X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

৪৭ বছর পর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন যে চার নারী

শরীয়তপুর প্রতিনিধি
১১ এপ্রিল ২০২১, ২০:১৩আপডেট : ১১ এপ্রিল ২০২১, ২০:৫৪

একাত্তরের ভয়াল স্মৃতি মনে করে এখনো আঁতকে ওঠেন যোগমায়া মালো। ৫০ বছর ধরে শরীর ও মনের ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছেন তিনি। ৪০ বছর ধরে অন্যের আশ্রয়ে আছেন। তবে শেষ জীবনে সান্ত্বনা একটাই-রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন তিনি। শুধু যোগমায়া মালো নন, তার মতো স্বীকৃতি পেয়েছেন এ অঞ্চলের আরও তিন নারী। এদের মধ্যে দুজনকে দেওয়া হয় মরণোত্তর স্বীকৃতি।

যোগমায়া মালোর বাড়ি শরীয়তপুর সদরের দক্ষিণ মধ্যপাড়া গ্রামে। তার মতো শরীয়তপুরের আরও তিন জন ২০১৮ সালে নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়েছেন। তাঁরা হলেন গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুরের ভানু বিবি, সদর উপজেলার দক্ষিণ মধ্যপাড়া গ্রামের যুগলবালা পোদ্দার ও মধ্যপাড়া গ্রামের সুমিত্রা মালো। এরমধ্যে যোগমায়া মালো শরীয়তপুরে ও ভানু বিবি ঢাকায় এক বস্তিতে বাস করেন। আর বাকি দুজন প্রয়াত হয়েছেন ২০১৪ সালে।

নারী মুক্তিযাদ্ধা যোগমায়া। দেশ স্বাধীনের ৪৮ বছর পর পেয়েছেন এ সম্মান।

১৯৭১ সালে ১৫ বছরের কিশোরী বধূ ছিলেন যোগমায়া মালো। একাত্তরের স্মৃতি মনে এলে এখনও তার চোখে বেয়ে অবিরাম জলধারা নামে। চোখের পানি মুছতে মুছতে তিনি বলেন, ‘২২ মে আমাদের গ্রামসহ আশপাশের হিন্দুপাড়ায় পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায়। আমার স্বামী মৎস্যজীবী ছিলেন। তিনি পদ্মা নদীতে মাছ শিকার করতে গিয়েছিলেন। খানসেনা আর রাজাকারদের ভয়ে আশেপাশের অনেকে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো। কিন্দু, আমার তখন একেবারে কম বয়স। আমার স্বামী গেছে মাছ ধরতে। আমারও ভয় করছিল কিন্তু, স্বামীকে ছাড়া একা বাড়ি ছেড়ে পালাতে সাহস পাইনি। বসতঘরেই ছিলাম। আর তাতেই…। ২৩ মে পাকিস্তানি বাহিনী ও রাজাকাররা গ্রামে ঢুকলো। রাজাকাররা আমারে ঘর থেকে জোর করে নিয়ে গেলো…।’

যোগমায়াসহ ৩০-৩৫ নারীকে নেওয়া হয় মাদারীপুর এআর হাওলাদার জুট মিলে। সেখানে আটকে রেখে তাঁদের চরম নির্যাতন করা হয় ও সম্ভ্রম লুট করা হয়। পাঁচ দিন পর সেখান থেকে ছাড়া পান যোগমায়া। পরে স্বামীকে খুঁজে পান। স্বামী তার ওই ঘটনা মেনে নেন।

একাত্তরের ওই নির্যাতনের স্মৃতি এখনও তাড়া করে এই নারীকে। এখন বয়সের ভারে ন্যুব্জ। তার স্বামী মারা গেছেন প্রায় ৩০ বছর আগে। মুক্তিযুদ্ধের পরে তিনিও যে মুক্তিযোদ্ধা সেটা কাউকে বোঝাতে পারেন নাই সুদীর্ঘ সময়ে। বীরাঙ্গনা হলেও আগের সরকারগুলো তাকে স্বীকৃতি দেয় নাই। অবশেষে দীর্ঘ ৪৭ বছর পর মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পেয়ে আপ্লুত তিনি। বর্তমানে অন্যের আশ্রয়ে থাকা এই মুক্তিযোদ্ধার শেষ জীবনটা অন্তত আনন্দময় হোক বঙ্গবন্ধুর জন্ম শতবার্ষিকী ও স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে এই দাবি এলাকাবাসীর।

ভানু বিবির বাড়ি গোসাইরহাট উপজেলার কোদালপুরে। বর্তমানে তিনি থাকেন ঢাকার মিরপুরের গরিবে নেওয়াজ বস্তিতে। গত ৫০ বছরই কেটেছে তাঁর দুঃখ, কষ্ট ও অবহেলায়। সম্প্রতি মুঠোফোনে কথা হয় তাঁর সঙ্গে। তিনি বলেন, যুদ্ধ শুরুর পর গ্রামে মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা করতেন তিনি। বিভিন্ন স্থানে অস্ত্র ও খবর পৌঁছে দিতেন। এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়িতে পাকিস্তানি বাহিনী হামলা চালায়। সেখানেই তাকে আটক করে সেনারা। মুক্তিযোদ্ধা ও অস্ত্রের সন্ধান জানতে চায় তারা। বেয়োনেট দিয়ে তার শরীর ক্ষতবিক্ষত করে। পরে তিনি ছাড়া পান।

ভানু বিবি। দেশ স্বাধীনের ৪৮ বছর পর পেয়েছেন নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।

ভানু বিবির স্বামী রোস্তম ব্যাপারীও মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। ১৯৭৪ সালে তিনি মারা যান। এরপর চার শিশুসন্তান নিয়ে ভানু বিবি ঢাকায় চলে যান। বস্তিতে আশ্রয় নেন। এখন অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। সেই কষ্টের জীবন এখনও বয়ে চলেছেন তিনি।

যুগলবালা পোদ্দার, তাঁর স্বামী গৌরাঙ্গ চন্দ্র পোদ্দার ও দেবর নৃপেন চন্দ্র পোদ্দারকে ২৩ মে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি বাহিনী। তার স্বামী ও দেবরকে হত্যা করা হয়। চার দিন নির্যাতনের পর মুক্তি পান যুগলবালা। মুক্তিযুদ্ধের পর শিশুসন্তানদের নিয়ে বিপাকে পড়েন তিনি। অভাব-অনটনে সন্তানদের পড়ালেখা করাতে পারেননি। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পাওয়ার আগেই ২০১১ সালে মারা যান যুগলবালা। তাঁর এক সন্তান রতন পোদ্দার গ্রামে চায়ের দোকান দিয়েছেন। আরেক ছেলে তপন পোদ্দার খুলনায় সবজি বিক্রি করেন।

যুগলবালা পোদ্দার। মুক্তিযুদ্ধের ৪৮ বছর পর এবং মৃত্যুর ৪ বছর পর নারী মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে তাকে।

রতন পোদ্দার বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের সময় আমার বয়স আট বছর। মা বন্দিদশা থেকে ফিরে অনেক দিন কথা বলতে পারেননি। স্বাধীনতার জন্য আমাদের পরিবারকে অনেক বড় ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। কিন্তু ৫০ বছর ধরে স্বাধীন দেশে আমরা চরম অবহেলিত।’

শরীয়তপুরে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি পাওয়া চতুর্থ নারী হচ্ছেন সুমিত্রা মালো। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় সুমিত্রা মালো অন্তঃসত্ত্বা ছিলেন। ২৩ মে তাকে ও তার তিন সন্তানকে ধরে নিয়ে যায় পাকিস্তানি সেনারা। তাঁদের বসতঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। তিন দিন আটকে রেখে তাদের নির্যাতন করা হয়। ছাড়া পাওয়ার পর তারা অন্যের আশ্রয়ে থাকতে শুরু করেন।

সুমিত্রা মালো। মৃত্যুর চার বছর পর এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার ৪৮ বছর পর পেয়েছেন নারী মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি।

স্বাধীনতার পর তার ওপর করা নির্যাতন মেনে নিতে পারেননি তার স্বামী শম্ভু মালো। স্ত্রী ও মেয়েদের এ নিয়ে কটু কথার মুখোমুখি হতে হতো পরিবার ও বাইরে। দেশ স্বাধীনের ১০ বছর পর তার স্বামী সম্ভু মালো ও ছেলে সুকদেব মালো ভারতে চলে যান। তিন মেয়ে নিয়ে মধ্যপাড়া গ্রামেই থেকে যান সুমিত্রা মালো। শুরু হয় তার নতুন সংগ্রাম। মেয়েদের মানুষ করার যুদ্ধে নেমে সব ধরনের কষ্ট ভাগ করতে হয়েছে সুমিত্রা মালোকে। মেয়েদের পাত্রস্থ করে ২০১৪ সালে মারা যান তিনি।

সুমিত্রা মালোর মেয়ে বীনা রানী মালো বলেন, ‘স্বাধীনতার পর বেঁচে থাকার জন্য অনেক লড়াই করতে হয়েছে। মাও অনেক কষ্ট করেছেন। দুঃখ একটাই, মা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেখে যেতে পারলেন না।’

শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান বলেন, ‘যাঁদের মহান ত্যাগের বিনিময়ে আমাদের এই স্বাধীনতা, তাঁদের কষ্টের জীবন মেনে নেওয়া যায় না। চার নারী মুক্তিযোদ্ধার জন্য বীর নিবাস নির্মাণ করে দেওয়া হবে। এ বিষয়ে জেলা প্রশাসন থেকে মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে।’

/টিএন/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
সার্বিক অগ্রগতির পথে প্রধান বাধা বিএনপি: ওবায়দুল কাদের
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
ইউক্রেনে রুশ বিমান হামলায় দুই শিশুসহ নিহত ৮
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
হাসপাতালের বদলে শিশুরা ঘুমাচ্ছে স্বজনের কোলে
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
পারটেক্সের বিপক্ষে হেরে রূপগঞ্জ টাইগার্সের অবনমন
সর্বাধিক পঠিত
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
নিজ বাহিনীতে ফিরে গেলেন র‍্যাবের মুখপাত্র কমান্ডার মঈন
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
বৈধ পথে রেমিট্যান্স কম আসার ১০ কারণ
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইসরায়েলি হামলা কি প্রতিহত করতে পারবে ইরান?
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!