X
বৃহস্পতিবার, ০২ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

গণহত্যার দলিল

মেহেদি রাসেল
১৮ মার্চ ২০১৮, ১৬:৪২আপডেট : ১৮ মার্চ ২০১৮, ১৬:৫৬

গণহত্যার দলিল

নদী বিধৌত এক প্রান্তিক জনপদ গজারিয়া। প্রায় চারশ বছর আগে মেঘনার বুকে জেগে ওঠা— ছোট ছোট চর  একত্রিত হয়ে সৃষ্টি হয়েছিল এ জনপদ। উর্বর ভূমির টানে পরিশ্রমী মানুষ ভাগ্যান্বেষণে এসেছিল এ ভূখণ্ডে। মেঘনাকে বলা হতো দড়িয়া, সাগরের মতোই উত্তাল। মেঘনার সেই প্রমত্তা রূপ আজ আর নেই। ভাঙা-গড়ার চিরন্তন খেলায় মেঘনার বুকে জেগে আছে গজারিয়া নামের এ ভূখণ্ড। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের অন্যান্য অনেক অঞ্চলের মতো এখানেও চলে ভয়াবহ নৃশংসতা। সেই ইতিহাস এতকাল বহন করত শুধু সেখানকার ভুক্তভোগী মানুষেরা, একাত্তরের যারা প্রত্যক্ষদর্শী। সেই ইতিহাসের লিখিত বিস্তারিত কোনো দলিল ছিল না। সাহাদাত পারভেজ দারুণ মমতায় সেই ইতিহাস তুলে এনেছেন। তাঁর লেখা ‘গণহত্যা গজারিয়া : রক্ত মৃত্যু মুক্তি’ বইটি  সে কারণেই তাৎপর্যপূর্ণ।

পাকবাহিনী গজারিয়ায় যে তাণ্ডব চালায় তা আমাদের দুঃস্বপ্নকেও হার মানায়। চারদিকে নদীবেষ্টিত হওয়ায় অনেকেই গজারিয়াকে নিরাপদ এলাকা মনে করতেন। অন্তত আশপাশের মানুষ এবং কাজের সূত্রে যারা গজারিয়ার বাইরে থাকতেন, তারা ভাবতেন প্রত্যন্ত এলাকা হওয়ায় সহসা এখানে হানাদার বাহিনী আক্রমণ করবে না। ফলে ২৫ শে মার্চের পরে নিরাপত্তার জন্য ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও আশেপাশের শহরাঞ্চল থেকে অনেকেই পরিবার পরিজনসহ এখানে এসে আশ্রয় নেন। গজারিয়া প্রত্যন্ত এলাকা হওয়া সত্ত্বেও সেখানকার কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া তরুণেরা নেতৃত্বে ছিল। ফলে, মুন্সিগঞ্জ সদরের আগেই আক্রান্ত হয় গজারিয়া। গজারিয়ার তরুণেরা প্রথম থেকেই সংগঠিত ছিল। ‘অগ্নিবীণা’ নামে তাঁদের সংগঠনটি সামাজিক নানা সমস্যায় প্রথমেই এগিয়ে আসতো। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ‘আলোর দিশারী’ নামের আরেকটি সংগঠন গজারিয়ায় কিশোর তরুণদের ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে। এই তরুণ শক্তির কারণেই ১৯৭০ সালের নির্বাচনে গজারিয়ায় যিনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নির্বাচন করেছিলেন, নেজামে ইসলাম পার্টির ওই প্রার্থীর জামানত পর্যন্ত বাজেয়াপ্ত হয়। তিনি সব মিলে ৪৪ ভোট পেয়েছিলেন। পাকিস্তানপন্থীদের নানা অপকর্মের বিরুদ্ধে গজারিয়ার প্রগতিশীল যুবক সমাজ যুদ্ধের আগে থেকেই সোচ্চার ছিলেন। অর্থ-বিত্তে বড় এবং সামাজিকভাবে প্রভাবশালী নেজামে ইসলাম ও মুসলিম লীগের সমর্থকেরা শুরু থেকেই এসব যুবকের ওপর ক্ষুব্ধ ছিলেন। গজারিয়ায় পাকিস্তানপন্থীরা সুবিধা করে উঠতে পারছিল না সেখানকার প্রগতিশীল এবং স্বাধীনতার স্বপক্ষের যুবকদের জন্য। ‘গণহত্যা গজারিয়া’ বইয়ে সাহাদাত পারভেজ এসব ঘটনাকে গণহত্যার অন্যতম কারণ বলে মনে করেন। এর স্বপক্ষে তিনি যথাযথ যুক্তি ও সাক্ষ্য প্রমাণ দেখিয়েছেন। গজারিয়ার মুক্তিযোদ্ধারা দারুণ সক্রিয় ও সংগঠিত থাকায় ৯ মে গণহত্যার দিনে তাঁরা আগে থেকেই নিরাপদে চলে যেতে সক্ষম হন। হানাদার এবং পাকিস্তানপন্থী রাজাকারদের রাগ গিয়ে পড়ে নিরীহ গ্রামবাসীর ওপর।

গবেষণাধর্মী এ বইয়ে প্রত্যক্ষদর্শী ৩৪ জনের সাক্ষাৎকার প্রকাশ করেছেন সাহাদাত পারভেজ। এদের মধ্যে যুদ্ধাহত যেমন আছেন, সরাসরি সেখানে উপস্থিত ছিলেন কিন্তু আক্রান্ত হননি, এ রকম লোকও রয়েছেন। প্রত্যক্ষদর্শীদের বয়ানের সঙ্গে তখনকার ও পরবর্তীকালের নানা দলিলপত্র মিলিয়ে দেখে তিনি সিদ্ধান্ত টেনেছেন। অর্থাৎ, বিষয়ের ওপর নানা দিক থেকে আলো ফেলে, নানা সূত্র থেকে প্রমাণ সংগ্রহ করে তিনি তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্যের দিকে এগিয়েছেন। গজারিয়া আক্রমণের আগে মিলিটারি ও স্বাধীনতাবিরোধীরা পর্যাপ্ত হোমওয়ার্ক করেন। হামলার কয়েক দিন আগে হেলিকপ্টার থেকে গজারিয়ার বসতি ও ভূ-প্রকৃতি দেখে যায় পাকবাহিনী।

সেদিন পাকবাহিনীর হাতে তিনশোর বেশি নিরীহ মানুষ প্রাণ হারান। সবাই ভেবেছিলেন, পানিতে হানাদাররা সুবিধা করে উঠতে পারবে না, তাই মানুষ ঘর থেকে বের হয়ে আশ্রয় নেন ফুলদী নদীর পাড়ের বিশাল চরে। কিন্তু জাল দিয়ে মাছ ধরার মতো গলাপানিতে থাকা লোকজনও খুঁজে বের করে তারা। গুলি করে, বেয়নেট চার্জ করে মারে অসহায় মানুষদের। যুদ্ধের নিয়মে সংখ্যালঘু মানুষ আক্রান্ত হয় প্রচুর। কিন্তু হানাদার বাহিনী সেদিন কাউকেই ছাড় দেয়নি। এমনকি তারা পবিত্র কোরআন শরীফ লাথি মেরে ফেলে দিয়ে পাঠরত মুসলমানকে হত্যা করে। মসজিদ থেকে লোক ধরে এনেও হত্যা করে। গজারিয়ার এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে বিস্তারিত কাজ সম্ভবত এই একটাই। নানা কারণে আমাদের প্রান্তিক এলাকায় ঘটে যাওয়া গণহত্যাগুলো যথাযথভাবে তুলে ধরা হয়নি এখনো। সেই অর্থে সাহাদাত পারভেজের বইটি একটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল হয়ে থাকবে। গবেষণালব্ধ বিষয় হলেও এর ভাষা দারুণ প্রাঞ্জল। তবে, রাজাকারদের পরিচিত অংশটি (গণহত্যার হোতা) আরেকটু বিস্তারিত হতে পারত বলে মনে হয়েছে। শুধু গণহত্যাই নয় গজারিয়ার ইতিহাস, সংস্কৃতি, সেখানকার মানুষ, প্রকৃতি ইত্যাদি সম্পর্কে এ বই থেকে পাঠক মোটামুটি একটি ধারণা পাবেন ।

গণহত্যা গজারিয়া  : রক্ত মৃত্যু মুক্তি; সাহাদাত পারভেজ; প্রচ্ছদ  : মোস্তাফিজ কারিগর; প্রকাশকাল  : ফেব্রুয়ারি২০১৮; প্রকাশক  : সাহিত্য প্রকাশ

//জেড-এস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
‘গরমে অসুস্থ’ হয়ে মারা যাওয়া সেই শ্রমিকের পরিবারের পাশে জেলা প্রশাসন
‘গরমে অসুস্থ’ হয়ে মারা যাওয়া সেই শ্রমিকের পরিবারের পাশে জেলা প্রশাসন
ওমরাহ করতে স্ত্রীসহ সৌদি আরব যাচ্ছেন মির্জা ফখরুল
ওমরাহ করতে স্ত্রীসহ সৌদি আরব যাচ্ছেন মির্জা ফখরুল
ঢাকার অধস্তন আদালতগুলোতে এসি লাগাতে আইনি নোটিশ
ঢাকার অধস্তন আদালতগুলোতে এসি লাগাতে আইনি নোটিশ
ড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি পেছালো
অর্থ আত্মসাতের মামলাড. ইউনূসসহ ১৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন শুনানি পেছালো
সর্বাধিক পঠিত
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
শিশু ঝুমুরকে ধর্ষণ ও হত্যার বর্ণনা দিতে গিয়ে চোখ মুছলেন র‌্যাব কর্মকর্তা
মিল্টন সমাদ্দার আটক
মিল্টন সমাদ্দার আটক
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
একজন অপরাধীর গল্প বলতে চেয়েছিলেন তিশা
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি
মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ তদন্ত করবে ডিবি