জাপানের পুরনো এবং আধুনিক সব কবিতার মধ্যে হাইকু সবচেয়ে জনপ্রিয়। জাপানি সংস্কৃতি এবং তাদের দীর্ঘ জীবন দর্শনের সম্পূর্ণ রূপ এই হাইকু। হাইকু’র বিশাল জায়গা জুড়ে রয়েছে প্রকৃতির সাথে মানুষের একাত্মতা ও আধ্যাত্মিকতাবোধ।
বাংলা সাহিত্যে হাইকুর প্রবেশ ঘটে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাত ধরে। তিনি তাঁর ‘জাপান যাত্রী’ (১৯১৩) বইয়ে জাপানের বিখ্যাত কবি বাশো মাৎসুয়ো-এর দুটি হাইকুর অনুবাদ করেন। এ গ্রন্থে হাইকুর সঙ্গে পরিচয় করাতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছেন, “তিন লাইনের কাব্য জগতের আর কোথাও নাই”। সত্যিই তাই, হাইকু (একবচনে হাইকি) হলো এক ধরনের সংক্ষিপ্ত জাপানি কবিতা। অনেকের মতে এটিই পৃথিবীর সংক্ষিপ্ত কাব্যরূপ যার গভীরত্বের বিস্তার অসীম।
প্রাচীনকালে জাপানে, দুই বা ততোধিক কবি এক জনের পর অপর জন মিলে একেকটি করে স্তবক লিখে কবিতা চর্চার রেওয়াজ ছিল। যার নাম ছিল ‘রেঙ্গা’। রেঙ্গার প্রথম স্তবককে বলা হতো ‘হোক্কু’ এবং রেঙ্গার হাস্যরসাত্মক রূপ বা সংযুক্ত স্তবককে বলা হতো ‘হাইকাই’। জাপানি ‘হাইকাই’ শব্দটির অর্থ হল মজা, কৌতুক, নিচুতা, পার্থিব ইত্যাদি। এই ধরনের পদ্যগুলোতে কৌতুকের পরিমাণ বেশি থাকত। সে যুগে হাইকাইকে তেমন উচ্চশ্রেণির রচনা বলে মনে করা হতো না। কিন্তু এদো যুগে (১৬০৭-১৮৬৭) যখন বাশো মাৎসুয়ো হাইকাই রচনা শুরু করেন তখন তা বিশেষ মর্যাদার স্থান দখল করতে থাকে। অবশ্য বাশো মাৎসুয়ো-এর আগ থেকেও হাইকাই নানাভাবে উন্নত হতে শুরু করেছিল। এই হাইকাই শব্দের প্রথমাংশ আর হোক্কুর শেষাংশ নিয়ে ‘হাইকু’ শব্দটির উৎপত্তি। সাধারণত একজন কবি হোক্কু অংশটুকু লিখে দিয়ে দিতেন তার ছাত্রদের কাছে অনুশীলন হিসেবে, পরের অংশ গুলো চর্চা করার জন্যে। এর অনেক পরে হোক্কু নিজস্ব গুণেই স্বয়ংসম্পূর্ণ কবিতার মর্যাদা পেতে শুরু করে। ১৯ শতকের শেষের দিকে জাপানি লেখক মাসাওকা শিকি (১৮৬৭-১৯০২) হাইকু নামটি রাখেন।
হাইকু কবিতার তিনটি লাইন ৫/৭/৫ অক্ষর বা সিলেবলের বিন্যাসে সাজানো থাকে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য প্রতিটি ভাষার গড়ন ভিন্ন ভিন্ন। জাপানি ভাষায় যেমন 'হাইকু' শব্দটিতে রয়েছে- হা, ই আর কু। অর্থাৎ মোট তিনটি অক্ষর। আবার বাংলাতে রয়েছে- হাই আর কু। অর্থাৎ দুটি অক্ষর। আবার ইংরেজিতে Haiku শব্দটিতে রয়েছে - Hai এবং ku। অর্থাৎ মোট দুটো সিলেবল বা অক্ষর। জাপানি ভাষার গঠন বাংলা এবং ইংরেজি থেকে স্পষ্টতই আলাদা। তাই ৫/৭/৫ বা ১৭ অক্ষর বা সিলেবলের নিয়ম মেনে চলা অন্যান্য ভাষার জন্য সত্যিই কঠিন। এতে করে মূল হাইকু অনুবাদের ক্ষেত্রে অনেকাংশেই মূলভাব ব্যতিরেকে আক্ষরিক বা আংশিক অনুবাদ করতে হয়। তাই হাইকুর অনুবাদ করাও বেশ কষ্টসাধ্য বিষয়। কেননা হাইকুতে প্রকৃতি, আধ্যাত্মিকতা, মানব জীবন সহ বিভিন্ন বিষয়কে খুব সূক্ষ্মতার সাথে তুলে ধরা হয়। তাই যেকোনো ভালো হাইকুর একের অধিক ব্যাখা বা অর্থ তৈরি হয়। অসংখ্য অর্থের স্তরীভূত এ সকল হাইকু এক ভাষা থেকে অন্য ভাষাতে অনুবাদের সময় স্বাভাবিকভাবেই তার শুদ্ধতা রক্ষা পায় না এবং শব্দগত ব্যঞ্জনাও ব্যহত হয়।
হাইকু হয়ে ওঠার ক্ষেত্রে শুধুমাত্র ৩ লাইনে ১৭ টিকে অক্ষরই মূল নয়। তার সাথেও রয়েছে আরো কিছু বিষয়। হাইকুতে একই বিষয়ে দুটো ভিন্ন চিত্রের বর্ণনা করা হয় এবং চিত্র দুটো একটা ‘কিরেজি‘ বা ছেদক-শব্দ দিয়ে সংযু্ক্ত করা থাকে। জাপানের ‘কিরেজি’ আসলে বাংলাতে যতিচিহ্নের মতো কাজ করে। উল্লেখিত পৃথক ঘটনা দুটি পরস্পর স্বনির্ভর আবার উভয়ে মিলেই একটি মুহূর্তের ছবি তৈরি করে। রবীন্দ্রনাথ এ প্রসঙ্গে তাঁর ‘জাপান যাত্রী’ গ্রন্থতে বলেছেন- ‘এ ছবি দেখার কবিতা, গান গাওয়ার কবিতা নয়।’ ছবি দেখার এই কবিতার মূল উদ্দেশ্যের একটি হলো সূক্ষ্মতার অনুশীলন। আমাদের চারপাশে যা বড়, তা তো বড়ই। আবার ছোট সকল কিছুও বড় হয়ে উঠতে পারে, যদি তাকে কাছ থেকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। হাইকুতে চেষ্টা করা হয় সকল কিছুকে খুব সূক্ষ্মতার সাথে পূঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার করতে।
হাইকু লেখা হয়ে থাকে বর্তমানকালের ভিত্তিতে। বর্তমানকালের যেকোনো একটি মুহূর্তেকে ফুটিয়ে তুলতে এখানে রূপকের ব্যবহারকে পরিহার করাই শ্রেয়। হাইকু হতে হবে বাহুল্য বর্জিত ঝরঝরে একগুচ্ছ শব্দের একটি ছবি। মূলত এখানেই কবিতার সাথে হাইকুর একটি বৃহৎ পার্থক্য তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কবিতা যেখানে বাস্তবকে ধরে রূপকের জাল দিয়ে, হাইকু সেখানে নিজেকে এ জালের বাইরে রাখতেই বেশি পছন্দ করে। হাইকুর অন্যতম মূল একটি বিষয় হলো প্রকৃতি-প্রেম। ট্রেডিশনাল হাইকুতে কিগো থাকতে হয়। ‘কিগো’ মানে এমন এক শব্দ যা দিয়ে কোনো ঋতু বা কাল প্রকাশ পায়। যেমন: বাংলা ভাষায় ‘কদমফুল’ শব্দটি বর্ষাকাল, ‘আম’ শব্দটি গ্রীষ্মকাল বা ‘পিঠা’ শব্দটি শীতকালের ইঙ্গিত বহন করে। হাইকুতে ‘কিগো’ দিয়ে মূলত যেকোনো ঋতুর নাম সরাসরি উল্লেখ না করে তবুও তার পরোক্ষ উল্লেখকে বোঝায়।
হাইকুর পাশাপাশি অনেকটা একই রকমের হলো সেনরিউ এবং টাংকা। সেনরিউ হাইকুর মতোই তিন লাইনে সতেরোটি অক্ষরের বিন্যাসে লেখা হয়। তবে প্রকৃতির বদলে এর বিষয়বস্তু হয় মানবিক দুর্বলতা। সাধারনত এগুলো বিদ্রুপাত্বক অথবা ডার্ক-হিউমার হয়ে থাকে। অপরদিকে টাংকা হলো পাঁচ লাইনে অর্থাৎ ৫/৭/৫/৭/৭ বিন্যাসে, মোট একত্রিশটি অক্ষরে লেখা কবিতা। হাইকু, সেনরিউ ও টাংকার মূল পার্থক্য লাইনের গড়নে ও বিষয়বস্তুর ভিন্নতায়। তাছাড়াও সেনরিউ আর টাংকাতে হাইকুর মতো কিরেজি ও কিগোর ব্যবহার আবশ্যক নয়। এর পাশাপাশি অনেকে মনে করেন হাইকুতে কিগোর ব্যবহার অপরিহার্য নয়। এ ধরনের হাইকুকে বলা হয় ‘ফ্রি-ফর্ম’। বতর্মান সময়ে ট্রেডিশনাল হাইকুর পাশাপাশি ফ্রি-ফর্ম হাইকুর চর্চাও সমান ভাবে বিদ্যমান।
জাপানি সাহিত্যে সপ্তদশ শতক থেকে ঊনবিংশ শতকের শেষ পর্যন্ত হাইকু কবিতার উৎকর্ষ সাধিত হয় চারজন কবির মাধ্যমে। যাদেরকে 'দ্য গ্রেট ফোর' বলা হয়ে থাকে। এরা হলেন বাশো মাৎসুয়ো (১৬৪৪-৯৪), তানিগুচি বুশো (১৭১৫-৮৩), কোবায়শি ইসসা (১৭৬২-১৮২৬) এবং মাসাওকা শিকি (১৮৬৭-১৯০২)। মাতসুও বাশো জাপানের এদো যুগের শ্রেষ্ঠ কবি। তানকা বা ওয়াকা কবিতা থেকে সম্পুর্ণ আলাদা করে ৫-৭-৫ অক্ষরের বা সিলেবলে নতুন ধরনের কবিতার লেখার প্রচলন করেন তিনি।
বাশো জেন বৌদ্ধধর্ম দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। বাশো তার জীবনের অনেকটা সময় ঘুরে বেড়িয়েছেন জাপানের বিভিন্ন জায়গায়। তার সেই ভ্রমণ অভিজ্ঞতাসূমহ আধ্যাত্নিকতার মিশেলে আরো পরিপূর্ণ করে তুলেছে বাশোর কাব্য সাধনাকে। বাশোর সেরা কাজ 'ওকু নো হোশোমিচী' (গভীর উত্তরের সরু পথ) প্রকাশিত হয় তার মৃত্যুর পরে। বাশোর অন্যতম উল্লেখযোগ্য একটি হাইকু হল-
পুরনো পুকুর
ব্যাঙের ঝাঁপ
পানির শব্দ।
অনেক সমালোচকের কাছে এটি উচ্চমার্গীয় অর্থবহন করে আবার অনেকের কাছে এটি রহস্য আবৃত এক অর্থের বাহক। বুশো ছিলেন বাশোর সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী। বাশোকে যদি বলা হয় মুক্তা, বুশোকে তুলনা করতে হয় হীরকখন্ডের সঙ্গে। বুশো শব্দের প্রতি দখল ছিল অসাধারণ। বুশোর একটি হাইকু-
বসন্তের বৃষ্টি
একসঙ্গে কথা বলায় ব্যস্ত
খড়ের রেইনকোট আর ছাতা।
বুশো আধ্যাত্নিকতার জায়গা থেকে সরে গিয়ে শব্দের আঙ্গিকের মধ্যে দিয়ে জীবন ও জগতকে হালকা চালে অথচ গভীর ভাবে তুলে ধরতে চেষ্টা করেছেন। সকল হাইকু কবির মধ্যে ইসসা ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয়। তার মধ্যে বাশোর মতো আধ্যত্নিকতা ছিল না আবার বুশোর মতো শব্দের কৌশলীও তিনি হয়ে উঠতে পারেননি। জীবন থেকে পাওয়া রূঢ়তাকে তিনি ছবির মতো বেঁধে রেখেছেন তার কাব্যের মধ্যে দিয়ে। ইসসার হাইকুতে প্রকাশ পেয়েছে সামাজিক বৈষম্যের প্রতি ধিক্কার ও চিরায়ত মানবিক অসহায়ত্ব। জীবনের প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটেছে ‘ডেথ-পোয়েম’ নামে পরিচিত হাইকুতে-
হাত ধোয়ার পাত্র থেকে
হাত ধোয়ার পাত্রে আমার যাত্রা
শুধুই জটিলতা।
ইসসার মৃত্যুর পর কিছুদিন হাইকুর বলিষ্ঠ চর্চা অভাব দেখা দিয়েছিল। শিকি মেজাজ ও আঙ্গিক উভয় দিকের নতুন সাহিত্য আন্দোলনের মধ্যে দিয়ে সেই অবস্থার অবসান ঘটান । তিনি পূর্ববর্তী কবিদের কাব্যচর্চাকে পিছনে ফেলে নতুনভাবে স্কুল প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তিনি অনেকাংশে বুশোর আঙ্গিক দ্বারা প্রভাবিত ছিলেন। ধর্মের প্রতি বিশ্বাসহীনতা থেকে তৈরি নির্লিপ্ততা ও বিষাদকে তিনি অসাধারণভাবে তুলে ধরেছেন তার হাইকুতে -
হেমন্তের বাতাস
আমার কোনো ঈশ্বর নেই
নেই কোনো বুদ্ধ।
১৯ শতকের আগে বিশ্বের অন্যান্য দেশে হাইকুর পরিচিতি ছিল না। ১৯০৫ খ্রিষ্টাব্দে পল-লোউস কোউচোউড এক ধরনের অনেক গুলো ছোট ছোট জাপানি কবিতা নিজ মাতৃভাষা ফরাসীতে অনুবাদ করেন। পরবর্তীকালে ফরাসি থেকে তা অনূদিত হয় ইংরেজিতে। ইংরেজি সাহিত্যের জগতে ইজরা পাউন্ড এবং অ্যালন জিন্সবার্গের মতো কবিদের হাতে হাইকু জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। বাংলা ভাষায় হাইকু রচনায় উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিরা হলেন দুলাল বিশ্বাস, রহিমা আক্তার কল্পনা, বুদ্ধদেব চ্যাটার্জি, আসাদ চৌধুরী, হাসনাত আবদুল হাই, জগলুল হায়দার, আবিদ আনোয়ার, রইম মনরম, কামরুল হাসান সহ আরো অনেকে। হাইকু তার সংক্ষিপ্ত গঠন, নান্দনিক বোধ ও গভীরতার জন্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত এবং দিন দিন এর প্রসার আরো বৃদ্ধি পাচ্ছে।