মসজিদ মন্দিরে যেতে বলো না আমায়... এমন কথার মৌলিক গান গেয়ে অসাম্প্রদায়িক মানুষ হিসেবে নিজেকে ভিন্নমাত্রায় নিয়েছেন জনপ্রিয় বাউল শফি মণ্ডল। পাশাপাশি সুফিবাদ প্রচারে লালন ফকিরের গান গেয়ে জনপ্রিয়তা পাওয়া এই শিল্পী এবার নিজ গ্রামে সাধকদের ভাব-সাধনার জন্য ‘সুধা সিন্ধু ভাবাশ্রম’ নামের একটি ঠিকানা গড়ে তুলছেন। শহুরে কোলাহল ফেলে যেখানে ফিরতে চান তিনি নিজেও।
কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার নিজ গ্রাম হোসেনাবাদে গড়ছেন এই ভাবাশ্রম। জীবনের শেষ সময়গুলো সেখানেই কাটাতে চান তিনি।
আশ্রম তৈরির বিষয়ে জানতে চাইলে শফি মণ্ডল বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ভাবাশ্রম নির্মাণের কাজ শুরু হয়েছে। শেষ হতে বছর খানেক সময় লাগবে।
সুধা সিন্ধু ভাবাশ্রমের উদ্দেশ্য কী জানতে চাইলে শফি মণ্ডল বলেন, ‘ভক্তরা আমার কাছে ছুটে আসতে চায়। তাদের ভালোবাসা আমার পাথেয়। মানুষের ভক্তির মধ্যেই সব শান্তি। ভক্তদের ভাব সাধনার জন্য আশ্রমটি তৈরি করছি। বাড়ির চারদিক ঘিরেই ভক্তরা সময় কাটাতে পারবেন, ভাব-সাধনা করতে পারবেন। প্রতি বছর ১১ নভেম্বর সুফি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। প্রতি বছর সেখানে সাধুদের মেলাও অনুষ্ঠিত হবে। আশ্রমে ভক্তরা গিয়ে যাতে ভালোভাবে সময় কাটাতে পারেন সে লক্ষ্যে এই ভাবাশ্রম তৈরি করছি।’
বলা দরকার, নতুন গান তৈরি ও পরিবেশনার সুবাদে শফি মণ্ডলের বর্তমান বসবাস রাজধানীর মোহাম্মদপুরের একটি ফ্ল্যাটে।
শেষ জীবনের ইচ্ছে প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এই নগরবাউল বলেন, ‘জীবনে শেষ সময় বলতে আমি মনে করি এখনই। কখন আমার সময় ফুরায়ে যাবে জানি না। পাখিরা উড়ে বেড়ায় দিনভর। দিনশেষে সন্ধ্যায় সব পাখিই ঘরে ফিরতে চায়। আমিও আমার গ্রামে ফিরে যাবো। গ্রামের মানুষের কাছে আমার অনেক ঋণ। তাদের ভালোবাসার ঋণ শোধ করা সম্ভব হবে না। তবে তাদের কাছে ফিরে গিয়ে কৃতজ্ঞতা স্বীকার করা উচিত। আমি তাই গ্রামে ফিরতে চাই। জানি না কী হবে আগামীকাল। সেজন্যই আশ্রমটি গড়ে তুলছি। শেষ সময়টা যেন সেখানেই কাটাতে পারি।’
শিল্পী হিসেবে ভক্ত ও দর্শকদের কাছে নিজেকে সামনে আরও কীভাবে মেলে ধরতে চান জানতে চাইলে এই শিল্পী গড়ার কারিগর বলেন, ‘মনে তারুণ্য থাকলেও শরীরে সেই তারুণ্য তো নেই এখন। গান গাইলে ত্রুটি হতে পারে। তবে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত আমি গাইতে চাই।’
শফি মণ্ডলের পারিবারিক সূত্র জানায়, ১৯৫২ সালের ১৩ ডিসেম্বর কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলার ফিলিপনগর গ্রামে জন্ম নেন তিনি। জন্ম নেওয়া ফিলিপনগর গ্রামের বাড়িটি পদ্মার ভাঙনে তলিয়ে গেলে পাশের হোসেনাবাদ গ্রামে স্থানান্তর হন সপরিবারে।
শফি মণ্ডলের ভক্তরা জানান, তিনি হিন্দু বা মুসলিম ধর্মে না, মানব ধর্মে বিশ্বাসী একজন মানুষ। অসাম্প্রদায়িক চেতনার এই মানুষটির গানে হাতেখড়ি হয়েছিল ছোটবেলায় মামাতো ভাই সাবদার হোসেনের কাছে। এরপর ১৯৭৯ সালে উচ্চাঙ্গসংগীতের তালিম নেন ভারতের শ্রী সাধন মুখার্জির কাছে। গুরু সাধন মুখার্জির পরামর্শে বেছে নেন সুফিবাদ সংগীতের পথ। ‘ষষ্ঠ কান্ত কবি উৎসব-২০২২’ পুরস্কারও পেয়েছেন শফি মণ্ডল।
নন্দিত এই বাউলশিল্পী প্রভুপ্রেমে খেলাফত নিয়েছেন। ‘এসো হে প্রভু নিরঞ্জন’- এই বাণীর প্রতিপাদ্যে প্রয়াত গুরু সুলতান ফকিরের আদেশে খেলাফত নিয়েছেন শফি মণ্ডল। ইহজাগতিক লোভ, লালসা, মায়া-মমতা ও মোহ ত্যাগ করে জীবিত থেকেই গ্রহণ করেছেন মরণের স্বাদ। সস্ত্রীক খেলাফত গ্রহণ উপলক্ষে এই শিল্পীর আখড়াবাড়িতে সাধুসঙ্গ অনুষ্ঠানে আগমন ঘটেছিল হাজারো সাধু, গুরু, বাউল ও লালন অনুসারীর। ২০২২ সালের ১১ নভেম্বর নিজেদের দীনহীন করে শুধু সাদা কাফনের কয়েক টুকরো পরে শফি মণ্ডল ও তার স্ত্রী জরিনা খাতুন খেলাফত গ্রহণ করেছেন।