X
সোমবার, ২৭ মে ২০২৪
১২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মৃত্যুদণ্ড ‘সিম্পটমের উপশম’, সমাধান নয়

উদিসা ইসলাম ও বাহাউদ্দিন ইমরান
১৩ অক্টোবর ২০২০, ০৯:০০আপডেট : ১৩ অক্টোবর ২০২০, ১২:৩৩

মৃত্যুদণ্ড ‘সিম্পটমের উপশম’, সমাধান নয় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড সংযোজন নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত মত দিচ্ছেন নারী অধিকারকর্মী ও আইনজীবীরা। পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে তারা বলছেন—কেবল সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড লিখে দিয়ে বিচার নিশ্চিত করা যাবে না। মৃত্যুদণ্ড ধর্ষণ সিম্পটমের উপশম, কিন্তু যে কারণে ধর্ষণ হয়—সেটি দূর করতে হলে দরকার সামাজিক আন্দোলন। আবার পক্ষে মত দিয়ে অনেকে বলছেন, সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রাখা হয়েছে—এটি প্রশংসনীয়। এতে অপরাধীর মধ্যে ভীতি সঞ্চারিত হবে। তবে উভয়পক্ষই ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন হওয়ার বিধান কার্যকর করতে পদক্ষেপ নেওয়ার বিষয়ে জোর দিচ্ছেন।

সোমবার (১২ অক্টোবর) মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর সচিবালয়ে প্রেস ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব খন্দকার আনোয়ারুল ইসলাম জানান, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন (সংশোধন) অধ্যাদেশ, ২০২০’ চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অধ্যাদেশে ধর্ষণের সর্বোচ্চ শাস্তি করা হয়েছে মৃত্যুদণ্ড। মামলা শুরু থেকে বিচার শেষ করতে হবে ছয় মাস বা ১৮০ দিনের মধ্যে। বিচারক বদলি হলেও মামলার ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। ব্রিফিংয়ে মন্ত্রিপরিষদ সচিব বলেন, ‘এ সংশোধনী শুধু আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে নয়, বিভিন্ন দেশের সার্বিক পরিস্থিতি আমরা দেখেছি, আমাদের বর্তমান পরিস্থিতিসহ সবকিছু মিলিয়েই এ সিদ্ধান্ত এসেছে। সরকারের পক্ষ থেকেও এটি আলোচনায় এসেছে। মানুষের সচেতনতাটাই গুরুত্বপূর্ণ।’

বেগমগঞ্জের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে গড়ে ওঠা মাঠের আন্দোলনে ‘ফাঁসি চাই’ স্লোগান দেওয়া হলেও মৃত্যুদণ্ড সমস্যার সমাধান করবে না বলে মনে করছেন নারী নেত্রীরা। তারা বলছেন, যেকোনও আন্দোলনের সময় শাস্তি চেয়ে স্লোগান দেওয়া হয়। সেখানে ‘ফাঁসি চাই’ একটা প্রতীকী অর্থও বটে। স্লোগানের ভাষাকে ধরে আইন পরিবর্তন হলে সেটা দুঃখজনক উল্লেখ করে নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশি কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ধর্ষণের মামলায় কেবল ফাঁসি আর যাবজ্জীবন অপশন থাকলে, রায় ভিকটিমের পক্ষে যাওয়ার সুযোগ কমে যায়। বর্তমানে যে মামলা তার মাত্র ৩ শতাংশের রায় হয় বলে আমরা জানি। অর্থাৎ ৯৭ শতাংশের বিচারই হয় না। আর সেসব রায়ের মাত্র দশমিক চার শতাংশ রায় ভিকটিমের পক্ষে আসে। সেই অংশটিও আমরা পাবো না। কেননা, মৃত্যুদণ্ড যদি সর্বোচ্চ বিধান হয়, তাহলে ধর্ষণের মামলায় সামান্য সন্দেহ থাকলেও আদালত সেটিকে সর্বোচ্চ শাস্তি দেবেন না।’ তিনি আরও বলেন, ‘সবচেয়ে ভয়াবহ যে শঙ্কাবোধ করছি তা হলো—ধর্ষক নির্যাতনের পর সাক্ষী নিশ্চিহ্ন করতে ভিকটিমকে হত্যার পথ বেছে নেবে।’

ধর্ষণকে সামাজিক ব্যাধি উল্লেখ করে নারী প্রগতি সংঘের নির্বাহী পরিচালক রোকেয়া কবীর বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পিতৃতন্ত্রে সবক্ষেত্রে পুরুষের আধিপত্য থাকে। নারীর প্রতি সবক্ষেত্রে বৈষম্য পরিলক্ষিত হয়। সেসব থিওরিটিক্যাল জায়গায় কথা না বলে, সমাধান না করে, কেবল সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড উল্লেখ করা ধর্ষণ কমাবে না। মৃত্যুদণ্ডকে সিম্পটমের উপশম হিসেবে দেখা যেতে পারে। কিন্তু এতে ধর্ষণের কারণটাতো দূর হচ্ছে না। সম্পদের উত্তরাধিকারে সমানাধিকার, সব বৈষম্য লোপ করতে হবে, নারীকে সমান নাগরিক হিসেবে দেখার জায়গায় কাজ করতে হবে।’

ধর্ষণের অপরাধে সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড রাখার সিদ্ধান্তকে প্রশংসনীয় উল্লেখ করে আইনজীবী ফাওজিয়া করিম ফিরোজ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কিন্তু আমি বলবো, এই আইন করার পাশাপাশি আইনের বাইরে বিচার দ্রুত করা নিয়ে আরও যেসব উদ্যোগ নিয়েছে, সেগুলো অবিলম্বে কার্যকর করতে হবে। আইনে একটানা বিচারের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু তার কার্যকারিতা না থাকায় একেকটি মামলা বছর বছর পড়ে আছে। এসব অপরাধের সঙ্গে প্রভাবশালীরাও জড়িত থাকে। তাই মামলার বিচার দ্রুত করার স্বার্থে শুধু সাজা না বাড়িয়ে, আনুষঙ্গিক প্রক্রিয়া হিসেবে ভিকটিম ও সাক্ষীর সুরক্ষা আইনের মাধ্যমে নিশ্চিত করাও জরুরি। এসব বিষয় নিশ্চিত করা গেলে বিচারটিও দ্রুততম সময়ে করা সম্ভব হবে।’

সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মোতাহার হোসেন সাজু বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ধর্ষণের সাজা মৃত্যুদণ্ড করা হলে হয়তো ভয়ের কারণে অপরাধের প্রবণতা কিছুটা কমে আসবে। তবে সাজা বাড়ানো ছাড়াও যারা ধর্ষক, তাদের জাতীয় পরিচয়পত্রে কোনও বিশেষ সিম্বল দেওয়া যায় কিনা, সেদিকে ভাবা যেতে পারে। এতে হয়তো অপরাধী ভয়ে থাকবে, সরকারি-বেসরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে তাদের কোনও চাকরি হবে না। বিচারক, প্রসিকিউশন ও আইনজীবীদের সদিচ্ছা থাকলে এসব মামলার দ্রুত বিচার করা সম্ভব হবে বলেও মনে করেন তিনি। 

২০০০ সালে করা নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ২০(২) নম্বর ধারা অনুযায়ী, মামলার বিচার শুরু হওয়ার পর একটানা চলতে হবে। আর ২০(৩) ধারা অনুযায়ী ১৮০ দিনের মধ্যে মামলার বিচার শেষ করতে হবে। এমনকি হাইকোর্টের দেওয়া নির্দেশনার আলোকেও ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার সম্পন্ন হওয়ার কথা। শুধু এই সময়সীমা নয়, নির্ধারিত সময়ের মধ্যে বিচার সম্পন্ন করতে না পারলে, তা এক মাসের মধ্যে লিখিতভাবে সুপ্রিম কোর্টকে জানানোর বিধান ও নির্দেশনা থাকলেও তা মানছেন না কেউই। আইনজীবী ফাওজিয়া করীম মনে করেন, এই জায়গাতে কাজ হওয়া খুব জরুরি। না হলে আইনের সংশোধনীটা খুব বেশি কার্যকর হবে না।

/এপিএইচ/আপ-এনএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
যুক্তরাজ্যের এমপি হতে লেবারের হয়ে লড়বেন আরেক ব্রিটিশ বাংলাদেশি
যুক্তরাজ্যের এমপি হতে লেবারের হয়ে লড়বেন আরেক ব্রিটিশ বাংলাদেশি
ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চট্টগ্রামের ১২ হাজার মানুষ
ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয়কেন্দ্রে চট্টগ্রামের ১২ হাজার মানুষ
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরও অভিযোগ দুদকে
ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতির আরও অভিযোগ দুদকে
লক্ষ্মীপুর উপকূলের ২০ গ্রাম প্লাবিত
লক্ষ্মীপুর উপকূলের ২০ গ্রাম প্লাবিত
সর্বাধিক পঠিত
ঘূর্ণিঝড় রিমাল: পায়রা ও মোংলায় ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত
ঘূর্ণিঝড় রিমাল: পায়রা ও মোংলায় ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত
জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেলো সুন্দরবন
জলোচ্ছ্বাসে তলিয়ে গেলো সুন্দরবন
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ নিয়ে যা বললেন শিক্ষামন্ত্রী
শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ নিয়ে যা বললেন শিক্ষামন্ত্রী
কখন উপকূল অতিক্রম করতে পারে ‘রিমাল’?
কখন উপকূল অতিক্রম করতে পারে ‘রিমাল’?
ধানমন্ডিতে হকারদের সড়ক অবরোধ
ধানমন্ডিতে হকারদের সড়ক অবরোধ