X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

নেত্রকোণার নামকাহন পানি ও নেত্রকোণার জনজীবন

মঈনউল ইসলাম
০৯ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৪৩আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৪৫

কেভিন কস্টনার অভিনীত হলিউডি বিখ্যাত ছবি ‘ওয়াটার ওয়ার্ল্ড’। কল্পিত এই সিনেমায় দেখানো হয়েছে যে, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পৃথিবীর সভ্যতা, জনপদ সব পানির নিচে ডুবে যায়। বেঁচে থাকা মানুষগুলো সবাই জেগে থাকা ভূ-খণ্ডের সন্ধানে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত। এই সময়ে পানিতে বসবাস করতে করতে তারা আবার পানিতে অভিযোজিত হয়ে যায়। মানুষের কানের পেছনে মাছের মতো ফুলকা বা কানকো তৈরি হয়ে যায়। পানি থেকে তারা শ্বসনের জন্য অক্সিজেন গ্রহণের সক্ষমতা অর্জন করে। আবার ডিজনির জনপ্রিয় এনিমেশন মুভি ‘মোয়ানা’-তে দেখানো হয়েছে একটু ভিন্নতা। মাটুনিই দ্বীপের গোত্রপ্রধানের ছোট্ট মেয়ে মোয়ানা একদিন সমুদ্রের বেলাভূমিতে একটি কচ্ছপছানাকে উলটে পড়ে থাকতে দেখে। শিশু মোয়ানা কচ্ছপছানাটিকে সমুদ্রে চলে যেতে সাহায্য করে। সমুদ্র ভীষণ খুশি হয় তার প্রতি। সমুদ্র যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে। সে মোয়ানার সঙ্গে খুনশুটিতে মেতে ওঠে। খুঁনশুটির সেই দৃশ্যটি হয়েছে অপলক উপভোগ করার মতো। সমুদ্রের বরে পানিতে না ডোবার ক্ষমতা পায় মোয়ানা। অর্থাৎ, কোনো রকম অভিযোজন ছাড়াই ভালো কাজের মাধ্যমে সমুদ্রের মন জয় করে নেওয়া যায়। দ্বীপবাসী এই দ্বীপ ও এর চারদিকে ঘিরে থাকা সমুদ্র থেকেই তাঁরা প্রয়োজনীয় সকল জীবনোপকরণ পেয়ে থাকে। তাই, তারা দ্বীপ ছেড়ে কোথাও না যাওয়ার জন্য সঙ্কল্পবদ্ধ। কোনো স্থানে বসবাসরত মানুষ সেখানকার পরিবেশ ও প্রতিবেশের সঙ্গে যত ভালোভাবে মানিয়ে নিতে পারে তারা তত শান্তিতে সেখানে থাকতে পারে। পানির সান্নিধ্যে থাকা হাওড়ের মানুষগুলো হাওড়ের সঙ্গে গড়ে তুলেছে মিতালি। কখনো তাঁদের নির্বুদ্ধিতায় ক্রুদ্ধ হয়ে তীরবর্তী বাসিন্দাদের সবকিছু যেমন ধ্বংস করে দেয়, তেমনি বেঁচে থাকার রসদ জোগাতেও উজাড় করে দেয় এই জলরাশি। সমুদ্র না হলেও পরিবর্তিত সমুদ্র (সাগর>সায়র>হাওড়) অর্থাৎ হাওড়ের সঙ্গে নেত্রকোণার মানুষের রয়েছে আজন্মলালিত সখ্য। পানিতে বসবাসকারী মাছ এবং বায়ুর সমুদ্র থেকে প্রাণিকূল যেমন নিজের অজান্তে অক্সিজেন গ্রহণ করে, তেমনি এখানকার শিশুরাও খেলতে খেলতে কখন যে পানিতে ভেসে থাকা শিখে যায় তারা নিজেরাও জানে না।

বর্ষাকালে হাওড়গুলো জীবন্ত হয়ে ওঠে। পূর্ণতা পায় যৌবনের সাহসিকতা। আফালের গর্জনে ফেরে বাঁধনহারা উল্লাসধ্বনী। হাওড়বিলাসী মানবকুলও মেতে ওঠে ফি বছরের সাংস্কৃতিক উৎসব আয়োজনে। আষাঢ় মাসের ভাসা পানিতে ‘উইজ্জা মারা’ থেকে শুরু হয় নতুন উৎসবের। রঙবেরঙের পাল তোলা নৌকায় সাজানো খোলা প্রান্তর যেন প্রাকৃতিক ক্যানভাস। মাঝির প্রাণখোলা গানের সুর সুবাস ছড়ায় ঢেউয়ের তালে তালে। মাঝিরা নৌকা থেকে ঝাঁপিয়ে গোসল করে নেয় হাঁসের মতো। শিশু-কিশোরেরা লম্ফ-ঝম্ফে মেতে ওঠে শৈশব উদ্‌যাপনে। রাস্তা, বাঁশের সাকো, ব্রিজ বা কোনো গাছের শাখা থেকে লাফিয়ে পড়ে পানিতে। তাঁদের উচ্ছ্বাস দেখে মনে হয় জগতের সকল আনন্দ নিহিত রয়েছে এই লাফালাফিতে। ভ্রমণপিয়াসী পর্যটকেরাও পানিতে অবগাহন করে শরীরের জ্বালা জুড়ায়। রাহাত খান অনূদিত জেমস জে. নোভাকের ‘বাংলাদেশ : জলে যার প্রতিবিম্ব’ বইয়ে গ্রাম-বাংলার গোসলের মনোমুগ্ধকর বর্ণনা রয়েছে—

গ্রীষ্মকালে একদিকে পানির অপ্রতুলতা এবং পানির উষ্ণতায় জীবন যেখানে দুর্বিষহ হয়ে ওঠে, বর্ষার ফলে হঠাৎ করে শীতল ও স্বস্তিকর অঢেল পানির সমারোহ যেন উৎসবের আমেজ আনে। শিশুরা উলঙ্গ হয়ে লাফ দিয়ে দিয়ে স্নান করে। যুবতী মহিলারা গোসল সারে মনের আনন্দে। পুরুষরা শরীরে প্রচুর সাবান মাখে। পরনে থাকে লুঙ্গি। ডুব দিয়ে দিয়ে গোসল করে। পুকুরের নিশ্চল পানিতে গোসল করা আরেক অনির্বচনীয় আনন্দ। গোসল মানেই এখানে আনন্দ। জীবনের প্রকৃত বিলাসিতা যেন স্নান। একখানা ভালো সাবান, একটি টুথব্রাশ কিংবা মাজন, একখানা চিরুনিতে জীবনের অনেক চাওয়া-পাওয়া যেন পূর্ণ হয়ে ওঠে। প্রকৃতপক্ষে স্নান এই বর্ণনারও অধিক। স্নান হলো শুদ্ধতা। পবিত্র হওয়ার সুযোগ। একটি দিন শুরু ও শেষ হওয়ার সাথে স্নানের গভীর সম্পর্ক বিদ্যমান। স্নানের সময়ই পানিতে থাকা অবস্থায় অনেকে নিজ নিজ শাড়ি-লুঙ্গি ধোয়ার কাজটা সারে। এবার বৃষ্টির বিরতিতে কিংবা শরীরের তাপে সেই কাপড় শুকানোর পালা। পশ্চিমা বাথরুম সম্পর্কে সাতকাহন করার সুযোগ থাকলেও হলফ করে এ কথা বলতে পারি যে, বাংলাদেশের মানুষ যে প্রক্রিয়ায় স্নান করে তার কোনো তুলনা হয় না। কিষাণ-কিষাণী, তাদের ছেলেমেয়েরা কুটিরের অদূরবর্তী স্থানের সঞ্চিত পানিতে সহজেই স্নান সম্পন্ন করতে পারে। স্নানের সময় পুরুষে পুরুষে, মহিলারা পরস্পরের মধ্যে নানা বিষয়ে গল্প করে থাকে। অপূর্ব সে দৃশ্য। আড্ডা, গল্প-গুজব স্নানের সময় সম্পন্ন হয়। খ্রিষ্টধর্মে প্রাতে এবং সন্ধ্যায় পানি ব্যবহারের মাধ্যমে পবিত্র হওয়া ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অন্তর্ভুক্ত। কিন্তু এদেশের মানুষ সকাল-সন্ধ্যায় আপন মনে অবচেতনভাবে পানি দ্বারা নিজেকে পরিশুদ্ধ করে থাকে।

কথাসাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদের জনপ্রিয় চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’-তে ব্যবহৃত ‘আমার যমুনার জল’ শীর্ষক গানেও অনুরূপ বর্ণনা রয়েছে। কুলবালার ধীরে ধীরে পানিতে অবগাহন এবং শরীরের সেই ডুবন্ত অংশ ধৌতকরণের যে রোমাঞ্চকর বর্ণনা রয়েছে তা শুনলে যে-কারও ইচ্ছে হবে জীবনে একবার হলেও এমন গোসল করার। আর্কিমিডিসের ‘প্লবতা’ ব্যবহার করে এই সঞ্জীবনি গোসলের তুলনায় অধুনা স্পা, স্টিম বাথ, শরীর মর্দন নিতান্তই বালখিল্য মনে হয়। এমন স্নানের পরে সুন্দরী রমণী হয়ে ওঠেন মোহনীয়, মনোহর। সাইফিনা’র সেই বিজ্ঞাপনের মতো বলতে হয় ‘যখন চেহারাতেই চাঁদের আলো বিচ্ছুরিত তখন মোমবাতির কী প্রয়োজন’।

আমার যমুনার জল দেখতে কালো,
চান করিতে লাগে ভালো,
যৌবন মিশিয়া গেলো জলে

গডা পানিত নাইম্যা কন্যা গডা মাঞ্জন করে,
হাডু পানিত নাইম্যা কন্যা হাডু মাঞ্জন করে।

…….

উরত পানিত নাইম্যা কন্যা উরত মাঞ্জন করে,
কোমর পানিত নাইম্যা কন্যা কোমর মাঞ্জন করে।

…….

গোসল বড় কইরা সখি মুখে দিছে পান,
ঘর থাইকা বাইর হইছে পূর্ণিমারই চান।

পানির সান্নিধ্যে বসবাসরত মানুষ পানিতেই খুঁজে নেয় জীবনকে উপভোগের অনুষঙ্গ। হাওড়ে আনন্দের এমনই এক উৎস হলো নৌকাবাইচ। বর্ষাকালের নির্দিষ্ট পার্বণকে লক্ষ্য রেখে গ্রামে গ্রামে সাড়া পড়ে যায়। শৌখিন ও স্বচ্ছল গৃহস্থ পরিবার প্রস্তুত করে বাইচের নৌকা। সংকল্প থাকে গত বছরের ট্রফি ধরে রাখা; অথবা রবার্ট ব্রুসের অধ্যাবসায়ের পরীক্ষা দিয়ে বিজয় ছিনিয়ে আনার। নির্ধারিত সময়ের কয়েকদিন পূর্ব থেকেই নৌকা সাজানো শুরু হয়। অভিজ্ঞ মাঝির নেতৃত্বে শুরু হয় শক্ত-সমর্থ বাইছা নির্বাচন। পোশাক এবং বয়াতী বা সাইরল নির্বাচন, বাইছাদের খাবারের আয়োজন, সব মিলিয়ে এলাহি ব্যাপার। কখনো  কখনো  এই প্রতিযোগিতা রূপ নেয় গ্রামের মান-ইজ্জতের বিষয় হিসেবে। নৌকাবাইচের যাত্রা শুরু হয় সারিগানের ধীর লয়ের বন্দনার মাধ্যমে। যাত্রার বিভিন্ন পর্যায়ের সঙ্গে মিল রেখে এই গানের লয় ক্রমান্বয়ে দ্রুততর হতে থাকে। প্রতিযোগিতা শুরু হওয়ার মুহূর্তে মাঝিদের উজ্জীবিত করার জন্য বয়াতি কাঁসর বাজিয়ে গাইতে থাকেন—

ওগো ভাবীজান, ওগো বুবুজান
নাও বাওয়া মর্দলোকের কাম
মর্দ লোকের কামগো জোয়ান পোলার কাম।

তবে, প্রতিযোগিতার ‘ছোপ’ ছাড়লে গান বন্ধ হয়ে যায়। তখন দ্রুত লয়ে বাজানো বাদ্যের সঙ্গে মাঝিরা বৈঠা চালায়। বাদ্যের তালে তালে বৈঠা প্রদর্শন, বৈঠার টান, পানির কলধ্বনি মিলে এক অভাবনীয় দৃশ্যের অবতারণা ঘটে। বাঙালির প্রিয় যান্ত্রিক ও মানবিক কোলাহল, রং ও রূপে প্রতিযোগিতার স্থান হয়ে ওঠে এক বিশাল মিলনমেলা। বিজয়ী নৌকার মাঝিদের শ্রান্তি রূপ নেয় বাধভাঙ্গা উল্লাসে। গ্রামে ঘুরতে ঘুরতে তাঁদের কণ্ঠে ধ্বনিত হয়—

খলাপাড়ার কাচু মিয়া বড় ভাগ্যবান
সোনার একটা মেডেল দিয়া বাড়াইছে সম্মান
মান বাড়িবে গুণ বাড়িবে সকল আল্লার দান
জীবন দিয়া রাখবো মোরা তালুকদারের মান।

বাড়ির ঘাটে পৌঁছাতে পৌঁছাতে এই গান পরিবর্তিত হয়ে যায়—

নাওয়ের গলুইত ধান-ধূপ মাথায় তুইল্যা দে
ও আমার সোনামুখি ঘাটে আইসাছে
ঘাটে আইছে সোনার নাও আড়ঙ্গে জিতিয়া
ভালা খাওনের জোগাড় কর বাইছারার লাগিয়া।

বর্ষাকালে হাওড়ের কর্মহীন মানুষের থাকে অখণ্ড অবসর। যোগাযোগও হয়ে ওঠে সহজ। তাই, ঘরের লায়েক হওয়া পুত্র-কন্যার বিয়েথা দেওয়ার ধুম পড়ে যায়। নৌকা রঙিন কাগজে সাজিয়ে, শামিয়ানা টাঙিয়ে, মাইক বাজিয়ে বিয়ে করতে যাওয়ার মধ্যে পাওয়া যায় বাদশাহি আড়ম্বর। বছরের অন্য সময়ে বিয়ে হলেও সাধারণত মেয়েকে বাবার বাড়িতে যাওয়ার জন্য বর্ষাকালের অপেক্ষায় থাকতে হয়। বাবার বাড়িতে যাওয়ার জন্য কত রকমের আকুতি তাঁর। উকিল মুন্সির প্রকাশ করেন সে অনুভূতি—

আষাঢ় মাইস্যা ভাসা পানি রে
পুবালি বাতাসে
বাদাম দেইখ্যা চাইয়া থাকি
আমারনি কেউ আসে রে।

বাড়ির পাশ দিয়ে অসংখ্য নাইওরির নৌকা যায়। নৌকার যাত্রীদের সুখের কলরবে হেসে ওঠে হাওড়ের পরিবেশ। অন্যদের এই সুখ দেখে অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকা নববধূর মনখারাপ তীব্রতর হয়। দীর্ঘশ্বাস গভীর হয়। মা-বাবা, ভাই-বোনকে দীর্ঘদিন দেখতে না পেয়ে কলজে শুকিয়ে যায়। মুখটা হয়ে ওঠে পাঙশুর। প্রতীক্ষার প্রহর যেন আর শেষ হয় না। আষাঢ় মাসের তাজা পানি ধীরে ধীরে কমে আসে। পানির রং বদলে যায়। কিন্তু বাবার বাড়ি থেকে অভাগা গৃহবধূর জন্য কোনো নৌকা আসে না। মনে ভয় জাগে, বাবার বাড়ির সবাই হয়তো তাকে ভুলেই গেছে। বাউল রশিদ উদ্দিনের কথায় সে আকুতি প্রাণ পায়…

কোন ঘাটের কেওয়ানি তুমি কোথা চইলা যাও
মন মাঝিরে একবার এসে ঘাটে নাও লাগাও।।

নিত্য নিত্য আইস যাও, ডাকলে নাহি চাও
মাঝিরে, ঘরের কোনার বউ হইয়াছি ধরি তোমার পাও
নিদয়া হইয়াছে বুঝি আমার বাপ মায়।।

বাবার বাড়ি মানে কন্যার জন্য এক খোলা আকাশ। মুক্ত বিহঙ্গের মতো উড়ে বেড়ানো। হাঁসের সঙ্গে গোল্লাছুট খেলা। সখিদের সঙ্গে জলকেলি। কখনো শ্বশুরবাড়ির নির্যাতন, দমবদ্ধ পরিবেশের কারণেও সে বাবার বাড়ি যাওয়ার জন্য উন্মুখ হয়ে পড়ে। উকিল মুন্সির বর্ণনায়—

দুঃখ দিতে জানে বন্ধে দুঃখ বোঝে না
কান্দাইতে জানে বন্ধে কানতে জানে না,
মায়ে যে গো দিছে বিয়া না বুঝে সম্মান
দেশ-বিদেশে মুই অভাগীর কলঙ্কিনী নাম রে।।

নাইর থেকে সাহিত্যাঙ্গনের দিকে দৃষ্টি ফেরানো যাক। বাংলা সাহিত্যের এক বিশাল অংশ জুড়ে রয়েছে ‘ময়মনসিংহ গীতিকা’। এই গীতিকার যে পালাগুলো রচিত হয়েছে তা সবই হাওড় কেন্দ্রিক। মহুয়া, মলুয়া, দেওয়ান ভাবনা, দস্যু কেনারামের পালা প্রভৃতি কাহিনির প্রত্যেকটির সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে হাওড়ের হাহাকার। তলার হাওড়, বাইদ্যার দিঘি, নিরলইক্ষার চর, ধলাই বিল, জালিয়ার হাওড়, বাঘরার হাওড়, আড়ালিয়া বিল এবং ধনু ও কংস নদ একাকার হয়ে মিশে গেছে কাহিনির সঙ্গে। মহুয়াকে চুরি করে নিয়ে যাওয়া, আবার ফিরে আসা ও পালিয়ে যাওয়া এবং উদ্ধার-অভিযান সবকিছুরই প্রত্যক্ষ সাক্ষী হাওড় ও ধনু নদ। মলুয়া ও চাঁদ বিনোদের প্রেমকাহিনি, স্বামীকে ফিরে পেতে এবং দেওয়ানের লোভ-লালসা থেকে নিজেকে রক্ষা করতে মলুয়ার ধনুর্ভঙ্গ পণ জীবন্ত হয়ে ওঠে আড়ালিয়া বিল ও কোড়া শিকারের ফাঁদে।

নেত্রকোণার সাহিত্যজগতের প্রবাদ পুরুষ খালেকদাদ চৌধুরীর ‘সাপমারির অভিশাপ’ ও ‘চাঁদবেগের গড়’ উপন্যাস রচিত হয়েছে হাওড়ের পটভূমিতে। ‘সাপমারির অভিশাপ’ উপন্যাসে রয়েছে নেত্রকোণার সীমান্তবর্তী শনির হাওড়ের রহস্যময়ী আচরণ। হাওড়ের মধ্যবর্তী পাঁচতালীর খাল ও সাপমারির বিল এলাকায় বেদে গোত্রের সম্মান রক্ষার লড়াই এবং বিষাক্ত সাপের মাধ্যমে ভয়ংকর প্রতিশোধ গ্রহণের রোমহর্ষক কাহিনি বিধৃত হয়েছে এই উপন্যাসে। অপরদিকে, ‘চাঁদবেগের গড়’ উপন্যাসজুড়ে রয়েছে হালির হাওড়, ডিঙ্গেপোতা হাওড়, গণেশের হাওড়, জালিয়া ও বাঘরার হাওড়। এই সমস্ত এলাকা জুড়ে ছিল দুর্ধর্ষ ডাকাত চাঁদবেগের ত্রাসের রাজত্ব। ডাকাতি করতে করতেই এক সময় এক নারীর সান্নিধ্যে হয়ে যায় জনদরদি ও দেশপ্রেমিক শাসক। স্বজাতির বিশ্বাসঘাতকতা, দখলদার ব্রিটিশদের কূটচাল এবং দেশপ্রেমের অনবদ্য নজির কাহিনিতে যোগ করেছে ভিন্নমাত্রা। উভয় উপন্যাসের পরতে পরতে রয়েছে হাওড়ের সৌম্য সৌন্দর্য ও ভয়ংকর রূপের টুকরো টুকরো বিবরণ।

হাওড়ের উদাস দুপুরে বাতাসের টানে ভেসে চলা নৌকার মাঝির হৃদয়ের গভীর থেকে উৎসারিত হয় প্রাণের সুর। নিস্তব্ধ দুপুরের সেই সুর জলরাশির থিরিথিরি কম্পনে শিহরন তোলে শ্রোতার মরমে। অতলস্পর্শী সে আবেদন। লোকায়ত বাংলার মানুষের প্রাণের কথার সহজ সুর একটি বৈরাগ্যের আবহ তৈরি করে। স্বতঃস্ফূর্ত হৃদয়ের এই সুর ভাটিয়ালি নামে হাজির হয় সঙ্গীতাঙ্গনে। আপাত সহজ কথা ও সুরের এই গানের রয়েছে গভীর অর্থবোধকতা। ছায়েদুন্নেছা সরকার রচিত এবং আব্দুল আলীমের কণ্ঠে পরিবেশিত একটি বিখ্যাত ও জনপ্রিয় ভাটিয়ালি গান ধ্বনিত হয় বাংলার ঘরে ঘরে—

নাইয়ারে, ভাটির দেশে যাও যদি তুমি
হিজলতলীর হাটে
সেথায় আমার ভাইজান থাকে
আমার কথা কইও তাকে
মইলাম দুঃখে জ্বইলা।।

সহজিয়া এই সুরের অনুরণন মানুষকে নিয়ে যায় ভাবের জগতে, যেখানে লৌকিক প্রেম, ভালোবাসা, পরিণয় এবং পারলৌকিকতা মিলেমিশে একাকার। জালাল খাঁ-এর কথায় এমনটিই ধ্বনিত হয়—

এই বাইশ্যাতে নাহিরে নিলে গলায় কলসি বান্ধিয়া
ঐ না গহিন গাঙের তলায় মরিব ডুবিয়ারে।।

জালালে কয় আর কতদিন থাক সইয়া সইয়া
জল শুকাইলে নিবেরে নাইয়র বাঁশের পালঙ্ক দিয়ারে।।

শুরু হয় অসীমের উদ্দেশে যাত্রা। ক্ষণস্থায়ী ইহকাল থেকে চিরস্থায়ী পরকালের পথে। এই দুই কালের মধ্যে পারাপারের একটি সম্পর্ক বিদ্যমান। নদীর এক পাড় থেকে অন্য পাড়ে যাত্রার পারাপারে এসে তাই নদী, ঘাট, মাঝি, নৌকা রূপকার্থে বহুল ব্যবহৃত হয়। তাই তো পুলছিরাত পার হওয়ার জন্য মাঝির কাছে মরমী বাউল রশিদউদ্দিনের নিবেদন—

আমায় পার কর রাসুল॥
আখেরাতে আঁধার রাতে পুলছেরাতের পুল॥

তুমি সবার নায়ের মাঝি, তুমি সবার মূল
তুমি হাওয়া তুমি বাদাম তুমি হও নায়ের মাস্তুল॥

খেয়াঘাটের কুঞ্জি তুমি, অকুলেতে কুল,
মুই পাপীরে পার করিতে হয় না যেন ভুল॥

ইহকাল থেকে পরকালে যাত্রার সঙ্গে তুলনীয় ঘাট থেকে ঘাটের এই পারাপারকে সাধকগণ নাম দিয়েছেন পারঘাটতত্ত্ব। চালু করেছেন সাধনার একটি নতুন ধরন। সে সাধনা কঠিন আত্মনিয়ন্ত্রণের সাধনা। জাগতিক ক্ষুৎপিপাসা নিয়ন্ত্রণের সাধনা। কামনার সাগরে ঝড় উঠলে তা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য বাউল ফকির চাঁন্দ সাবধান করে দিয়েছেন—

যে ঘাট পার হইয়া আইলে
সেই ঘাটে কেন দিলে সাঁতার?

নদীর নাম কামনা সাগর, উঠে লহর
পাড়ি দেওয়া হইল না তার।

ফকির চাঁন্দ বাউলে বলে, নদীর কূলে
বসত করা হইল না, আর।

স্রষ্টাকে পাওয়ার অন্যতম বিষয় হলো ষড়রিপুকে নিয়ন্ত্রণ করা। আত্মনিয়ন্ত্রণের পর্যায়ে যৌবনের তাড়নায় পার্থিব ভোগ-লালসায় অবগাহন করলে মোক্ষলাভ করা হবে না। আবার যৌবনের প্রচণ্ডতায় শুধু ডুবাডুবি করলেই হবে না। প্রয়োজন পার্থিব চাহিদা অতিক্রমের অভ্যাস, সর্বোচ্চ ত্যাগ, গুরুর শিক্ষা এবং ভাবের সমুদ্রে অবগাহন। আবদুল মজিদ তালুকদারের গানে দুর্গম যাত্রাপথের বিবরণ এবং তা অতিক্রমের উপায় বাতলে দিয়েছেন।

ছয়জনা মোর নায়ের বাদি
কুপথে নেয় নিরবধি রে

উঠছে তুফান বিশাল নদী
পাড়ি ধরে ঠেকিলাম

ভব দরিয়ায় উঠছে তুফান
ভয়েতে কাঁপিছে পরাণ রে

সম্বল যে মোর মুর্শিদের নাম
ঐ নামেও নাও ছাড়িলাম।।

ভাবজগতের এই গহিন সমুদ্র থেকে মুক্তা আহরণের জন্য প্রয়োজন ক্ষণ ও লগ্ন সম্পর্কে বিশেষ ধারণা। প্রয়োজন উপযুক্ত গুরু, পির বা ওস্তাদ। তাহলেই সিদ্ধি লাভ করা সম্ভব। স্রষ্টাকে পাওয়ার পথে রয়েছে প্রতিবন্ধকতা। সমস্যাসঙ্কুল ও বন্ধুর পথ। তাই, উচ্চারণ করা হয়েছে সতর্কবাণী। নবীন সাধককে সাবধান করা হয়েছে প্রমাদজনিত লোকসান সম্পর্কে। বাউলরাজ চান মিয়া দিয়েছেন হিসাব-নিকাশের খতিয়ান—

বেলা গেল সন্ধ্যা হলো
যাবে রে কোথায়
চাইয়া দেখ ঢেউ বেশুমার
অকুল দরিয়ায়।।
নদীর উপর কালসাপিনী
সব সময় ঘুরে বেড়ায়
মন্ত্র ছাড়া কাছে গেলে
এমনি তারে ধইরা খায়।।

সাধনায় মোক্ষ লাভ করতে হলে লক্ষ্যে স্থির হতে হবে। তরঙ্গবিক্ষুব্ধ ও ঝঞ্ঝাসঙ্কুল পথ দেখে ভীত হলে চলবে না। কঠিন সাধনায় অটল থাকলেই শুধু পরমাত্মার সন্ধান পাওয়া যায়। সন্ধান মেলে পরপারের চিরস্থায়ী শান্তির। বাউল কবি রশিদ উদ্দিন পথ নির্দেশ করেছেন—

শোন বলি জালুয়ার ছেলে, বসে থাক নদীর কূলে
যখন নদীর জোয়ার চলে, ভেসে যায় তার অনেক মাল

ষোলোআনা টিকেট করে, পারঘাটা লও রিজার্ভ করে
ভয় পাইয়া পলাইস না দূরে, দেখিয়া তরঙ্গের তাল।

লক্ষ্যে অটুট থেকে কঠোর তপস্যার মাধ্যমে পাথেয় সঞ্চয় করতে হবে। লাভ করতে হবে আত্মিক উন্নয়ন। আত্মিক উন্নয়নের সঙ্গে তৈরি হয় অন্তর্দৃষ্টি। তাহলেই পাওয়া যাবে মুর্শিদের দেখা। পরপারের পরম প্রশান্তি। হবে মোক্ষ লাভ। মুর্শিদের নয়ন মনোহারি রূপ ভুলিয়ে দেবে সকল দুঃখ, কষ্ট আর শ্রান্তি। আব্দুল মজিদ তালুকদারের ভাষায় পাওয়া যায় অনবদ্য বিবরণ—

হিরামন মানিক্যির দেশে
আমার মুর্শিদ আছে।

সাত সমদ্দুর পাড়ি দিয়া
কেমনে যাই তার কাছে।।

সাত সমদ্দুর তেরো নদী
পার হইতে পারি যদি

দেখব সে রূপ নিরবধি
যদি দীন পরান বাঁচে।।

পানির এই প্রভাব সামাজিক জীবনের অন্যত্রও ছড়িয়ে পড়েছে। নেত্রকোণার খালিয়াজুরি ও সুনামগঞ্জ এলাকার ধামাইল গান ও হিন্দু মেয়েলি গীতেও রয়েছে পানির উপস্থিতি। গ্রামীণ সামাজিকতার শিলুক এবং জনপ্রিয় লোকছড়াতেও পাওয়া যায় পানির সংশ্লেষ। জনপ্রিয় লোকছড়ায় কখনো ছোট সোনামণির আপদ-বালাই দূর করার দাওয়া হিসেবে পানিকে ব্যবহার করা হয়েছে—

লালি লালি লালিরে, ঘুইঙ্গ্যা মাছের তেল
আমার আবু চান করে গায়ে মাইখ্যা তেল
গাঙে থাইক্যা আইন্যা পানি ঢাইল্যা দিছি গায়
আপদ বালাই লইয়া পানি গাঙে চইল্যা যায়।

হাওড়ের পানি ভাটি অঞ্চলের মানুষের জীবন ও জীবিকার রসদ। পানি যেমন এই জনপদকে বিপর্যস্ত করে, তেমনি মাছ, ফসল এবং সমৃদ্ধ সামাজিকতা ও সংস্কৃতি করেছে অনন্য। তাই, সিরাজ উদ্দিন কাশিমপুরীর এই পানির সীমানায় খুঁজে পান জীবনের রং, আবার কখনো বিচ্ছেদের বিউগল—

আমার ভাইটাল গাঙ্গের নাইয়া
তুমি কোন দেশে যাও, রঙ খেলাইতে রঙের ভান্ডার লইয়া।
এই না গাঙ্গোর এই বাঁকেতে
কত রঙ খেলাইতাম বন্ধুর সাথেরে…
এখন বন্ধু আমার ছাইড়া গেছে
আমি কান্দি তার লাগিয়া।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৬ এপ্রিল, ২০২৪)
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
ট্রাকেই পচে যাচ্ছে ভারত থেকে আনা আলু, বাজারে ৫৫ টাকা কেজি
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
দুর্বৃত্তের হামলায় গুরুতর আহত যুবলীগ নেতা
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা