ইরানের পারমাণবিক অবকাঠামো ও সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে শুক্রবার (১৩ জুন) হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। জবাবে ইসরায়েলের বিরুদ্ধেও হামলা শুরু করেছে তেহরান। চলমান সংঘাত বন্ধে বিভিন্ন পক্ষ আহ্বান জানাচ্ছে।
চলমান সংঘর্ষের ভয়াবহতা নির্ভর করবে প্রধানত দুটো বিষয়ের ওপর- ইরান কতটা শক্তি নিয়ে কীভাবে শোধ নেবে এবং ইসরায়েলের ওপর কতটুকু নিয়ন্ত্রণ মার্কিন প্রশাসন ধরে রাখবে। যদি কোনও কারণে পরিস্থিতি বেসামাল হয়ে ওঠে, সেক্ষেত্রে কয়েকটি সম্ভাব্য ঝুঁকি নিয়ে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির ভিত্তিতে এই প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়েছে।
সংঘর্ষ বেঁধে গেলে বসে থাকবে না যুক্তরাষ্ট্র
ইরানের দৃঢ় বিশ্বাস, মার্কিন মদদেই হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। ওদিকে, মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বলেছেন, তাদের কাছে হামলার বিষয়ে খবর ছিল। সে জন্যই বোধহয়, বিগত কয়েকদিন ধরে মধ্যপ্রাচ্য থেকে কর্মী সরিয়ে নিচ্ছিল যুক্তরাষ্ট্র।
চলমান সংঘাত নিয়ন্ত্রণ হারালে ইরাক, গালফসহ মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে মার্কিন ঘাঁটি ও কূটনৈতিক মিশনে হামলা চালিয়ে বসতে পারে তেহরান। তাদের মদদপুষ্ট আঞ্চলিক সশস্ত্র বা সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলো এ কাজে তাদের সহায়তাও করতে পারে।
ট্রাম্প যদিও বারবার বলে আসছেন, তিনি কোনও দীর্ঘমেয়াদি যুদ্ধে জড়াতে চান না, কিন্তু ইসরায়েল বা মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও কোনও মার্কিনি নাগরিক ইরানি হামলায় মারা গেলে, তিনি হয়ত সামরিক পদক্ষেপ নিতে বাধ্য হবেন।
আর মার্কিন বাহিনী যদি যুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তবে আমরা হয়ত ইরাক বা আফগানিস্তানের মতো আরেকটা বহুবছরব্যাপী সংঘর্ষ দেখব, যা পুরো একটি রাষ্ট্রকে পুরো ধ্বংস করে দিতে পারে।
ইরান ও উপসাগরীয় দেশগুলো মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে যেতে পারে
ইসরায়েলের দিক থেকে উপসাগরীয় দেশগুলো ওপর ইরানের ক্ষোভ ঘুরে যাওয়া অসম্ভব কিছু নয়, যদি তারা তেল আবিবের সামরিক সক্ষমতা হ্রাস করতে ব্যর্থ হয়ে উলটো কোণঠাসা হয়ে পড়ে। সেক্ষেত্রে, তেহরানের শত্রুদের সঙ্গে সখ্যতা থাকার অপরাধে তাদের শাস্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে পারে ইরানের ধর্মীয় শাসক গোষ্ঠী।
উল্লেখ্য, ওই দেশগুলোতে মার্কিন বিমানঘাঁটি যেমন রয়েছে তেমনি কয়েকটি দেশ গতবছর ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলা ঠেকাতে ইসরায়েলকে গোপনে সাহায্য করেছে বলেও শোনা যায়।
যদি ইরান ওই দেশগুলোতে হামলা চালিয়ে বসে, তবে নিরাপত্তার জন্য তারাই যুদ্ধবিমান নিয়ে মার্কিন বাহিনীকে আসার জন্য আহ্বান জানাবে। সেক্ষেত্রে আবারও গালফ ওয়ার বা উপসাগরীয় যুদ্ধের মতো ভয়াবহ একটা পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে।
২০১৯ সালে সৌদি আরবের তেলক্ষেত্রে হামলা চালানোর অভিযোগ এসেছিল ইরানের বিরুদ্ধে। এর তিন বছর পর সংযুক্ত আরব আমিরাতে তেহরানের মদদপুষ্ট হুথিরা হামলা চালায়। এরপর থেকে আঞ্চলিকভাবে আরও একঘরে হয়ে পড়েছে ইরান।
পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনে আরও বেপরোয়া হতে পারে ইরান
ইরানের কাছে ৬০ শতাংশ সমৃদ্ধকৃত চারশ কেজি ইউরেনিয়াম রয়েছে বলে খবর রয়েছে পশ্চিমা ও তার মিত্রদের কাছে। তাদের দাবি, ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি যে অবস্থানে ছিল, পারমাণবিক অস্ত্র অর্জন করা তাদের জন্য দিন কয়েকের মামলা।
গতকালের হামলার পর এক ইসরায়েলি এক কর্মী দাবি করেছেন, আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই অন্তত ১০টি পারমাণবিক বোমা তৈরি করে ফেলত ইরান।
যদি ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতার মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে পারে ইসরায়েল, তবে তাদের উদ্দেশ্য পূরণ হবে। কিন্তু যদি সেটা না হয় এবং ইরান যদি অস্তিত্ব রক্ষার জন্য একমাত্র উপায় হিসেবে পারমাণবিক বোমা বানানোই সমাধান মনে করে সর্বস্ব নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেক্ষেত্রে ইরানের পারমাণবিক শক্তি হয়ে ওঠার পেছনে অন্যতম প্রভাবক হবে ১৩ জুনের ইসরায়েলি হামলা।
সর্বাত্মক না হলেও দীর্ঘমেয়াদি সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়তে পারে ইরান-ইসরায়েল
ইসরায়েলি হামলার লক্ষ্য ছিল ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা গুড়িয়ে দেওয়া। কিন্তু, দেখা গেল, সক্ষমতা পুরো ধ্বংস করা যাচ্ছে না, অথচ পারমাণবিক অস্ত্র অর্জনের জন্য যথেষ্ট সক্ষমতা নেই তেহরানের-তখন কী হবে?
সেক্ষেত্রে, প্রায় নিয়মিতভাবে ইরানে হামলা চালিয়ে যেতে পারে ইসরায়েল, যেন তারা কখনই পারমাণবিক অবকাঠামো পুরোপুরি গড়ে তুলতে না পারে।
বৈশ্বিক অর্থনৈতিক দুর্গতি
ইতোমধ্যেই তেলের দাম বাড়ছে। যদি ইরান হরমুজ প্রণালি বন্ধের চেষ্টা করে কিংবা ইয়েমেনের হুথিরা আবারও লোহিত সাগরে বাণিজ্যিক জাহাজে হামলা বাড়িয়ে দেয়, তবে বৈশ্বিক সরবরাহে ভয়াবহ বিপর্যয় দেখা দেবে।
বিশ্ব অর্থনীতি এখনও কোভিড-পরবর্তী চাপ ও ট্রাম্পের শুল্ক যুদ্ধের ধকল সামলাচ্ছে। এর মধ্যে তেলের দাম বৃদ্ধি মানে আরও উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি ও জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধির ঝুঁকি।
উল্লেখ্য, তেলের দাম বাড়লে উপকৃত হবেন রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন।
ইরানে ইসলামিক শাসনের অবসান এবং রাজনৈতিক শূন্যতা
ইসরায়েল যদি কৌশলগতভাবে সফল হয় এবং ইরানের ইসলামি বিপ্লবী সরকারকে উৎখাতে বাধ্য করতে পারে, তবে সেই শূন্যতা ভরাট করতে গিয়ে দেখা দিতে পারে মারাত্মক বিশৃঙ্খলা।
ইসরায়েল যতই বলুক, ইরানের পারমাণবিক সক্ষমতা সীমিত করাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য, নেতানিয়াহুর ভাষণে তাদের দীর্ঘমেয়াদি আকাঙ্ক্ষার আভাস টের পাওয়া গেছে।
হামলার পর ধারণকৃত এক ভিডিও বার্তা প্রচার করে ইসরায়েল। প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইরানি জনগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে সেখানে বলেছেন, তাদের হামলার কারণে ইরানিদের পথ কণ্টকমুক্ত হচ্ছে, যেন তারা শোষকগোষ্ঠীকে উৎখাত করতে পারে।
ইরানের শাসন ব্যবস্থা নিয়ে বৈশ্বিক সমালোচনার পাশাপাশি দেশের মানুষের মধ্যেই অনেক পুঞ্জীভূত ক্ষোভ রয়েছে। বিশেষত, নারীদের ওপর তাদের চরম দমননীতি নিয়ে পুরো দেশটি বারুদের স্তূপ হয়ে রয়েছে। যে কোনও একটি আগুনের স্ফুলিঙ্গ পুরো দেশে জনরোষের বিস্ফোরণ ঘটাতে পারে।
তবে এক্ষেত্রে আমরা স্মরণ করতে পারি ইরাক ও লিবিয়ার কথা। সেখানকার শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযোগের অন্তঃ ছিল না এটি যেমন সত্য, তেমনি এটিও সত্য বাহিরের মদদে সৃষ্ট আন্দোলনে সরকার উৎখাতের ফলাফল দেশটিকে ভোগান্তির আরও দুর্বিপাকে ফেলে দিয়েছে।
এই কয়েকটি সম্ভাব্য দৃশ্যপটের একটি বাস্তবায়িত হবেই তা জোর দিয়ে অবশ্য বলা যাচ্ছে না। সম্পূর্ণ ভিন্ন কিছু যেমন ঘটতে পারে, আবার তেমন ভারত-পাকিস্তানের সাম্প্রতিক সংঘাতের মতো অনেক তর্জন গর্জনের পর একটু ঝিরঝিরে বৃষ্টির মতোই সব মিইয়ে যেতে পারে।
পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেবে, তা দেখার জন্য আমাদের শ্বাস আটকে অপেক্ষা করা ছাড়া গতি নেই।