পুলিশ তো বটেই, প্রকৃতিও যেন চরম বিরোধী হয়ে দাঁড়ালো শিল্পীদের বিপরীতে। বৃহস্পতিবার (১ আগস্ট) সকাল ১১টায় শিল্পীরা মানববন্ধনে দাঁড়ানোর কথা মানিক মিয়া অ্যাভিনিউ তথা জাতীয় সংসদ ভবনের সামনে। পৌনে ১১টার দিকে খামারবাড়ি মোড়ে এসে পুলিশি বাধায় আটকে গেলেন তারা। ঠিক ১১টা থেকে শুরু হলো তুমুল বৃষ্টি। পুলিশি বাধা আর বৃষ্টির শব্দ যেন ছাপিয়ে দিচ্ছিল শিল্পী মনের চিৎকার।
না। সেই চিৎকার পুলিশ কিংবা বৃষ্টি রুখে দিতে পারেনি। সংসদ ভবনের সামনে যাওয়ার পথ রুদ্ধ হওয়ার পর খামারবাড়ি মোড় থেকে বৃষ্টিতে ভিজে উপস্থিত প্রতিজন শিল্পী ব্যানার হাতে স্লোগান দিতে দিতে এসে দাঁড়ালেন ফার্মগেট সেজান পয়েন্টের সামনে, রাজপথে।
যেখানে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্য দিবালোকে রাষ্ট্রের প্রতি দাবি জানান ভয়হীন, ন্যায্য ও মানবিক মর্যাদার বাংলাদেশ গড়ার, সব হত্যার বিচার করার এবং চলমান হত্যা, সহিংসতা, গণগ্রেফতার আর হয়রানি বন্ধ করার।
‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে যুক্ত হওয়া এই সংস্কৃতি কর্মীদের মধ্যে এদিন সরাসরি হাজির ছিলেন মামুনুর রশীদ, মোশাররফ করিম, আজমেরী হক বাঁধন, সাবিলা নূর, আশফাক নিপুণ, নুরুল আলম আতিক, অমিতাভ রেজা, পিপলু আর খান, শিবু কুমার শীল, রেদওয়ান রনি, জাকিয়া বারী মম, সোহেল মণ্ডল, সিয়াম আহমেদসহ অনেকে।
প্রায় প্রত্যেকেরই একই দাবি, হত্যার বিচার এবং হত্যা বন্ধ করা। সঙ্গে সংহতি জানিয়েছেন শিক্ষার্থীদের ৯ দফা দাবির প্রতিও।
এই জোটের অন্যতম কণ্ঠস্বর অভিনেত্রী আজমেরী হক বাঁধন। তিনি এই আন্দোলনে প্রকাশ্যে একাত্মটা ঘোষণা করে রাজপথে দাঁড়ানো প্রসঙ্গে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেখুন আমিও কিন্তু অন্য অনেকের মতো এই রাষ্ট্র বা সরকারের সর্বোচ্চ সুবিধাভোগী একজন মানুষ। এই সরকারের আমলেই আমি আমার জীবনের সবচেয়ে সুন্দর সময়গুলো ফিরে পেয়েছি। যেমন আদালত থেকে বাচ্চার অধিকার পেয়েছি, যেটা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম ঘটলো। এই সরকারের আমলেই আমি সেরা অভিনেত্রীর জাতীয় পুরস্কার পেয়েছি। এর বাইরে ক্যারিয়ার বিচারে আমি সর্বোচ্চ সফল সময় পার করছি এখন। আমার তো দরকার ছিল না সরকারের বিরুদ্ধে গিয়ে এভাবে বৃষ্টিতে ভিজে রাস্তায় এসে স্লোগান ধরার। বাকি জীবনটা আমি খুব আরামেই কাটাতে পারি চুপচাপ। প্রশ্ন আসবে আরাম ফেলে কেন আমি এমনটা করছি? উত্তরও দিচ্ছি। আমি তো শুধু অভিনেত্রী নই। এর বাইরেও আমি একজন মা, একজনের সন্তান এবং এই দেশের একজন সচেতন নাগরিক। যে বাচ্চাটা ছাদে খেলতে গিয়ে খুলি খেয়ে মরে গেলো, সে তো আমারও মেয়ে হতে পারতো। তখন কি আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে এর বিচার চাইতাম না? যে হত্যাকাণ্ড ঘটে গেলো এবং ঘটছে, সেটির বিচার কি আমি চাইবো না? যদি না চাই, তাহলে তো আমি এই রাষ্ট্রের কেউ না। অথবা বোধশূন্য অমানুষ। আমার মনে হয়েছে, এর প্রতিবাদ করা উচিত। না করলে কাল যখন আমার মেয়েটা গুলি খেয়ে মরে পড়ে থাকবে, তখন অন্য কেউ আমার পাশে দাঁড়াবে না। এবং এই গুলি চলতেই থাকবে। সেই বিবেচনায় বলা যায়, আমি আমার স্বার্থেই রাজপথে নেমেছি। এর বিনিময়ে আমাকে যত মূল্য দিতে হয়, দিবো। কিন্তু আমার কণ্ঠ থামাবো না।’
অনেকটা একই কথা ভিন্ন ভিন্ন সুরে বলেছেন জমায়েতে উপস্থিত শিল্পীরা।
‘কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে সহিংসতায় নিহতদের প্রতি বড় একটা স্যালুট। যারা মারা গেছেন, তাদের পরিবারের ত্যাগের সঙ্গে আর কারও তুলনায় হয় না।’ বলছিলেন প্রতিবাদী নির্মাতা আশফাক নিপুণ।
নায়ক সিয়াম আহমেদ বলেন, ‘আমার আলাদা করে কিছু বলার প্রয়োজন নেই। কারণ, পুরো দেশের মানুষ একই কথা বলছে। দেশের বেশিরভাগ মানুষ যখন কোনও দাবি রাখে, তখন সেটা মাথায় আনা দরকার। আপনি যদি সুস্থ স্বাভাবিক মানুষ হন, মৃত্যুগুলো দেখে আপনি রাতে ঘুমাতে পারবেন না। সত্যি কথা বলতে আমার কানে এখনও বাজে- কারও পানি লাগবে? এটা যতদিন আমার মাথায় থাকবে ততদিন মনে হয় আমি শান্তিতে ঘুমাতেও পারবো না।’
আরও বলেন, ‘আমরা যারা বিনোদন অঙ্গনে আছি, তারা তো মানুষের জন্যই কাজ করি। শিক্ষার্থীদের হত্যার ঘটনায় আমরা যদি তাদের পাশে না থাকতে পারি তাহলে এই অঙ্গনে কাজ না করাই ভালো।’
আড়াই বছরের সন্তানের কথা টেনে এই অভিনেতা আরও বলেন, ‘আমার সন্তান আছে। আজ থেকে ১৫ বছর পর সে তো এই ব্যপারগুলো জানবে। সে যদি আমাকে প্রশ্ন করে- আমি শিক্ষার্থীদের জন্য কী করেছি? আমি তার কাছে কী উত্তর দেবো? এসব শিক্ষার্থী হত্যার বিচার যতদিন না হবে ততদিন কোনও মানুষই শান্তি পাবে না। তাই দ্রুত শিক্ষার্থীদের হত্যার বিচার দাবি জানাই।’
অভিনেতা মোশাররফ করিম বলেছেন, ‘আমরা রক্তপাত চাই না, শান্তি চাই। এসবের বাইরে থাকতে চাই।’
বৃহত্তর চলচ্চিত্র, আলোকচিত্র, থিয়েটার, গণমাধ্যমসহ দৃশ্যমাধ্যমের নানা শাখার কর্মীরা ‘দৃশ্যমাধ্যম শিল্পীসমাজ’-এর ব্যানারে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশে হত্যা-সহিংসতা-গণগ্রেফতার-হয়রানির প্রতিবাদে এবং সব হত্যার হিসাব ও বিচার করা, গুলি ও সহিংসতা বন্ধ, গণগ্রেফতার ও হয়রানি বন্ধ, আটক শিক্ষার্থীদের মুক্তির দাবিতে এদিন সড়কে জমায়েত হয়েছেন।
তাদের দাবি, অবিলম্বে সব হত্যাকাণ্ডের বিচার এবং হত্যা, সহিংসতা, গণগ্রেফতার ও হয়রানি বন্ধ করতে হবে।
শিল্পীরা বলেন, ‘যেই ন্যায্যতা, সমতা ও মানবিক মর্যাদার অঙ্গীকার নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ঘটেছিল স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়, সেই বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে নিরাপত্তা ও ন্যায়বিচার আমাদের সাংবিধানিক অধিকার। সেই অধিকার নিয়েই আমরা রাজপথে দাঁড়ানোর প্রয়োজন মনে করেছি।’
প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার এই সমাবেশ শেষ হতেই বৃষ্টিও থেমে গেলো। বুঝি ধুয়ে নিলো শিল্পীমনের যত ক্ষোভ আর অভিমানগুলো।