X
বৃহস্পতিবার, ২৬ জুন ২০২৫
১২ আষাঢ় ১৪৩২

ঠাকুরগাঁওয়ের ঐতিহ্য ধামের গান

সামিউল্যাহ সমরাট
১৩ নভেম্বর ২০১৬, ১৯:৩১আপডেট : ১৩ নভেম্বর ২০১৬, ১৯:৩৮
image

হাউসের বিহাই-অঙ্গিলা বিহানী, হিরাসরি-আজলা, আম্বলসরি-পিছলা বাউধিয়া, হলদিসরি-সোনাইফাত্রা, জলসরি-জুলুম আলসিয়া, পাশ করা কামাইল, সাইকেল সরি-হ্যান্ডেল বাউধিয়া,চালাকিসরি–থুবড়াঘুচা, দশ নাম্বার আঢি হাকু দাকু অধিকারী, এমনি হরেক নামের সাথে যোগ হয়েছে ‘বউমার মিসকল!’ এই নামগুলো ধামের গানের একেকটি গল্প বা পালার নাম।  

ধামের গান

ধামের গান ঠাকুরগাঁও পঞ্চগড় অঞ্চলের জীবন্ত লোকাচার বা লোকনাট্যের প্রকরণ। কালের গর্ভে এখন যা হারিয়ে যায়নি। গ্রামীণ জীবনে এখনও জনপ্রিয়তা নিয়ে সকল ধর্মের সাধারণ মানুষের বিনোদনের খোরাক হিসেবে সদর্পে টিকে আছে ধামের গান। ধাম শব্দের অর্থ স্থান বা আশ্রয়স্থল। হেমন্তে এই অঞ্চলে শুরু হওয়া ধামের গানের উৎসব চলে শীতের শুরু পর্যন্ত।
নতুন ফসল ঘরে তোলার আনন্দ উদযাপনের একটি মাধ্যম এই ধামের গান। সাধারণত ধান কাটা হয়ে গেলে আর ধামের আসর বসে না। আরও কয়েকটি নাম রয়েছে ঐতিহ্যবাহী এই গানের। ধান মাড়াইয়ের সাথে মিল থাকার কারণে কোথাও কোথাও এর নাম মারাঘুরা গান, পালা করে গাওয়া হয় বলে পালাটিয়া গান, কালীপূজার (হোলি) সময় অনুষ্ঠিত হয় বলে হুলিগান, দেবীর ধামের গান, লক্ষ্মীর ধামের গান নামেও অভিহিত করা হয়।    

ঠাকুরগাঁও জেলার পাঁচটি উপজেলায় প্রায় ৬০০ শ’র বেশি ধাম বসে। বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার চাড়োল খোকো পাড়া, পতিলাভাষা, ভাণ্ডার রানী দেবধাম, ফুটানি বাজার, বগাদিঘী, বড়পুল, ডাক্তার পাড়া, হরি ভিটা, লাহিড়ী ধাম, পীরগঞ্জ উপজেলার মিত্রবাটি, বাঁশগাড়া, দস্তমপুর, মাটিয়ানি, আগ্রা গড়িনাবাড়ি, দানাজপুর, শীতলপুর, বিশ্বাসপুর সদর উপজেলার আকচা, রায়পুর, রহিমানপুরসহ অন্যান্য ইউনিয়নে রয়েছে চার শতাধিক ধাম। এছাড়াও পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলায় রয়েছে বেশকিছু ধামের গানের দল।

পুরুষরাই নারী সেজে অভিনয় করেন
ধামের গান এই অঞ্চলের আঞ্চলিক ভাষায় ‘ধামের গাউন' নামে পরিচিত। এ গানের সংলাপ হয় সংক্ষিপ্ত আর ভাষা সম্পূর্ণ আঞ্চলিক। সংলাপ গদ্যেও হয় আবার গানেও হয়। গানের আধিক্যের কারণেই এর নামের শেষে গান যুক্ত করা হয়েছে। দৈনন্দিন জীবনযাপনের নানা বিষয় নিয়ে তৈরি হয় নাটকের গল্প ও গান। এই গল্পে যেমন থাকে প্রান্তিক খেটে খাওয়া মানুষের আনন্দ উপাখ্যান, তেমনি থাকে নানা  দুঃখ বেদনার উপস্থাপন। প্রেম-পরকীয়া, মহাজনের শোষণ, সাংসারিক নানা টানাপড়েন অত্যন্ত সরল সহজ ভাবে উঠে আসে প্রতিটি গল্পে। জটিল বিষয়গুলোকেও হাস্যরসের মাধ্যমে চিত্তাকর্ষক করে তোলা হয় অভিনয়ের মাধ্যমে। গল্পগুলো মূলত নায়িকাকেন্দ্রিক। এক একটি গল্পে তৈরি লোকনাট্যকে আলাদাভাবে  পালা  হিসেবে উল্লেখ করা হয়ে থাকে। আর একরাতে তিন-চারটি পালা অনুষ্ঠিত হয়। পালাগুলোর ব্যাপ্তি গল্পভেদে এক ঘণ্টা থেকে দেড়-দুই ঘণ্টা পর্যন্ত হয়ে থাকে। একেকটি দল এসে একেক পালা পরিবেশন করে। পালার দলগুলোর নাম হয় তাদের গ্রাম বা পাড়ার নামে। যেমন কচুবাড়ি পালাটিয়া দল, চুচুলি বটতলী পালাটিয়া দল, বালাভীর গোয়ালপাড়া পালাটিয়া দল। কখনও কখনও ধামের গানের আসর একটানা সাতদিন পর্যন্ত চলে।
পালার নামকরণের ক্ষেত্রে গল্পের নায়ক নায়িকার নামকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। আর নায়ক নায়িকার নামগুলোও রাখা হয় বেশ কৌতুকপূর্ণভাবে। নামের প্রথম অংশ নায়িকার নাম এবং শেষ অংশ নায়কের নামানুসারে রাখা হয়। নায়িকার নামের শেষে 'সরি' যুক্ত করা হয়। ধামের গানের মূল বৈশিষ্ট্য হলো এখানে কোনও নারী অভিনয় করেন না! পুরুষরাই নারী সেজে অভিনয় করেন। সেই সাজে থাকে একেবারে গ্রামীণ ছোঁয়া। লম্বা চুলের বেণি, খোঁপা, ঝুঁটি, চুলে লাল ফিতা, কানে দুল, নাকে নাকফুল, মুখে অত্যন্ত সাধারণ মেকআপ। ধামের গানে দেশীয় বাদ্যযন্ত্র যেমন ঢোল, খঞ্জনি, একতারা, খোল, বাঁশি, হারমোনিয়াম এসবই ব্যবহার করা হয়। মঞ্চের মাঝখানে যন্ত্রীরা বৃত্তাকারে বসে থাকেন। কুশীলবরা উঠে দাঁড়িয়ে ঘুরে ঘুরে অভিনয় করেন। মাঝে মাঝে যন্ত্রীরাই তাৎক্ষণিক নতুন সংলাপের সূচনা করেন।

সাধারণত বাড়ির পাশের নির্দিষ্ট কোনও স্থান উঁচু করে মাটির ঢিবি তৈরি করে, কোনও মন্দির চত্বরে কিংবা বড় কোনও গাছের গোড়ায় মঞ্চ বানানো হয়। এই মঞ্চে তেমন কোন আড়ম্বর থাকে না। সস্তা শামিয়ানা অথবা পুরনো শাড়ির ছাউনি টাঙিয়ে পরিবেশন করা হয় ধামের গান। রঙিন কাগজ কেটে নকশা করে সাজানো হয় মঞ্চের প্রবেশপথ ও চারপাশ। দিন ছাড়াও রাতের বেলায় হারিকেন কিংবা হ্যাজাক লাইটের আলোয় রাতভর এই গানের উৎসব চলে। অবশ্য এখন গ্রামেগঞ্জে বিদ্যুতায়নের বদৌলতে হারিকেন আর হ্যাজাকের ব্যবহার নেই বললেই চলে। মঞ্চের চারপাশে মাটিতে বিছানো খড়ে বসে বা দাঁড়িয়ে দর্শক এই গান উপভোগ করেন। বাঁশের তৈরি আলাদা বেড়া দিয়ে মহিলা দর্শকদের বসার ব্যবস্থা থাকে। মঞ্চ ঘিরে রকমারি খাবারের দোকান বসে ছোট খাট মেলায় রূপ নেয়।

ধামের গান ধামের গান
ধামের গানের আয়োজন করে থাকেন স্থানীয়রাই। কখনও সবাই চাঁদা তুলে আবার কখনও অবস্থাসম্পন্ন গেরস্থের একক ব্যবস্থাপনায় আসর বসানো হয়। যদিও মূল অভিনেতারা গাঁয়েরই সাধারণ মানুষজন। কিন্তু অনেক সময় দূরের গ্রাম থেকে পেশাদার অভিনেতাও ডেকে আনা হয়। সেক্ষেত্রে নামমাত্র পারিশ্রমিক দেওয়ার নিয়ম রয়েছে। অনেক ক্ষেত্রে আয়োজকরা প্রতিযোগিতার আয়োজনও করে থাকেন। এক একটি পালার অভিনেতারা দলভুক্ত হিসেবে এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেন। প্রতিটি দলের অভিনয়ের মান বিচার করেন আয়োজকরাই। পুরস্কারও দেওয়া হয় দলগতভাবে। পুরস্কার হিসেবে টেলিভিশন, বাইসাইকেল, গাভী, ছাগল অনেকে ক্ষেত্রে নগদ টাকাও দেওয়া হয়।
ধামের গানের উৎপত্তি ঠিক কবে হয়েছে এ সম্পর্কে সঠিক কোনও তথ্য পাওয়া না গেলেও লোক গবেষক ও শিক্ষাবিদ মনতোষ কুমার দে জানালেন, কয়েকশত বছর আগে থেকে ধামের গান উদযাপন করে আসছে এই এলাকার মানুষ। পার্শ্ববর্তী জলপাইগুঁড়ি কুচবিহার এলাকায় ধামের গানের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ এক ধরনের লোকনাট্য রয়েছে । তবে সেটার পরিবেশনের ধরন আলাদা। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা ছাড়াই ধামের গান চলে আসছে বছরের পর বছর। এটি এখনও বিবর্ণ হয়নি। বরং আধুনিকতার মিশেলে আরও  হৃদয়গ্রাহী করে উপস্থাপন করা হচ্ছে। যদিও আজকাল যাত্রাগানের কিছু কিছু উপাদান ধামের গানে অনুপ্রবেশ করে এর স্বকীয়তাকে নষ্ট করছে। বাদ্যযন্ত্রেও ঢুকে পড়েছে পাশ্চাত্য উপকরণ। তবে ধামের গান মানুষের সাথে সরাসরি একটা যোগাযোগ তৈরি করে দেয় বলে এর উপযোগিতা কমেনি এখনও।

/এনএ/          

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ঘরে ভ্যাপসা গন্ধ? দূর করার ৬ উপায় জেনে নিন
ঘরে ভ্যাপসা গন্ধ? দূর করার ৬ উপায় জেনে নিন
খাগড়াছড়িতে এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রের আশপাশে ১৪৪ ধারা জারিসহ ৬ নির্দেশনা
খাগড়াছড়িতে এইচএসসি পরীক্ষা কেন্দ্রের আশপাশে ১৪৪ ধারা জারিসহ ৬ নির্দেশনা
দিনের শুরুতে এবাদতের বিদায়ে পড়লো নবম উইকেট
দিনের শুরুতে এবাদতের বিদায়ে পড়লো নবম উইকেট
বৈশ্বিক অনুদান কমায় রোহিঙ্গা শিশুদের পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
বৈশ্বিক অনুদান কমায় রোহিঙ্গা শিশুদের পড়ালেখার ক্ষতি হচ্ছে: হিউম্যান রাইটস ওয়াচ
সর্বাধিক পঠিত
যে কারণে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী টিটুকে সরিয়ে দিলেন ট্রাইব্যুনাল
যে কারণে শেখ হাসিনার পক্ষে রাষ্ট্রনিযুক্ত আইনজীবী টিটুকে সরিয়ে দিলেন ট্রাইব্যুনাল
রাইস কুকারে রান্না করতে গিয়ে মা-মেয়ের মৃত্যু
রাইস কুকারে রান্না করতে গিয়ে মা-মেয়ের মৃত্যু
বছরে ৯৬০ কোটি টাকা সুদ দিতে হয়, চলছে না আইসিবি: অধ্যাপক আবু আহমেদ
বছরে ৯৬০ কোটি টাকা সুদ দিতে হয়, চলছে না আইসিবি: অধ্যাপক আবু আহমেদ
আটকের পর অধ্যক্ষ বললেন ‘আ.লীগ করায় দোষ হলে যেকোনও শাস্তি মেনে নেবো’
আটকের পর অধ্যক্ষ বললেন ‘আ.লীগ করায় দোষ হলে যেকোনও শাস্তি মেনে নেবো’
ইশরাক বললেন ক্ষমা চাইতে, আসিফ দিলেন ‘কড়া বার্তা’
ইশরাক বললেন ক্ষমা চাইতে, আসিফ দিলেন ‘কড়া বার্তা’