X
সোমবার, ০৬ মে ২০২৪
২৩ বৈশাখ ১৪৩১

দেবেশ রায় নিয়ে বিক্ষিপ্ত

মাহবুব মোর্শেদ
২১ মে ২০২০, ১৯:০৩আপডেট : ২১ মে ২০২০, ১৯:০৪

দেবেশ রায় নিয়ে বিক্ষিপ্ত

ফিকশন লেখার শুরুতে উত্তরবঙ্গে বাড়ি বলে মনে বেশ একটা তৃপ্তি কাজ করতো। বাংলা সাহিত্যের অনেক বড় ফিকশন লেখকের মতো আমার বাড়িও উত্তরবঙ্গে। সৈয়দ শামসুল হক, শওকত আলী, আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বাড়ি উত্তরবঙ্গে। হাসান আজিজুল হক ওপারের উত্তর থেকে খুলনা হয়ে রাজশাহীতে থিতু হয়েছেন। অমিয়ভূষণ মজুমদার কোচবিহারের, দেবেশ রায় পাবনা হয়ে জলপাইগুড়ির। এখন অনেকের নাম ও জেলা ভুলে গেলেও সে সময় বেশ একটা হাইপোথিসিস মতো দাঁড় করিয়ে ফেলেছিলাম অনেক তথ্য-উপাত্ত দিয়ে। কৈশোরের চিন্তা থেকে রীতিমতো একটা তত্ত্বও বের করে ফেলেছিলাম। আমার মনে হতো, উত্তরের ল্যান্ডস্কেপটা গদ্যের ফলনে একটা বড় কারণ। এখানে যারা বেড়ে ওঠে তারা গদ্যের ঢঙটা হয়তো রপ্ত করে ফেলতে পারে সহজে। মনে হতো, দক্ষিণ হলো গান ও কবিতার। আর উত্তর গদ্যের। উত্তরেও গান আছে, তবে সে গান খানিকটা গদ্যধর্মী, তাতে মেলোডি যেন কম। ভাওয়াইয়া যেমন। আর দক্ষিণে গান হয়ে ওঠে মধুর মেলোডিয়াস। পার্থক্যটা গড়ে দেয় নদী ও নদীভ্রমণ। নদীপ্রধান দক্ষিণের সঙ্গে উত্তরের অনেক পার্থক্য। নদীর সঙ্গে হয়তো মেলোডির একটা সম্পর্ক আছে। উত্তরের ল্যান্ডস্কেপে নদী কম। যাও বা কিছু নদী আছে তাতে ভ্রমণের সুযোগ বেশ কমই বলতে হবে। এসব ভেবে আমি নিজে ফিকশন রাইটার হবার জন্য যুক্তি খুঁজতাম। আর এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করতাম। এখন এ মনোভাব থেকে সরে এসেছি। কিন্তু যখন পুরনো দিনের কথা ঝালাই করতে গেলাম ওই পুরনো চিন্তাগুলোর কথাও মনে পড়লো। এইসব চিন্তার হয়তো বিশেষ গুরুত্ব নেই। কিন্তু, এগুলো ছোটবেলায় ঘোর ও প্যাশন তৈরি করে দিতো।

কীভাবে দেবেশ রায়ের লেখার খোঁজ পেলাম সেসব ভাবতে গিয়ে এই চিন্তার কথা মনে পড়লো। তখন বোধহয় রংপুরেই থাকি আমি। এক বন্ধুর কাছ থেকে ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ নিয়ে পড়া শুরু করি। সে অভিজ্ঞতাটা রীতিমতো লিখে রাখার মতো। আমি বড় উপন্যাসগুলোও গোয়েন্দা-কাহিনির মতো করেই পড়তাম। তিস্তাপারের বৃত্তান্তের বেলাতেও তেমনই ঘটলো। যারা পড়েছেন তাদের হয়তো একটু অবাক লাগবে। কেননা উপন্যাসটা অতো সহজ না। ঢোকাই বড় কঠিন। কিন্তু আমি ঢুকে পড়েছিলাম। ভাষাটা অত্যন্ত কাছের। রংপুর থেকে জলপাইগুড়ি খুব দূরের নয়। আর পঞ্চগড়েও অনেকদিন থেকেছি আমি। পঞ্চগড়ের সীমানাতেই জলপাইগুড়ি। কাঁটাতারের ওপারেই। তিস্তাপারের চরিত্রগুলোর সংলাপের ভাষা আমার খুব চেনাজানা। ওদের চালচলন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভূগোল, এমনকি কিছু স্থান, নামও চেনা। ফলে, আমি তরতর করে এক নিঃশ্বাসে পড়ে গেলাম। তখনো তো জানি না ফিকশনে ডিটেইলিং বলে একটা ব্যাপার আছে। আর তাতে বেশ দখল দেবেশ রায়ের। সেটুকু না বুঝলেও উপন্যাসে শ্রীদেবীর যে রূপ বর্ণনা আছে প্রায় দুই ফর্মার বেশি কি তিন ফর্মাই, তা আলাদা করে ভীষণ এনজয় করেছিলাম। রুশ, লাতিন, ফ্রেঞ্চ, ইংলিশ উপন্যাস ততোদিনে কিছু পড়েছি অনুবাদে। কিন্তু বাড়ির কাছের গল্প একেবারে আমার গ্রামের ভাষাতেই যে লেখা হচ্ছে এভাবে ক্ল্যাসিকের মতো স্বাদে সেটা দারুণ আত্মীয়তা তৈরি করে দিয়েছিল দেবেশ রায়ের সঙ্গে।

পরে ‘খোয়াবনামা’র বেলাতেও তেমন হয়েছিল। চেনা ল্যান্ডস্কেপে, চেনা ভাষার গল্প আমি রুদ্ধশ্বাসে প্রায় এক বসায় পড়েছিলাম। অনেকেই পড়তে পারেন না বলেন। সেটা হয়তো সত্যি। কিন্তু আমি অনেক বড় উপন্যাস একটানে পড়ে ফেলেছি। ‘তিস্তাপারের বৃত্তান্ত’ বা ‘খোয়াবনামা’র বেলায় বাড়তি যে ব্যাপারটা যোগ হলো তা হলো— এর ভাষা, ল্যান্ডস্কেপ, মানুষ আমার বেশ চেনা। ফলে, বিদেশি উপন্যাস যত ভালোই হোক সেটা যে দূরের তা তো পড়ার সময় মনে থাকে। অনুবাদ পড়ার পরও চরিত্রগুলোকে অনুবাদ করে নিতে হয়। কিন্তু নিজেদের ভাষায় যখন তুলনীয় ব্যাপ্তি ও গভীরতার উপন্যাস আলাদা আরাম দেয়। অমিয়ভূষণের বেলাতেও তাই ঘটেছে।

সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো—মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, কমলকুমার মজুমদাররা তো বেঁচে নেই। ইতিহাসের দূরত্বে তারা। কিন্তু জীবিত লেখকরা লিখছেন, আমরা পড়তে পারছি আর আমরাও লিখছি এটা আরেক আত্মীয়তার সম্পর্ক।

লেখালেখির ভেতর যত ঢুকছি ততোই প্রিয় লেখকদের খবরও পাচ্ছি। সাক্ষাৎকার পড়ছি, কোনো প্রবন্ধও হয়তো চোখে পড়লো, কোথাও হয়তো শোনা গেল কিছু কথা। পরিচয়টা বাড়ছে। যেন ঘনিষ্টতা বাড়ছে না দেখার মধ্যেও। আখতারুজ্জামান ইলিয়াসের বেলায় যেমন হয়েছে, লাইব্রেরির কোণায় একবার ‘অন্য ঘরে অন্য স্বর’ খুঁজে পাওয়ার পর তার লেখা যেখানেই পেয়েছি পড়েছি। খুব অল্প লিখেছেন। সবই পড়া হয়ে গেছে। অমিয়ভূষণ মজুমদারের বেলাতেও তাই। একটার পরে একটা পড়ে গেছি বিস্ময় নিয়ে। কিন্তু রচনাবলী এখনও শেষ হয়নি। কিছু বাকি রয়ে গেছে। দেবেশ রায় একটা সময় পর্যন্ত মুগ্ধ হয়ে পড়েছি। তারপর হুট করে বাদ দিয়েছি।

আমার সবচেয়ে প্রিয় লেখকদের মতো করে আমি খুব একটা লিখিনি। শুরুর গল্পগুলোতে পাওয়া যাবে তাদের উপস্থিতি। পরম্পরা বা প্রভাব। কিন্তু দ্রুত তাদের হাত ছেড়ে দিয়েছি। লেখক হিসেবে হাত ছেড়ে দিলেও পাঠক হিসেবে তো আর ছাড়া যায় না। পাঠক হিসেবে আমি এখনও সমান মুগ্ধতা নিয়ে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় পড়ি। তারাশঙ্কর পড়ি। সতীনাথ পড়ি। জগদীশ পড়ি। কিন্তু যখন কথা বলি তখন লোকে একটু বিভ্রান্ত হয়ে যায়। প্রিয় লেখকের মতো নয় কেন আপনার লেখা? দেবেশ রায়ের যে ডিটেইলিংয়ের টেকনিকের খুব ভক্ত আমি। কিন্তু নিজের উপন্যাসে আমি ডিটেইলিং আনার চেষ্টা হয়তো করবো না। এটা হলো, যোগাযোগের একটা বিশেষ সিদ্ধান্ত। আমি ভিন্ন রকমের একটা যোগাযোগ পছন্দ করি।

আবার ধরা যাক ভূগোলের প্রসঙ্গ। তারাশঙ্কর যেভাবে কলকাতার গলিঘুপচি আর ফ্ল্যাটবাড়ির চলাচলের বাইরে একটা বিস্তৃত প্রেক্ষাপটে, বড় ভূগোলের মধ্যে বাংলা উপন্যাসকে আনলেন সেটা একটা অন্যরকম অভিজ্ঞতাই বটে। ওই ভূগোলের ওপর লেখকের দখল থাকলে পাঠক হিসেবে আমি ভীষণ আমোদ পাই। একটা বিস্তৃত ভূগোলে গল্প ঘুরছে এটা বাস্তব পরিভ্রমণের আনন্দ দেয়। লেখকের কল্পনা আর কব্জির জোরও বোঝা যায় বেশ। দেবেশ রায় এক্ষেত্রে একেবারে শীর্ষস্থানীয় লেখক। জলপাইগুড়ি ডুয়ার্সের ভূগোল তার উপন্যাসের চরিত্রও, শুধু পরিপ্রেক্ষিত নয়। তার যে দখল ওই অঞ্চলের ওপর সেটা প্রত্যেক বাক্যে, শব্দে বোঝা যায়। কিন্তু কোনো একটা বিশেষ এলাকার ওপর যে লেখকের সামান্য দখল নেই, তিনি যদি সেই এলাকার ওপর একটা গল্প ফেঁদে বসেন, সেটা বেশ বিরক্তিকর ঠেকে। আমি এর কঠোর সমালোচক। নিজে হয়তো কখনো লিখবো না এভাবে।

লেখকের কল্পনার ওপর কারো হাত নেই। তিনি কল্পনা করে ষোড়শ শতকের গল্প লিখতে পারেন। সেজন্য তাকে ষোড়শ শতকে জন্ম নিতে হবে এমন দাবি আমি করছি না। কিন্তু কল্পনাটা পর্যাপ্ত হতে হবে। আর যদি তিনি ষোড়শ শতকটা কোনো যাদুমন্ত্রবলে যাপন করতে পারেন তাহলেও মন্দ হয় না। আমাদের সমসাময়িকদের অনেককে যখন ভূগোলের দিকে এগুতে গিয়ে মুখ থুবড়ে পড়তে দেখি তখন দেবেশ রায়ের কথা মনে হয়। দেবেশ রায় প্রায় ক্যামেরা চালিয়ে লিখেছেন। আমি এটা পছন্দ করি। এটা বিরাট তাগদের ব্যাপার।

ওনার সেরা কাজ বোধহয় ‘তিস্তাপুরাণ’। সেটা পড়তে গিয়ে মনে হয়েছিল, এই গল্প ডিটেইলে না বললে হয় না। একটা অনন্য মানবিক অভিজ্ঞতা ছিল ‘তিস্তাপুরাণ’। একটা নৃতাত্ত্বিক ফিকশন। বাংলাভাষায় এমন কাজ আর নেই। আমি অন্তত পড়িনি।

দেবেশ রায় উপন্যাস-চিন্তার ক্ষেত্রেও বেশ বড় ধরনের নাড়া দিয়েছেন আমাদের। বাংলা সাহিত্যের প্রথম উপন্যাসে এক মুসলিম নারী যখন বলে, এই বন্দী আমার প্রাণেশ্বর সেটা যে কত বড় মিথ্যা সে কথা দেবেশ রায় আমাদের বলেছিলেন। বাংলা সাহিত্যের বহু মিথ্যাই তিনি ধরিয়ে দিয়েছেন। বিশেষ করে তিনি বড় প্রশ্ন তুলেছেন ফর্ম নিয়ে। যে প্রশ্নটা অন্যভাবে সেলিম আল দীন তুলেছিলেন। পশ্চিমাদের শেখানো উপন্যাস রেখে উপনিবেশের আগের উপাখ্যান আখ্যান পাঁচালির ফর্মে ফিরে যেতে পারি কি-না আমরা। সেলিম আল দীন নিজে ফেরার চেষ্টা করেছিলেন। দেবেশ রায় ওপথে খুব বেশি আগাননি। নাটকের খোলনলচের চাইতে উপন্যাসের খোলনলচে হয়তো শক্ত। উপন্যাস তো নিজেই একটা প্রতিষ্ঠান। স্টোরিটেলিং নিজেই একটা ক্রাফট। এই ক্রাফটের ভেতরে বাইরে খুব বেশি ক্রাফট জুড়লে কতটা পাঠকের সুবিধা হবে কে জানে। সেলিম আল দীন নাটকে যে সাহস করেছেন উপন্যাসে সে সাহস করা সত্যিই খুব কঠিন। তবু চিন্তা হিসেবে এটা বেশ ভালো। নতুন কিন্তু একটা অকার্যকর চিন্তা। অন্তত উপন্যাসের ক্ষেত্রে।

দেবেশ রায়ের রচনাবলী একটা বিস্ময় তৈরি করে দিয়ে গেল। একেবারে রুশ ঔপন্যাসিকদের মতো দম তার। ঢাউস ঢাউস লেখা। গুরুতর অভিনিবেশ নিয়ে লেখা উপন্যাসগুলো বেশ ভাবাচ্ছে এখন। লেখার পেছনে অর্থযোগ খুব বেশি ছিল না, তা তো স্পষ্ট। কতই বা বিক্রি হতো, কত টাকাই বা আসতো। খ্যাতি বা স্টারডম যে খুব বাড়তি ছিল, তাও নয়। একাডেমিক অঙ্গনে কিছু খ্যাতি হয়েছিল। বোদ্ধাদের মধ্যে একটা জায়গা। খুব সাহসী লোক ছিলেন। প্রাতিষ্ঠানিক সুবিধার দিকে দৌড়াননি। অনেক কম বিনিময় মূল্যে অনেক লিখে রেখে গেলেন।

শুনেছি, আমি পড়া বাদ দেবার পর সাম্প্রতিক বিষয় নিয়ে কয়েকটি উপন্যাস লিখেছেন। এখন সেগুলো পড়তে হবে। শুরু করবো শীঘ্রই।
বিদায়।

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
নারায়ণগঞ্জে চেয়ারম্যান প্রার্থীর সমর্থকদের ওপর হামলার অভিযোগ, আহত ৩
সুন্দরবনে আগুন ছড়ানো রুখতে দেওয়া হয়েছে বেরিকেট
সুন্দরবনে আগুন ছড়ানো রুখতে দেওয়া হয়েছে বেরিকেট
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
এই ৬ বীজ নিয়মিত খেলে সুস্থ থাকতে পারবেন দীর্ঘদিন
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
লখনউকে বড় হারের লজ্জা দিয়ে শীর্ষে কলকাতা
সর্বাধিক পঠিত
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
‘টর্চার সেলে’ নিজ হাতে অপারেশনের নামে পৈশাচিক আনন্দ পেতো মিল্টন, জানালেন হারুন
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে যা বললেন জনপ্রশাসনমন্ত্রী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
নিজেদের তৈরি ভেহিকেল পেরুকে উপহার দিলো সেনাবাহিনী
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
আজকের আবহাওয়া: কোথায় কেমন বৃষ্টি হবে
সব জেনেও পুলিশকে কিছু জানাননি মিল্টনের স্ত্রী
জিজ্ঞাসাবাদ শেষে ডিবি হারুনসব জেনেও পুলিশকে কিছু জানাননি মিল্টনের স্ত্রী