X
শনিবার, ১৭ মে ২০২৫
২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩২
তৃতীয় চোখ

আকি কাউরিসমাকির চলচ্চিত্র—রাজনীতি ও আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান 

কামরুল হাসান কাইউম
১৬ মে ২০২৫, ১৮:৪৭আপডেট : ১৬ মে ২০২৫, ১৮:৫২

আকি কাউরিসমাকিকে বলা যেতে পারে ফিনিশ চলচ্চিত্রের নিয়ত অস্বস্তির পুনরুৎপাদনকারী। যার চলচ্চিত্রে হরহামেশাই খুঁজে পাওয়া যায় ফিনল্যান্ডের জাতীয় আর্থ-সামাজিক অবস্থা, শ্রেণি-কেন্দ্রিক শিল্প ভাবনা, মার্ক্সবাদ ও পোস্টন্যাশনালিজম। কাউরিসমাকির চলচ্চিত্রে বিশ্বায়নের প্রেক্ষিতে ফিনল্যান্ডের জাতীয় সংস্কৃতি ও পরিচয়ের রূপান্তরিত অবয়ব অনুসন্ধান করা হয়েছে—যে সংস্কৃতি ও পরিচয় ধারাবাহিকভাবে বিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। কাউরিসমাকি জাতীয় পরিচয়ের প্রথাগত ধারণাকে যেমন চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছেন, তেমনি আর্থ-সামাজিক ও ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এর রূপান্তরকে নজির হিসেবে হাজির করেছেন।  

তিনি অনেকটা কৌতুকমিশ্রিত সাবলীল ভঙ্গিতে রাজনীতিকে নিয়ে আসেন তার চলচ্চিত্রে, যেখানে ফিনল্যান্ডের মতো উন্নত দেশের প্রান্তিক মানুষরা হয় তার চলচ্চিত্রের মূল চরিত্র এবং চরিত্রগুলোর জীবন নিরানন্দ, বলা যেতে পারে এক অদ্ভুত বিষাদে আক্রান্ত। কাউরিসমাকি তাদের দৈনন্দিন জীবনযাপনের মাধ্যমে তুলে ধরেন দারিদ্র্য, বৈষম্য, ব্যক্তির জাতীয় চরিত্রের পরিচয় ও অভিবাসনের মতো সঙ্কটকে। তিনি তার দর্শকদের কোনও অস্বস্তির মধ্য দিয়ে যেতে বাধ্য করেন না, বরঞ্চ ডেডপ্যান কমেডির মাধ্যমে তিনি বাস্তবতার সরলীকরণ সেলুলয়েডে তুলে ধরেন, ফিনল্যান্ডের সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে তিনি সূক্ষ্মভাবে কিন্তু তীর্যক ভঙ্গিতে নব্য উদারনীতিবাদ ও বিশ্বায়নের সমালোচনা করেন। শ্যাডোস ইন প্যারাডাইস অ্যান্ড্রু নেস্টিংয়েন কাউরিসমাকির চলচ্চিত্রকে আখ্যায়িত করেছেন ‘কন্ট্রারিয়ান সিনেমা’ বলে। তার মতে, কাউরিসমাকির চলচ্চিত্র প্রথাগত কোনও কাঠামোতে লিপিবদ্ধ করা যায় না এবং অর্থগত অবস্থান থেকে এ চলচ্চিত্র পরস্পরবিরোধী। তিনি ‘দ্য সিনেমা অব আকি কাউরিসমাকি: কন্ট্রারিয়ান স্টোরিজ’ বইয়ে কাউরিসমাকির স্বকীয়তাবাদী ব্যক্তিত্বকে কেন্দ্র করে তার চলচ্চিত্রের দ্বান্দ্বিকতার নিরীক্ষা করেছেন। যেখানে তিনি কাউরিসমাকির চলচ্চিত্রের আঙ্গিককে ‘পোস্টমডার্নিস্ট ইকলেকটিসিজিম’-এর সম্মিলন (যেখানে কাউরিসমাকির চরিত্রগুলো সমাজের জন্য অনুপযুক্ত) এবং চলচ্চিত্রকার কাউরিসমাকিকে উল্লেখ করেছে প্রকৃত অর্থেই একজন রাজনৈতিক চলচ্চিত্রকার বলে।  অ্যারিয়েল কাউরিসমাকির ‘শ্যাডোস ইন প্যারাডাইস’ (১৯৮৬), ‘অ্যারিয়েল’ (১৯৮৮) ও ‘দ্য ম্যাচ ফ্যাক্টরি গার্ল’ (১৯৯০) চলচ্চিত্রত্রয়ী প্রলেতারিয়েত ট্রিলজি নামে পরিচিত। তবে, কাউরিসমাকি তার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তার এ চলচ্চিত্রত্রয়ীর ক্ষেত্রে শুধুমাত্র শ্রমিক বা প্রলেতারিয়েত শব্দটা ব্যবহার করা ভুল হবে; তিনি মনে করেন, তার চরিত্রগুলোর বিচ্ছিন্নতা তাদের শ্রেণিগত অবস্থা সম্পর্কে অসচেতন অথবা শ্রেণি রাজনীতির প্রতি উদাসীন করে তোলে। কাউরিসমাকিকে ফিনিশ চলচ্চিত্রের একজন বোহেমিয়ান হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে, যিনি তার সমাজ ও রাষ্ট্রের অস্বাভাবিকতা ও অদ্ভুতুড়ে খেয়ালকে রাজনৈতিক ভাষায় চলচ্চিত্রে তুলে ধরেছেন। এবং যার রাজনৈতিক প্রভাবের ব্যাপ্তি রাজনীতি ছাপিয়ে বিস্তৃত হয়েছে নান্দনিকতা, ইতিহাস, অতীতবিধুরতা এবং চলচ্চিত্রের বাণিজ্য ও উৎসব পর্যন্ত। 

কাউরিসমাকি তাঁর লুজার ট্রিলজিতে আধুনিক সময়ে জীবনের একঘেয়েমি, কর্মসংস্থানের সুযোগের অপর্যাপ্ততা, বেকারত্ব ও গৃহহীন অবস্থা এবং শ্রমজীবী মানুষের প্রতিদিনকার জীবন নিয়ে স্থানিক রাজনীতিকে চলচ্চিত্রের ভাষায় সূক্ষ্মভাবে তুলে এনেছেন।  দ্য ম্যাচ ফ্যাক্টরি গার্ল চলচ্চিত্রগুলোর প্রেক্ষাপট হিসেবে ছিল ফিনল্যান্ডের অন্যতম বাণিজ্যিক অংশীদার সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে পড়ার পর নব্বই দশকে ফিনল্যান্ডের অর্থনীতির সঙ্কট। ‘ড্রিফটিং ক্লাউডস’ (১৯৯৬)-এ এক দম্পতির গল্প বলা হয়েছে, যারা হঠাৎ করেই জানতে পারেন তাদের আর চাকরি নেই। অন্যদিকে, ‘দ্য ম্যান উইদাউট আ পাস্ট’ (২০০২) চলচ্চিত্রে দেখানো হয় অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি হেলসিঙ্কির এক পার্কে মারধরের শিকার হওয়ার পর তার স্মৃতির বিলোপ ঘটে এবং তিনি নতুনভাবে তার জীবন শুরু করেন। ‘লাইটস ইন দ্য ডাস্ক’ (২০০৬) চলচ্চিত্রের গল্প একজন নাইটওয়াচম্যানের একাকিত্ব নিয়ে, যাকে জীবনের প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই নানারকম হয়রানির শিকার হতে হয়। এ ট্রিলজির প্রোটাগনিস্টরা সবাই সমাজের জন্য অনুপযুক্ত এবং একইসাথে ‘লুজার’। আকি কাউরিসমাকি নিজেও তার চলচ্চিত্র জীবন শুরুর আগে পোস্টম্যান ও ডিশ ওয়াশারের পেশায় কাজ করেছেন। লাইটস ইন দ্য ডাস্ক ১৯৮৯ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত চলচ্চিত্র ‘লেনিনগ্রাদ কাউবয়েজ গো আমেরিকা’ চলচ্চিত্রে ফিনল্যান্ড ও ফিনিশ আত্ম-পরিচয় উদযাটনের অনুসন্ধান করেছেন কাউরিসমাকি। উল্লেখ্য, এ চলচ্চিত্র মুক্তির একই বছরে ফিনল্যান্ড নিউট্র্যালিটির আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেয় সোভিয়েত ইউনিয়ন। কাউরিসমাকি নির্মিত সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ফলেন লিভস’ (২০২৩)। এ চলচ্চিত্রের সংবাদ সম্মেলনে কাউরিসমাকি ‘ফলেন লিভস’-কে ওয়ার্কিং ক্লাস (প্রলেতারিয়েত) ট্রিলজির চতুর্থ চলচ্চিত্র হিসেবে উল্লেখ করেছেন, অনেকটা ব্যাঙ্গাত্মকভাবেই। ‘ফলেন লিভস’র গল্প আবর্তিত হয়েছে আনসা আর হোলাপ্পাকে ঘিরে। কাকতালীয়ভাবে তাদের একটি ক্যারিওকে বারে দেখা হয়। রোমান্টিক-কমেডি ঘরানার এ চলচ্চিত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, একাকিত্ব, অনিয়ন্ত্রিত মদ্যপান ও বিষণ্নতা উঠে এসেছে। ফলেন লিভস এক সংবাদ সম্মেলনে চলচ্চিত্রটিতে রাজনৈতিক বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন করা হলে কাউরিসমাকি বলেন, ‘যুদ্ধের ব্যাপারে উল্লেখ করা অবশ্যম্ভাবী ছিল। রক্তক্ষয়ী এ যুদ্ধ নিয়ে নিজস্ব বক্তব্য না রেখে এ চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারতাম না। তাই, আমি রেডিওর মাধ্যমে এটা করেছি।’ চলচ্চিত্রটিতে বারেবারেই ঘুরেফিরে এসেছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। কাউরিসমাকি একইসাথে মনে করেন চলচ্চিত্রে প্রেমের গল্পের প্রয়োজন; তবে, সেটা পারিপার্শ্বিকতাকে বাদ দিয়ে নয়। একইরকমভাবে তিনি যেমন ব্যক্তিগতভাবে ফিনল্যান্ডের ন্যাটোতে যুক্ত হওয়াকে সমর্থন করেন না। বর্তমান পৃথিবীতে মানবতার অস্তিত্ব নিয়েও শঙ্কিত কাউরিসমাকি। তার বিশ্বাস একমাত্র মানবতাই যা একটু টিকে আছে; কিন্তু সেটিও বেশি নেই। কামরুল হাসান কাইউম ফিনিশ এ চলচ্চিত্রকার তার চলচ্চিত্রে তুলে ধরেছেনে অনিশ্চিত ও অস্থির এক সময়কে, যেখানে প্রশান্তি হচ্ছে ভোগবাদ, যেখানে ব্যক্তির স্ব-নিয়ন্ত্রণ ও স্বাধীনতা রাষ্ট্রের কাছে কুক্ষিগত, যেখানে নৈতিকতার প্রশ্ন অবান্তর, যুদ্ধ ও সংগ্রাম জীবনের প্রাত্যহিকতা এবং যেখানে মানবতা ভূলুণ্ঠিত হয় ন্যায়বিচার প্রাপ্তির সম্ভাবনায়। আকি কাউরিসমাকির কাছে মানুষের জন্য রাজনীতি হচ্ছে ‘আদি পাপ’। আর এভাবেই শুধুমাত্র চলচ্চিত্রের ভাষায়ই নয়, ব্যক্তিজীবনেও রাজনৈতিক হয়ে ওঠেন আকি কাউরিসমাকি। যিনি পরিশেষে ভালোবাসার মায়ায় আবদ্ধ কিন্তু জাতীয় ও বিশ্ব রাজনীতিকে অস্বীকার করে নয়। আর নিজের এ দর্শন প্রকাশে তিনি কেন বারবার কমেডিকে বেছে নেন- তার উত্তর বোধহয় মেলে কেন চ্যাপলিনকে তিনি সবচেয়ে প্রভাবশালী চলচ্চিত্রকার মনে করেন তার ব্যাখ্যায়। 

লেখক: চলচ্চিত্রকর্মী
ইমেইল: [email protected]

/এমএম/
সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
রিমাক্রিতে চিত্রায়িত সিনেমা ‘নাদান’
রিমাক্রিতে চিত্রায়িত সিনেমা ‘নাদান’
আকি কাউরিসমাকির চলচ্চিত্র—রাজনীতি ও আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান 
তৃতীয় চোখআকি কাউরিসমাকির চলচ্চিত্র—রাজনীতি ও আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান 
প্রযোজক হিসেবেও আনন্দিত জয়া!
প্রযোজক হিসেবেও আনন্দিত জয়া!
কানসৈকতে দেখা নির্মাতা অনুপম খেরের সঙ্গে
কানসৈকতে দেখা নির্মাতা অনুপম খেরের সঙ্গে
মাত্র ৪ প্রেক্ষাগৃহে কেন জয়ার সিনেমা!
এ সপ্তাহের সিনেমামাত্র ৪ প্রেক্ষাগৃহে কেন জয়ার সিনেমা!