বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে সবচেয়ে বেশি বাংলার চর্চা হয় ইংরেজি ভাষার দেশ ব্রিটেনে। দেশটির বিভিন্ন স্থানে শুধু সাইনবোর্ড বা প্রতিষ্ঠানের নামকরণই নয়, রেলস্টেশন, হাসপাতাল, পার্ক, মসজিদ থেকে সব জায়গাতেই বাংলা ভাষার ব্যবহার চোখে পড়ে। ব্রিটেনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে বিভিন্ন মেয়াদের কোর্স চালু রয়েছে। হাসপাতাল ও অফিসসহ বিভিন্ন স্থানের বিজ্ঞপ্তি ও ঘোষণা দেওয়া হয় বাংলা ভাষায়। তবে নতুন প্রজন্মের ব্রিটিশ-বাংলাদেশিদের মধ্যে বাংলা ভাষার চর্চা সীমিত হয়ে গেছে। এই পরিস্থিতিতে যুক্তরাজ্যে বাংলা ভাষার জয়জয়কার অবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে শঙ্কা জানিয়েছেন অনেকে।
জানা গেছে, বাংলাদেশিরা বর্তমানে যুক্তরাজ্যের চতুর্থ বৃহত্তম জাতিগত সংখ্যালঘু সম্প্রদায় (এথনিক মাইনোরিটি কমিউনিটি)। ব্রিটিশ পরিসংখ্যান বিভাগসহ কয়েকটি সমীক্ষার তথ্য অনুযায়ী, ব্রিটেনে প্রায় তিন লাখ মানুষ বাংলা ভাষায় কথা বলেন। আশির দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে টাওয়ার হ্যামলেটসে ৩০টি বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু অর্থ সংকটের কারণে ২০২১ সালে সব স্কুল বন্ধ হয়ে যায়। এসব স্কুলে ভাষা আন্দোলন, মহান মুক্তিযুদ্ধ, বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস সম্পর্কে পাঠদান করা হতো। ২০১৪ সালের ৭ এপ্রিল পর্যন্ত ব্রিটেনে বাংলা ভাষায় ড্রাইভিং টেস্টের থিওরি পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ ছিল। পরে বিদেশি সব ভাষায় পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ বাতিল করা হয়েছে। ২০১৭ সালের জুনে ব্রিটেনের স্কুলগুলোতে স্বকীয় ভাষা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয় সিলেটি ভাষা। গত ছয় বছরে অনেক বাংলা টিভি চ্যানেল ও বাংলা সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে গেছে। এছাড়া টাওয়ার হ্যামলেটসের বাইরে বিভিন্ন শহরে বিভিন্ন সময়ে খণ্ডকালীন বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা হলেও সেগুলো স্থায়িত্ব পায়নি।
টাওয়ার হ্যামলেটস কাউন্সিলে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত মেয়র নির্বাচিত হলেও বাংলা স্কুলগুলো এখনও চালু হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন টাওয়ার হ্যামলেটসের সাবেক ডেপুটি মেয়র ও কাউন্সিলর অহিদ আহমদ।
লন্ডনের ক্রয়োডন কাউন্সিলের কাউন্সিলর মোহাম্মদ ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ব্রিটেনের লাইব্রেরিগুলোতে বাংলা বই রয়েছে। অন্তত ৯ ধরনের ফর্মে বা চিঠিতে জাতীয়তার কলামে বাংলা চালু হয় আশির দশকে।
ভাষাসৈনিক তাসাদ্দুক আহমেদের এক সময়ের ঘনিষ্ঠ সহচর, লন্ডন সেন্টমেরি সেন্টারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও সাবেক চেয়ারম্যান মো. লোকমান উদ্দীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ব্রিটেনের আইনে সমান অধিকারের বলে ইংরেজির পাশাপাশি বাংলা ভাষা চালুর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তারপর থেকে টাওয়ার হ্যামলেটস, ক্যামডেন, বার্মিংহাম, কার্ডিফের বিভিন্ন ভবন, রাস্তার নামকরণ বাংলায় করা হয়েছে। তাছাড়া বহু রাস্তা ও প্রতিষ্ঠানের নাম বাঙালির নামে নামকরণ করা হয়েছে।
এমনকি হাসপাতালগুলোতে অন্যান্য ভাষার পাশাপাশি বাংলা ও সিলেটের আঞ্চলিক ভাষা চালু রয়েছে। টাওয়ার হ্যামলেটসের স্পিটারফিল্ড হাউজিং অ্যাসোসিয়েশনের বহু ভবনের নামকরণ করা হয়েছে বাংলায়। লন্ডনে কবি নজরুল প্রাইমারি স্কুল, ওসমানী স্কুল ব্রিটেনে বাংলা ভাষার ঐতিহ্য বহন করছে।
লোকমান উদ্দীন আরও বলেন, বাংলা ভাষাকে ‘ও লেভেল’ এবং ‘এ লেভেলে’ অন্তর্ভুক্ত করার জন্য আন্দোলন করে আসছি। লন্ডনে আলতাব আলী পার্কের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার বাংলা ভাষা ও বাঙালির শত বছরের ঐতিহ্য বহন করছে। এখানে ১৯৮৫ সালের আগ থেকে অস্থায়ী শহীদ মিনার বানিয়ে ২১শে ফেব্রুয়ারি পালন করা হতো।
ব্রিটেনে বাংলা ভাষার ইতিহাস ও ঐতিহ্য তুলে ধরে কবি ও লেখক আবু মকসুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ব্রিটেনে বাংলা চর্চার ইতিহাস একশ বছরের। একশ বছর আগে এখান থেকে সংবাদপত্র প্রকাশ হয়েছে। প্রথম সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের বয়সও সত্তর পেরিয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে পত্রিকা, টিভি চ্যানেল, সাহিত্য, সাংস্কৃতিক সংগঠন বাংলা চর্চা ও প্রচারে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে।
প্রবাসে বাংলা সাহিত্য চর্চা নিয়ে তিনি বলেন, প্রতিবছর মেলা উপলক্ষে প্রবাসী লেখকদের অনেক বই প্রকাশিত হয়। কবিতা ছাড়াও কথাসাহিত্য, অনুবাদ, নাটক, গবেষণাধর্মী বই প্রকাশে বাংলাদেশি লেখকরা পিছিয়ে নেই।
কমিউনিটি ব্যক্তিত্ব ও ব্রিটেনের স্বনামধন্য সংগীত শিল্পী মাহবুবুর রহমান শিবলু বলেন, কেবল লন্ডনের আলতাব আলী পার্কেই নয়, ওল্ডহামসহ কয়েকটি এলাকায় স্থায়ী শহীদ মিনার প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। মাতৃভাষাকে গুরুত্ব দেওয়ায় বাংলা ভাষা গুরুত্ব পাচ্ছে ব্রিটেনে। তবে বাংলাদেশ হাইকমিশনের তেমন কোনও দীর্ঘমেয়াদি উদ্যোগ নেই।
সাংবাদিক ও লেখক জুবায়ের বাবু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বাইরে ব্রিটেনে সবচেয়ে বেশি বাংলার চর্চা হয়। ব্রিটেনে দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রজন্মের মধ্যে দিন দিন বাংলা ভাষার চর্চা কমছে। অনেকে বাংলা লিখতে ও পড়তে জানেন না। তাই বিলেতে বাংলা ভাষার চর্চা সমানতালে থাকবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ আছে।