X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

ছোট হরিণার পথে পথে...

ফারুখ আহমেদ
০২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৪:০৫আপডেট : ০২ সেপ্টেম্বর ২০১৬, ১৪:০৫
image

শুভলং বাজার। হাটবার বলে  নানান রকম পসরা নিয়ে বসেছেন বিক্রেতারা। বিক্রেতা আর ক্রেতার হাঁকডাকে এলাকা মুখরিত। তরমুজ বিক্রি হচ্ছে দেদার। পাশেই এক ফল বিক্রেতা ফল বিক্রি করছেন আর অনেকেই হুমরি খেয়ে তার বিক্রি দেখছেন। কেউ কেউ কিনেও নিচ্ছেন। আমরা কাছে গিয়ে চোখে-মুখে বিস্ময় নিয়ে সে ফল দেখলে বিক্রেতা আমাদের মুফতে কিছু ফল ধরিয়ে দিয়ে বললেন, ‘খায়া দেহেন, ভাল না হইলে নিয়েন না।’ টক মিষ্টির অদ্ভুত স্বাদের ফল, এমন ফল আগে কখনও দেখিনি বা খাইনি। কামড়ে খাওয়ার কিছু নেই, ফলটির উপরের চামড়া ছিলে অনেকটা লটকনের মতো খেতে হয়। আমরা যারপরনাই সে ফলের স্বাদে মজলাম। ফলের কিন্তু মজার ব্যাপার হচ্ছে স্থানীয়রা কেউ ফলের নাম বলতে পারলেন না!

কী আর করা! আমরা শুভলং বাজার থেকে বরকলের দিকে বজরা ভাসালাম। আমাদের আপাতত গন্তব্য বাঙালটিলা, ভূষণছড়া হয়ে ছোট হরিণা। ঠেগামুখ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী শেষ বাজার হলেও ঠেগামুখ পর্যন্ত যাওয়া যায় না বা বিজিবির অনুমতি পাওয়া যায় না বিধায় অনেকেই মনে করেন ছোট হরিণাই বাংলাদেশ ভারতের মিজোরাম সীমান্তবর্তী শেষ বাজার বা পাহাড়ি জনপদ। কর্ণফুলী নদীতে ভেসে আমাদের নয়জনের দল মিল্টন চাকমার বজরায় চেপে সেদিকেই চললাম, ছোট হরিণায়!

ছোট হরিণার পথে পথে

আমরা যাত্রা শুরু করেছি রাঙামাটির সমতা ঘাট থেকে রির্জাভ বজরায়। শুরুতে হিমেল হাওয়ার প্রলেপ থাকলেও দিন বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রচণ্ড রোদের সঙ্গে প্রচণ্ড তাপদাহ সঙ্গী হয়। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কিছু গ্রাম মানুষজন আর বাঁশের ভেলা দেখে দেখে এক সময় আমাদের ট্রলার বরকল পৌঁছলো। আমাদের ট্রলার দেখে বরকল বিজিবির সদস্যরা এগিয়ে এসে আমাদের পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর হাফ ছেড়ে বাঁচলেন। কারণ আমরা এক ঘন্টা দেরিতে গিয়েছি, সেজন্য তাদের মধ্যে অস্থিরতা কাজ করছিল। বরকল উপজেলার বাজার এটা। আবার এটা বিজিবি চেকপোস্ট বা চৌকিও বটে। আমরা বাজার ঘুরে চকোরিয়ার এক পরিবারের ঘরে দুপুরের খাবার খেতে বসলাম। যখন আমরা বরকল ছাড়ি তখন বেলা প্রায় আড়াইটা।

টক মিষ্টি স্বাদের ফল

ছোট হরিণার পথে পথে

বরকল ছাড়তেই সামনে ছোট্ট একটা দ্বীপের মত চোখে পড়ল। একটা ছোট্ট বৌদ্ধমন্দির রয়েছে সেখানে। মিল্টন যায়গাটা সম্পর্কে কোনও ধারণা দিতে পারলো না। আমরাও নামতে পারলাম না সময় ছিল না বলে। সন্ধ্যার আগে আমরা ছোট হরিণা পৌঁছবো, সে লক্ষ্যে মিল্টনকে বজরার গতি বাড়াতে বলি। কর্ণফুলির এই অংশে কোনও বসতি চোখে পড়ল না, শুধু জঙ্গল। রোদ পড়ে এলে আমরাও বজরার ছাদে চড়ে বসি। এবার শুধু দৃশ্য অবলোকন আর অনুভব। পাশের জঙ্গল দেখে মিল্টনকে আনিচ মুন্সির প্রশ্ন ‘এ বনের নাম কি?’ নির্লিপ্ত ভাবে মিল্টনের জবাব, ‘জানি না।’

চশমা পরা হনুমান

এ জঙ্গলে কি আছে আমরা জানি না। কিন্তু হঠাৎ আরমানের ভেতর চঞ্চলতা দেখে আমি ক্যামেরা বের করে গলুইয়ের কাছে গিয়ে বসতেই দেখি গাছে গাছে সব বিলুপ্তপ্রায় চশমা পড়া হনুমান। তারা লাফাচ্ছে আর একে অপরের সঙ্গে খুনসুটি করে  চলেছে। আমার ভ্রমণসঙ্গীরা আমাকে আর আরমানকে ছবি তোলার সুযোগ করে দিতে চুপ করে গেল, আর আমরা ক্লিক করতে থাকলাম। কিছুক্ষণের মধ্যে জঙ্গলের পাশের গা ছমছমে ভাব শেষ হলে চশমা পড়া হনুমানদলের লাফালাফিও আড়াল হয়ে গেল। আমরা একসময় চলে আসি বাঙালটিলা।

ছোট হরিণার পথে পথে...

দুপুরে বরকলবাজারের প্রায় সব খাবারের দোকান বন্ধ ছিল। সে অর্থে সেখানে আমাদের খাওয়া হয়নি। বাঙালটিলা বাজার দেখে আমাদের পেট মোচড় দিয়ে উঠলো। বজরার পপুলার সেফট ভেঙ্গে যাওয়ায় বাধ্যতাও ছিল এখানে বজরা থামাবার। আমরা বাঙালটিলায় নামি। বাঙালটিলায় সত্যি সত্যি বাঙালিদের বসবাস। এমন নির্জন লোকালয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কাউকে চোখে পড়লো না। তবে জানা গেল বাঙালটিলা নামটি বাঙালিদের কারণে হয়নি। বহু আগে এখানে বাঙাল নামের এক চাকমা কারবারি ছিল, তার নাম অনুসারেই লোকালয়ের নাম বাঙালটিলা।

বরকল ছাড়তেই চোখে পড়বে এই ছোট্ট বৌদ্ধমন্দির

ছোট হরিণার পথে পথে...

কথা হয় স্থানীয় তপন বোসের সঙ্গে। তার কাছেই জানতে পারি ছোট হরিণা আর ঘন্টাখানেকের পথ, একটু এগিয়ে বাঙালটিলা গ্রাম দেখি। এরপর যখন আমাদের যাত্রা শুরু হয়, তখন সোনারোদ আকাশে ছড়িয়েছে। সন্ধ্যা নামছে পাহাড়ে, কমছে আলো। তাপমাত্রাও কমে এসে ঠাণ্ডা বাতাসের পরশ বুলিয়ে দিচ্ছে। কিছু দূর আসতেই একটা গাছে ঝাঁকে ঝাঁকে কালো মাথা কাস্তেচেরা পাখিদের ল্যান্ডিং করতে দেখা যায়, কি অভূতপূর্ব দৃশ্য! সে দৃশ্যে চোখ ফেরে না, ক্যামেরার সাটার চলতেই থাকে। চলতে থাকে বজরা। এভাবেই কোথাও না থেমে মাঝেমধ্যে নদীতে পানি কম থাকার কারণে বজরা ঠেলে ঠেলে আমরা শেষ পর্যন্ত ছোট হরিণা পৌঁছলাম।

ছোট হরিণা

এক পাশে পাহাড় আর মাঝে কর্ণফুলী নদীর তীরবর্তী পাহাড়ি জনপদ ছোট হরিণা এক কথায় অসাধারণ। ছোট হরিণা বাজারটি খুব বড় নয়। পাঁচ মিনিট হাঁটলেই দেখা শেষ হয়ে যায়। দুপুরের পর থেকে প্রায় তিন ঘন্টা বাজার বন্ধ থাকে। বিদ্যুৎ বলতে জেনারেটর, সেও সন্ধ্যে ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত। বাকি সময় চলে সোলারে। ঠেগামুখের আগে এটাই এই এলাকার শেষ জনবসতি। আমরা এখানে বিজিবি সদস্যদের অভ্যর্থনা পাই। জোন কমান্ডার ল্যাফটেনেন্ট কর্ণেল ফেরদৌসের মাধ্যমে আমাদের সবার তথ্য ছোট হরিণা পৌঁছে গিয়েছিল। সাজানো গোছানো খুব সুন্দর ছোট হরিণা আর ভূষণছড়ার গল্প বলে শেষ করা যাবে না। মনে থাকবে বিজিবির জোন কমান্ডার থেকে শুরু করে নায়েক রহমতসহ প্রতিটি সদস্যের আন্তরিক সহযোগিতার কথা, সঙ্গে মনে থাকবে বিজিবির মেডিক্যাল অফিসার ক্যাপ্টেন সজীবকে এবং অবশ্যই স্থানীয় বাথুয়া রাখাইনকে। বাথুয়াদা’র ঘরের রান্না আর তার আতিথেয়তার গল্প অনেক!

ছোট হরিণার গোধূলিবেলা

প্রয়োজনীয় তথ্য

ছোট হরিণা যাওয়ার এখনই সময়। নদী পথই ছোট হরিণা যাওবার একমাত্র পথ। রাঙামাটি থেকে ছোট হরিণা পর্যন্ত লঞ্চ সার্ভিস রয়েছে। সমতাঘাট থেকে রিজার্ভ ট্রলার ভাড়া নিতে পারেন অথবা লঞ্চে চলে যেতে পারেন। প্রতিদিন রাঙামাটি থেকে ছোট হরিণার উদ্দেশ্যে সকাল সাড়ে সাতটা ও দুপুর বারোটায় লঞ্চ ছেড়ে যায়। পাহাড় ও কর্ণফুলীর সৌন্দর্য দেখতে দেখতে চলে যান ছোট হরিণা। ছোট হরিণায় টাটকা মাছের সঙ্গে দেশি মুরগী অবশ্যই ভালো খাবার বলতে হবে, তবে থাকার ব্যবস্থা ভালো না। রাত্রিযাপনের জন্য ছোট হরিণার বিদ্যুৎ ও টয়লেটবিহীন রেস্ট হাউসের ছোট্ট ঘরই একমাত্র ভরসা। দু’তিনটা খাবারের হোটেল থাকলেও আগে থেকে ফরমায়েশ না দিলে খাবার পাবেন না। তবে খাওয়া-দাওয়ার জন্য আপনি বাথুয়া রাখাইনের উপরই ভরসা করতেই পারেন।

ছবি: লেখক

 

/এনএ/

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ এপ্রিল, ২০২৪)
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
রাজশাহীতে গরমে নাকাল প্রাণিকুল, মারা যাচ্ছে পাখি
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
দুর্নীতির অভিযোগে ইসলামপুর পৌর মেয়র বরখাস্ত
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
মাটি কাটার সময় ‘গরমে অসুস্থ হয়ে’ নারী শ্রমিকের মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
‘পুলিশ’ স্টিকার লাগানো গাড়িতে অভিযান চালাবে পুলিশ
আজ কি বৃষ্টি হবে?
আজ কি বৃষ্টি হবে?
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
জালিয়াতির মামলায় সাবেক ব্যাংক কর্মকর্তার ২৬ বছরের কারাদণ্ড
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
মঙ্গলবার দুই বিভাগের সব, তিন বিভাগের আংশিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে
এসি কেনার আগে মনে রাখতে হবে এই ৭ বিষয়
এসি কেনার আগে মনে রাখতে হবে এই ৭ বিষয়