X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

বৈরুতের আকাশে ধোঁয়া সরে যেতেই শোক পরিণত হচ্ছে ক্ষোভে

বিদেশ ডেস্ক
০৬ আগস্ট ২০২০, ১৫:০৯আপডেট : ০৬ আগস্ট ২০২০, ১৫:১৭

লেবাননের রাজধানী বৈরুতের বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ধ্বংস্তূপ থেকে নিজেদের প্রয়োজনীয় মূল্যবান জিনিসপত্র ও নিখোঁজ স্বজনদের খোঁজ করছেন স্থানীয়রা। এরই মাঝে অনেকেই এই বিস্ফোরণকে লেবাননের রাজনৈতিক নেতাদের কয়েক বছরের অব্যবস্থাপনার ফল হিসেবে দেখছেন। মার্কিন সংবাদমাধ্যম নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে এমন পরিস্থিতির কথাই উঠে এসেছে।

বৈরুতের আকাশে ধোঁয়া সরে যেতেই শোক পরিণত হচ্ছে ক্ষোভে

২০১৩ সালে মালিকানাবিহীন উচ্চমাত্রার রাসায়নিক বিস্ফোরকের একটি চালান নিয়ে বৈরুত বন্দরে পৌঁছায় একটি জাহাজ। লেবানন কর্তৃপক্ষ জাহাজটি নিয়ে তেমনই পদক্ষেপ নেয় যেভাবে তারা দেশের বিদ্যুতের ঘাটতি, বিষাক্ত কলের পানি ও উপচেপড়া বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করছে। আর তা হলো, বিষয়টি নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পড়া এবং আশা করা সমস্যাটি নিজ থেকেই সমাধান হয়ে যাবে।  

কিন্তু মঙ্গলবার ২ হাজার ৭৫০ টন উচ্চ ঘনত্বের অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট আগুনে বিস্ফোরিত হয়েছে। কর্মকর্তারা বলছেন, এই বিস্ফোরণের ধাক্কা এতই শক্তিশালী ছিল যে রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ ভবন ও স্থাপনা ধূলোয় মিশে গেছে, নিহত হয়েছেন অন্তত ১৩৫ জন এবং আহতের সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার। এছাড়া ২ লাখের বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছেন।

সরকার বিস্ফোরণের ঘটনা তদন্তের অঙ্গীকারের কথা জানিয়েছে। বলেছে, জড়িতদের বিচারের মুখোমুখি করা হবে। কিন্তু স্থানীয় যুদ্ধকালীন বিপর্যস্ত অবস্থার মধ্যে বুধবার ভোরে জেগে উঠেছেন। তারা ভেবে কূল কিনারা পাচ্ছেন না তাদের বাড়ি ও ব্যবসার কী হবে। অনেকেই দেশের রাজনীতিকদের বহু বছরের অব্যবস্থাপনা ও অবহেলার ফল হিসেবে মনেই করছেন এই বিস্ফোরণকে।

বৈরুতের আকাশে ধোঁয়া সরে যেতেই শোক পরিণত হচ্ছে ক্ষোভে

নাদা চেমালি একজন ক্ষুব্ধ ব্যবসায়ী। লেবাননের মানুষদের তিনি আহ্বান জানিয়েছেন, রাজনীতিকদের মোকাবিলা করার জন্য। এরাই দেশকে ধ্বংসের পথে নিয়ে যাওয়ার জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী। তিনি বলেন, তাদের বাড়ি যাও।

বিস্ফোরণে তার দোকান ও বাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এবং তা মেরামতে সরকারের কোনও সহযোগিতার প্রত্যাশা করছেন না। চিমালি চিৎকার করে বলেন, নেতাদের কে আমাদের সহযোগিতা করবে? কে আমাদের এই ক্ষতিপূরণ দেবে?

বুধবার নিহতের সংখ্যা ঘোষণার পর বৈরুত ও আশেপাশে কিছুটা স্বস্তির আভাস দেখা গিয়েছে। শহরের গভর্নর জানিয়েছেন, বিস্ফোরণে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কয়েকশ কোটি ডলার হতে পারে।

সীমিত সামর্থ্যে উদ্ধারকর্মীরা কয়েক হাজার আহতকে চিকিৎসা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন। বেশ কয়েকটি হাসপাতাল সেবা দিতে পারছে না। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হামাদ হাসান বলেন, আহতদের হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়ার জন্য আমাদের সবকিছু করত হবে। আর সবকিছুরই মারাত্মক সংকট রয়েছে।

বৈরুতের আকাশে ধোঁয়া সরে যেতেই শোক পরিণত হচ্ছে ক্ষোভে

বিস্ফোরণের আঘাতে ভূমধ্যসাগরের তীর ও বন্দরের কাছের আবাসিক জেলাগুলো সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তবে বাদ যায়নি আরেকটু দূরবর্তী এলাকাও। বিস্ফোরণে শক ওয়েভে কয়েক মাইল দূরে পাহাড়ি এলাকার বিভিন্ন ভবনের জানালাও ভেঙে দিয়েছে।

নগরের প্রাণকেন্দ্রে শহরটির গুরুত্বপূর্ণ হোটেলগুলোর জানালার দেয়াল ভেঙে গেছে, জানালার পর্দা বাতাসে ভবনের বাইরে উড়ছে। লেবাননের গৃহযুদ্ধের পর পুনর্নির্মিত শহরের উপকণ্ঠ ছিল ধ্বংসস্তূপ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর গর্বের চিহ্ন। সেখানকার দামি বুটিকের দোকান, রেস্তোরাঁ ধসে পড়েছে, মিশে গেছে ধূলোয়।

খ্রিস্টান এলাকা গেম্মায়জেহ ঐতিহাসিক ভবন, গির্জা ও হৈচৈপুর্ণ রাত যাপনের জন্য পরিচিত। বিস্ফোরণে তা যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকাতে পরিণত হয়েছে। গাছ ভেঙে সড়ক বন্ধ হয়ে গেছে, ভাঙা কাঁচ নিয়ে গাড়ি উল্টে পড়ে আছে রাস্তার পাশে। শহরের সব প্রান্তেই দেখা গেছে মানুষ কাঁচ কুড়াচ্ছে, দোকান, বাসা ও বারান্দা থেকে ধূলো ও রক্ত পরিষ্কার করছে।

কিন্তু গভীর অর্থনৈতিক সংকটে থাকা দেশটির বাসিন্দাদের কোনও ধারণা নেই কীভাবে এসব পুনরায় সচল করবেন।

বৈরুতের আকাশে ধোঁয়া সরে যেতেই শোক পরিণত হচ্ছে ক্ষোভে

৪২ বছরের রজার মাটার জানান, তার অ্যাপার্টমেন্টের দরজা ও জানালা উড়ে গেছে, জানালার ফ্রেম বিছানায় গড়াগড়ি খাচ্ছে এবং মেঝে ও সোফাতে ছড়িয়ে আছে ভাঙা কাঁচের টুকরো। তিনি একটি বিকট শব্দ শুনতে পান এবং তার কথায়, এরপর সবকিছুই কেঁপে উঠে এবং সব দরজা-জানালা নাই হয়ে যায়।

অর্থনৈতিক সংকটের কারণে ব্যাংকগুলোর নগদ উত্তোলনে কঠোর সীমাবদ্ধতা জারি করা হয়েছে। যাতে করে নগদ সংকট না হয়। মাতার বলেন, ব্যাংকে আমাদের টাকা জমা আছে। শ্রমিকদের মজুরি দিতে চাইলে নগদ লাগবে। এমন সময়ে সরকারের সহযোগিতা করা উচিত। কিন্তু তারা দেউলিয়া। এই দেশ ভেঙে পড়েছে।

১৯৯০ সালে গৃহযুদ্ধের অবসানের পর মধ্যপ্রাচ্যের সাংস্কৃতিক ও আর্থিক কেন্দ্র হিসেবে দেশকে গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করে লেবানন। লক্ষ্য ছিল দক্ষ ব্যাংকার, বহুমাত্রিক পেশা ও ভোর পর্যন্ত চলবে ড্যান্স ক্লাব নিয়ে মধ্যপ্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড হয়ে ওঠা। কিন্তু সাবেক সেনাপতিরা দুর্বল গোষ্ঠীগত গণতন্ত্রে ক্ষমতার ক্রীড়নকে পরিনত হয়। যারা ক্ষমতা ভাগাভাগি করে দেয় দেশের ১৮টি ধর্মীয় গোষ্ঠীর কাছে।

এই ব্যবস্থার ফলে বড় ধরনের রাজনৈতিক অচলাবস্থা ও সর্বব্যাপী দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। আর সরকার ঋণে জর্জরিত হয়ে পড়ে। বার্ষিক জিডিপির প্রায় ১৬০ শতাংশ ঋণের বোঝা রয়েছে দেশটির।

বৈরুতের আকাশে ধোঁয়া সরে যেতেই শোক পরিণত হচ্ছে ক্ষোভে

গত কয়েক বছর ধরে জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বেড়ে চলেছে। রাজনৈতিক অভিজাত শ্রেণিকে উৎখাতে গত বছর রাজপথে নামেন দেশটির জনগণ। বিক্ষোভের ফলে ক্ষমতা ছাড়েন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু সংকট ক্রমশই বাড়ছিল। এরপর থেকে দেশটির মুদ্রার মান কমেছে ৮০ শতাংশ। বেকারত্ব বেড়েছে এবং দ্রব্যমূল্য বেড়েছে আকাশছোঁয়া। করোনাভাইরাস মহামারি ঠেকাতে জারি করা লকডাউন অর্থনীতির মড়ার উপর খাড়ার ঘা হয়ে এসেছে।

খুব লেবানিজ বিশ্বাস রাখেন যে সরকার তাদের সহযোগিতা করবে এবং রাজধানী বিপর্যস্ত করে ফেলা বিস্ফোরণের ঘটনা পুরোপুরি তদন্ত করা হবে।

নগরের বন্দরের কীভাবে এত বিপুল পরিমাণ সম্ভাব্য বিস্ফোরক অরক্ষিত অবস্থায় মজুদ ছিল সেই বিষয় নতুন তথ্য সামনে আসার পর আশেপাশের এলাকার মানুষেরা সরকারের কর্মহীনতাকে দায়ী করছেন। দীর্ঘদিন ধরেই তারা এমন অভিযোগ করে আসছেন।

রাসায়নিকবহনকারী জাহাজটি মোজাব্বিক যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বৈরুতে আটক করা হয়। লেবাননের একটি আদালত জাহাজের কার্গোগুলো বাজেয়াপ্ত করে। ফলে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট বন্দরের একটি হ্যাংগারে স্থানান্তর করা হয়। পরবর্তী ছয় বছর বন্দর কর্তৃপক্ষ বারবার এগুলো সরানোর উপায় বের করার জন্য বিচারকদের দ্বারস্থ হয়েছেন। কিন্তু কোনও কাজ হয়নি।

বৈরুতের আকাশে ধোঁয়া সরে যেতেই শোক পরিণত হচ্ছে ক্ষোভে

বন্দরের পরিচালক হাসান কোরায়টেম জানিয়েছেন, কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছিল এগুলো নিলামে বিক্রি হবে। কিন্তু সেই নিলাম কখনও হয়নি এবং বিচারব্যবস্থা বন্দর কর্তৃপক্ষের চিঠি অগ্রাহ্য করেছে। তিনি দাবি করেছেন, রাসায়নিকের ক্ষমতা সম্পর্কে তিনি জানতেন না ফলে সেগুলোর সুরক্ষার জন্য বন্দরের পক্ষ থেকে বিশেষ কোনও সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এখন আমরা জাতীয় দুর্যোগে বাস করছি। কোনও বন্দর অবশিষ্ট নেই।

এই জাহাজেই বন্দরে আসে অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট

বন্দর এলাকার কাছাকাছি থাকা কয়েকটি হাসপাতালে বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। দুটি হাসপাতালের অবস্থা এতই খারাপ যে সেগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে, কবে পুনরায় চালু হবে সেটির কোনও ইঙ্গিতও পাওয়া যাচ্ছে না। বৈরুতের বাসিন্দাদের মতো হাসপাতালগুলোও সরকারের কাছ থেকে কোনও সহযোগিতা পাবে বলে মনে করে না।

একটি হাসপাতালের প্রকৌশলী টনি টৌফিক বলেন, আমরা কোনও সহযোগিতা প্রত্যাশা করছি না। কারণ কোনও রাষ্ট্র অবশিষ্ট নেই।

শতাব্দী পূরনো সেন্ট জর্জ হসপিটাল ইউনিভার্সিটি মেডিক্যাল সেন্টারও বন্ধ হয়েছে বিস্ফোরণে। হাসপাতালের চার নার্স ও অন্তত ১৩ রোগী নিহত হয়েছে। বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হওয়ায় হাসপাতাল থেকে সবাইকে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। যদিও চিকিৎসা পাওয়ার আশায় বিস্ফোরণে আহতরা হাসপাতালে ভিড় করছে।

 

হাসপাতালটির রেডিওলজি বিভাগের প্রধান ড. রাজা আশু বলেন, ১১ সেপ্টেম্বরের মতোই ভয়াবহ। আমাদের জন্য তা সেরকমই।

বৈরুতের আকাশে ধোঁয়া সরে যেতেই শোক পরিণত হচ্ছে ক্ষোভে

অনেকের কাছে ক্ষোভের বড় কারণ হলো দেশের সর্বশেষ এই বিপর্যয় কোনও ঐতিহাসিক বিরোধের জের ধরে হয়নি। একটি নিজেদের ডেকে আনা।

ড. ডমিনিক ডাউ বলেন, আমাদের নেতাদের মূর্খ অবহেলা না হয়ে ইসরায়েলি বিস্ফোরণ হলেই ভালো হতো। নিজেদের দ্বারা আহত হওয়ার চেয়ে তা অনেক বেশি সহজে মেনে নেওয়া যেত।

নিজের কশি শপের সামনে দাঁড়িয়ে ইমান হাশেম জানান, তিনি বিমা নবায়ন করেননি। কারণ ব্যাংক তাকে টাকা স্থানান্তর করতে দেয়নি। অর্থনীতি সংকটে থাকায় ব্যবসাও খুব ভালো যাচ্ছিল না। এখন বিস্ফোরণের আঘাত। তিনি বলেন, দেখতেই পাচ্ছেন আমার দোকান ভেঙে পড়ছে। এখন কিছুই নাই। ব্যাংকে থাকা টাকাও চুরি হয়ে গেছে। এখন আমি কোথা থেকে পুনর্গঠন শুরু করব? 

/এএ/
সম্পর্কিত
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
সর্বশেষ খবর
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
নুসিরাত শরণার্থী শিবিরে ইসরায়েলি হামলা, শিশুসহ নিহত ৮
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
লাল কৃষ্ণচূড়া, বেগুনি জারুলে ছুঁয়ে যায় তপ্ত হৃদয়
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৭ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বাধিক পঠিত
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
কুষ্টিয়ায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!