ভাষার জন্য প্রাণ দেওয়ার ইতিহাস এই মাটিতেই রচিত হয়েছে। বিশ্বের আর কোথাও কোনও ভাষার জন্য এমন বিপ্লব, রক্তপাত আর বিজয়ের ঘটনা ঘটেনি। তাই তো একুশে ফেব্রুয়ারি আজ সারাবিশ্বে স্বীকৃত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে। এই মহান ভাষা দিবসের তাৎপর্য, ভাষাসৈনিকদের আত্মত্যাগ আমাদের বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে খুব একটা ফুটে ওঠেনি। বিস্ময়কর হলেও বাস্তবতা এটাই, মাত্র দুটি ছবির মধ্যেই আটকে আছে আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনের ক্যানভাস। সিনেমার বরপুত্র জহির রায়হানই প্রথম ভাষা আন্দোলন ও গণ-আন্দোলন নিয়ে ‘জীবন থেকে নেয়া’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। যে ছবি শুধু কালজয়ী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, স্বাধীনতা সংগ্রামেও ব্যাপক অবদান রেখেছিল।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশ কিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও ভাষা আন্দোলনকে প্রাধান্য দিয়ে শহীদুল ইসলাম খোকনের ‘বাঙলা’ ছাড়া আর কোনও চলচ্চিত্র নির্মিত হয়নি। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আহমেদ ছফার ‘ওংকার’ উপন্যাস নিয়ে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে নির্মিত হয় ‘বাঙলা’। হুমায়ুন ফরীদি, মাহফুজ আহমেদ, শাবনূর অভিনীত এ ছবির শেষ দৃশ্যে একজন বোবা মেয়ের মুখ থেকে বের হয়ে আসে একটি শব্দ, আর সেটি হচ্ছে ‘বাঙলা’।
‘জীবন থেকে নেয়া’ এবং ‘বাঙলা’র বাইরে আর তেমন কোনও চলচ্চিত্র পাওয়া যাবে না- যাতে ভাষা আন্দোলনটি পরিচ্ছন্নভাবে ফুটে উঠেছে। তবে চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে একটি ছবি নির্মাণের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকার এ ছবি নির্মাণের অনুমতি দেয়নি। আরেক বরেণ্য চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন ‘শহীদ আসাদ’ নামে একটি ছবি নির্মাণের ঘোষণাও দিয়েছিলেন। কুমিল্লার এক জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে দিয়ে এ ছবির মহরতও করেছিলেন। কিন্তু পরে ছবিটি আর হয়নি। কারণ একটাই, তৎকালীন পাক সরকার অনুমতি দেয়নি। তার পরও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ এবং ‘শহীদ আসাদ’- দুটি ছবি নিয়েই চলচ্চিত্রশিল্পের আশা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার দেড় মাস পর জহির রায়হান-এর রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ হলে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ছবির সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। অন্যদিকে ‘শহীদ আসাদ’ ছবিটির পরিকল্পনা থামিয়ে দিয়ে আমজাদ হোসেনও ব্যস্ত হয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণে।
মহান ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের কেন এমন দীন? নানাজনের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়, ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার মতো এখন প্রযোজক নেই। সব প্রযোজকই লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত চান। এটাই স্বাভাবিক। সে ক্ষেত্রে সরকার অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে এ বিষয়ে। কিন্তু তেমন কিছু তো দৃশ্যমান নয়। এ কারণেই দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, নতুন প্রজন্মের জন্য তেমন কোনও ছবি হচ্ছে না- যেখানে ভাষা আন্দোলনের গল্প উঠে আসবে। এরজন্য চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট অনেকেই দাবি করছেন, চলচ্চিত্র শিল্পের সার্বিক উন্নয়নের জন্য আলাদা মন্ত্রণালয়ের। যার নাম হবে চলচ্চিত্র মন্ত্রণালয়।
/এস/এমএম/