স্পেনের মাদ্রিদে শুরু হয়েছে বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলন। সেখানে বিশ্বনেতারা আলোচনা করবেন মানবজাতির সবচেয়ে ভয়াবহ সংকট নিয়ে। সম্প্রতি সুইডিশ কিশোরী গ্রেটা থানবার্গ পৃথিবীর সুরক্ষার জন্য জলবায়ু পরিবর্তনে দায়ী বিশ্বনেতাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করা এই জলবায়ুকর্মী একত্রিত করেছেন লাখ লাখ শিশু-কিশোরকে। বুঝিয়েছেন জলবায়ু ইস্যুতে পদক্ষেপ নেওয়া কতটা জরুরি। গ্রেটার ডাকে যুক্তরাষ্ট্রের ম্যানহাটনে জড়ো হয়েছিলো ২ লাখেরও বেশি মানুষ। তাদের সামনের সারিতে ছিল বাংলাদেশি কিশোরী রেবেকা শবনম। ১৬ বছর বয়সী রেবেকাকে নিয়ে বিশেষ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে কাতারভিত্তিক সংবাদমাধ্যম আল-জাজিরা।
সেপ্টেম্বরের জলবায়ু পরিবর্তন রোধের আন্দোলনে বেশ আলোচিত হয়েছিল ১৬ বছর বয়সী রেবেকা শবনম। একাদশ শ্রেণির ছাত্রী রেবেকা পরিবারের সঙ্গে নিউ ইয়র্কে বসবাস করেন। ছয় বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্র যান তিনি। সেখানে শবনম সবাইকে বোঝাতে চেয়েছেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বাংলাদেশ কতটা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। নিউ ইয়র্কে হাজার হাজার মানুষের সামনে তিনি বলেছেন, ‘আমি বাংলাদেশ থেকে এসেছি, যা জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার দেশগুলোর মধ্যে একটি অনন্য দৃষ্টান্ত।’ বক্তৃতায় জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে কেমন করে বাংলাদেশের মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছেন তাও তুলে ধরেছেন রেবেকা।
বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অব্স্থানে থাকা দেশগুলোর মধ্যে একটি বাংলাদেশ। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে, জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারসহ উন্নয়নের বর্তমান পরিবেশ বৈরী ধারা-প্রবণতা বজায় রাখলে ভয়ঙ্কর জলবায়ু ঝুঁকিতে পড়বে বাংলাদেশ। এখানে নারী, শিশু ও রোহিঙ্গা শরণার্থীরাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।
আল-জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে শবনম বলে, ‘ভেবেছিলাম যখন বাংলাদেশের নাম উচ্চারিত হবে তখন সবাই চুপ থাকবেন। তবে সবার সাড়া দেখে আমি নিজেই অবাক। এটা শুধু পরিবেশগত সংকট না। এটা মানবাধিকার সংকটও। বাংলাদেশের নারীরা পাচারের শিকার হন আর এটা জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে আরও বেড়েছে। আমরা বাংলাদেশে থাকা নারী ও রোহিঙ্গাদের জানাতে চাই, তাদের জীবনের জন্য বিশ্বজুড়ে আন্দোলন করছি আমরা।’
গত বছরের চেয়ে এবারের জলবায়ু সম্মেলনে আরও জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে আশা শবনমের। তিনি বলেন, ‘আমরা চাই এই সম্মেলনে যেন শুধু প্রাপ্ত তথ্যের ওপর নোট নেওয়া না হয়। বরং জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধে যেন পদক্ষেপ নেওয়া হয়।’ তার আশা, শুধু পুনঃব্যবহারযোগ্য সম্পদ ব্যবহারে পরিবর্তিত না হয়ে এমন পদক্ষেপ নেওয়া হোক, যেন এর ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোর জীবন পরিবর্তিত হয়।
বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট ঝুঁকির কারণেই ১৬ কোটি মানুষের অনেকেই অভিবাসনের আশ্রয় নিচ্ছেন। ছেড়ে আসছেন নিজ এলাকা, ফলে জলবায়ু উদ্বাস্তুর সংখ্যা বেড়েই চলছে। এতে শহরগুলোতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। পাচারকারীরা শিশু ও নারীদের লক্ষ্যবস্তু বানাচ্ছে। চলতি বছর জুলাইয়ের জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, নারীদের ঘর ছেড়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন। আর এতে পাচার হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ছেন তারা।
ইউনিসেফ বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাপক শাকিল ফয়জুল্লাহ আল জাজিরাকে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের এ বিষয়টি আসলে নীরব ঘাতক। প্রতিদিনই আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে কিছু দেখা যাচ্ছে না।’
গত এপ্রিলে প্রকাশিত ইউনিসেফের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১ কোটি ৯০ লাখ শিশু জলবায়ু পরিবর্তনে সৃষ্ট দুর্যোগের ঝুঁকিতে রয়েছে। ফয়জুল্লাহ বলেন, ‘এই শিশুরা এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় চলে যেতে বাধ্য হওয়ায় তাদের শিক্ষা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। যখনই কোনও বন্যা হয়, তখন স্বাস্থ্যসেবা বিঘ্নিত হয়। বিশেষ করে টিউবয়েল ভেঙে যায়, স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। একজন শিশু যদি স্বাস্থ্যসেবা না পায়, শিক্ষা না পায়, এমনকি খাবার পানি না পায়, তাকে আপনি আর কী দেবেন?’
শবনম সেপ্টেম্বরে দেওয়া এক ভাষণে তুলে ধরেছিলেন কীভাবে জলবায়ু পরিবর্তনে অভ্যন্তরীণ উদ্বাস্তু তৈরি হয় আর বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া বিশ্বের সবচেয়ে নিপীড়িত জনগোষ্ঠী রোহিঙ্গারা কতটা ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্লেষকরাও বলছেন, নারী ও রোহিঙ্গারা বিশেষভাবে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার।
ব্র্যাকের ইমারজেন্সি রেসপন্স অ্যান্ড প্রিপেয়ার্ডনেস-এর পরিচালক মইন উদ্দিন আহমেদ বলেন, নারীরা তো সাংস্কৃতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেনই, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবও তাদের ওপর বেশি। পুরুষ সদস্য সহজেই অন্য কোথাও চলে যাচ্ছেন কিংবা বাইরে ছোটাছুটি করছেন। এতে করে সংসারের সব চাপ নারীদের সামলাতে হচ্ছে।
জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিতে ২০১৮ সালে প্রতি শুক্রবার সুইডিশ পার্লামেন্টের বাইরে অবস্থান নেওয়া শুরু করেন স্কুলছাত্রী গ্রেটা থানবার্গ। তার এই অবস্থানের মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে বেগবান হয় জলবায়ু আন্দোলন। সম্প্রতি তার প্রতি সমর্থন জানিয়ে দুনিয়াজুড়ে এই আন্দোলনে শামিল হন লাখ লাখ মানুষ। সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ আয়োজিত এক সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তন রোধে বিশ্বনেতারা যথাযথ ভূমিকা রাখছেন না অভিযোগ করে তাদের বিরুদ্ধে বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগ তোলেন এই জলবায়ুকর্মী। বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত রেবেকা শবনমও গ্রেটার মতো করেই অনেক পথ পাড়ি দিতে চান।
এখনও স্কুলজীবন শেষ হয়নি শবনমের। তিনি মনে করেন, সামনে হাঁটতে হবে আরও অনেক পথ। ভয়াবহ ঝুঁকিতে থাকা বাংলাদেশের নারী, শিশু ও রোহিঙ্গাদের জন্য বিশ্বের দরবারে কীভাবে সুবিচার প্রত্যাশা করা যায়, সেটাই তার চিন্তার মূল বিষয়। আল জাজিরাকে শবনম জানিয়েছেন, জলবায়ু আন্দোলনে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ কেউ যেন ভুলে না যান, তা নিশ্চিত করতে লড়াই চালিয়ে যাবেন তিনি।