X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২২ বৈশাখ ১৪৩১

ছোট্ট আলিনাকে নিয়ে ন্যান্‌সির ডায়েরি...

বিনোদন রিপোর্ট
২৩ মে ২০১৬, ১১:৪৬আপডেট : ২৩ মে ২০১৬, ১৬:৪৬


গত ৪ মে তৃতীয়বারের মতো মা হন জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত কণ্ঠশিল্পী ন্যান্‌সি। এ নিয়ে ন্যান্‌সি ও জায়েদ দম্পতির পরিবারে ছিল খুশির বন্যা। নাম রেখেছিলেন আলিনা জাফরিন।কিন্তু মাত্র ১৭ দিনের মাথায় শনিবার সবাইকে কাঁদিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছে সেই কন্যাসন্তানটি। একজন মায়ের জন্য এটা কতটা বেদনাবিধুর তা কিছুটা আঁচ করা যায় ন্যান্‌সি লেখা একটি ডায়েরিতে। ১০ থেকে ২২ মে পর্যন্ত সে দিনগুলোর কথা ফেসবুকে লিখেছেন এ শিল্পী। তার সে দিনলিপি তুলে ধরা হলো- ন্যান্‌সি। ছবি সাজ্জাদ হোসেন
১০ মে, ২০১৬
-হ্যালো, কে বলছেন?
-আমি ন্যান্‌সি বলছি।
-কে?
(মনে পড়ে গেল এখন আর আমি ন্যান্‌সি নই। আমার এখন নতুন পরিচয়)
- আমি ‘এনআইসিইউ ১০’-এর (হাসপাতালের ক্রম নম্বর) মা বলছি।
(অপর প্রান্তে নীরবতা। কিছুক্ষণ পরে নতুন একটি কণ্ঠ মোলায়েম স্বরে জি আপু বলেন)
‘এনআইসিইউ ১০’-এর আসল নাম আলিনা জাফরিন। আমার তৃতীয় কন্যাসন্তান। ‘সেপটিসেমিয়া’তে আক্রান্ত। গতকাল ওকে এই হাসপাতালের এনআইসিইউতে ভর্তি করা হয়েছে। কতদিন থাকবে- জানি না। দিনে কয়েকবার গিয়ে ওকে দেখে আসি। আমার মেয়েটা বেশিরভাগ সময় চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকে, আর শুধু কাঁদে। আমি নীরবে তাকিয়ে শুধু দেখি।

১১ মে, ২০১৬
আজ রাত ১০টায় আলিনার প্রথম অপারেশন হবে। ওর পরিপাকতন্ত্রের কিছুটা অংশে সংক্রামণের জন্য পচন ধরেছে। ডাক্তাররা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আক্রান্ত অংশটুকু কেটে ফেলে দিবেন। বাচ্চার বেঁচে থাকার সুযোগ ৭০%। আমরা একসাথে আল্লাহ্‌র কাছে প্রার্থনা করছি। বেশ কিছুক্ষণ পর অপারেশন থিয়েটার থেকে একজন জায়েদকে ভেতরে ডেকে নিলেন। জায়েদ বের হওয়ার পর জানলাম, আলিনার পেটের ভেতরের পচনটা দেখানোর জন্য ওকে ডাকা হয়েছিল। প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর অপরেশন সফলভাবে শেষ হলো। আমরা আল্লাহ্‌র কাছে শোকরিয়া আদায় করে বাড়ি ফিরলাম।

১২ মে, ২০১৬
আলিনার নাকের ভেতর নল, মাথায় ক্যানোলা, হাতে ক্যনোলা, পেটে বড় একটা ব্যান্ডেজ, ব্যান্ডেজের পাশে মলমূত্র বের হবার জন্য একটা ড্রেন (আলিনার পেটের ভেতরের যে অংশটুকু কেটে বাদ দেওয়া হয়েছে, সেটা আর জোড়া দেওয়া হয়নি। সব কিছু যদি ঠিক থাকে, তাহলে দেড় মাস পরে আরেকটা অপারেশন করে ড্রেনটা বন্ধ করে দেওয়া হবে। ততদিন পর্যন্ত পেটের পাশের ড্রেন দিয়েই মলমূত্র বের হবে), পায়ে ক্লিপ আটকানো, বুকে একটা নল স্কচটেপ দিয়ে আটকানো। ও কেঁদেই যাচ্ছে, যথারীতি আমি দেখছি। মাঝে মাঝে ওর মাথায়, হাতে, পায়ে হাত বুলাচ্ছি।

১৫ মে, ২০১৬
আলিনার শরীরের অবস্থা হঠাৎ করেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। মেডিসিন দিয়েও ওর সংক্রমণ থামানো যাচ্ছে না। ওর চোখ বন্ধ, আমি ওর চোখ খোলার আশায়...।

১৬ মে, ২০১৬
আলিনা এখনও চোখ বন্ধ করে আছে। আমি ওর পিঠে চাপড় দিচ্ছি, হাত ঝাঁকাচ্ছি, চোখের ওপর হাত বুলাচ্ছি, ‘মা মা’ করে ডাকছি, তবুও ও চোখ খুলছে না।

১৮ মে, ২০১৬
সকাল ৯টা। এনআইসিইউতে ফোন করে জানলাম, আজ আলিনার মুখে খাবার দেওয়া হবে। আমি আর জায়েদ আনন্দে আত্মহারা। তাড়াতাড়ি ফিডারে দুধ ভরে নিয়ে ছুটলাম হাসপাতালে।
আলিনার সামনে চেয়ারে বসে আছি। ওর মুখে খাবার দেওয়া হয়নি। দায়িত্বরত ডাক্তাররা পেডিয়াট্রিক সার্জনের জন্য অপেক্ষা করছেন। কী করতে হবে- তা উনি এসে বলবেন। ঘড়িতে তিনটা পনেরো। আলিনার ব্যন্ডেজের ফাক দিয়ে সবুজ পানি বের হচ্ছে। সবুজ পানিটা যে দিক দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে, সেখানকার চামড়া ঝলসে যাচ্ছে (এসিডে পুড়লে যেমন ঝলসে যায়, সেরকম)। আমি নিচে নেমে আসলাম। আমি যখন এনআইসিইউর ভেতরে থাকি, তখন জায়েদ বাইরে অপেক্ষা করে। বের হয়ে ওকে বললাম, ডাক্তার কখন আসে জানি না, চল চলে যাই। ও যেতে রাজি না। একটু পর ডাক্তার আসলেন। আলিনার ব্যান্ডেজ খোলা হলো। পেটের যে অংশটুকু সেলাই করা হয়েছিল তার অনেকটাই ঝলসে গিয়ে সেলাই খুলে যাওয়ার উপক্রম।
৪টা ৩০ মিনিট বাজে। অপারেশন থিয়েটারের ভেতর আলিনা, বাইরে আমরা। এবার তার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা ৫০% এরও কম। আবার অপারেশন থিয়েটারের ভেতর থেকে জায়েদের ডাক পড়ল। ও তখন রক্ত দিতে গিয়েছে। ভেতরে আমি গেলাম। ডাক্তার আলিনার পেটের ভেতরটা দেখালেন। আমি মনোযোগ দিয়ে দেখলাম, নাড়ির কতটুকু পচে গেছে, কতটুকু কেটে বাদ দেবে। বাইরে এসে অপেক্ষার পালা। এবারও অপরেশন সফল হল। আমরা এক বুক আশা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম।

১৯ মে, ২০১৬
আলিনার চোখ খোলা, আমি নিষ্পলক। তখনও জানতাম না শেষবারের মতো দুজন দুজনকে দেখছি।

২০ মে, ২০১৬
আলিনার যেকোনও সময় ভেন্টিলেটর প্রয়োজন হতে পারে। ডাক্তার ইনিয়ে-বিনিয়ে জানতে চাচ্ছেন, মেশিনের সাপোর্ট দেবেন কি দেবেন না? জায়েদ ডাক্তারকে বলল, যা যা দরকার, সব করেন। শুধু আমাদেরকে ফোন দিয়ে জানাবেন।
রাতে আলিনাকে ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা (সাদা রক্ত) দেওয়া হল। এই কয়েক দিনে আলিনাকে বেশ কয়েক দফায় ফ্রেশ রক্ত ও ফ্রেশ ফ্রোজেন প্লাজমা দেওয়া হয়েছে। জায়েদ শেষবারের মতো মেয়েকে চোখ খোলা অবস্থায় দেখলো। রাতে হাসপাতালে না যাওয়ার কারণে আমার আর দেখা হলো না।

২১ মে, ২০১৬
সকাল ৮টা ৩০ মিনিট। আলিনার হার্টবিট রেট ক্রমশ কমছে। বুকের পাঁজরের হাড়গুলো কৃত্রিম শ্বাস-প্রশ্বাসের সাথে সাথে উঠানামা করছে। চোখের পাতা একটু খোলা, মনে হচ্ছে যেন চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করছে। আমি ওকে কোলে নিতে চাইলাম। আজ আর কেউ বাধা দিল না। কতক্ষণ পর ঠিক জানি না, কিন্তু মনে হল আলিনা মারা গেছে। জায়েদ আমার কাঁধে হাত রেখেছে। আজ আর ওর স্পর্শে ভরসা পাচ্ছি না। মৃত্যুর পরও আলিনার বুকের হাড় কৃত্রিমভাবে ওঠা নামা করছে।

আলিনার শরীর থেকে সমস্ত নল খুলে নেওয়া হলো। এবার ওর সমস্ত শরীর কচি কলাপাতা রঙের পাতলা পেপার দিয়ে মুড়ে দেওয়া হল। শুধু ছোট্ট মুখটা বের হয়ে আছে। আমার দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। চিৎকার করে বলছি, আমি সংগীতশিল্পী ন্যান্‌সি নই, আমি এনআইসিইউ ১০-এর মা নই, আমি এই ছোট্ট শিশুটির মা- যার নাম আলিনা জাফরিন। ওর বয়স ১৭ দিন। কেউ কি ওকে আমার বুকে ফিরিয়ে দেবেন? আল্লাহ, তুমি কি দয়া করে ওর হায়াত বাড়িয়ে দেবে? কেউ কি আছেন যে এই নিষ্পাপ বাচ্চার জন্য প্রাণভরে দোয়া করবেন। হয়তো আপনাদের দোয়ায় আল্লাহ্‌ ওর প্রাণ ভিক্ষা দেবেন...
কেউ আমার চিৎকার শুনতে পাচ্ছে না...

২২ মে, ২০১৬
সকাল ৯টা ৩০ মিনিট। সব আবার আগের মতো। আলিনার বিছানা, বালিশ, কাঁথা, টাওয়েল, দোলনা, খেলনা, জামা সব গোছানো। আলিনার জামা থেকে এখনও ওর গায়ের গন্ধ পাচ্ছি। আমাকে আর প্রতিদিন হাসপাতালে যেতে হয় না, ফোন দিয়ে বলতে হয় না- আমি এনআইসিইউ ১০-এর মা বলছি। আমি এখন আলিনা জাফরিনের মা। জন্মের পর  আলিনা জাফরিন

/এম/

সম্পর্কিত
বিনোদন বিভাগের সর্বশেষ
কারিনাকে নিজ পরিবারে স্বাগত জানালেন প্রিয়াঙ্কা
কারিনাকে নিজ পরিবারে স্বাগত জানালেন প্রিয়াঙ্কা
ফারিণের ৮ বছরের অপেক্ষা শেষ হচ্ছে ২৪ মে
ফারিণের ৮ বছরের অপেক্ষা শেষ হচ্ছে ২৪ মে
পরীর মনে প্রেমানুভব!
পরীর মনে প্রেমানুভব!
অজানা তথ্য সামনে আনলেন পরিণীতি
অজানা তথ্য সামনে আনলেন পরিণীতি
৪ বছর বয়সে শুরু, জিতেছেন ১৬টি গ্র্যামি
শুভ জন্মদিন৪ বছর বয়সে শুরু, জিতেছেন ১৬টি গ্র্যামি