X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১
ট্রাভেলগ

নিসর্গের শান্তিবাড়ি আর পদ্মবনের কথকতা

রিয়াসাদ সানভী
১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ১৫:০২আপডেট : ১৮ সেপ্টেম্বর ২০১৮, ২১:০১

শান্তিবাড়ি সকালে ঘুম ভেঙে রুমের বাইরে যেতেই পা পিছলে যাওয়ার উপক্রম। আধখাওয়া কলা ফেলে রাখা সামনে। ব্যাপারটা বুঝতে দেরি হলো না মোটেই। আগের দিনই তাদের আনাগোনা টের পেয়েছিলাম। কখনও এ-গাছ থেকে ও-গাছ, কখনও ঘরের জানালা গলে ঢুকে পড়ার উপক্রম করছিল। কাঠবিড়ালি! আজকালকার প্রজন্মের ভাষায় চেহারা, যাকে বলে কিউট। কিন্তু সাংঘাতিক তার কাজকারবার। একবার ঘরে ঢুকে পড়তে পারলে খাবার-দাবার নিয়ে চম্পট। এখানে কাঠবিড়ালির অভাব নেই। এখানে মানে শান্তিবাড়িতে। পারাবত এক্সপ্রেসে চড়ে এসেছি আমরা। ট্রেনেই নাশতা সেরে নেওয়ার ইচ্ছে থাকলেও ভিড়ভাট্টায় তার আর জো ছিল না।

শ্রীমঙ্গল স্টেশনে নামতেই ক্ষুধার কথা বেমালুম ভুলে গেলাম। এ জায়গা চিরকাল ধরিত্রীর বড় কাছাকাছি। এখানকার লাল মাটি, ছোট টিলা বন, চা বাগান আর মানুষেরা চিরকাল আমাকে টানে। ঠিক বন্য নয়, কিন্তু কোত্থেকে যেন বুনো গন্ধ ঠিকই নাকে এসে লাগে।

স্টেশন থেকে বাইরে যেতেই সত্য বাবুর সঙ্গে দেখা। স্থানীয় সিএনজি ড্রাইভার। সঙ্গে করে নিয়ে এসেছেন ভাতিজাকেও। তাদের দুই সিএনজিতে করে চললাম রাধানগর থেকে। শ্রীমঙ্গল মূল শহর থেকে ১৫-২০ মিনিটের দূরত্ব। বিজিবির আঞ্চলিক হেডকোয়ার্টার পার হতেই দুই পাশে চা বাগান শুরু। মনে সেই চেনা হিল্লোল খেলে গেলো। এ পথ সোজা চলে গেছে কমলগঞ্জের দিকে। মাঝে পেরোতে হয় লাউয়াছড়া সংরক্ষিত অরণ্য। এর ঠিক আগেই গ্র্যান্ড সুলতান টি রিসোর্ট অ্যান্ড গলফের বিপরীত দিকে রাস্তায় ঢুকে ৭-৮ মিনিট গেলেই শান্তিবাড়ির নামফলক চোখে পড়বে। এ এলাকায় এখন প্রচুর হোটেল-মোটেল তৈরি হচ্ছে। সবই অবশ্য সেই ইট-পাথরের। শহুরে ক্লান্ত মানুষের কাছে এই জায়গাটা ছুটি কাটানোর দারুণ গন্তব্য।

শরতে বাইক্কা বিলে পদ্মের বাহারি রঙ মূল সড়ক থেকে মিনিট কয়েকের দূরত্বে শান্তিবাড়ি। কয়েক মিনিট যেন পরিবর্তন করে দেয় আশপাশের দৃশ্যকল্পও। উচ্চাভিলাষী দালানকোঠার জঙ্গল থেকে চুপচাপ ঘুমিয়ে থাকা শান্ত প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যাওয়ার ব্যবধান মাত্র কয়েক মিনিট। প্রথম দেখাতেই মুগ্ধতা জাগাবে শান্তিবাড়ি। সামনেই দুটো পুকুর। একটিতে আবার পদ্মফুল ফুটে আছে। দালান বলতে যা বোঝায় তা এখানে নেই। বাংলো আকৃতির দোতলা কাঠের ঘর। এখানে দু’দিনের আবাস আমাদের। পাশেই ছনওয়ালা আরেকটি ঘর। সেখানে থাকতে না পারার আফসোস রয়ে গেছে এখনও। এ আঙিনার পেছন থেকেই শুরু হয়েছে টিলা শ্রেণির। সেখানে আনারসের চাষ হচ্ছে। একটু ওপরে উঠলেই চোখে পড়ে চা বাগান, আদিবাসীদের বসতি।

রুমে ব্যাগ রেখে পুকুরপাড়ে তৈরি করা আরামকেদারায় গা এলিয়ে দিলাম। এখানে বসলে কয়েক ধরনের অনুভূতি হতে পারে। নিজেকে রাজবংশীয় কেউ ভাবতে পারেন! আছে প্রাণজুড়ানো লেবুর শরবত। আর নিছক প্রকৃতিকে উপভোগ করতে চাইলে চোখটা একটু বন্ধ করুন। শান্তিময়তার গভীর প্রদেশে হারিয়ে যাবেন।

শান্ত পুকুরে জলকেলি এরপর অবশ্য শান্তিবাড়ির শান্ত পুকুরের জল আর শান্ত রইলো না আমাদের দাপটে। সুইমিংপুল নয়, পুরোপুরি খাঁটি দেশি পুকুর। গোসল শেষে বাঙালিয়ানার কবজি ডোবানো খাবার চলে এলো। আলু ভর্তা, লাল শাক, বড়া, রুই মাছ আর ডাল। এমন খাবার সামনে নিয়ে অভুক্ত পেটে বেশিক্ষণ বসে থাকা বড়ই কঠিন। আমরা হামলে পড়লাম রীতিমতো।

শান্তিবাড়িতে অর্ডারি খাবারের চল নেই। খেতে হবে এখানকার মেন্যু অনুযায়ী। শতভাগ দেশীয় খাবার। বাগানের অর্গানিক শাকসবজি আর মাছ এখানকার মূল আকর্ষণ। ভরপেট ভোজের পর ভাতঘুমের পালা। কাঠের ঘর কঠিন গ্রীষ্মেও বেশ শীতল থাকে। তার ওপর চারপাশে গাছগাছালির সমারোহ। ঘুম নামবে এমনিতেই।

নিসর্গের শান্তিবাড়ি আর পদ্মবনের কথকতা ভাতঘুমের পর আমরা চললাম মাধবপুর লেকের দিকে। তবে একটু অন্য রাস্তা ধরে। লাউয়াছড়া বনের শুরুতেই একটি রাস্তা নূরজাহান টি এস্টেটের ভেতর দিয়ে গেছে লেকের দিকে। রাস্তার চারপাশ জুড়ে চা বাগান আর টিলা বন। একটা জায়গায় চোখে পড়লো চশমা পরা বানরের দলকে। এ এলাকায় এখনও টিকে আছে চশমাপরা বানর। শাখামৃগ শ্রেণির সবচেয়ে সুন্দর প্রজাতি হচ্ছে এটি। ইংরেজি নাম প্রেয়ারস লিফ ল্যাঙ্গুর। এখানকার চা বাগানগুলোতে কিছুদূর পরপরই ছোট টিলাবন আছে। এর ওপর ভিত্তি করে কিছু বন্যপ্রাণী এখনও টিকে আছে।

ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপে চা বাগান বা পাহাড়ি অঞ্চলের জীববৈচিত্র  টিকিয়ে রাখায় দারুণ ভূমিকা রাখতে পারে এ ধরনের ছোট ছোট বনের করিডোর। পার্বত্য অঞ্চলে পাড়া বন নামে এ ধরনেরই একটা কনসেপ্ট দাঁড় করানোর চেষ্টা চলছে। পর্যটক বন্ধুরা শ্রীমঙ্গল গেলে অযথা লাউয়াছড়া বনে ভিড় না বাড়িয়ে রাধানগরের ওই রাস্তায় ঘুরে আসতে পারেন।

মন ভালো করে দেয় পদ্ম মাধবপুর লেকের দিকে পর্যটকদের প্রচুর ভিড়। লেকের পদ্মগুলো মন ভালো করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। সন্ধ্যার মুখে আমরা ফিরে এলাম শান্তিবাড়িতে। ততক্ষণে বারবিকিউয়ের আয়োজন চলছে। বারবিকিউয়ে এখানকার ইউনিক মেন্যু হচ্ছে আনারস। গোল করে কেটে আগুনে বিশেষ কায়দায় সেঁকা হয়। খেতে এককথায় দারুণ। বারবিকিউ চিকেন, আনারস, পরটা আর ডাল দিয়ে অসাধারণ নৈশভোজ সেরে আমরা ছুটলাম পদ্মের ঘুম ভাঙা দেখতে। শান্তিবাড়ির পুকুরের এই পদ্মগুলো রাতের আঁধারে পাপড়ি মেলে জেগে ওঠে। সূর্য জাগলে আবার এরা ঘুমিয়ে পড়ে। পদ্ম অভিযান শেষ করে বিছানায় যেতেই ঘুম নেমে এলো চোখজুড়ে।

এখানকার সকাল দারুণ স্নিগ্ধ। নাম না জানা নানান পাখির কলকাকলি কানে ভাসে। ভাগ্য ভালো হলে দেখা হয়ে যেতে পারে বুনো মুরগির দলের সঙ্গে। ভোরেই আমাদের বেরিয়ে যাওয়ার কথা ছিল বাইক্কা বিলের উদ্দেশে। আগে থেকে ঠিক করে রাখা সিএনজির আর খবর নেই। এই ফাঁকে নাশতায় উপভোগ করলাম ভুনাখিচুড়ি ও ডিম। এরপরও সিএনজির দেখা না পেয়ে অগত্যা মাইক্রোবাস ভাড়া করেই আমরা ছুটলাম বাইক্কা বিলের উদ্দেশে।

শান্তিবাড়ি শ্রীমঙ্গল শহর থেকে কিছুদূরে বরুণা গ্রাম হয়ে যেতে হয় বাইক্কা বিল ওয়াচ টাওয়ারে। তবে আমাদের লক্ষ্য বাইক্কা বিলের লালপদ্ম দর্শন। শরতের এই সময়ে বাইক্কা বিলে গেলে পদ্মের বাহারি রঙে চোখ রাঙিয়ে যাবে। দিগন্তজোড়া বিলের বিভিন্ন জায়গায় বিশাল এলাকাজুড়ে পদ্মের সমারোহ। এর মাঝে শাপলা সংগ্রহকারীদের দুটো নৌকা নিয়ে আমরা একপাঁক ঘুরে এলাম। কবি নীলপদ্মের জন্য পৃথিবী তোলপাড় করার কথা বলেছিলেন। বাস্তবে তা হয়তো সম্ভব নয়। কিন্তু চোখের সামনে যে পদ্ম আছে তা প্রেয়সীকে দিতে মন চাইবেই।

নির্ধারিত সময় শেষ। আমাদের ফিরতে হবে। আবারও সেই শান্তিবাড়ি। ফিরতি পথে বাড়তি পাওনা হয়ে রইলো চা বাগানের ঝিরির ধারে শরতের আদি অকৃত্রিম কাশবন। এই শুভ্রতার অনুভূতি মনে সাজিয়েই উঠতে হলো ঢাকার ট্রেনে। ফের সেই নাগরিক শহুরে কোলাহলে।

ছবি: লেখক

/জেএইচ/চেক/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মেসির জোড়া গোলে মায়ামির আরেকটি জয় 
মেসির জোড়া গোলে মায়ামির আরেকটি জয় 
কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ৫ ইউনিয়নে চলছে ভোট গ্রহণ
কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার ৫ ইউনিয়নে চলছে ভোট গ্রহণ
যাদের স্যালাইনে বাঁচে প্রাণ, তাদের মজুরি বাড়ে না
১৬ শ্রমিকের উৎপাদিত স্যালাইন দিয়ে চলছে ৯ জেলার হাসপাতালযাদের স্যালাইনে বাঁচে প্রাণ, তাদের মজুরি বাড়ে না
সিলেটে ট্রাকের ধাক্কায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
সিলেটে ট্রাকের ধাক্কায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে
মিয়ানমারে গিয়ে সেনা ট্রেনিং নিলেন ২ রোহিঙ্গা, বাংলাদেশে ঢুকলেন বুলেট নিয়ে