X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

সুলতানি আমলের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন ‘দরসবাড়ি মসজিদ’

সালাহউদ্দীন জাহাঙ্গীর
১৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১৮:০৭আপডেট : ১৫ ডিসেম্বর ২০২২, ১৯:২৭

বাংলাদেশে মুসলিম শাসন ও ইসলামি সভ্যতার অনেক নিদর্শন আবিষ্কার হয়েছে। তবে বাংলার ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রের একমাত্র প্রাচীন নিদর্শন দরসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে বেশকিছু ইসলামি শিক্ষাকেন্দ্রের উল্লেখ পাওয়া গেলেও প্রত্নতাত্ত্বিক ধ্বংসাবশেষ আবিষ্কৃত হয়েছে কেবল দরসবাড়িতে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় কানসাটের কাছাকাছি দরসবাড়ি মসজিদ ও মাদরাসা। এর আশেপাশে রয়েছে বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড়-পাণ্ডুয়ার বিভিন্ন ঐতিহাসিক নিদর্শন। এগুলো হলো ছোট সোনা মসজিদ, তাহখানা কমপ্লেক্স, কোতয়ালী দরজা, সোনা মসজিদ স্থলবন্দর, চামচিক্কা মসজিদ, বালিয়াদীঘি, খানিয়াদীঘি। এসব প্রত্নতাত্ত্বিক স্থাপনা কাছাকাছি অবস্থিত। তাই সবখানেই একবেলায় ঘুরে আসা যায়।

আজ থেকে ৫০০ বছর আগে বাংলার প্রাচীন রাজধানী গৌড়ে স্থাপিত হয়েছিল দরসবাড়ি মসজিদ ও মাদরাসা কমপ্লেক্স। বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্যমতে, সুলতান শামছুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইউসুফ শাহ (শাসন ১৪৭৫-১৪৮১) ১৪৭৯ খ্রিষ্টাব্দে অনিন্দ্যসুন্দর এই কমপ্লেক্স নির্মাণ শুরু করেন। কিন্তু ১৪৮১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি মৃত্যুবরণ করলে এর নির্মাণকাজ স্থগিত হয়ে যায়। কিছুদিন পর বাংলায় অল্প সময়ের জন্য হাবশী শাসনের গোড়াপত্তন হয়। বিভিন্ন বিশৃঙ্খলায় তখন রাষ্ট্রীয় উন্নয়নমূলক কাজে খুব একটা অগ্রগতি হয়নি। পরবর্তী সময়ে সুলতান আলাউদ্দীন হোসাইন শাহ (শাসন ১৪৯৪-১৫২০) ১৫০২ খ্রিষ্টাব্দে দরসবাড়ি মসজিদ-মাদ্রাসার নির্মাণ বাকি কাজ সম্পন্ন করেন।

দরসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা

২.
দরসবাড়ি মসজিদ বা মাদ্রাসার কথা বললে স্থানীয়রা খুব একটা চেনে না। তাদের কাছে পরিচিত নয় গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনটি। অথচ সোনা মসজিদ বা তাহখানা কমপ্লেক্সের কথা অনেকেই জানে, এগুলোর নাম বললেই তারা অনায়াসে চিনতে পারে। যদিও ঐতিহাসিকভাবে দরসবাড়ি মাদ্রাসার গুরুত্ব অনেক বেশিই হওয়ার কথা। 

সোনা মসজিদ ও দরসবাড়ি মসজিদ কাছাকাছি, বড়জোর এক কিলোমিটার দূরত্বে দুটির অবস্থান। কানসাট থেকে সোনা মসজিদ ও দরসবাড়ির দূরত্ব প্রায় ১৫ কিলোমিটার। আমরা যে অটোরিকশায় দরসবাড়ি যাচ্ছি, তার চালক দরসবাড়ির নাম শোনেননি আগে। আমরাই রাস্তার পশ্চিম পাশে ধুলো জমা সাইনবোর্ড দেখতে পেলাম। আশেপাশে পাথর ব্যবসায়ীদের ভাঙানো পাথর স্তূপ করে রাখা। সোনা মসজিদ স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন ভারতীয় ট্রাকে করে এসব পাথর আমদানি হয়। পাথরের জগদ্দলের ভেতর দিয়ে একটি কাঁচা রাস্তা ধরে সামনে এগোলে দরসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা।

কাঁচা রাস্তা ধরে ১০০ গজ সামনে এগিয়ে পাকা রাস্তা চোখে পড়লো। তারপর আবারও কাঁচা রাস্তা ধরে আরেকটু সামনে এগোলে হাতের ডান দিকে দরসবাড়ি মসজিদ। রাস্তা থেকে আমবাগানের ভেতর দিয়ে তাকালে লাল ইটের ইমারতের অবয়ব নজরে আসে। সাধারণ পথচারী কেউ না জানলে রাস্তা ধরে সামনে চলে যাবে। কেননা রাস্তা থেকে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে না দেখলে আমবাগানের ভেতর দিয়ে মসজিদটি চোখে পড়ে না। এখানে সরকারি কোনও নির্দেশিকা দেওয়া নেই। আমরা কৌতূহল নিয়ে এসেছি বলে আশেপাশে নজর রেখে এগোচ্ছিলাম।

আমবাগানের ভেতর দিয়ে মসজিদে যাওয়ার নির্দিষ্ট কোনও রাস্তা নেই। স্থানীয়দের যাতায়াতের একটি মাটির আলপথ তৈরি হয়েছে। সেটাই মসজিদে যাওয়ার একমাত্র পথ। সেই সরু মাটির পথ ধরে মসজিদ চত্বরে দাঁড়ালাম। আমাদের স্বাগত জানালো ছড়িয়ে রাখা মাসকালাই। আশেপাশের কৃষকরা ক্ষেত থেকে মাসকালাই গাছ তুলে শুকাতে দিয়েছেন মসজিদ চত্বরের সামনে ও পেছনে। মাসকালাই মাড়াইয়ের একটি যন্ত্রও বিদ্যমান এখানে। ভটভট শব্দে চলছে সেটি। পাঁচ-সাতজন কৃষক-মজুর মাসকালাই মাড়াই করে হাত-পা থেকে ধুলো ঝেড়ে ফেলছিলেন। পঞ্চদশ শতকের একটি প্রাচীন মসজিদের ধ্বংসাবশেষ এমন জবুথবু, ভাবা যায়! এটি ঐতিহাসিক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নাকি কৃষকদের গুদাম তা ভেবে অবাক হতে হয়।

দরসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা

৩.
মসজিদ চত্বর পেরিয়ে আমরা দরসবাড়ি মসজিদের ভেতরে প্রবেশ করলাম। চারপাশের দেয়াল প্রায় সম্পূর্ণই অক্ষত। মূল মসজিদের ছাদ খসে পড়েছে অনেক আগেই। বারান্দার পিলারগুলোর শুধু নিচের অংশ অবশিষ্ট রয়েছে, উপরিভাগ এখন আর নেই। ভেতরের অনেক পাথরের পিলার খসে পড়েছে। 

মসজিদটি পোড়া ইটের তৈরি হলেও পিলারগুলো পাথরের। পাথরের পিলারের কারণে হয়তো মসজিদের দেয়াল এখনও দাঁড়িয়ে আছে। যেসব পিলার খসে পড়েছে সেগুলো অবিন্যস্তভাবে মসজিদের ভেতরের মেঝেতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। মেঝে বলতে যদিও এখন আর কিছু অবশিষ্ট নেই। মাটি ও ঘাসের ওপর পড়ে আছে বিরাটাকার পাথরের পিলার, ভেঙে পড়া দেয়াল এবং খসে পড়া ইট।

মসজিদের ভেতরে সামনের দেয়ালে আঁকা টেরাকোটা নকশা বেশ নান্দনিক ও নিখুঁত। বিশেষত মসজিদের মিহরাব ও এর পাশে ছড়ানো নকশা এখনও যেকোনও শিল্পমনকে বিমোহিত করতে পারে। মসজিদের বাইরের দেয়ালে নিখুঁত ও নান্দনিক টেরাকোটা নকশা এখনও প্রায় অক্ষত। ৫০০ বছর আগে কত শত শিল্পীর মনন ও শ্রম মিশে আছে এই দেয়াল, পোড়ামাটির ইট ও টেরাকোটা নকশায়। মসজিদের ভেতরে শতাব্দী ধরে নামাজ আদায় করেছে হাজার হাজার ধর্মপ্রাণ মুসলমান। তাদের প্রার্থনা এখনও হয়তো মিশে আছে মসজিদের দেয়ালে।

মসজিদটি একটি উঁচু ঢিবির ওপর নির্মিত। পাশের একটি পুকুর খনন করে ঢিবিটি তৈরি হয়েছে। পুকুরের অপর পাশে দরসবাড়ি মাদ্রাসার ধ্বংসাবশেষ। সেটিও উঁচু ঢিবির ওপর নির্মিত।

দরসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা

দরসবাড়ি মসজিদে প্রায় এক ঘণ্টার মতো সময় কাটালাম। এরমধ্যে দুই-তিন জন তরুণ-তরুণীকে ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে দেখা গেলো। মসজিদের চারপাশে বিস্তীর্ণ আমবাগানে কিছুক্ষণ হাঁটলাম। আমবাগানের ভেতর প্রাচীনকালের প্রচুর ইট, ইটের টুকরো, ভাঙা তৈজসপত্র এখনও দৃশ্যমান। এতে বোঝা যায়, দরসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা ঘিরে গড়ে উঠেছিল বিরাট কোনও নগরী। প্রাচীন গৌড় নগরীর অনেক অজানা স্থাপনা এখনও হয়তো মাটিচাপা পড়ে আছে আমবাগানের নিচে।

সুলতান শামছুদ্দীন আবুল মুজাফফর ইউসুফ শাহ এবং সুলতান আলাউদ্দীন হোসাইন শাহ বাংলার দুই সফল সুলতান ছিলেন। তাদের সময়ে বাংলার সীমানা ত্রিপুরা থেকে বিহার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। গৌড়-পাণ্ডুয়া ছাড়াও সোনারগাঁওয়ে আধুনিক নগরী নির্মাণে সুলতান হোসাইন শাহ অমর হয়ে থাকবেন। কিন্তু তাদের শাসনের অন্যতম স্মৃতিচিহ্ন এই দরসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা অবহেলায় হারিয়ে যেতে বসেছে। যেহেতু এটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের অধিগ্রহণ করা সম্পত্তি, সেহেতু এর সুষ্ঠু সংরক্ষণ করার দায়িত্ব তাদের।

দরসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা

৪.
দরসবাড়ি মসজিদের চারপাশে কোনও নিরাপত্তা দেয়াল নেই। অথচ দেশের প্রতিটি প্রত্নতত্ত্ব স্থাপত্য সংরক্ষণের জন্য নিরাপত্তা দেয়াল নির্মাণ করা হয়। 

মসজিদের পাশে একটি সাইনবোর্ড ছাড়া প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের আর কোনও নিদর্শন বা নির্দেশিকা চোখে পড়েনি। মসজিদ ও মাদ্রাসায় যাওয়ার সঠিক কোনও সড়ক নির্দেশিকাও নেই। দর্শনার্থীরা জানতেই পারে না দরসবাড়ি নামে এখানে কোনও মসজিদ ও মাদ্রাসা আছে। তাই মসজিদ ও মাদ্রাসায় যাওয়ার নির্দেশিকা সংবলিত সাইনবোর্ড স্থাপন করা জরুরি।

মসজিদ ও মাদ্রাসায় যাওয়ার রাস্তাটি কাঁচা। কিছু অংশ দুই বছর আগে পাকা করা হলেও বাকি অংশ এখনও কাঁচাই রয়ে গেছে। বর্ষা মৌসুমে লালমাটি বৈশিষ্ট্যের এই কাঁচা রাস্তায় চলাচল প্রায় দুঃসাধ্য।

ছোট সোনা মসজিদ, তাহখানা কমপ্লেক্স ইত্যাদি স্থাপত্যে দর্শনার্থী সংখ্যার হিসাব রাখার জন্য একজন সার্বক্ষণিক হিসাবরক্ষক আছে। কিন্তু দরসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসার দর্শনার্থীদের জন্য তেমন কোনও ব্যবস্থা নেই।

দরসবাড়ি মসজিদ ও মাদ্রাসা

মসজিদ ও মাদ্রাসা রক্ষণাবেক্ষণে কোনও কেয়ারটেকার বা প্রশাসন কর্তৃক নিয়োগকৃত কোনও ব্যক্তি আছেন কিনা জানা নেই। অন্তত আমরা ঘণ্টাখানেক এমন কাউকে দেখতে পাইনি। এমন কেউ থাকলে প্রাচীন স্থাপত্যের চত্বরে মাসকালাই শুকানো বা কালাই মাড়ানোর যন্ত্র চলার কথা নয়। এমন কর্মকাণ্ডের কারণে মসজিদের ভিটি, দেয়াল ও পুরনো নকশা ক্ষয়িষ্ণু হয়ে খসে পড়ার শঙ্কা রয়েছে।

মসজিদের ভেতরে বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ যেমন- পাথরের পিলার, দেয়ালের নিম্নাংশ, ইট, টেরাকোটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এগুলো সঠিকভাবে সংরক্ষণের কোনও ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। প্রাচীন স্থাপনার প্রতিটি অংশ সংরক্ষণে প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা প্রয়োজন। 

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
এবার ‘হুব্বা’ নামে হলো গানচিত্র
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
আঙুরের গোড়া কালো হয়ে যাচ্ছে? জেনে নিন টিপস
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
টেকনাফে ১০ জন কৃষক অপহরণের ঘটনায় ২ জন আটক
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
এরদোয়ানের যুক্তরাষ্ট্র সফর, যা জানা গেলো
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!