X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

ইরানি বিজ্ঞানীকে হত্যার নেপথ্যে!

বিদেশ ডেস্ক
২৯ নভেম্বর ২০২০, ২৩:৫৯আপডেট : ৩০ নভেম্বর ২০২০, ০০:০৪

দেশের শীর্ষ পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ-এর মৃত্যুর আগ পর্যন্ত ইরানের অধিকাংশ মানুষেরই তার সম্পর্কে কোনও ধারণা ছিল না। কিন্তু দেশটির পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর যারা নজর রাখেন তারা তাকে ভালোই চেনেন। ইসরায়েল এবং পশ্চিমা গোয়েন্দাদের মতে, তিনিই ছিলেন ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির প্রধান স্তম্ভ। ইরানি বিজ্ঞানীকে হত্যার নেপথ্যে!

ইরানের সংবাদমাধ্যম অবশ্য ফাখরিজাদেহ-এর গুরুত্বকে খাটো কারে দেখাচ্ছে। তারা তাকে বর্ণনা করছে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে যিনি সাম্প্রতিক কয়েক সপ্তাহ ধরে করোনাভাইরাস শনাক্ত করতে একটি টেস্ট কিট বানানোর গবেষণায় যুক্ত ছিলেন।

লন্ডনে গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের মার্ক ফিটজপ্র্যাট্রিক, যিনি ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির ওপর গভীর নজর রাখেন, মোহসেন ফাখরিজাদেহ হত্যাকাণ্ডের পর তিনি একটি টুইট করেছেন। ওই টুইটে বলা হয়েছে, ‘ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচি এখন এমন অবস্থায় চলে গেছে যেখানে তা আর একজন মাত্র ব্যক্তির ওপর নির্ভরশীল নয়।’

ফাখরিজাদেহ-এর ওপর যখন হামলা হয়, তখন তার সঙ্গে বেশ কয়েকজন দেহরক্ষী ছিল। সুতরাং বোঝা যায় যে, তার নিরাপত্তাকে ইরান কতটা গুরুত্ব দিতো। ফলে তাকে হত্যার পেছনে ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচির সম্পর্ক যতটা না ছিল, রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল তার চেয়ে বেশি।

হত্যার সম্ভাব্য মোটিভ

এই হত্যাকাণ্ডের পেছনে সম্ভাব্য দুটো মোটিভ বা উদ্দেশ্য কাজ করেছে বলে এখন পর্যন্ত মনে হচ্ছে। প্রথমত, যুক্তরাষ্ট্রের জো বাইডেন সরকারের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক ভালো হওয়ার যে কোনও সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ফেলা। দ্বিতীয়ত তেহরানকে বদলা নিতে উস্কানি দেওয়া।

মোহসেন ফখরিযাদের হত্যাকাণ্ডের পর তার প্রথম বক্তব্যে ইরানের প্রেসিডেন্ট হাসান রুহানি মন্তব্য করেন, ‘শত্রুরা গত কয়েক সপ্তাহ ধরে দুশ্চিন্তার মধ্যে রয়েছে। তারা বুঝতে পারছে, বিশ্বের পরিস্থিতি বদলে যাচ্ছে। হাতের বাকি সময়টায় তারা এই অঞ্চলে একটি অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা তারা চালিয়ে যাচ্ছে।’

সন্দেহ নেই যে শত্রু বলতে রুহানি যুক্তরাষ্ট্রের ট্রাম্প সরকার, ইসরায়েল ও সৌদি আরবকে বুঝিয়েছেন।

মধ্যপ্রাচ্যের রাজনীতিতে পরিবর্তনের যে জোয়ার শুরু হয়েছে তা নিয়ে ইসরায়েল ও সৌদি আরব উদ্বিগ্ন। জো বাইডেন ক্ষমতা নেওয়ার পর তার সম্ভাব্য প্রভাব নিয়ে এই দুই দেশ চিন্তিত।

নির্বাচনি প্রচারণার সময় বাইডেন পরিষ্কার করে দিয়েছেন যে, তিনি ইরানের সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তিতে ফিরে যেতে চান। ২০১৫ সালে বারাক ওবামা সরকার এই চুক্তির প্রধান উদ্যোক্তা ছিল। কিন্তু ডোনাল্ড ট্রাম্প ২০১৮ সালে একতরফাভাবে চুক্তি থেকে আমেরিকাকে প্রত্যাহার করে নেন।

ইসরায়েলি এবং পশ্চিমা অনেক মিডিয়ায় গত রবিবার সৌদি আরবের নিওম শহরে সৌদি যুবরাজ মোহাম্মদ বিন সালমান এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর মধ্যে গোপন বৈঠকের খবর প্রচারিত হয়। এতে বলা হয় ইরান নিয়ে তাদের দুই দেশের উদ্বেগ নিয়ে ওই বৈঠকে আলোচনা হয়েছে।

বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হয়েছে, নিওমে ওই বৈঠকে ইসরায়েলের সঙ্গে এখনই কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনে নেতানিয়াহু সৌদি যুবরাজকে রাজি করাতে পারেননি। অবশ্য সৌদি পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমন কোনও বৈঠক হওয়ার কথা অস্বীকার করেছেন।

ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী এবং সৌদি যুবরাজের বৈঠকের পরদিনই সোমবার ইয়েমেনের ইরান সমর্থিত হুথি বিদ্রোহীরা জেদ্দায় একটি তেল স্থাপনায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায়। এটিকে সৌদি আরব হয়তো বদলা নেওয়ার একটি সুযোগ হিসেবে দেখছে।

ওই ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইরানের কট্টরপন্থী মিডিয়ায় ঢাক-ঢোল বাজিয়ে প্রচার করা হয়, হুথিরা কুদস-২ (ইরানে তৈরি) দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে।

ইরানের সরকার সমর্থক সংবাদ সংস্থা মেহের-এর প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘এই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা একটি কৌশলগত পদক্ষেপ। সৌদি-ইসরায়েল বৈঠকের পর ওই দুই দেশকে একটি সতর্ক বার্তা দেওয়া হলো যে, ইরানের বিরুদ্ধে কিছু করার আগে তারা যেন ১০ বার ভাবে।’ ওই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা নিয়ে সৌদি ক্ষোভের প্রতি সমর্থন জানিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন।

ইরানে হামলার পরিকল্পনা ট্রাম্পের

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জন বোল্টন তার ‘দি রুম হোয়ার ইট হ্যাপেনড’ বইতে লিখেছেন কিভাবে ট্রাম্প প্রশাসন ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীদের প্রতি ইরানের সমর্থনকে মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থ ক্ষুণ্ণ করার একটি প্রয়াস হিসাবে দেখে।

নিওমে সৌদি যুবরাজ ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার বৈঠকের আয়োজন করেন ট্রাম্পের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মাইক পম্পেও। ওই বৈঠকের আগে তিনি কাতার এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতে গিয়ে প্রধানত ইরান নিয়ে কথা বলে আসেন।

মার্কিন মিডিয়ায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, তার দুই সপ্তাহ আগে ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় হামলার উপায় নিয়ে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প তার উপদেষ্টাদের সঙ্গে পরামর্শ করেছিলেন। ট্রাম্প সম্ভবত তার বিদায়ের আগে ইরানকে এক হাত দেখে নেওয়ার চিন্তা করছিলেন।

জানুয়ারিতে ইরানি সামরিক কমান্ডার কাসেম সোলায়মানিকে ড্রোন হামলায় হত্যার পর তা নিয়ে খোলাখুলি বাগাড়ম্বরে মেতেছিলেন ট্রাম্প। যদিও ওই হত্যাকাণ্ডকে জাতিসংঘের একজন কর্মকর্তা ‘বেআইনি’ বলে বর্ণনা করেন, তবে ট্রাম্প প্রকাশ্যেই ঘোষণা দেন তার নির্দেশেই কাসেম সোলায়মানিকে হত্যা করা হয়েছে।

এখনকার বাস্তবতায় পরমাণু বিজ্ঞানী মোহসেন ফাখরিজাদেহ-এর হত্যকাণ্ডে ট্রাম্পের অনুমোদনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে ইরানের প্রেসিডেন্ট এই হত্যাকাণ্ডের জন্য সরাসরি ইসরায়েলকে দায়ী করেছেন।

২০১৮ সালে এক লাইভ টিভি অনুষ্ঠানে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু ইরানের পারমাণবিক কর্মসূচিতে ফাখরিজাদেহ-এর ভূমিকা উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘মোহসেন ফাখরিজাদেহ নামটি মনে রাখুন।’

ইসরায়েল জানে জো বাইডেন তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকবেন। কিন্তু তাদের মনে একটি উদ্বেগ কাজ করছে যে, বাইডেনের মনোনীত পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ইরানের সঙ্গে করা পারমাণবিক চুক্তির একজন ঘোরতর সমর্থক।

ইসরায়েল হয়তো এ নিয়েও শঙ্কিত যে, ব্লিঙ্কেনের দৃষ্টিভঙ্গি ফিলিস্তিনিদের কিছুটা সুবিধা দেবে। ট্রাম্প প্রশাসন জেরুজালেমকে ইসরায়েলের বৈধ রাজধানী হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়াকে পছন্দ করেননি নতুন এই সম্ভাব্য মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। যদিও জো বাইডেন বলেছেন, তিনি জেরুজালেম নিয়ে ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত বদলাবেন না।

ইরানের দ্বিধা

মোহসেন ফাখরিজাদেহ হত্যকাণ্ডের জন্য দায়ীদের নিশ্চিত শাস্তির কথা বলেছেন ইরানের শীর্ষ নেতা আয়াতুল্লাহ আলি খামেনি। তবে দেশটির ভেতরেই নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা দুর্বলতা নিয়ে কথা উঠেছে। ইরানের রেভল্যুশনারী গার্ড বাহিনীর প্রভাবশালী একজন কমান্ডার মোহসিন রেজায়েই বলেন, ‘ভেতরে ঢুকে পড়া গুপ্তচর যারা বিদেশি গোয়েন্দা সংস্থাগুলোকে খবর দিচ্ছে তাদের খুঁজে বের করতে হবে।’

ইরানে সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেকেই প্রশ্ন তুলছেন যে, সরকার যখন তাদের সেনা ও গোয়েন্দা দক্ষতা নিয়ে এতোটা বড়াই করে, তখন কীভাবে নিরাপত্তার আবরণে থাকা একজন বিজ্ঞানী এভাবে দিনে দুপুরে হত্যাকাণ্ডের শিকার হলেন। এই হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে দেশের ভেতর নির্বিচারে ধরপাকড়েরও আশঙ্কা প্রকাশ করা হচ্ছে।

ট্রাম্পের প্রস্থানে ইসরায়েল এবং সৌদি আরব যেখানে তাদের প্রধান একজন মিত্র হারাচ্ছে সে সময় ইরান আশা করছে, জো বাইডেন তাদের ওপর থেকে অনেক নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করবেন যা তাদের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে সাহায্য করবে। ফলে তারা মোহসেন ফাখরিজাদেহ-এর হত্যাকাণ্ডের বদলা নিতে এখনই কিছু করতে চাইছে না। সূত্র: বিবিসি বাংলা।

/এমপি/
সম্পর্কিত
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
চীনে আমেরিকার কোম্পানিগুলোর প্রতি ন্যায্য আচরণের আহ্বান ব্লিঙ্কেনের
মিয়াবতী থেকে পিছু হটলো মিয়ানমারের বিদ্রোহীরা?
সর্বশেষ খবর
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
উপজেলা নির্বাচন: অংশ নিতে পারবেন না পৌর এলাকার ভোটার এবং প্রার্থীরা
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
ভারতে লোকসভা নির্বাচনের দ্বিতীয় ধাপের ভোট শুরু
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ