলম ওই লেখাটা প্রসব করছে! তারা চলে গেছেন ঠিক, কিন্তু সবসময় থাকবেন। তারা যে সম্পদ আমাদের দিয়ে গেছেন, সেটাকে আমরা কাজে লাগাতে পারি। একটি সংগীত ইনস্টিটিউট করতে পারি, সেখানে তাদের গান, সুর, কথা এসব বিষয়ে শিক্ষা দেওয়া হবে; তাদের সৃষ্টি নিয়ে চর্চা হবে। কিন্তু দুঃখজনক ব্যাপার হলো, এই যে গাজী ভাই মারা গেলেন, একদিন পর তাকে দাফন করা হলো। এর আগেই ভুলভাল সুরে তার গান লাইভে গাওয়া শুরু হয়ে গেলো! এতে কি তাকে শ্রদ্ধা জানানো হলো? বরং ওই চ্যানেল কিছু পয়সার জন্য এই কাজ করেছে। বিভিন্ন চ্যানেলে এমন অনেক শিল্পী আসেন, যাদের আসা উচিত না। শিল্পী প্রতিষ্ঠিত কিনা, সেটা বিষয় নয়। আমি চাই, ভুল সুরে যাতে না গায়। ভুলভাবে স্মরণ না হোক। বরং তাদের গান নিয়ে পড়াশোনা করুক এবং শিখুক। এটা আমি জোর দাবি জানাই। 

বাংলা ট্রিবিউন: আপনার গ্রামীণ স্বপ্ন সফল হোক। জন্মদিনে এতোটা সময় দেওয়ার জন্য ট্রিবিউন পরিবার কৃতজ্ঞ।

কনকচাঁপা: আপনাদেরও অনেক ধন্যবাদ, এমন দিনে আমাকে মনে করার জন্য। আমিও চাই গ্রামস্বপ্নটা সবার ভেতর প্রতিফলিত হোক। এই শীতেই ঢাকা ছাড়বো, গ্রামে স্থায়ী হবো: কনকচাঁপা

/এমএম/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
অবশেষে মুক্তির বার্তা
অবশেষে মুক্তির বার্তা
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
হলিউডের প্রস্তাব ফেরালেন ক্যাটরিনা!
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
টিভি ধারাবাহিকে খলনায়িকা রিনা খান
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
এই গরমে শিরোনামহীনের শীতল সুর!
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া
নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি জয়া