ইরানে আকস্মিকভাবে ইসরায়েলি বিমান হামলার কারণ প্রথম থেকেই খুব স্পষ্ট- তেহরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে ব্যাঘাত ঘটিয়ে তাদের পরমাণু অস্ত্র তৈরির সম্ভাবনা আরও বিলম্বিত করা। তবে হামলার ব্যাপ্তি, তাদের বাছাইকৃত লক্ষ্যবস্তু এবং দেশটির রাজনীতিবিদদের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, চলমান অভিযানের দীর্ঘমেয়াদি উদ্দেশ্য হতে পারে ইরানের শাসকগোষ্ঠীকেই উৎখাত করা।
ইসরায়েল বলছে, শুক্রবারের (১৩ জুন) হামলা ছিল দীর্ঘমেয়াদি এক অভিযানের প্রথম ধাপ। বিশ্লেষকদের মতে, ইসরায়েল ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিকে বারবার আঘাত করে বিলম্বিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাবে—যদিও এককভাবে তারা পুরো কর্মসূচি ধ্বংস করতে পারবে না।
ইরান দাবি করছে, তাদের পারমাণবিক কর্মসূচি সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ উদ্দেশ্যে। তবে জাতিসংঘের পারমাণবিক পর্যবেক্ষক সংস্থার অভিযোগ, পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির শর্ত লঙ্ঘন করছে তেহরান।
শুক্রবার ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে হামলার চালানোর পাশাপাশি দেশটির সামরিক শীর্ষ কর্মকর্তাসহ গুরুত্বপূর্ণ পরমাণু বিজ্ঞানীদেরও হত্যা করেছে ইসরায়েল। হামলার কারণে দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচি যেমন পিছিয়ে গেল, তেমনি ইরানের ঘরোয়া ও আঞ্চলিক প্রভাবকে ক্ষুণ্ন করে শাসকগোষ্ঠীর ভিত নড়বড়ে করে দিতে পারে বলে ধারণা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
গবেষণা প্রতিষ্ঠান ওয়াশিংটন ইন্সটিটিউট ফর নিয়ার ইস্ট পলিসির বিশেষজ্ঞ মাইকেল সিং বলেছেন, ইসরায়েল যেভাবে অভিযান পরিচালনা করছে, তাতে ধারণা করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে যে, তারা শাসকগোষ্ঠীর পতন দেখতে চায়।
বেসামরিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ সীমিত রাখার প্রতি ইঙ্গিত করে বলেন, প্রাথমিকভাবে বেসামরিক হতাহত সীমাবদ্ধ রাখাটা বৃহত্তর কোনও লক্ষ্যের আভাস দেয়। ইসরায়েল সম্ভবত ইরানে গণজাগরণ দেখতে চাচ্ছে।
হামলার পর এক ভিডিও বার্তায় ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু সরাসরি ইরানি জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে ইসরায়েলি পদক্ষেপ লেবাননে নতুন সরকার প্রতিষ্ঠা করেছে এবং সিরিয়ায় আসাদ শাসনের পতন ঘটিয়েছে।
তিনি আরও বলেন, আমি বিশ্বাস করি, ইরানিদের মুক্তির দিন আর বেশি দূরে নয়। যখন তা ঘটবে, তখন আমাদের দুই প্রাচীন জাতির বন্ধুত্ব আবারও বিকশিত হবে।
এর আগেও ইরানে সরকার পরিবর্তনের আহ্বান জানিয়েছিলেন নেতানিয়াহু।
ওয়াশিংটনে অবস্থিত ইসরায়েলি রাষ্ট্রদূত রয়টার্সকে বলেছেন, গণতান্ত্রিক দেশ হিসেবে ইসরায়েল বিশ্বাস করে যে, কোনও দেশের জনগণ তাদের রাজনীতি ও সরকার নির্ধারণের অধিকারী। তাই, ইরানের ভবিষ্যৎ তাদের সাধারণ মানুষই নির্ধারণ করবে।
তবে এই পরিকল্পনা কতটা সফল হবে, সেটা বোঝা মুশকিল। আকস্মিক ইসরায়েলি হামলার ধাক্কা যদি আমরা একপাশে সরিয়েও রাখি, তারপরও দু দেশের মধ্যে দীর্ঘ কয়েক দশকের শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব কেবল শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, তা ইরানের সাধারণ শিয়া জনগণ এবং সাধারণ ইসরায়েলি ইহুদিদের মধ্যেও ছড়িয়ে গেছে। এরমধ্যে থেকে শাসকগোষ্ঠীকে উৎখাতের জন্য যথেষ্ট পরিমাণ জনমত গড়ে তুলতে হবে, যে শাসকগোষ্ঠীর পেছনে আবার রয়েছে অনুগত নিরাপত্তা বাহিনীর অকুণ্ঠ সমর্থন।
সার্বিক পরিস্থিতি যাচাই করে সিং বলেছেন, কীভাবে বা কী পদক্ষেপ নিলে ইরানে সরকারবিরোধীরা এক ছাতার নিচে আসবে, তা বলা সম্ভব নয়।
ইসরায়েলি হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সহায়তা না থাকলেও ট্রাম্প প্রশাসনের মৌন সম্মতি ছিল বলে ধারণা করা যাচ্ছে। কেননা, এই পরিস্থিতিতে তেল আবিবকে নিন্দা জানানোর বদলে তেহরানকে পারমাণবিক চুক্তি করার চাপ দিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প। ইরানি পাল্টা হামলা ঠেকাতেও ইসরায়েলকে সহায়তা করছে ওয়াশিংটন।
তবে তাদের পক্ষ থেকে ইরানে সরকার পরিবর্তনের পক্ষে কোনও সরাসরি বক্তব্য বা আভাস পাওয়া যায়নি। এ বিষয়ে আনুষ্ঠানিক বক্তব্যের জন্য হোয়াইট হাউজ ও নিউ ইয়র্কে ইরানের জাতিসংঘ মিশনে যোগাযোগ করেছিল রয়টার্স। তবে তাদের অনুরোধে কোনও পক্ষই সাড়া দেয়নি।
তথ্যসূত্র: রয়টার্স