X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
সিরিজ সমালোচনা

‘দ্য রেলওয়ে মেন’: মানবিক বিপর্যয়ের হৃদয়বিদারক সত্যি গল্প

জনি হক
২১ নভেম্বর ২০২৩, ২০:০৯আপডেট : ২২ নভেম্বর ২০২৩, ১৩:৫৭

‘দ্য রেলওয়ে মেন’ সাধারণ কিছু মানুষের বীরত্ব নিয়ে দুর্দান্ত একটি ওয়েব সিরিজ, যাদের কথা খুব একটা জানাজানি হয়নি। সেজন্য এর ট্যাগলাইন– ‘দ্য আনটোল্ড স্টোরি অব ভোপাল ১৯৮৪’। প্রায় চার দশক আগে ভোপালে একটি কারখানায় অতি বিষাক্ত গ্যাস নির্গমনের ঘটনা মানবিক বিপর্যয় ডেকে এনেছিল। এমন পরিস্থিতিতে অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচিয়েছেন রেলওয়ে কর্মীরা। সেই সত্যি ঘটনার ব্যাপকতা দেখানো হয়েছে এই সিরিজে। নেটফ্লিক্সে এখন বাংলাদেশে শীর্ষ আছে এটি।

শুরুতে দম বন্ধ হতে থাকা মানুষের নেপথ্য শব্দের সঙ্গে পর্দায় ভেসে ওঠে সিরিজটির প্রেক্ষাপট। ১৯৮৪ সালের ২ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে অর্থাৎ ৩ ডিসেম্বরের প্রথম প্রহরে ভারতের মধ্যপ্রদেশ রাজ্যের ভোপালে আমেরিকান মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন কার্বাইডের কীটনাশক উৎপাদনের রাসায়নিক কারখানায় ভূর্গভস্থ মজুত ট্যাংক ফেটে ৪০ টন বিষাক্ত গ্যাস মিথাইল আইসোসায়ানেট (এমআইসি) নির্গমন হয়। সেই রাতেই অন্তত তিন হাজার মানুষের প্রাণহানি ঘটে। তারপর বিভিন্ন রোগে ভুগে মৃতের সংখ্যা দাঁড়ায় ১৫ হাজার। কারখানার পাঁচিলের বাইরে ও কারখানা লাগোয়া বস্তিতে বসবাসকারী দুই লাখের বেশি মানুষ গ্যাসের শিকার হয়ে ক্যানসার, অন্ধত্ব, পঙ্গুত্বসহ যকৃৎ ও কিডনির বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগেছে। সিরিজটি দেখে বোঝা যায়, রেলওয়ে কর্মীরা জীবনবাজি না রাখলে প্রাণহানি নির্ঘাত বাড়তো।

বাবিল খান ভোপাল গ্যাস ট্র্যাজেডিকে বিশ্বের সবচেয়ে ভয়াবহ শিল্প বিপর্যয় হিসেবে ধরা হয়। এমন কিছু যে ঘটতে পারে সেই ব্যাপারে আগেই সতর্ক করেছিলেন ভোপালের প্রয়াত সাংবাদিক রাজকুমার কেসওয়ানি। গ্যাস ট্র্যাজেডির আগে ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানার নিরাপত্তা ত্রুটি নিয়ে একাধিক প্রতিবেদন লিখেছিলেন তিনি। তার ওপর ভিত্তি করেই সিরিজের নির্ভীক সাংবাদিক জগমোহন কুমাওয়াত চরিত্রটি লেখা।

গল্পে দেখা যায়, ইমাদ রিয়াজ (বাবিল খান) রেলওয়ের চাকরিতে যোগদানের জন্য প্রস্তুত। তার আগে জগমোহন কুমাওয়াতকে (সানি হিন্দুজা) একটি সাক্ষাৎকার দেয় সে। ইমাদ একসময় ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানায় ট্রাক ড্রাইভার হিসেবে কাজ করতো। মিথাইল আইসোসায়ানেটের বিষক্রিয়ায় তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু মোহাম্মদ আনসারির মৃত্যু হয়। আনসারির স্ত্রী শাজিয়াকে ন্যায়বিচার এনে দেওয়ার প্রতিজ্ঞা থেকে সাংবাদিককে তথ্য দেয় ইমাদ। সেই রাতে গোরখপুর এক্সপ্রেস ট্রেনে দুই সন্তান নিয়ে ভোপাল আসতে থাকে শাজিয়া।

বাস্তবে সাজদা বানু নামের একজন নারীর স্বামী ১৯৮১ সালে ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানায় গ্যাস নির্গমনের কারণে প্রাণ হারান। গ্যাস ট্র্যাজেডিতে তার দুই সন্তানের একজনের মৃত্যু হয়, অন্যজন বিকলাঙ্গ হয়ে যায়। বিষাক্ত গ্যাসের সংস্পর্শে আসা অনেক মায়ের সন্তানেরা মানসিক-বিকাশজনিত সমস্যায় ভুগেছে। ফুসফুসের প্রদাহ থেকে শুরু করে আজীবন পঙ্গুত্বের মধ্যে আছে হাজার হাজার মানুষ। আজও অনেকে সেই ভয়াবহতার চিহ্ন বহন করে চলেছেন। বাতাসের চেয়ে ভারী বিষাক্ত গ্যাস মিথাইল আইসোসায়ানেট ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য রেখে গেছে মারাত্মক রোগব্যাধির অভিশাপ। পরিবেশবাদীদের দাবি, ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানা থেকে নির্গত বিষের কারণে এখনও ভোপালের মাটি ও ভূগর্ভস্থ জল নিরাপদ নয়। বিষাক্ত গ্যাসের প্রভাবে প্রায় ৪০ বছর পরও অনেক শিশু প্রতিবন্ধী ও পঙ্গু হয়ে জন্মাচ্ছে। সেই বিপর্যয়ের পর ভোপালে জন্ম নেওয়া বেশিরভাগ শিশুর স্বাভাবিক বৃদ্ধি হয়নি।

আর. মাধবন সিরিজের গল্পে ফেরা যাক। ১৯৬৯ সালে তৈরি হয় ইউনিয়ন কার্বাইড। চরম বিপজ্জনক রাসায়নিক মিথাইল আইসোসায়ানেট ব্যবহার করে কীটনাশক উৎপাদন হচ্ছিল এতে। কারখানার বেশ কিছু নিয়ম লঙ্ঘনের চিত্র তুলে ধরতে মরিয়া জগমোহন কুমাওয়াত। দায়িত্বজ্ঞানহীন ত্রুটি ও সাধারণ মানুষের ওপর এর নেতিবাচক প্রভাবের কথা চিন্তা করে কারখানা সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে চায় এই সাংবাদিক। ইউনিয়ন কার্বাইডের ম্যানেজার কমরুদ্দিনের (দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য) সহায়তা চায় সে। তাকে কমরুদ্দিন ১৯৮২ সালের একটি প্রতিবেদনের কপি হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেয়, যার মাধ্যমে প্রমাণ হবে ইউনিয়ন কার্বাইড কর্তৃপক্ষ যথাযথ নিরাপত্তা ব্যবস্থা না রেখে পুরো ভোপালকে ঝুঁকিতে ফেলে কারখানা চালিয়ে যাচ্ছে।

এদিকে ইমাদ রিয়াজ ভোপাল জংশনে পৌঁছে প্রখর পর্যবেক্ষণ গুণের মাধ্যমে স্টেশনমাস্টার ইফতেখার সিদ্দিকীকে (কে কে মেনন) মুগ্ধ করে। ইমাদকে নিশাতপুরা ইয়ার্ডের দায়িত্ব দেয় স্টেশনমাস্টার। সেই রাতে রহস্যময় এক তরুণের (দিব্যেন্দু শর্মা) সঙ্গে পরিচয় হয় স্টেশনমাস্টারের। নিজেকে রেলওয়ে নিরাপত্তা বাহিনীর (আরপিএফ) কনস্টেবল পরিচয় দেয় সে। মূলত সে হলো ট্রেনে যাত্রীদের মালামাল লুট করা কুখ্যাত ডাকাত বলবন্ত যাদব। নিরাপত্তা বাহিনীর পোশাকে ছদ্মবেশ নিয়েছে এই তরুণ। সে জানতে পারে, ইফতেখারের কেবিনের সিন্দুকে কোটি টাকার বেশি মজুত আছে। বিপুল অর্থ কবজা করতেই তার ভোপালে আসার কারণ।

কে কে মেনন বলবন্ত যাদব রেলস্টেশনে ডাকাতি করার আগেই ইউনিয়ন কার্বাইড কারখানা থেকে নির্গত বিষাক্ত গ্যাসের আস্তরণ বাতাসে ভর করে শহরের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ায় অনেকের মৃত্যু হয়। ফলে ভোপাল জংশনে বিশৃঙ্খলা দানা বাঁধে। ইফতেখার যাত্রীদের সবাইকে ওয়েটিং রুমে ঢুকে দরজা-জানালা বন্ধ করে থাকতে বলে। দুঃখজনকভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিকল থাকায় কাছাকাছি রেলস্টেশনগুলোকে সে জানাতে পারে না যে, ভোপাল অভিমুখে কোনও ট্রেন আসতে দেওয়া নিরাপদ নয়। সময় গড়ানোর সঙ্গে তার কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ে।

সৌভাগ্যক্রমে ইতারসি জংশনে হাজির হয়ে পরিস্থিতির গভীরতা উপলব্ধি করে সেন্ট্রাল রেলওয়ের জেনারেল ম্যানেজার (জিএম) রতি পান্ডে (আর. মাধবন)। মৃত্যুঝুঁকির কথা না ভেবেই সে ভোপালে আটকে পড়া যাত্রীদের সহযোগিতা করার সিদ্ধান্ত নেয়। এরপর ভোপাল জংশনকে কেন্দ্র করে ঘটতে থাকে রুদ্ধশ্বাস ও হৃদয়বিদারক অনেক ঘটনা। গ্যাস আক্রান্ত মানুষের ভিড়ে উপচেপড়া হাসপাতাল, রাস্তার ওপর মরে পড়ে থাকা গরু, কুকুর ও বিড়ালের দৃশ্য দেখে নির্বাক হতে হয়।

সত্যি ঘটনা অবলম্বনে ওয়েব সিরিজের গল্পটি লিখেছেন আয়ুষ গুপ্তা। তার চিত্রনাট্যের বুনন অনবদ্য। তিনি পুরো পরিস্থিতি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে তুলে ধরেছেন। তবে মোটেও একঘেঁয়ে লাগে না। বরং বোঝা খুব সহজ। আয়ুষ গুপ্তা ও শিব রাওয়াইল ঘটনার সঙ্গে মানানসই সহজ সংলাপ লিখেছেন।

দিব্যেন্দু শর্মা

বাস্তব ঘটনা মুন্সিয়ানার সঙ্গে পর্দায় তুলে ধরার ক্ষেত্রে পরিচালক শিব রাওয়াইল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন বলা যায়। ‘দ্য রেলওয়ে মেন’ দেখে বোঝার উপায় নেই এটাই তার প্রথম পরিচালনা। তিনি ভোপাল অভিমুখী ট্রেনগুলোর অবস্থান বোঝাতে গ্রাফিক্স ব্যবহার করেছেন। এর ফলে দর্শকদের জন্য বিরাজমান পরিস্থিতি বুঝতে সহায়ক হয়েছে। মধ্যপ্রদেশের ঘনবসতির শহর ভোপালের আকাশে চরম বিপজ্জনক রাসায়নিকের ছড়িয়ে পড়া দেখানো হয়েছে গ্রাফিক্সে। এতে বোঝা যায়, লেক সিটি মুহূর্তেই পরিণত হয়েছে বিষাক্ত শহরে। গ্যাস ট্র্যাজেডির গভীরতার প্রতি সম্মান দেখিয়ে নাটকীয়তা বেশি আনেননি পরিচালক। বরং গল্প বলার চেনা শৈলী বেছে নিয়েছেন তিনি।

ভোপালের গ্যাস বিপর্যয় নিয়ে ভারতে এর আগে দুটি চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে। এগুলো হলো– মহেশ মাথাই পরিচালিত ‘ভোপাল এক্সপ্রেস’ (১৯৯৯) এবং রবি কুমারের ‘ভোপাল: অ্যা প্রেয়ার ফর রেইন’ (২০১৪)। কিন্তু বিশদভাবে পুরো ঘটনা তুলে ধরার ক্ষেত্রে ‘দ্য রেলওয়ে মেন’ পুরোপুরি সফল।

সিরিজের বেশ কয়েকটি দৃশ্য হতভম্ব করে দেয়, বিশেষ করে সেই সর্বনাশা রাতে যেভাবে অসংখ্য মানুষের প্রাণ বাঁচানো সম্ভব হয়েছিল। গ্যাস ট্র্যাজেডির মাত্রা এতটাই বেশি ছিল যে, অনেক মানুষ সেই রাতে ঘটে যাওয়া ঘটনার ভয়াবহতা বুঝতেই পারেনি। মা জানে না সন্তান মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েছে, সন্তান জানে না মাকে হারিয়েছে, এমনকি কারও কারও গোটা পরিবার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। সিরিজের বিভিন্ন দৃশ্যে এসব সত্যি ঘটনার উদাহরণ রয়েছে।  

বলিউডের নামজাদা সংস্থা যশরাজ ফিল্মসের স্ট্রিমিং শাখা ওয়াইআরএফ এন্টারটেইনমেন্টের প্রথম ওয়েব সিরিজ ‘দ্য রেলওয়ে মেন’। এর নির্বাহী প্রযোজক আদিত্য চোপড়া ও উদয় চোপড়া। নির্মাতারা অযথা টেনে বড় করেননি সিরিজ। তাই মাত্র চারটি পর্ব রয়েছে এতে।

জুহি চাওলা ইন্দিরা গান্ধী হত্যার এক মাস পর ভোপালে গ্যাস ট্র্যাজেডি ঘটেছিল। এ কারণে শিখবিরোধী দাঙ্গার বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা জুতসই লেগেছে। অপর দিকে গল্পে সাঁতারুদের অংশ জোরপূর্বক মনে হয়েছে। এমন কয়েকটি উপ-প্লট ও অতীত ঘটনার কারণে টানটান থ্রিলার হয়ে ওঠেনি সিরিজটি।

১৯৮৪ সালের ৩ ডিসেম্বর যেসব লাশ শনাক্ত হয়নি সেগুলোর নাম-পরিচয় জানা না যাওয়ায় ভোপাল জংশনের কাছের একটি মাঠে একপাশে দাফন ও অন্য পাশে দাহ করা হয়েছে। সিরিজের ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যে সেটি দেখা গেছে। স্টেশনমাস্টারকে মৃত ঘোষণা করা হলেও কবর দেওয়ার সময় তিনি জেগে ওঠেন! সিরিজের অন্যতম প্রধান চরিত্র বলেই এমন করা হয়েছে ভাবলে ভুল হবে। বাস্তবে এমনটাই ঘটেছে।

অভিনয়ের কথা বললে কে কে মেনন এককথায় অনবদ্য। শেষ পর্যন্ত তিনিই সিরিজটির সেরা অভিনেতা। শেষ পর্বে তো তার অভিনয় অসামান্য। কাকতালীয় হলো, ২৪ বছর আগে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ভোপাল এক্সপ্রেস’ ছবিতেও প্রধান চরিত্রে ছিলেন তিনি।

আর. মাধবন একটু দেরিতে পর্দায় এসেছেন, তবে ঠিকই মন ছুঁয়েছেন। তাকে দেখে ইচ্ছে জাগতে পারে, যদি আরেকটু বেশি সময় পর্দায় থাকতেন! বাবিল খানের উপস্থিতি দারুণ। দর্শকেরা যাদের কাজ দেখতে মুখিয়ে থাকে তেমন একজন অভিনেতা হিসেবে নিজের অবস্থান গড়ে নিয়েছেন প্রয়াত অভিনেতা ইরফান খানের এই যোগ্য উত্তরসূরি। দিব্যেন্দু নিজের সেরাটা নিংড়ে দিয়েছেন। সানি হিন্দুজা ও দিব্যেন্দু ভট্টাচার্য মনে দাগ কেটেছেন।

রেলওয়ে মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা রাজেশ্বরী জাংলে চরিত্রে জুহি চাওলার বিশেষ উপস্থিতি ভালো লাগার মতো। একটি দৃশ্যেই মনীশ বাধওয়া (মির্জা) দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন। কারখানার প্রধান ম্যাডসেন চরিত্রে ফিলিপ রশের অতিরঞ্জিত অভিনয় দৃষ্টিকটু লাগে। তবে জার্মান বিজ্ঞানী অ্যালেক্স ব্রাউনের ভূমিকায় কনোর কিন বেশ ভালো। দুই জনই ব্রিটিশ অভিনেতা।

রেলস্টেশনের ভিক্ষুক দুই শিশু চরিত্রে দুর্দান্ত থানু খান (মারকান্ড) ও আদিত্য শুক্লা (রাতলু)। এছাড়া ঈশ্বর কুমার প্রসাদ চরিত্রে শ্রীকান্ত ভার্মা, পরিচ্ছন্নতাকর্মী বিজয়া চরিত্রে সুনিতা চাঁদ রাজওয়ার ও বিজয়ার মেয়ে সোহিনি চরিত্রে প্রিয়া যাদব যথাযথ। শাজিয়া চরিত্রে অন্নপূর্ণা সোনি খুব একটা সুযোগ পাননি। কমরুদ্দিনের স্ত্রী নাফিসা চরিত্রে ভূমিকা দুবে ঠিকঠাক। ইতারসি জংশনের রুক্ষ স্বভাবের কর্মকর্তা বিনোদ চরিত্রে লোকেশ মিত্তাল ও দায়িত্ববান বেনেডিক্ট চরিত্রে রাহুল তেওয়ারি ভালো করেছেন। ট্রেনের গার্ড চরিত্রে রঘুবীর যাদব বীরোচিত ভূমিকা রেখেছেন। শিখ নারী রাজবীর কৌর চরিত্রে মন্দিরা বেদি জুতসই। ইমাদের মায়ের ভূমিকায় নিবেদিতা ভারগাভাও ভালো। কিন্তু সাঁতারু হিমানি চরিত্রে আদরিজা সিনহার উপস্থিতি অপচয় মনে হয়েছে।

‘দ্য রেলওয়ে মেন’ সিরিজে কেবল একটি গান আছে। এর শিরোনাম ‘নিন্দিয়া’। দুই ভাই অঙ্কিত বলহারা ও সঞ্চিত বলহারার সুর ও সংগীতে গানটি মন ছুঁয়ে যায়। স্যাম স্লেটারের আবহ সংগীত বিভিন্ন মুহূর্তে উত্তেজনা বাড়িয়েছে। রুবাইসের চিত্রগ্রহণ মনে ছাপ ফেলে। রজত পোদ্দাতের চমৎকার শিল্প নির্দেশনা ভালো গবেষণার ফসল। তার দক্ষতায় ১৯৮৪ সালের প্রেক্ষাপট বাস্তবিক লেগেছে। একই কথা প্রযোজ্য রুশি শর্মা ও মানসী নাথের পোশাক পরিকল্পনার ক্ষেত্রেও। সুনীল রদ্রিগেজের অ্যাকশন বাস্তবসম্মত। ইয়াশা জয়দেব রামচান্দানির সম্পাদনা বেশ শাণিত। তবে ভিএফএক্স আহামরি নয়।

গ্যাস বিপর্যয়ের ঘটনায় ইউনিয়ন কার্বাইড কর্তৃপক্ষের বিতর্কিত মনোভাব তুলে ধরা হয়েছে এই সিরিজে। একইসঙ্গে ভারতীয় কর্মীদের অবহেলার প্রমাণ রয়েছে। গ্যাস বিপর্যয় মামলায় দোষী সাব্যস্ত ইউনিয়ন কার্বাইডের সাবেক দুই কর্মচারী সত্য প্রকাশ চৌধুরী ও জে. মুকুন্দ ওয়েব সিরিজটির মুক্তির স্থগিতাদেশ চেয়ে আদালতে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু বোম্বে হাইকোর্ট সেই মামলা খারিজ করেছে। এরপর গত ১৮ নভেম্বর নেটফ্লিক্সে মুক্তি পেয়েছে এটি।

সামগ্রিকভাবে সাধারণ মানুষের বীরত্বের দুর্দান্ত গল্প নিয়ে নির্মিত ‘দ্য রেলওয়ে মেন’ দারুণ একটি ওয়েব সিরিজ। এতে সবার প্রচেষ্টা প্রশংসনীয়। গ্যাস ট্র্যাজেডির প্রেক্ষাপট আজও প্রাসঙ্গিক বলা যায়। ২০২৩ সালে এসেও সমাজের নিম্ন আয়ের কর্মীদের প্রতি বিত্তবানদের অবহেলা একই রকম বিদ্যমান। সিরিজটি একইসঙ্গে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছে, বিশুদ্ধ বাতাস ও পানি সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য কতটা জরুরি।

জনি হক ‘দ্য রেলওয়ে মেন’-এর প্রথম পর্ব ৫৫ মিনিট, দ্বিতীয় পর্ব ১ ঘণ্টা ৪ মিনিট, তৃতীয় পর্ব ৫১ মিনিট ও শেষ পর্বের দৈর্ঘ্য ১ ঘণ্টা ৫ মিনিট। সিরিজের প্রথম পর্বের শুরুতে ও শেষ পর্বের শেষের দিকে বাস্তবের কিছু ফুটেজ জুড়ে দেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন কার্বাইডের সাবেক চেয়ারম্যান ওয়ারেন অ্যান্ডারসন দুর্ঘটনার কয়েকদিন পর কারখানা দেখতে ভোপালে এলে তাকে ভারতীয় পুলিশ গ্রেফতার করে। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যে তিনি জামিন পেয়ে যান।

সিরিজের শুরুতে দেখা যায়, সরকারি সহায়তায় ওয়ারেন অ্যান্ডারসন ভারত ত্যাগ করেন। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে মারা যান তিনি। ভোপাল দুর্ঘটনায় ক্ষতিগ্রস্তদের প্রতিনিধি হিসেবে ভারত সরকার ৩৩০ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণের আবেদন করে। কিন্তু আদালতের বাইরে সমঝোতার মাধ্যমে ইউনিয়ন কার্বাইড ১৯৮৯ সালে ৪৭ কোটি ডলার ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায়মুক্ত হয়। কিন্তু সাধারণ জনগণ ওয়ারেন অ্যান্ডারসনের শাস্তি দাবি করেছিল। তবে সাংবাদিক জগমোহন কুমুওয়াতের একটি সংলাপে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে, ‘এ দেশে ১৫ হাজার মানুষের প্রাণ নেওয়ার সাজা কী জানেন? শ্যাম্পেনের আতিথেয়তা ও ভিআইপি সেবাসহ পালানোর জন্য সরকারি বিমান।’

লেখক: গীতিকবি ও ডেপুটি নিউজ এডিটর, বাংলা ট্রিবিউন

/এমএম/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
কানাডার স্টেডিয়ামে রেকর্ড গড়লেন দিলজিৎ
কানাডার স্টেডিয়ামে রেকর্ড গড়লেন দিলজিৎ
আট গল্পের প্রদর্শনী ‘অল দ্যাট ওয়েদারস’
আট গল্পের প্রদর্শনী ‘অল দ্যাট ওয়েদারস’
অপু-বুবলীর ‘কথাযুদ্ধ’ চলমান, মাঝে শাকিবের বিয়ে গুঞ্জন!
অপু-বুবলীর ‘কথাযুদ্ধ’ চলমান, মাঝে শাকিবের বিয়ে গুঞ্জন!
ইরফান খান: জীবনের মোড় ঘুরেছিল ২০০ রুপির অভাবে!
প্রয়াণ দিনে স্মরণইরফান খান: জীবনের মোড় ঘুরেছিল ২০০ রুপির অভাবে!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!