X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৪ বৈশাখ ১৪৩১

হাসপাতালে করোনা সংক্রমণের ভয়, ঘরে ঘরে বাড়ছে রোগী

জাকিয়া আহমেদ
১৪ জুলাই ২০২০, ১৬:৪২আপডেট : ১৪ জুলাই ২০২০, ১৭:০৩

করোনা টেস্টের জন্য উপচেপড়া ভিড় কিডনির সমস্যায় ভোগা নূর-এ জান্নাতকে সপ্তাহে একবার ডায়ালাইসিস করতে হয়। করোনার প্রকোপ শুরুর পর থেকে হাসপাতালে যাওয়া হচ্ছিল না তার। একটা সময় সমস্যা প্রকট আকার ধারণ করলে হাসপাতালে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। কিন্তু রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে গিয়েও তাকে পড়তে হয় আরেক সমস্যায়। করোনা পরীক্ষা ছাড়া কোনোভাবেই তাকে ডায়ালাইসিস করতে দেওয়া হবে না বলে হাসপাতাল থেকে জানানো হয়। নমুনা পরীক্ষার ঝক্কির কারণে পুরো এক সপ্তাহ তাকে অপেক্ষা করতে হয়েছে। পরে করোনা পরীক্ষা করেই ডায়ালাইসিস করতে পেরেছেন জান্নাত।
ক্যানসারে আক্রান্ত আরেক রোগী হোসনে আরা বেগম হাতের ব্যথায় ভুগছেন। চিকিৎসক ছেলের পরামর্শ মতো ওষুধ খেলেও তাতে কমছিল না। অবশেষে এক্সরে করার কথা বলেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। কিন্তু চিকিৎসক ছেলে কোনোমতেই হাসপাতাল বা অন্য কোনও ডায়াগনস্টিক সেন্টারে মাকে নিয়ে যেতে রাজি নন সংক্রমণের ভয়ে। হোসনে আরা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বয়স হয়েছে, ক্যানসার আছে, কিন্তু এক্সরে করাতে পারছি না। হাসপাতালগুলোতে করোনার সংক্রমণের ভয়ে দিনরাত এক করে হাতের তীব্র ব্যথা নিয়ে ঘরে বসে আছি।’
সংক্রমণের ভয়ে লিভারে সমস্যা, কিডনি সমস্যা, ক্যানসার, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও অন্যান্য রোগে আক্রান্তরা সময়মতো চিকিৎসা নিতে পারছেন না হাসপাতালে গিয়ে। সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রতিদিনের একটু একটু হঠাৎ অসুস্থতা। সাধারণত বয়সে তরুণ, অন্যান্য রোগে আক্রান্ত না হলে, শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ভালো হলে করোনাকে মোকাবিলা করা সম্ভব বলে মন্তব্য করেছেন চিকিৎসকরা। তবে তারা বলছেন, বয়স্ক, অন্যান্য রোগে আক্রান্তদের জন্য করোনার ঝুঁকিটা অনেক গুণ বেশি।
চিকিৎসকরা বলছেন, করোনা প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই হাসপাতালগুলোতে নিয়মিত রোগী সংখ্যা অর্ধেকেরও কমে নেমে এসেছে। খুব জরুরি প্রয়োজন না হলে রোগীরা হাসপাতালে আসছেন না। করোনার পরীক্ষা, হাসপাতালে সংক্রমণের ভয়, যাতায়াতে পরিবহন সমস্যাসহ নানা কারণ ছিল। তবে বিভিন্ন হাসপাতালের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, গত মার্চের পর সাধারণ রোগী কমে গিয়েছিল। এখন ধীরে ধীরে রোগী বাড়ছে, যদিও সেটা খুবই কম, বলার মতো নয়।
আতঙ্ক, ভয়, চিকিৎসা না পাওয়া আর ব্যবস্থার প্রতি আস্থাহীনতা ইত্যাদি কারণেই মানুষ হাসপাতালে যাচ্ছেন না মন্তব্য করে অধ্যাপক ডা. এবিএম আব্দুল্লাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোগীরা যেমন হাসপাতালে চিকিৎসা পাচ্ছেন না, তেমনি করোনা সংক্রমণের আশঙ্কায় হাসপাতালে যেতেও চাচ্ছেন না। করোনার প্রাদুর্ভাব শুরু হওয়ার পর থেকেই হাসপাতালে রোগী ভর্তি না হতে পারা, স্বাস্থ্যকর্মীদের উল্লেখযোগ্য হারে আক্রান্ত হওয়া–এসব রোগীর মধ্যে ভয় ধরিয়েছে, আস্থাহীনতা তৈরি করেছে। যার কারণে হাসপাতালে রোগী কমেছে।’
এদিকে, বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) জানিয়েছে, ১৩ জুলাই পর্যন্ত করোনাতে আক্রান্ত হয়ে ৬৩ জন চিকিৎসক মারা গেছেন। আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৯৫৩ জন চিকিৎসক, নার্স এক হাজার ৫০৪ জন, আর অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী দুই হাজার ১০০ জন।
সংগঠনটির মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বলেন, ‘কেবলমাত্র মনের জোরে চিকিৎসকসহ অন্য স্বাস্থ্যকর্মী হাসপাতালে আসছেন, চিকিৎসা দিচ্ছেন। নয়তো হাসপাতাল তো সংক্রমণের উৎস হয়ে উঠেছে শুরু থেকেই।’ তবে এজন্য ট্রায়াজ সিস্টেম না থাকা, রোগীর তথ্য গোপন, চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত সুরক্ষা সামগ্রীর অভাবকে কারণ হিসেবে বলেন তিনি। এছাড়া চিকিৎসকসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের আক্রান্তের খবরে হাসপাতালগুলোর প্রতি রোগীদের ভীতি তৈরি হয়েছে বলে জানান তিনি।
কোভিড-১৯ বিষয়ক জাতীয় কারিগরি পরামর্শক কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘শুরু থেকেই হাসপাতালগুলোতে আমরা ট্রায়াজ (কোভিড সন্দেহভাজন রোগী বাছাই প্রক্রিয়া) শুরু করার কথা বলেছিলাম। এর মাধ্যমে যদি সব হাসপাতালে কোভিড নন-কোভিড বাছাই করা যেতো, তাহলে হাসপাতালগুলোতে সংক্রমণের এত ভয় থাকতো না। এখন সেটা না হওয়ার ফলে চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী ও রোগী সবার মনেই আতঙ্ক কাজ করে, যার কারণে রোগীরা হাসপাতাল আসতে চাচ্ছে না।’ খুব সহসা এই অবস্থা কাটবে না বলেও মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘সরকারিভাবে এর উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন।’
‘রোগী তো অনেক কমে গেছে, বিশেষ করে বহির্বিভাগের সার্ভিস অনেক কমে গেছে’ মন্তব্য করেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের সহকারী পরিচালক ডা. কেএম মামুন মোর্শেদ। তিনি বলেন, ‘আগে প্রতিদিন বহির্বিভাগে তিন থেকে চার হাজার রোগী হতো, এখন সেটা হয়েছে ৫০০ থেকে ৬০০-এর মতো। অর্থাৎ ছয় ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।’ রোগী না আসার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘হাসপাতাল তো করোনার আখড়া। চিকিৎসকসহ অন্যরা আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু এখন জরুরি এই ভয়টা কাটানো।’ এই হাসপাতালে ইনডোরে ২০০ শয্যা করোনা রোগীদের জন্য রাখা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘গত ২৭ জুন থেকে করোনা রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে এখানে। পাশাপাশি ৬৫০টি নন কোভিড রোগীদের শয্যা।’
‘১২ জুলাই হাসপাতালে কোভিড বেডে ভর্তি ছিলেন ১১৬ জন, আর নন কোভিড বেডে ভর্তি ছিলেন ৬৪৮ জন। মোট ভর্তি ৭৬৪ জন। অথচ আগে এই বেডে এক হাজার ৩০০ থেকে এক হাজার ৫০০-এর মতো রোগী ভর্তি থাকতো,’ বলেন তিনি।
একই দিনে, বহির্বিভাগে ৫৫২ জন, জরুরি বিভাগে ২৪৮ জন আর ফ্লু কর্নারে ৮১ জন এসেছে জানান ডা. মামুন। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘মানুষ ভয়ে হাসপাতালে আসছে না, দ্বিতীয়ত অনেকেই সরকারি হাসপাতালে যারা চিকিৎসা নিতেন তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ঢাকা ছেড়েছে। তবে গত ৮ জুলাই থেকে প্রতিদিন রোগী সংখ্যা একটু একটু করে বাড়ছে।’
রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ এবং জাতীয় ক্যানসার গবেষণা ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. গুলজার হোসেন উজ্জ্বল বলেন, ‘সরকারি এই বিশেষায়িত হাসপাতালেও রোগীর সংখ্যা কমে গেছে। আগে যেখানে একটা শয্যার জন্য দিনের পর দিন অপেক্ষা করতে হতো, এখন সেখানে বেড ফাঁকা পড়ে আছে। আর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য কোভিড নেগেটিভ সার্টিফিকেট দরকার হয়, যেটা আসলে এখন একটা হয়রানির বিষয়, যোগাযোগও সমস্যা একই সঙ্গে। অনেক রোগীই মুভ করতে পারছেন না। তবে সবচেয়ে বড় ভয় মানসিক, হাসপাতাল থেকে করোনা সংক্রমণের ভয়।’
‘হাসপাতালে গেলে করোনায় আক্রান্ত হতে হবে এই ভয় রয়েছে এবং হচ্ছেও অনেকে’ মন্তব্য করে ডা. গুলজার বলেন, ‘আগে করোনা পজিটিভ না হলেও অনেক রোগী পেয়েছি যারা ভর্তি হওয়ার পর পজিটিভ হয়েছেন এবং সেটা কীভাবে হয়েছেন সেই কন্টাক্ট ট্রেসিংও করতে পারছি না। একই সঙ্গে হাসপাতালে রোগীদের করোনা পরীক্ষা হলেও তার সঙ্গে যারা থাকছেন (অ্যাটেনডেন্স) তাদের তো আর করোনা পরীক্ষা হচ্ছে না। তাদের অনেকেও তো ক্যারিয়ার হতে পারেন। নানাভাবেই সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি আমরা।’

/এমএএ/এমএমজে/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘উপজেলা নির্বাচনে এমপিদের প্রভাব খাটানোর প্রমাণ পেলে আইনি ব্যবস্থা’
‘উপজেলা নির্বাচনে এমপিদের প্রভাব খাটানোর প্রমাণ পেলে আইনি ব্যবস্থা’
দেবিদ্বারে পানিতে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু
দেবিদ্বারে পানিতে ডুবে ২ শিশুর মৃত্যু
‘গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড’ পাচ্ছে ২৯ প্রতিষ্ঠান
‘গ্রিন ফ্যাক্টরি অ্যাওয়ার্ড’ পাচ্ছে ২৯ প্রতিষ্ঠান
মানবিক সমাজ বিনির্মাণে তরুণদের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে: স্পিকার
মানবিক সমাজ বিনির্মাণে তরুণদের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হবে: স্পিকার
সর্বাধিক পঠিত
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
দক্ষিণে ‘ডায়াবেটিক ধানের’ প্রথম চাষেই বাম্পার ফলন, বীজ পাবেন কই?
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন: এখনও অপেক্ষায় স্বজনরা
নারায়ণগঞ্জের আলোচিত ৭ খুন: এখনও অপেক্ষায় স্বজনরা