X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

ইরানের সস্তা ড্রোন যেভাবে পাল্টে দিচ্ছে যুদ্ধের ধরন

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
০৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৮:১২আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১২:১৩

মধ্যপ্রাচ্যে বিভিন্ন মার্কিন ঘাঁটিতে ৭ অক্টোবর থেকে এ পর্যন্ত অন্তত ১৬৫টি হামলা হয়েছে। এত বিপুল সংখ্যক হামলার ঘটনা কোনও না কোনও ড্রোন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাকে ফাঁকি দিতে সক্ষম হবে, এমনটি প্রায় অনিবার্য ছিল। অবশেষে গত সপ্তাহে তা-ই ঘটেছে। বলা হচ্ছে, গত সপ্তাহেই প্রথমবারের মতো মধ্যপ্রাচ্যে শত্রুর ড্রোন হামলায় মার্কিন সেনা নিহত হয়েছে। সিরিয়ার জর্ডান সীমান্তে এক মার্কিন ঘাঁটিতে ওই ড্রোন হামলায় তিন সেনা নিহত ও অন্তত ৮০ জন আহত হন। খুব কম মানুষই জানতো যে টাওয়ার-২২ নামের ওই স্থাপনাগুলো আসলে একটি মার্কিন ঘাঁটি।

মার্কিন প্রতিরক্ষা দফতর পেন্টাগন জানিয়েছে, ইরাকের ইরানপন্থি জঙ্গি গোষ্ঠী কাতাইব হিজবুল্লাহ এই হামলার সঙ্গে জড়িত। তবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন সরাসরি এই হামলায় অস্ত্র সরবরাহের জন্য তেহরানকে দায়ী করেছেন। তিনি বলেছেন, ‘জঙ্গি গোষ্ঠীর কাছে অস্ত্র সরবরাহ করেছে তেহরান।’ মূলত এই ড্রোনগুলো দ্রুতগতির ও তুলনামূলক সস্তা– যা যুদ্ধের ধরন পাল্টে দিচ্ছে।

ইন্টারন্যাশনাল ইনস্টিটিউট ফর স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজের মধ্যপ্রাচ্যের অস্ত্র বিশেষজ্ঞ ফ্যাবিয়ান হিনজ বলেছেন, ‘১৯৯০-এর দশকে কাতাইব হিজবুল্লাহর মতো মিলিশিয়া গোষ্ঠীগুলো মার্কিন ঘাঁটি লক্ষ্য করে রকেট হামলা চালাতে পারতো। কিন্তু এখন তারা ছোট ছোট ড্রোন দিয়েও বড় ধরনের ক্ষতি করতে পারে। এমনকি এখন সবচেয়ে ছোট ড্রোনগুলোও দীর্ঘ দূরত্ব পাড়ি দিয়ে সুনির্দিষ্টভাবে আঘাত হানতে পারে। 

টাওয়ার-২২-এর একটি কোয়ার্টারে যে ড্রোনটি আঘাত হেনেছিল সেটির সঠিক মডেলটি জানা যায়নি। তবে মার্কিন কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এটি এক ধরনের শাহেদ ড্রোন হতে পারে। যদি তাদের অনুমান সঠিক হয়, তাহলে সম্ভবত এটি ছোট শাহেদ ১০১ বা ডেল্টা উইং শাহেদ ১৩১ হতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, এই দুই ধরনের ড্রোন কাতাইব হিজবুল্লাহর অস্ত্রাগারে মজুত রয়েছে।

হিনজ বলেছেন, এ ধরনের ড্রোনগুলোর আনুমানিক রেঞ্জ কমপক্ষে ৭০০ কিলোমিটার (৪৩৪ মাইল)। এগুলোর নির্মাণ খরচও কম–২০ হাজার ডলার বা তার চেয়ে একটু বেশি।

মার্কিন বিশেষজ্ঞদের মতে, ড্রোনটির ডিজাইনার এবং সম্ভাব্য নির্মাতা প্রতিষ্ঠান শাহেদ অ্যাভিয়েশন ইন্ডাস্ট্রিজ রিসার্চ সেন্টার। ইরানি এই সংস্থাটি দেশটির ইসলামিক বিপ্লবী গার্ড করপোরেশনসের আওতাধীন। ৫ বছর ধরে প্রতিষ্ঠানটি এসব ড্রোন তৈরির চেষ্টা করছে। ইরানের কূটনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষা, ধারাবাহিক সংঘাত ও অভিনব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের তাগাদা থেকে এই ড্রোন নির্মাণ করা হয়েছে।

১৯৮০-এর দশকে ইরান-ইরাক যুদ্ধের সময় অত্যাধুনিক পশ্চিমা প্রযুক্তি ইরানের কাছে ছিল না। তখন থেকেই অত্যাধুনিক ড্রোন বা অস্ত্র ক্রয় ও তৈরির চেষ্টা করছে ইরান। কিন্তু ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের দুটি তেলের স্থাপনায় একটি অভিনব ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র আঘাত হানে। এতে বিশ্বের তেল সরবরাহ সাময়িকভাবে কমে যায় ৫ শতাংশ। এই হামলাগুলো ইরানের অস্ত্র নির্মাণে উল্লম্ফনের ইঙ্গিত দেয়।

ওই সময় ইয়েমেনের সঙ্গে গৃহযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে সৌদি আরব। ইরানের মিত্র হুথি বিদ্রোহীদের বিরুদ্ধে লড়াই করে রিয়াদ। সৌদি আরবে বেশিরভাগ ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার দায় স্বীকার করেছিল হুথিরা। কিন্তু সৌদি আরব বলেছিল, ডেল্টা উইং ধরনের যেসব ড্রোন দিয়ে হামলাগুলো চালানো হয়েছে সেগুলো ইরানের। ওই ড্রোনগুলোকে পরবর্তীতে শাহেদ ১৩১ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

২০২১ সালে একই ধরনের ডেল্টা উইং ড্রোন দিয়ে ইসরায়েল মালিকানাধীন তেল ট্যাংকারে হামলা চালানো হয়। এতে এক ব্রিটিশ নাগরিকসহ দুজন নিহত হন। তৎকালীন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব ডমিনিক রাব বলেছিলেন, এই হামলার জন্য সম্ভবত ইরান দায়ী। ওই বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত নতুন ড্রোনের অস্তিত্ব ইরান আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকার করেনি, যদিও শাহেদ-১৩১-এর পাশাপাশি শাহেদ-১৩৬ রেঞ্জের ড্রোনও তৈরি করছে তেহরান। 

কয়েক মাস পর ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারিতে ইউক্রেন আক্রমণ করে রাশিয়া। কিয়েভ দখলের প্রাথমিক প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর মস্কো নতুন অস্ত্রের খোঁজ করে। ওই সময় রাশিয়ার কাছে অস্ত্র বিক্রি করতে ইচ্ছুক মাত্র দুটি দেশ ছিল- ইরান ও উত্তর কোরিয়া। ইরান রাশিয়াকে শাহেদ-১৩৬ ড্রোন সরবরাহে রাজি হয়। ২০২২ সালের শরতের যুদ্ধক্ষেত্রেই এই ড্রোনগুলো দেখা গিয়েছিল।

ইউক্রেনের এক কমান্ডার জানিয়েছেন, খারকিভে পাল্টা আক্রমণের সময় ওই ড্রোনগুলো ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। ১০০ কামানের গোলা যা করতে পারে, তার চেয়ে বেশি ক্ষতি পারে একটি শাহেদ-১৩৬ ড্রোন।

কয়েক সপ্তাহের মধ্যে, শাহেদ ড্রোনগুলো ইউক্রেনে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। এগুলো শুধু তাদের আগের আকৃতি থেকে আলাদাই নয়, বরং রেঞ্জও বেশি। ২০২৩ সালের ১৭ অক্টোবর কিয়েভে যে আক্রমণ চালানো হয়েছিল, সেটাও এই ড্রোন দিয়েই। ফলে দেখা যাচ্ছে, এই ড্রোনগুলোর জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে বাড়ছে।

রয়্যাল ইউনাইটেড সার্ভিসেস ইনস্টিটিউটের অ্যাভিয়েশন বিশ্লেষক জাস্টিন ব্রঙ্ক বলেছেন, শাহেদ ১৩৬ ড্রোনে রয়েছে হালকা কার্বন ফাইবার এয়ারফ্রেম এবং এগুলোর রেঞ্জ দেড় হাজার মাইলের মতো। ফলে এগুলো উত্তরে রাশিয়া থেকে বেলারুশ পর্যন্ত উড়তে পারে এবং দক্ষিণে রুশ দখলকৃত ইউক্রেনীয় শহর পর্যন্ত পৌঁছাতে পারে। এগুলো ২০-৪০ কেজি বিস্ফোরক বহন করতে সক্ষম। 

তিনি বলেছেন, গাইডেড ক্রুজ ক্ষেপণাস্ত্রের সেরা সস্তা বিকল্প বিবেচনা করা হয় এসব ড্রোনকে। সাধারণত এগুলোর ওড়ার পথ আগে থেকেই নির্ধারণ করা যায় এবং তা অনেক জটিল। এছাড়া প্রায় এসব ড্রোন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া ও চীনের অত্যাধুনিক নেভিগেশন ব্যবস্থা ব্যবহার করে। ফলে এগুলোকে যান্ত্রিকভাবে অচল (জ্যাম) করা কঠিন হয়।

ইউক্রেনে শাহেদ ড্রোন দিয়ে রাশিয়ার হামলা অব্যাহত রয়েছে। নভেম্বরে ৭৫টি ড্রোন দিয়ে কিয়েভে হামলা হয়, যা ছিল একদিনের হামলায় ড্রোন ব্যবহারের একটি রেকর্ড। যদিও বহুল ব্যবহার ও মন্থর গতির কারণে এগুলোকে ধ্বংস করা কিছুটা সহজ। ইউক্রেনীয় কর্মকর্তারা বলেছেন, ৭৫টির মধ্যে ৭১টিই তারা ভূপাতিত করতে পেরেছে। গত নভেম্বরে শাহেদ ২৩৮ ড্রোন উন্মোচন করেছে ইরান। এগুলোতে দ্রুতগতির জেট ইঞ্জিন ব্যবহার করা হয়েছে। এগুলো শাহেদ ১৩৬-এর তুলনায় তিনগুণ গতিতে উড়তে পারে। গত মাসে ইউক্রেনে এসব ড্রোন দেখা গেছে বলে ধারণা করা হয়।

তেহরানের জন্য দারুণ কাজে আসছে এই প্রযুক্তি। হুথি ঘরানার ইরাক ও সিরিয়ার আঞ্চলিক মিত্র গোষ্ঠীর কাছে এগুলো সহজে পাঠানো যায়। আলাদা আলাদা যন্ত্রাংশ বা পুরো ড্রোন পাঠাতে পারছে ইরান। রাশিয়া ইউক্রেনে এগুলো প্রকাশ্যে ব্যবহার করছে। যদিও এগুলো আড়ালে থেকেও ব্যবহার করা যায়। যেমনটি হয়েছিল সৌদি আরবের দুটি তেলের স্থাপনায় অথবা টাওয়ার ২২-এর সাম্প্রতিক হামলায়। জর্ডানে হামলার ক্ষেত্রে দায়ীদের চিহ্নিত করতে যুক্তরাষ্ট্রও কিছুটা সময় নিয়েছে।

ইউএস সেন্টার নেভাল অ্যানালাইসিসের ড্রোন বিশেষজ্ঞ স্যামুয়েল বেন্ডেট বলেছেন, ইরান যা তৈরি করেছে সেগুলোর সামর্থ্য খুব অত্যাধুনিক নয়, কিন্তু বাস্তবে যেকোনও সংখ্যক ড্রোন যেকোনও বাহিনী ক্রয় করতে পারবে। এই প্রযুক্তি আরও ছড়িয়ে পড়তে পারে। অত্যাধুনিক ব্যয়বহুল লড়াইয়ের সামর্থ্যে বিনিয়োগের বদলে একটি ড্রোন কেনা সহজ এবং আশা করা যায় এগুলো কিছুতে আঘাত হানবে বা ভূপাতিত করতে শত্রুর সামর্থ্য নষ্ট হবে।

দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে।

/এসএস/এএ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
হেলিকপ্টারের সিটে বসতে গিয়ে পড়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
প্রেসিডেনশিয়াল ডিবেটে মুখোমুখি হবেন বাইডেন-ট্রাম্প, যা জানা গেলো
পশ্চিম তীরে ইসরায়েলি অভিযানে গ্রেফতার ২০
সর্বশেষ খবর
বনানীতে যাত্রীবাহী বাসে আগুন
বনানীতে যাত্রীবাহী বাসে আগুন
কোটি টাকার আইসসহ গ্রেফতার সংগীতশিল্পী এনামুল রিমান্ডে
কোটি টাকার আইসসহ গ্রেফতার সংগীতশিল্পী এনামুল রিমান্ডে
‘বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে প্রণোদনা ৩ শতাংশ বিবেচনা করা হবে’
‘বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠালে প্রণোদনা ৩ শতাংশ বিবেচনা করা হবে’
হেলিকপ্টারের সিটে বসতে গিয়ে পড়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
হেলিকপ্টারের সিটে বসতে গিয়ে পড়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম