X
রবিবার, ২৯ জুন ২০২৫
১৫ আষাঢ় ১৪৩২

৬ মামলায় মৃত্যুদণ্ড নিয়েই পালিয়ে বেড়াচ্ছে সেই জিয়া

নুরুজ্জামান লাবু
২১ ডিসেম্বর ২০২১, ২২:৩০আপডেট : ২২ ডিসেম্বর ২০২১, ১৫:০৮

সেনাবাহিনী থেকে বহিষ্কৃত মেজর সৈয়দ জিয়াউল হক ওরফে মেজর জিয়ার পলাতক জীবন শুরু ২০১১ সালে। এরপর পেরিয়ে গেছে একদশকেরও বেশি সময়। পলাতক থেকেই বাংলাদেশের নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসারুল্লাহ বাংলা টিম ও আনসার আল ইসলামের সামরিক কমান্ডার হিসেবে নেতৃত্ব দিয়ে আসছে। ২০১৩ থেকে ২০১৬ পর্যন্ত একাধিক টার্গেট কিলিংয়ের সঙ্গে জড়িত সে। তার বিরুদ্ধে মোট ১১টি মামলা হয়েছে। এর মধ্যে ব্লগার রাজীব হায়দার, অভিজিৎ রায়, নিলাদ্রী নিলয় ও জুলহাজ-তনয় হত্যাকাণ্ডসহ ছয়টিতে আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। কিন্তু এত বছরেও তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে না কেন?

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা মনে করেন, জিয়া অত্যন্ত চতুর, তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারে দক্ষ এবং শারীরিক গঠনেও অনেক শক্তিশালী। সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসার ছিল সে। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ ফাঁকি দেওয়া তার কাছে সহজ। দুর্গম এলাকায় অবস্থান করাটা তার জন্য কঠিন নয়। সে হিসাব-নিকাশ করে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলে। তবুও কয়েকবার তার অবস্থান শনাক্ত করা হয়েছিল। একাধিক স্থানে অভিযানও চালায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। কিন্তু তাকে ধরা যায়নি।

সোমবার (২০ ডিসেম্বর) মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের রিওয়ার্ডস ফর জাস্টিস বিভাগ থেকে জিয়াকে ধরিয়ে দিতে ৫০ লাখ ডলার পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে, বাংলাদেশি মুদ্রায় যার পরিমাণ প্রায় ৪৪ কোটি টাকা। পুরস্কারটি ঘোষণার পর আবারও আলোচনায় এসেছে জিয়ার নাম। অবশ্য ২০১৬ সালের ২ আগস্ট বাংলাদেশের পুলিশ সদর দফতর থেকেও তাকে ধরিয়ে দিতে ২০ লাখ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছিল।

জিয়ার বিরুদ্ধে দায়ের হওয়া বেশিরভাগ মামলা তদন্ত করেছে জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে পুলিশের বিশেষায়িত সংস্থা কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)। এর প্রধান ও ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘আমরা জিয়াকে গ্রেফতার করতে দীর্ঘদিন ধরেই চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। আমাদের নিয়মিত গোয়েন্দা নজরদারি চলছে। আমাদের এই প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকবে।’

ব্যর্থ অভ্যুত্থান চেষ্টার পর ২০১১ সালের ডিসেম্বরে জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে চাকরিচ্যুত করা হয়। এরপর পলাতক থেকেই সে প্রথম দিকে নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হিযবুত তাহরীরের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়। পরবর্তীকালে ‘জঙ্গিগুরু’ হিসেবে খ্যাত ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের আধ্যাত্মিক নেতা জসিম উদ্দিন রাহমানীর হাত ধরে এই সংগঠনের সামরিক কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব নেয়। আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হলে এর নেতাকর্মীরা নিজেদের আনসার আল ইসলাম বলে ঘোষণা দেয়। পরে আনসার আল ইসলামও নিষিদ্ধ করে সরকার। আনসার আল ইসলাম আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখার (একিউআইএস) সঙ্গে সম্পৃক্ত।

জঙ্গি প্রতিরোধে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা বলছেন, আনসার আল ইসলাম সদস্যদের বেশিরভাগই উচ্চ-শিক্ষিত এবং তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। জিয়া নিজেও তথ্য-প্রযুক্তি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। সেনাবাহিনীর বিশেষ প্যারাকমান্ডো দলের শীর্ষ কর্মকর্তা ছিল সে। জঙ্গি সংগঠনে যুক্ত হয়ে সে সদস্যদের নিয়মিত প্রশিক্ষণ দিয়ে আরও দক্ষ করে তুলেছিল।

সিটিটিসি’র একজন কর্মকর্তা বলছিলেন, কয়েক বছর আগে তারা চট্টগ্রাম থেকে ইয়ামিন নামে আনসার আল ইসলামের একজন সদস্যকে গ্রেফতার করেছিলেন। এরপর ইয়ামীন তাদের জানায়, ছয় মাস আগে (গ্রেফতারের ছয় মাস আগে) জিয়ার সঙ্গে তার চট্টগ্রামে দেখা হয়েছিল। এরপর থেকে জিয়ার আর কোনও অবস্থান শনাক্ত করতে পারেনি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনও সংস্থা।

পুলিশের এই কর্মকর্তা জানান, জিয়া অত্যন্ত ধূর্ত প্রকৃতির। সে সংগঠনের সদস্যদের সঙ্গেও সিক্রেট অ্যাপসের মাধ্যমে ভিন্ন ভিন্ন নামে যোগাযোগ করে। যোগাযোগের ভাষাও থাকে বিভিন্ন কোডভিত্তিক। ফলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা জিয়ার সহযোগী বা আনসার আল ইসলামের একাধিক সদস্যদের গ্রেফতার করলেও জিয়া পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি। কেউ গ্রেফতার হলেই জিয়ার কাছে বার্তা পৌঁছে যায়। এছাড়া জিয়া এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যাওয়ার আগে একাধিকবার নিজের ইন্টেল সদস্যদের মাধ্যমে জায়গাটি রেকি করায়। এভাবে শতভাগ নিশ্চিত হয়েই জিয়া সেদিকে পা বাড়ায়।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তাদের তথ্যানুযায়ী, ২০১৩ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত রাজধানী ঢাকায় সব টার্গেট কিলিংয়ের ঘটনাস্থলে জিয়া সশরীরে উপস্থিত ছিল। সংগঠনের আসকারী গ্রুপের সদস্যরা হামলায় অংশ নেয় আর ইন্টেল গ্রুপের সদস্যরা আশেপাশে অবস্থান করে। জিয়া ঘটনাস্থলের পাশে উপস্থিত থেকে পুরো বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দিতেন। 

র‌্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ‘জিয়াকে ধরতে আমরাও প্রতিনিয়ত গোয়েন্দা নজরদারি চালাচ্ছি। কিন্তু তার অবস্থানের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনও তথ্য আমাদের কাছে নেই। আমরা অন্যান্য সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করছি।’

জিয়া কি এখনও সক্রিয়?

২০১৬ সালের পর থেকে আনসার আল ইসলামের পক্ষ থেকে হামলার কোনও তথ্য পাওয়া না গেলেও এই সংগঠন ভেতরে ভেতরে সংগঠিত হচ্ছে বলে ধারণা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। তাদের মতে, গত কয়েক বছরে কোনও হামলা হয়নি বলে আনসার আল ইসলাম বা জিয়া নিষ্ক্রিয় হয়ে গেছে তা বলা যাবে না। পলাতক থেকেই জিয়া সংগঠনে এখনও সক্রিয় নেতা হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে। তবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর টানা অভিযানে খুব ধীরগতিতে কাজ করছে আনসার আল ইসলাম।

সিটিটিসি’র একজন কর্মকর্তা জানান, তারা এখনও সংগঠনের বিভিন্ন সিক্রেট অ্যাপসে জিয়ার সরব উপস্থিতি পাচ্ছেন। তবে ছদ্মনাম ব্যবহার করায় সেই ব্যক্তি জিয়াই কিনা তা নিয়ে শতভাগ নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে কমান্ডিং বার্তাসহ জিজ্ঞাসাবাদে প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে তাকে সক্রিয় বলেই ধরে নিতে চান ওই কর্মকর্তা।

আনসার আল ইসলাম প্রতিনিয়ত নিত্য-নতুন কৌশলে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে বলে মনে করেন পুলিশের এই কর্মকর্তা। তার মন্তব্য, কাট-আউট বা স্লিপার সেল পদ্ধতি ছাড়াও তারা এখন অনলাইন ভিত্তিক প্রচারণা এবং হিজরতের উদ্দেশে বাসা থেকে বের না হওয়ার পরামর্শ দিচ্ছে সদস্যদের। প্রয়োজনে যেকোনও সময় তাদের ভাষায় দাওয়ার কাজে বের হওয়ার জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকতে বলা হচ্ছে।

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানান, জিয়াকে ধরাটাই তাদের জন্য এখন বড় চ্যালেঞ্জ। তাকে ধরতে না পারলে আনসার আল ইসলামকে নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না। যদিও আনসার আল ইসলাম আপাতত হামলা বা টার্গেট কিলিং থেকে সরে এসেছে। কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে তারা আবারও আতঙ্ক ছড়িয়ে মাঠে নামতে পারে।

জঙ্গিবাদ প্রতিরোধে পুলিশের আরেক বিশেষায়িত ইউনিট এন্টি টেরোরিজম ইউনিটের পুলিশ সুপার (ইন্টেল) হাসানুল জাহিদ বলেন, ‘জিয়াকে ধরতে আমরা চেষ্টা করছি। সাম্প্রতিক সময়ে আনসার আল ইসলামের অনেক সদস্যকেই গ্রেফতার করা হয়েছে। কিন্তু তাদের কাছ থেকে জিয়ার কোনও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে, জিয়া সংগঠনের শীর্ষপর্যায়ের নেতা ছাড়া সাধারণ সদস্যদের সঙ্গে যোগাযোগ করছে না।’

/জেএইচ/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নেতানিয়াহুর দুর্নীতি মামলায় ইসরায়েলি প্রসিকিউটরদের তীব্র সমালোচনা ট্রাম্পের
নেতানিয়াহুর দুর্নীতি মামলায় ইসরায়েলি প্রসিকিউটরদের তীব্র সমালোচনা ট্রাম্পের
চরম অচলাবস্থায় বাণিজ্য, প্রতিদিন ২৫০০ কোটি টাকার ক্ষতির শঙ্কা
আজও এনবিআরে ‘কমপ্লিট শাটডাউন’চরম অচলাবস্থায় বাণিজ্য, প্রতিদিন ২৫০০ কোটি টাকার ক্ষতির শঙ্কা
বজ্রঝড়ের পর ৯ মিনিটের গোল উৎসবে কোয়ার্টার ফাইনালে চেলসি
বজ্রঝড়ের পর ৯ মিনিটের গোল উৎসবে কোয়ার্টার ফাইনালে চেলসি
শ্রমিক দল নেতার বিরুদ্ধে গ্রাম পুলিশকে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ  
শ্রমিক দল নেতার বিরুদ্ধে গ্রাম পুলিশকে পিটিয়ে হাত ভেঙে দেওয়ার অভিযোগ  
সর্বাধিক পঠিত
খুলনা প্রেসক্লাবে প্রেস সচিবকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ
খুলনা প্রেসক্লাবে প্রেস সচিবকে ঘেরাও করে বিক্ষোভ
বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিলেন অফিস সহকারী হয়ে, বেরোলেন এমবিএ’র সনদ নিয়ে
বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকেছিলেন অফিস সহকারী হয়ে, বেরোলেন এমবিএ’র সনদ নিয়ে
সরকারি গাড়িতে দাওয়াতে গেলো ইউএনও’র পরিবার
সরকারি গাড়িতে দাওয়াতে গেলো ইউএনও’র পরিবার
মুরাদনগরে গলায় ছুরি ধরে নারীকে ধর্ষণ, থানায় মামলা
মুরাদনগরে গলায় ছুরি ধরে নারীকে ধর্ষণ, থানায় মামলা
‘সরকার দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ না করলে আন্দোলন ঘোষণা করবো’
‘সরকার দেশবিরোধী কর্মকাণ্ড বন্ধ না করলে আন্দোলন ঘোষণা করবো’