X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

চল্লিশদিন উপন্যাসের সঙ্গে সহবাস, মৃত্যু পর্যন্ত

সমরেশ রায়
২৮ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৩০আপডেট : ২৮ অক্টোবর ২০২১, ১৬:৩০

শেষ পর্ব

সহবাসের রোজনামচা : ১
 
২০২০-র ৭ এপ্রিলে, পেপার ক্র্যাফটের, খাতার প্রথম পাতায় ‘কয়েক জন্মের তফাতে/ইয়ুসুফ-জুলেখার/মিলন কিংবা/স্বপ্নই সত্য’—লেখা বাঁদিকের সাদা পাতায় কুড়িটা অধ্যায়ের তালিকা, এক থেকে ছয় নম্বরের পাশে লম্বা টানা দাগ, পাশে লেখা ‘লেখা নেই’, সাত থেকে উনিশের ও আলাদা-লেখা, কুড়ি নম্বরের পাশে লেখা ‘লেখা আছে’। আরো কিছু নোটস, পরের পৃষ্ঠায় সূচি (এই খণ্ডের অধ্যায়ভাগ)। উপন্যাসটা লিখে ফেলার কথা হয়েছিল মার্চ মাসে, ছাব্বিশ সাতাশ নাগাদ। এরমধ্যে রোজ সকাল-সন্ধ্যা চারতলায় আসলেও, লেখালেখির কথা হয়নি। লিখতে দেখেছি। বারান্দায়, তিতিরের ঘরের চেয়ারে, কখনও বড়বৌদির ঘরে, যেখানে এখন দাদা দুপুরে ও রাতে শোয়। কী লিখছে সে-সব কোনোদিনই জিগ্যেস করি না। এখনও করিনি। আমি বুঝতেও পারিনি ইয়ুসুফ-জুলেখার শুরু হয়েছে। বলেওনি। বলে না কখনও। কথাও হয়নি এর মধ্যে। লকডাউনের অনিশ্চয়তায় ব্যতিব্যস্তও ছিলাম খানিক। উঁচু করে রাখা হাঁটুর ওপরে রাখা লেখার বোর্ডটা যেন বুকের ভেতরে ঢুকিয়ে নিয়েছে, বাঁ হাতে মুঠো করে ধরা বোর্ডের একধার, বোর্ডের ওপর ঝুঁকে রয়েছে, নোয়ানো মাথা যেন বোর্ডে লাগানো খাতার পাতা ছুঁয়েছে, চশমা নেই চোখে। কোনো শব্দ না করে, আমার চেয়ারে বসে তাকিয়ে থাকলাম সেই আত্মমগ্নতার দিকে। চকিতে একটা ছবি ভেসে উঠল মনে। আলি আকবর সাহেব বাজাচ্ছেন টাউন হলে। দু-হাতে যেন জড়িয়ে ধরেছেন সরোদ, বুকে, মাথা নোয়ানো সরোদের তারের ওপরে, চোখ বুঁজে, বুকের ভেতরের সুর শুনছেন। আর আঙুলের টোকায় যন্ত্রের তারে সুর লাগছে। ডানহাতের আঙুলের, করতলের সামান্য সঞ্চলন ছাড়া স্থির শরীর, মূর্তির মতো।
 

সহবাসের রোজনামচা : ২ 

—বাইবেল-এর কোনো ডিকশেনারি নেই রে? 
—আছে তো—দোতলায় থাকার কথা, একটা ছোট ছিলো, পরে অক্সফোর্ডের পেপার ব্যাক বই মেলায় কিনেছিলাম। দাঁড়া সখাকে জিগ্যেস করি। 
সখা আমার বারো ক্লাসে পড়া নাতি। আমার বইপত্রের বিশেষ করে ডিকশেনারির খোঁজখবর রাখতো। বারো ক্লাসের পড়ার চাপে এখন আর আগের মতো পারে না। তবে নতুন কোনো অভিধান কিনলে তাকে দেখানো বাধ্যতামূলক। 
—আরে ও জানবে কী করে? 
—ও-ই জানবে, ওই দোতলার অভিধানের লাইব্রেরিয়ান সখাকে ফোন করে জানা গেল, বাইবেলের ডিকশেনারি আছে। ব্রকহ্যাম্পটনের একটা, অক্সফোর্ডের একটা। বই দুটো উল্টেপাল্টে দেখতে দেখতেই বলো
—তুই তো ভালো অ্যাসিসটেন্ট পেয়েছিস রে—বই খুঁজে এনে দিতে পারে, বই পড়ে? 
—পড়ে তো দেখি, ওর পছন্দের বই অ্যামাজন থেকে আনায়ও, ছোটবেলা থেকে আমার সঙ্গে একদিন বইমেলায় যায়, যে বই ইচ্ছে কিনতে পারে, স্কাই ইজ দ্য লিমিট। সেটা এখনও চালু আছে। আমি তো ডিকশেনারির জন্যই বইমেলার যাই—এখন সখাও আমার জন্য ডিকশেনারি খোঁজে। 


সহবাসের রোজনামচা : ৩
 
—তোর কাছে বাইবেল আছে? 
—আছে—বাইবেল হাউজ থেকে কিনেছিলাম। 
—ওখানে ওল্ড টেস্টামেন্ট আছে? 
—ওল্ড-নিউ দুই-ই আছে—ওল্ড টেস্টামেন্ট ছাড়া বাইবেল হয়? 
—হয়—ওই নীলচে রঙের বইটা দেখ, ওল্ড টেস্টামেন্ট নেই। 
বইটা এনে উল্টেপাল্টে দেখলাম। 
—আরে এরা তো কীসব তত্ত্ব দিচ্ছে, ওল্ড টেস্টামেন্ট স্বীকার করে না—পাগলা নাকি? আরে ওল্ড টেস্টামেন্টেই তো বাইবেল 
—ওদেরও তত্ত্ব আছে—যুক্তি আছে। 
—পাগলের কথায়, কাজের ও তো যুক্তি থাকে, পাগলদের কাছে সে-সব সত্য। তোর বাইবেল লাগবে? দিয়ে যাবো? 
—নাহ থাক, আমি যা খুঁজছি ওখানে পাবো না। 
—কতটা লেখা হলো? 
—অনেকটা। ইয়ুসুফকে নিয়ে বুড়ো সওদাগর ফ্যারাও-এর নগরে যাচ্ছে নো-আমূনে। ওকে বিক্রি করতে। নৌকো করে। ইয়ুসুফের মিশর প্রবেশ হচ্ছে, জুলেখাও এখানেই ইয়ুসুফকে দেখবে আবার। 
—তুই ইয়ুসুফকে নিয়ে কতদূর যাবি? 
—যতদূর যাওয়ার, উপন্যাসের প্রয়োজনে যতটা নিয়ে যেতে হবে ততটা। তুই তো সকালে আর সন্ধ্যায় উঁকি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করিস। কথা বলারও কেউ নেই। যতক্ষণ জেগে থাকি লিখি। লেখাটা মনের মধ্যে ঘুরপাক খেতে খেতে তৈরি হয়, ঘুমের মধ্যেও। 
—লেখাটা যেন তৈরি হয়েইছিলো, এত তাড়াতাড়ি এতটা লেখা হয় না হলে? শেষ করে ফেল—এরপর তিস্তাদেশ ধরতে হবে এ রকম অবসর আর পাবি না 
—আমার অবসরের দরকার নেই—এভাবে লেখা যায়? ব্যস্ততা—মানুষজনের আসা যাওয়া, ঝগড়াঝাটি, প্রুফ দেখা—এসবের ভেতর থেকে সময় বের করে লিখতেই তো আমি স্বচ্ছন্দ, এভাবেই লিখেছি সারা জীবন।
—আরে সারা জীবনই তো বেড়ালের মতো ছানা মুখে একোণ ওকোণে বসে লেখার জায়গা খুঁজলি—এ কটা দিন না-হয় রয়ে-বসে লেখ, কেউ বিরক্ত করার নেই।
—আমার এখন একটু বিরক্তি দরকার—লেখালেখির জন্যেই দরকার—কবে শেষ হবে লকডাউন? 
—ভগায় জানে, সবাই তো প্রাণের ভয়ে বাড়িতে সেঁধিয়েছে। 
—ভয় দেখালে ভয় পাবে না? 


সহবাসের রোজনামচা : ৪
 
—এই খাতাটা নিয়ে যা, রাতের মধ্যে পড়ে সকালে নিয়ে আসবি, তোর সঙ্গে কথা বলে শেষটা শুরু করব, না-হলে দু-চার পাতা লিখে শেষ করে দেবো। 
—উপন্যাস তো ডানা মেলে উড়ছে, এক্ষুণি শেষ করবি ভাবিসও না।
—পড়লি? 
—রাতে অনেকটা, ঘুম থেকে তাড়াতাড়ি উঠে বাকিটা ইয়ুসুফ তো জুলেখার দিকে যাচ্ছে পাহাড়-পর্বত-সমুদ্র-মরুভূমি উজিয়ে। 
জুলেখার কথা না জেনেই। ইয়ুসুফের স্মৃতি জাগরণের সঙ্গেই জুলেখার স্মৃতি জাগরণ হতে পারে, না-ও পারে—দারুণ। 
—লিখবো বলছিস? 
—মনের আনন্দে। 


সহবাসের রোজনামচা : ৫
 
—হ্যাঁরে, ইয়ুসুফ ওর ভাইদের ডেকে আনছে, সে পর্যন্ত যাব? 
আবার ভাই বেরাদর ডাকবি? কেন? 
—ডাকলে ক্ষতি কি? তুই একটু পড়ে দেখবি যতটা লিখেছি? 
—নাহ—শেষ হলে পড়ব। 
—তোর আপত্তি আছে মনে হচ্ছে ইয়ুসুফের ভাইদের ব্যাপারে। 
—আপত্তি না—মনে হচ্ছে তাহলে তো গল্পটা ইয়ুসুফের গল্প হয়ে যাবে। গল্পটা। তো জুলেখার স্বপ্নপুরুষের সন্ধান, আমরা তো জুলেখার গল্প শুনতে চাইব—
আমি একটু ভেবে ভেবে বললাম। আমার মাথার ওপর দিয়ে অনির্দিষ্ট একদিকে তাকিয়ে থাকল খানিকক্ষণ। 
—ঠিকই তো, গল্পে শুরুই তো জুলেখার স্বপ্নপুরুষের সন্ধান—ঠিক বলেছিস। দেখি। 
—সেদিন, কম্পাস দিয়ে আমরা দিক ঠিক করলাম, তুই দিক হারানোর কথা বলেছিলি, এখন যেন বুঝতে পারছি তোর মনে কী ছিলো—খুব জব্দ করেছিস—
—তাহলে গল্প নিয়ে আর একটু খেলা যেতে পারে বলছিস? 
—একটু কেন, চালাও পানসি বেলঘরিয়া।

 
উপন্যাসের সহবাসহীন দিন ও রাত
 
সকালে, আমাদের সকালে, চারতলায় গিয়ে দেখি দাদা ঘরে নেই। গরম পড়ে গেছে। এখন তথা বারান্দায় আড্ডা বসে বিকেলে, বা তিতিরের ঘরে। আজ কী হলো? বারান্দায় চেয়ারে একটু অতিরিক্ত এলিয়ে বসেছিলো। সামনে ছড়ানো পা ছোট কাঠের জলচৌকিতে রাখা। 
—এখানে বসে আছিস কেন গরমে? 
—ভালো লাগছে, চারদিক ফাঁকা, হাওয়া আছে তো। 
—রাতে ঘুমোসনি? 
—ও-ই—অনির্দিষ্ট আঙুলে ভঙ্গি গড়ে ওঠার আগেই যেন ভেঙে গেল। আমি একটু দ্রুত পায়ে শোয়ার ঘরে গিয়ে লেখার খাতাটা বোর্ড থেকে খুলে নিলাম। দেখলাম শেষ লেখা পৃষ্ঠায় অচেনা হাতের লেখা কয়েকটা লাইন, অক্ষরগুলোয় সাম্য নেই, কেমন তেড়ছে গিয়েছে এদিক ওদিকে। হঠাৎ-ই আমার বুকের খুব খুব গভীরে মৃদু আর্তনাদ শুনতে পেলাম। লাইনগুলো এই রকম : 
‘যেকোনো সমান্তরাল সিদ্ধান্তকেই সহজতর মনে হয়। মিলে গেলে সেই মিলটাকে কী সহজ মনে হয়। না মিললে, সেই মিলটা কী অসম্ভব ঠেকে। আমি তো এই প্রলয়ের উৎস জানি না। 
আমি শুধু আমাকে গন্তব্যে নিতে চাই—সেই উদ্দেশ্যে আমার ডিঙিটার পালটাকে পৌঁছানোয় হাওয়ার অনুকূলে বাঁধতে পারি। কিন্তু এ তো জল নয়। মাটি ও পাথর। এখন কোনো রকমে এই প্রলয়ের সংযোগটুকু না ছেঁড়া। সেটাই একমাত্র ভরসা। কিন্তু সে ভরসাও খুব কম। কতটুকু কম তাও হিশেব করা যায় না। এগুলো কোনোটাই আমাদের তৈরি না, নয়। আমাদের তৈরিতে এগুলি ব্যবস্থাগুলি চলে না। অথচ একটা আপাত আপাত আলগা আলগা যেন আমাদের চলে। সেই চলায় মালিক চালার কর্তৃত্ব চলে না। এ এমন এক শক্তি যা নিজের জোরে আর সবকিছুকে অবান্তর করে দেবে। নিজেদেরও। এই প্রলয়ের সামনে অবনত হওয়া ছাড়া কোনো ভঙ্গি নেই। একটা নতুন কোনো উপায়ও নেই। সৎ মানুষ বলবে : পালিয়ে আয়, পালিয়ে আয়। কিন্তু সেই পালিয়ে আসাটাও অমিশ্র ছিল না। পালিয়ে আয়—নিজেকে বাঁচিয়ে, সেটা অসম্ভব।’ 
খাতাটা বোর্ডে লাগিয়ে, বালিশের পাশে রেখে বারান্দায় গেলাম, একটু ব্যস্ত পায়ে। 
—লিখিসনি কেন? 
—সেনটেন্সগুলো হারিয়ে যাচ্ছে সেনটেন্সগুলো। 
আমি বসার জায়গায় গিয়ে আমার ছেলে বাবানকে ছোড়দার গোপালকে, ফোন করে বললাম—চারতলায় আয়।—আর ডাঃ শবরী মজুমদারের ফোন নম্বরের বোতাম টিপলাম। 
ভি আই পি রোডের নার্সিং হোমের সামনে রাস্তার ডিভাইডারে আমরা তিনজন বা চারজন ইতস্তত বসে আছি, রাত্রির দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রহরে; আইসিসিইউ-এর আবছায়া শীতল অন্ধকারে, তখন, আপন শরীর থেকে সকল জ্ঞান ও বোধ ও চেতনা, করতল থেকে আত্মীয়তার উষ্ণতা বর্জন করতে করতে, এক কথোয়াল, গভীর গভীরতর কোনো এক চৈতন্যের ধূ ধূ নদীচরে, নির্মেঘ আকাশ-মহাকাশের শূন্যে, তাকে ছেড়ে যাওয়া বাক্য বাক্যাংশ অক্ষর খুঁজে বেড়ায় আলোয় অথবা অন্ধকারে।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর ডাকাতের হামলা
নদীতে মাছ ধরার সময় জেলেদের ওপর ডাকাতের হামলা
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
ক্রিমিয়া উপকূলে রুশ সামরিক উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
হোয়াইট হাউজের বিড়াল নিয়ে বই প্রকাশ করবেন মার্কিন ফার্স্টলেডি
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
সর্বাধিক পঠিত
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
মন্ত্রীর অপেক্ষায় তরমুজ বিক্রিতে দেরি, ক্ষুব্ধ ক্রেতারা
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!
সমুদ্রসৈকতে জোভান-সাফার ‘অনন্ত প্রেম’!