X
বুধবার, ২৪ এপ্রিল ২০২৪
১১ বৈশাখ ১৪৩১
কাজী মোতাহার হোসেন

শিক্ষকতার সেকাল-একাল

ড. এম আবদুল আলীম
৩০ জুলাই ২০২২, ১৩:০০আপডেট : ৩০ জুলাই ২০২২, ১৩:০০

এক.

কাজী মোতাহার হোসেন (১৮৯৭-১৯৮১) সম্পর্কে আলোকপাত করতে গেলে তাঁর সেসব বৈশিষ্ট্য, গুণাবলি, কর্ম ও কীর্তির কথা সামনে আসে, সেগুলোর মধ্যে প্রথমেই উচ্চারণ করতে হয় শিক্ষকতা/অধ্যাপনা-প্রসঙ্গ। একইভাবে কৌতূহল জাগে শিক্ষকতা কী? এ পেশার গুরুত্ব কিংবা মাহাত্ম্যই-বা কী? আর কিসের ভিত্তিতেই-বা কালে কালে অন্য পেশার মানুষের চেয়ে শিক্ষকরা সমাজে স্বতন্ত্রভাবে মূল্যায়িত হয়েছেন? শুধু কী তাই? অনুসন্ধিৎসু মনে প্রশ্ন জাগে শিক্ষক হিসেবে কাজী মোতাহার হোসেনের স্বকীয়তা, তাঁর কালের শিক্ষকদের কর্ম, নীতি এবং আদর্শ থেকে একালের শিক্ষকদের কর্মকাণ্ডে বড়ো ধরনের কোনো হেরফের ঘটেছে কি না? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গেলে প্রথমেই বলতে হয় শিক্ষকতা, অধ্যাপনা বা গুরুগিরি সহজ নয়; এ পেশার মানুষ স্বীয় জ্ঞান, প্রজ্ঞা, মেধা-মনন, দক্ষতা, অভিজ্ঞতা এবং জীবনাচার দ্বারা শিক্ষার্থীর মনে গভীর প্রভাব ফেলেন, তাকে দক্ষ ও যোগ্য করে গড়ে তুলতে কাজ করেন; সর্বোপরি নিত্য-নতুন জ্ঞান, বুদ্ধি ও চিন্তার উদ্ভাবন/কর্ষণ দ্বারা সমাজ-সভ্যতার অগ্রগতিতে অবদান রাখেন। শিক্ষকরা হন উন্নত জীবনাদর্শের, যা সমাজের কাছে হয় অনুকরণীয়-অনুসরণীয়। একজন প্রকৃত শিক্ষক শিক্ষার্থীর ভেতরের সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ ঘটান, তার মধ্যে কৌতূহল জাগ্রত করেন, তার চেতনায় প্রজ্বালিত করেন জ্ঞানের দীপশিখা, তাকে চিনিয়ে দেন সত্য-মিথ্যা এবং আলো-অন্ধকারের পার্থক্য। এক কথায় শিক্ষার্থীর দৈহিক, বৌদ্ধিক, আধ্যাত্মিক, সামাজিক, মানবিক, নান্দনিক সকল দিকের উৎকর্ষ সাধন করে যিনি তার মনে স্থায়ী আসন গাড়তে পারেন, তিনিই প্রকৃত শিক্ষক। কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন এ দলভুক্ত, যাকে বলে জাত শিক্ষক, তিনি ছিলেন তা-ই। পঠন-পাঠন, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা, গবেষণা, জীবনাচার, নীতি-আদর্শ এবং চিন্তা-চেতনা-কর্ম দ্বারা তিনি ও তাঁর কালের শিক্ষকেরা সমাজে স্থায়ী প্রভাব বিস্তার করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তাঁরা জাতির সার্বিক অগ্রগতিতে রেখেছিলেন অসামান্য অবদান। সেই ধারাবাহিকতায় সেকালের গণ্ডি পেরিয়ে একালের শিক্ষকদের অনেকে জ্ঞানান্বেষণ-জ্ঞানদান, অধ্যয়ন-অধ্যাপনা, উদ্ভাবনা, উন্নত জীবনাদর্শ প্রতিষ্ঠায় নিজেকে নিয়োজিত রেখেছেন। তবে এও সত্য যে, যুগ-পরিবেশ এবং সমাজের সামূহিক অবক্ষয়ের সঙ্গে গা ভাসিয়ে শিক্ষকদের বড়ো একটা অংশ শিক্ষকতার সেই মহান আদর্শ থেকে যে দূরে সরে গেছেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

স্রষ্টায় বিশ্বাসী মানুষদের কাছে আদি শিক্ষক স্রষ্টা। একেক ধর্মে তা একেকভাবে মান্য করা হয়। ইসলাম ধর্মে আল্লাহ আদি শিক্ষক। হিন্দু ধর্মে জ্ঞান, সংগীত, শিল্পকলা, বাক্য, প্রজ্ঞা ও বিদ্যার্জনের দেবী সরস্বতী। কীভাবে কোন্ পথে যেতে হবে, সে শিক্ষা শিশুকে দেওয়ার স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন যীশুখ্রিস্টও। ধর্মগ্রন্থগুলোতে শিক্ষার ওপর ব্যাপক গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। পবিত্র কুরআনের প্রথম আহ্বানই হচ্ছে ‘ইকরা’ অর্থাৎ—পড়ো। স্রষ্টায় অবিশ্বাসীদের মতে, আদি শিক্ষক প্রকৃতি; সৃষ্টির ঊষালগ্ন থেকে সভ্যতার বিকাশের ধাপে ধাপে প্রকৃতির পাঠশালা থেকে শিক্ষা নিয়ে মানুষ নিত্য-নতুন উদ্ভাবনে মেতে উঠেছে এবং সভ্যতার অগ্রগতির পথ প্রশস্ত করেছে। বুদ্ধিদীপ্ত প্রাণী হিসেবে মানুষ সৃষ্টির অপার রহস্য অনুসন্ধানে যতই এগিয়েছে, ততই তার মধ্যে জাগ্রত হয়েছে জানা ও শেখার কৌতূহল। আর তা থেকেই সৃষ্টি হয়েছে তাদের জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও উদ্ভাবনী শক্তি। এক্ষেত্রে যে যত জ্ঞান, দক্ষতা ও সম্মোহনী শক্তির অধিকারী, সে ততই অন্যের কাছে অনুকরণীয় এবং মান্য হয়ে গুরু তথা শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছেন। প্রাচীন কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত মানবসভ্যতার যে অভিযাত্রা তাতে শিক্ষকেরাই সবচেয়ে বেশি দেখিয়েছে চলার পথের দিশা। এক্ষেত্রে ধর্মপ্রবর্তক, সমাজতাত্ত্বিক, দার্শনিক, বিজ্ঞানী নানাজন নানা ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। সুসংবদ্ধভাবে শিক্ষা দিতেই সভ্যতার বিকাশের এক পর্যায়ে উদ্ভব হয় প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার, গড়ে ওঠে বিভিন্ন ধরার শিক্ষা ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। প্রাচীন গ্রিস, রোম, ভারতবর্ষ, আরবভূমি, ইউরোপ ও আমেরিকা হয়ে পৃথিবীর দেশে দেশে তার আলো ছড়িয়ে পড়ে। সময়ের প্রবহমাণতায় এক সভ্যতা থেকে অন্য সভ্যতা এবং এক দেশ থেকে অন্য দেশে তার বিস্তার ও সঞ্চার ঘটে। গুরুগৃহ থেকে ধর্মশালা হয়ে মানুষ ক্রমে হাজির হয়েছে অত্যাধুনিক স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ে; অভিনিবিষ্ট হয়েছে সমাজ, রাজনীতি, সাহিত্য-সংস্কৃতি, দর্শন, ইতিহাস, ভূগোল, বিজ্ঞান-প্রযুক্তির অধ্যয়ন ও গবেষণায়। সে একদিন-দুদিনের পথ নয়, কাজ নয় একজন-দুজনেরও; সে পথ বহু কালের, বহু শতাব্দীর অগণন মানুষের সাধনার মসৃণ হয়েছে।

দুই.
দেশে দেশে কালে কালে অনেক শিক্ষকের আবির্ভাব ঘটেছে। সক্রেটিস ক্রমাগত প্রশ্ন করে তার উত্তর-প্রত্যুত্তরের মাধ্যমে শিষ্যদের মাঝে জ্ঞান উস্কে দিতেন। সক্রেটিসের শিষ্য প্লেটো ‘লাইসিয়াম’ প্রতিষ্ঠা করে সেখানে জ্ঞানের বিচিত্র শাখায় পাঠ দিতেন। প্লেটোর শিষ্য এরিস্টটলও বিদ্যালয় খুলে শিষ্যদের মাঝে জ্ঞানবিতরণ করতেন। ষষ্ঠ শতাব্দীতে কেমব্রিজ নগরের প্রধান তোরণের পাশে এক বীজাগারে ফ্রান্স থেকে আসা চার নর্মান সাধু এবং অর্লিয়ঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক অ্যাবট জেফ্রিদ বক্তৃতা করে স্থানীয় জনসাধারণকে উজ্জীবিত করেন। পরবর্তীকালে বিশ্ববিদ্যালয়সহ নানা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে জ্ঞানে-প্রজ্ঞায় প্রাগ্রসর ব্যক্তিরা শিক্ষকতা করেন। মধ্যযুগে অনেক শিক্ষকের জনপ্রিয়তার ওপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠে বিখ্যাত সব বিশ্ববিদ্যালয়। বিস্তৃত হয় জ্ঞানের নানান শাখা-প্রশাখা। এমন একজন শিক্ষক ছিলেন প্যারিসের আবেলার্ড (১০৭৯-১১৪২); স্বকীয় চিন্তা, প্রথাবিরোধী বক্তব্য এবং পাঠদান দক্ষতায় তিনি সেকালের প্যারিসের মানুষকে শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলেন, যা জন্ম দেয় বুদ্ধিবৃত্তিক আন্দোলনের। যার অনিবার্য ফসল প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়। ইতালির ইরনেরিয়াসও (১০৫০-১১২৫) এমনই একজন জ্ঞানদীপ্ত শিক্ষক ছিলেন; যিনি মানসিক শক্তি, সাহসিকতা, বাচনভঙ্গি ও চিন্তার দ্বারা গড়ে তুলেছিলেন বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ। ভারতবর্ষের বিভিন্ন বিহারে জ্ঞানের নানা শাখার চর্চা ও প্রসারে অবদান রাখেন কীর্তিমান অনেক পণ্ডিত। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও জ্ঞানের মশাল উচ্চে তুলে ধরেন অগণিত শিক্ষক। মূলত, সাধনা, শিক্ষকদের পাঠদান দক্ষতা, জ্ঞানান্বেষণ ও জ্ঞান উদ্ভাবনের ফলেই দেশে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। জাতির উন্নত মনন গঠন এবং চিত্তবৈভব গড়তে শিক্ষকরা পালন করেছেন ঐতিহাসিক ভূমিকা। কাজী মোতাহার হোসেনের কালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান, দর্শন, ইতিহাস, সাহিত্য-সংস্কৃতিসহ জ্ঞানের বিচিত্র শাখায় পঠন-পাঠন ও গবেষণায় অবদান রাখেন অনেক গুণী শিক্ষক; যাঁদের মধ্যে ছিলেন মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, জ্ঞানচন্দ্র ঘোষ, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, রমেশচন্দ্র মজুমদার প্রমুখ। শিক্ষার্থীদের পাঠদান, উন্নত রুচি-মন গঠন, স্ব-স্ব বিষয়ে গবেষণা, নীতি-নৈতিকতাবোধে তাঁরা প্রত্যেকেই ছিলেন এক একজন দিকপাল। সমকালে তো বটেই, বর্তমান কালেও তাঁদের গবেষণা, উদ্ভাবনী চিন্তা ও জীবনাদর্শ জাতিকে সামনে এগিয়ে চলার প্রেরণা জোগায়।

তিন.
নানা গুণে-গুণান্বিত হলেও কাজী মোতাহার হোসেন শিক্ষকতা তথা অধ্যাপনাকেই সবকিছুর ওপরে স্থান দিয়েছিলেন। পদার্থবিজ্ঞান, গণিত, পরিসংখ্যান প্রভৃতির গবেষণা; সাহিত্য-সংস্কৃতিচর্চা, পঠন-পাঠন ও লেখালিখি; দাবা খেলা এবং সমকালের নানা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হওয়া; দৃঢ় ব্যক্তিত্ব, উন্নত রুচি, মানবিক গুণ, অসাম্প্রদায়িক চেতনা এবং নীতি-নৈতিকতায় সকলের কাছে ছিলেন অনুকরণীয়। বিজ্ঞানাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ বসু এবং সংখ্যাতত্ত্ববিদ প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশের মতো গুণী ব্যক্তির নিবিড় সান্নিধ্য তাঁকে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের গবেষণায় গভীরভাবে নিবিষ্ট করে। তবে এ পথে তাঁর যে অভিযাত্রা, তা আকস্মিক নয়; শৈশবে স্কুল শিক্ষকদের কাছে পেয়েছিলেন মানবিকতা, অসাম্প্রদায়িকতা এবং বিজ্ঞানমনস্কতার দীক্ষা। পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে অধ্যাপনা, উচ্চতর গবেষণা তো করেছেনই; পরিসংখানবিদ্যায় নিয়েছেন ডিপ্লোমা ও এিইচডি ডিগ্রি। এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগ এবং পরিসংখ্যান গবেষণা ইনস্টিটিউটের গোড়াপত্তন করে এ বিদ্যার পঠন-পাঠন ও গভেষণায় যুগান্তকারী অবদান রাখেন। দেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে তাঁর গবেষণা বিদেশি পণ্ডিত-বিশেষজ্ঞের কাছেও সমাদৃত হয়। জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চাকে তিনি গুটিকয় মানুষের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার পক্ষপাতী ছিলেন না; বিজ্ঞানের বিষয়কে সাধারণ পাঠকের উপযোগী করে সহজ-সরল বাংলায় তুলে ধরেছেন। শিক্ষক হিসেবে ছিলেন অসাধারণ; তবে বেশভূষা, জীবনাচারে ছিলেন অনাড়ম্বর। সাধারণ জীবন-যাপনে অভ্যস্ত হলেও চিন্তা ও আদর্শে ছিলেন খুব উন্নত। তাঁর পাঠদান শিক্ষার্থীদের যেমন মুগ্ধ করত, তেমনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে করতো গভীর কৌতূহলী। শ্রেণিকক্ষে তাঁর পড়ানোর ধরন কতটা আকর্ষণীয় এবং চিত্ত-মননগ্রাহী ছিল তা জানা যায় তাঁর ছাত্রদের স্মৃতিচারণামূলক রেখা থেকে। এঁদের একজন জামিল চৌধুরী লিখেছেন : ‘একজন আদর্শ শিক্ষক বলতে আমি যা বুঝি, কিউ এম এচ ছিলেন তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। লেখাপড়া নিয়ে মেতে থাকতেন সারাক্ষণ। বেশভূষায় ছিলেন অত্যন্ত সরল। ... প্রথম যখন আমাদের ক্লাস নিতে আসেন তখন আকাশের দিকে তাকিয়ে অবাক হয়েছিলাম এই ভেবে যে, স্বনবিদ্যার মতো একটি জটিল বিষয় কি করে এমন সহজভাবে বাংলায় পড়ানো যায়!’ তাঁর পাঠদানের পদ্ধতি ছিল সহজ ও কার্যকরী। সবকিছু গোড়া থেকে শুরু করতেন। বিশ্বাস করতেন, বহুতল ভবনের মতোই বিদ্যার ভিত মজবুত মজবুত না হলে তা টেকসই হয় না। শ্রেণিকক্ষের বাইরেও শিক্ষার্থীদের সঙ্গে মিশতেন; গান, কবিতা ও এবং খেলাধুলায় উৎসাহ দিতেন। তাঁর ছাত্র আব্দুল্লাহ আল-মুতী লিখেছেন : ‘ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে সহজভাবে যোগ দিতেন গানের জলসায় (কখনো নিজেই গাইতেন দু-চারটি গান), ফুটবল বা টেনিস খেলায়, দাবার আসরে।’ কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন সত্যিকারের গুরু, যাঁর দীক্ষা নিয়ে শিষ্যরা আজীবন পথ চলেছেন। এমন একজন ছাত্র এম শমশের আলী বলেছেন : “জীবনে যে ক’জন মানুষকে মনে প্রাণে অনুসরণ করেছি তিনি তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করেন, ‘আপনার শাস্ত্র তো পদার্থবিজ্ঞান, কিন্তু আপনি বিজ্ঞান ছাড়াও সাহিত্য, ধর্ম ও সংস্কৃতির জগতে অত সহজে বিচরণ করেন কি করে?’ উত্তরে আমি শুধু একটা কথাই বলি, ‘আমি আমার গুরুর পদচিহ্ন অনুসরণ করে চলি। জীবনে তিনি যা যা করেছেন আমিও সেগুলোই করে চলেছি সারা জীবন।”

চার.
কাজী মোতাহার হোসেন এবং তাঁর কালের শিক্ষকদের চেয়ে একালের শিক্ষকদের পার্থক্য বিস্তর। তাঁর উত্তরসূরী যে একেবারেই হয়নি তা নয়, তবে সংখ্যায় কম। শিক্ষক হিসেবে তাঁর যেমন গ্রহণযোগ্যতা, আপোসহীনতা, উদারতা, দৃঢ়তা, স্রোতের বিপরীতে শক্ত অবস্থান গ্রহণ; এক কথায় শিরদাঁড়া সোজা করে দাঁড়িয়ে থাকার যে দুঃসাহস ছিল, তা একালের শিক্ষকদের মধ্যে প্রায় দেখাই যায় না। অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক বলেছেন : “চারিত্রিক দৃঢ়তার দিক থেকে কাজী মোতাহার হোসেন সম্পর্কে বলা যায়, ‘দেয়ার ইজ নো রেকর্ডস অব এনি কম্প্রোমাইজ’। নিজের মতের কোন নড়চড় করেন নাই। যা বিশ্বাস করতেন তা সরলভাবে প্রকাশ করতেন। এবং তাঁকে কোনভাবেই প্রভাবিত করা যায় নাই। পাকিস্তান আমলে তো কিছু সময় রিক্স ছিল তো তিনি ওই রিস্ক-ফিস্ক নিয়া মাথা ঘামাননি কোনকালে।” একালের শিক্ষকরা বেশিরভাগই কম্প্রোমাইজ করতে এবং স্রোতের অনুকূলে গা ভাসাতে অভ্যস্ত। অধিকাংশ শিক্ষকের পঠন-পাঠন, অধ্যয়ন, অনুসন্ধান, গবেষণাবিমুখতা তো আছেই; তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সুবিধাবাদিতা। পদ-পদবি এবং সুযোগ-সুবিধার লোভে এমন কোনো তোষামোদী নেই, যা করতে তারা দ্বিধা করেন। নীতি-আদর্শের প্রশ্ন সে তো অনকের অভিধানেই নেই; হালুয়া-রুটির আশায় শিক্ষকতার মূল কাজ পাঠদান, গবেষণা এবং জ্ঞানসৃষ্টি থেকে দূরে গিয়ে তারা দল-উপদলে বিভক্ত হয়ে অশিক্ষকসুলভ কর্মকাণ্ডে সময় কাটান। বর্তমান কালের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকের মধ্যে অবক্ষয়ের চূড়ান্ত রূপ লক্ষ করা গেছে, উপাচার্যের পদে বসে অনয়ম-দুর্নীতি-স্বজনপ্রীতি করে স্বার্থসিদ্ধির ক্ষেত্রে। চাকরি প্রদানে ঘুষ গ্রহণ, উন্নয়ন প্রকল্প থেকে কমিশন গ্রহণসহ নানা আর্থিক দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়তেও দেখা গেছে অনেকে শিক্ষক/উপাচার্যকে। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্যপদে বসে অধ্যাপক মাহফুজুর রহমানের মতো শিক্ষকেরা দুর্নীতিতে যুক্ত ও দণ্ডিত হয়ে শিক্ষকতা পেশাকে কলঙ্কিত করেছেন। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যজনক হলো, বেশ কয়েকজন উপাচার্য ইউজিসি, দুদক, শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তদন্তের মুখোমুখি হয়ে দোষী সাব্যস্ত পর্যন্ত হয়েছেন। এমনকি কোনো কোনো উপাচার্যকে দুর্নীতির দায়ে জেলে পর্যন্ত যেতে হয়েছে! কাজী মোতাহার হোসেন এবং তাঁর কালের শিক্ষকদের বেলায় এসব কল্পনাই করা যেতো না। কারণ, তাঁরা নিজের সুবিধার কথা চিন্তা করে কখনো নীতি-আদর্শকে জলাঞ্জলি দেননি। একালে বহু শিক্ষককে দেখা গেছে নিজের সন্তান এবং আত্মীয়-স্বজনকে নীতি-নৈতিকতা বিসর্জন দিয়ে এবং আইন ও বিধি-বিধান লঙ্ঘন করে চাকরি দিয়ে বিতর্কিত হয়েছেন। কাজী মোতাহার হোসেন এসব থেকে ছিলেন যোজন যোজন দূরে। নিজের মেয়ের শিক্ষকতার আবেদনের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও তাকে বিরত রেখে অন্য শিক্ষার্থীর চাকুরির জন্য সুপারিশ করেছেন। অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সাক্ষ্য দিচ্ছেন এই বলে যে : “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একবার চাকরির আবেদন করার সময়ে তাঁর কাছে শংসাপত্র চেয়েছিলাম। তিনি যা লিখে দিয়েছিলেন, তা শ্লাঘার যোগ্য। কাগজটি আমার হাতে দিয়ে বলেছিলেন, ‘মিনু (সন্জীদা খাতুন) আবেদন করবে কি না জিজ্ঞেস করেছিল। তুমি করছ বলে তাকে দরখাস্ত করতে দিতে বারণ করেছি।’ ক’জন পিতা এমন করতে পারেন।” একালের শিক্ষকদের মধ্যে এমন দৃষ্টান্ত বিরল। সম্প্রতি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সদ্য সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম আবদুস সুবহান নিজের মেয়ে এবং জামাতাকে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ নীতিমালা পর্যন্ত শিথিল করে সমালোচনা ও তদন্তের মুখোমুখি হয়েছেন। শুধু নিজের নয়, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের আরও অনেক শিক্ষকের তুলনামূলকভাবে কম যোগ্যতাসম্পন্ন সন্তানদের তিনি অবৈধভাবে চাকুরি দিয়েছেন, যার বিচার উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়িয়েছে। আরও দুর্ভাগ্যজনক যে, ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য চৌধুরী সারোয়ার জাহান এক চাকরিপ্রার্থীর কাছে ঘুষ চেয়েছেন, যার অডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। একইভাবে অনিয়ম ও বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে যুক্ত হয়ে সমালোচনার মুখোমুখি হয়েছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ফাইসুল ইসলাম ফারুকী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অফতাব আহমেদ, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আব্দুল জলিল মিয়া, নাজমুল আহসান কলিমুল্লাহ, পাবনা বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম রোস্তম আলী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য খন্দকার নাসিরউদ্দিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ফারজানা ইসলাম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক এম অহিদুজ্জামান প্রমুখ। এ তালিকা আরও দীর্ঘ হবে। ভাবা যায়, কোথায় কাজী মোতাহার হোসেন, আর কোথায় একালের এই শিক্ষকেরা! একালের সকল শিক্ষকই যে এঁদের মতো অবক্ষয়ে গা ভাসিয়েছেন, তা নয়। অনেক শিক্ষক এখনও শিক্ষকতার মহান আদর্শকে সমুন্নত রেখে কাজী মোতাহার হোসেন ও তাঁর সমকালীন শিক্ষকদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে জাতির মননঋদ্ধি, জ্ঞানসাধনা ও জ্ঞানসৃষ্টিতে নিরলসভাবে কাজ করে চলেছেন।

পাঁচ.
কেবল পাঠদান, গবেষণা কিংবা নীতি-আদর্শের প্রশ্নেই নয়, ভাষা-সংস্কৃতি এবং বাঙালিত্বের প্রশ্নেও কাজী মোতাহার হোসেন ছিলেন আপোসহীন। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাংলা ভাষা, বাঙালি সংস্কৃতি এবং রবীন্দ্রসংগীতের ওপর খড়্গহস্ত হলে তিনি তা রুখে দিতে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়েছেন। শিক্ষক হিসেবে তিনি এমন সব গুণাবলির অধিকারী ছিলেন, যা কোনো একজন মানুষের পক্ষে অর্জন করা কঠিন। কবীর চৌধুরী বলেছেন : ‘শিশুর মতো সরল অথচ পরিসংখ্যান বিজ্ঞানের মতো জটিল বিষয়ের পণ্ডিত; গান ভালবাসেন, গানের কথা, সুর, ব্যাকরণ বিষয়ে সবিশে ওয়াকিবহাল, গাইতেও পারেন সুর তাল রয় শুদ্ধ করে, আবার দাবা খেলায় প্রচণ্ড আসক্ত; নির্ভেজাল বিজ্ঞানমনস্ক মানুষ অথচ গভীর ধর্মবিশ্বাস, এক-শ ভাগ মানবতাবাদী একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ; কোমলপ্রাণ, স্নেহপ্রবণ, পরমতসহিষ্ণু অথচ নীতির প্রশ্নে অসম্ভব দৃঢ়চিত্ত, কঠোর ও অনমনীয়। আদর্শ শিক্ষক, তীক্ষ্ন দৃষ্টিসম্পন্ন সাহিত্য-সমালোচক, বাঙালিত্বের চেতনায় উজ্জীবিত, জীবনরসে ভরপুর কাজী মোতাহার হোসেনের মতো মানুষ আমাদের সমাজে দিন দিন কমে আসছে, আমার এ দুঃখ রাখবার জায়গা নেই।’ বাস্তবিকই পুঁজিবাদের সর্বগ্রাসী প্রভাব আর বৈষয়িক স্বার্থসিদ্ধির এই কালে এমন শিক্ষকের সংখ্যা কমে গেছে। তবে আমরা হতাশার সাগরে ডুবতে চাই না; বরং আশায় বুক বেঁধে বলতে চাই, নতুন প্রজন্মের শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা কাজী মোতাহার হোসেনের চিন্তা, কর্ম ও জীবনাদর্শকে চেতনার মর্মমূলে এবং মননের গভীরে ধারণ করবে। তাঁর বিজ্ঞান-সাধনাকে যেমন তারা গ্রহণ করবে, তেমনি ধারণ করবে সাহিত্য-সংস্কৃতিমনস্ক, উদার ও অসাম্প্রদায়িক চেতনাধারা; যা দ্বারা নিজেকে আলোকিত করার পাশাপাশি দেশ, সমাজ ও জাতিকে আলোকিত করবে। ১২৫তম জন্মদিনে এই বিজ্ঞান-সাধক, মুক্তবুদ্ধির ধারক, বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম অগ্রনায়ক, খ্যাতিমান দাবাড়ু, সর্বোপরি একজন পরিপূর্ণ মানুষকে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরণ করি।

 

 

 

 

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৪ এপ্রিল, ২০২৪)
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
চেলসিকে গুঁড়িয়ে দিলো আর্সেনাল
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
আদালতে সাক্ষ্য দিতে এসে কাঁদলেন মিতুর মা
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
‘ভুঁইফোড় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানগুলো মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে’
সর্বাধিক পঠিত
মিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
চলচ্চিত্র শিল্পী সমিতিমিশা-ডিপজলদের শপথ শেষে রচিত হলো ‘কলঙ্কিত’ অধ্যায়!
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
আজকের আবহাওয়া: তাপমাত্রা আরও বাড়ার আভাস
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে যা জানালেন কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
জরিপ চলাকালীন জমির মালিকদের জানাতে হবে: ভূমিমন্ত্রী
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক
ব্যাংক একীভূতকরণ নিয়ে নতুন যা জানালো বাংলাদেশ ব্যাংক