পড়ছিলাম কবি আমিনুল ইসলামের কবিতাসমগ্র। আদ্যোপান্ত সব কবিতা পাঠ করে সুদীর্ঘ মূল্যায়ন হয়তো সম্ভবপর নয়। কিন্তু একজন কবির মৌল প্রণোদনা বুঝে উঠতে যতটা পাঠ প্রয়োজন তা আমার আন্তরিক প্রচেষ্টার মধ্যেই ছিলো। আমিনুল ইসলাম অনেকদিন ধরে কাব্যচর্চা করছেন। ইতিমধ্যে তার কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা দশ। উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ কাজে নিয়োজিত থেকেও তিনি কবিতার প্রতি যে অনন্য টান অনুভব করেন সেটি অবশ্যই প্রশংসার দাবি রাখে। কেননা আর যাইহোক, বৈষয়িকতার সমস্ত অনুষঙ্গ অটুট রেখে কবিতায় সচল থাকা কঠিন ব্যাপার। আমিনুল ইসলাম যেহেতু টিকে আছেন এবং মন ও মননে লালন করছেন কবিতার অনিবার্য প্রতিভা এবং তার অনুপ্রেরণা, অতএব আমরা ধরে নেবো বৈষয়িকতার চুলচেরা হিসাব-নিকাশ তার জীবনে নেই। কবিতার জন্য তার বরং ত্যাগ আছে। শুধু ইউরোপীয় নন্দনতত্ত্বে কবিতার মূল্যায়ন একটি পুরনো প্রকল্প। কবিতার শিল্পসৌন্দর্যের পরিমাপ কেবল তার নান্দনিকতার বিচারে হওয়া একটি ঔপনিবেশিক ধারণা। উত্তর-ঔপনিবেশিক চিন্তাকে আমলে নিলে আমরা বুঝতে পারি কবিতার একটি জাতিগত মানদণ্ড কাজ করে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশের কবিতায় আমিনুল ইসলামের অবদান মূল্যায়নের দাবি রাখে বলেই আমার বিশ্বাস। সেই অন্তর্গত বিশ্বাসই তার সম্পর্কে লিখতে প্ররোচিত করেছে আমাকে।
আমিনুল ইসলাম তার কবিতায় নিরীক্ষার অন্তঃজাল নির্মাণে আগ্রহী ছিলেন বলে মনে হয়নি। তাই তার কবিতা পড়লে কোনো যান্ত্রিক আরোপণ পাঠকের মন আড়ষ্ট করে তোলে না। মনে হয় কবিতা তার স্বভাবের অনুগামী। একটা হৃদয়জ প্যাশনের মধ্য দিয়ে যা ক্রমশ প্রতীয়মান হয়। নিরীক্ষা নয় বিষয় বৈচিত্র্যই তার কবিতাকে বহুবর্ণিল করে তুলেছে। নব্বই দশকে আবির্ভূত অন্যসব কবিদের চাইতে নিজেকে তিনি এই জায়গায় আলাদা করতে পেরেছেন বলে মনে হয়। কেননা তার কবিতা ভাষা ও প্রকরণের একটি নির্দিষ্ট ঘরানায় আটকে থাকেনি। ছন্দোবদ্ধ, ছন্দহীন, গদ্যঢং, টানা গদ্য মিলিয়ে সব রকমের কাব্য প্রচেষ্টায় তিনি নিজেকে বহুমুখী করে তুলেছেন। ফলে নব্বইয়ের অন্য কবিদের মতো কোনো নির্দিষ্ট ভাষাভঙ্গি বা প্রকরণের একমুখী ব্যঞ্জনায় তাকে আবিষ্কার করা যাবে না। বিষয়ের নানা রকম ভাঙচুরের মধ্যে দিয়ে তিনি তার কাব্যের স্বরূপ কতটা ‘পাজলিং’ আবহে লুকাতে পেরেছেন সেই সারবত্তায় কবি আমিনুল ইসলামকে খোঁজে পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।
আত্মদ্বন্দ্ব, সামষ্টিক অবক্ষয়, রাষ্ট্রিক প্রবঞ্চনা, বৈশ্বিক রাজনীতি, ব্যক্তিগত রোমান্স, প্রেম, প্রকৃতি বন্দনা, পরিবেশ দূষণ, বিদেশ ভ্রমণ, পারিবারিক সম্পর্কের মানবিক সংবেদনা মাতৃপ্রেম, পিতৃভক্তি, বন্ধুত্বের নিগূঢ়তা ইত্যাদি নানা প্রসঙ্গ তার কবিতার ব্যাপক বিস্তৃতি দিয়েছে। তবু তার কবিতার প্রধান কয়েকটি প্রণোদনা আমি নিজের মতো করে বুঝতে চেষ্টা করেছি।
প্রথমত বলা যায় আমিনুল ইসলাম প্রেমের কবি। তার প্রেম ব্যক্তির স্মৃতির সংরাগে লাবণ্যময়। কখনো ভাবালুতাকে শৈল্পিক পরিণতি দিতে চেয়েছেন। কখনো বৌদ্ধিক পরিশীলন তার প্রেমের কবিতাকে মননশীল অভিব্যক্তিতে ভরে তুলেছে। তখন তার প্রেম-বেদনা ধারণে সক্ষম । এই নানাবিধ ব্যঞ্জনে তার কবিতা জলো নয় কিন্তু জলের মতো সুনির্দিষ্ট আকার বিহীন। কোনো নির্দিষ্ট স্বরূপে তার প্রেমের অভিব্যক্তি আটকা পড়ে না বলে সব শ্রেণির পাঠকের জন্য আগ্রহের বিষয় হতে পারে। তবে হৃদয়জ অবেগ যেখানে অবাধ নয় আবার নিরাবেগ বোধি চেতনা যেখানে মননের নিরসতা মেনে চলেনি সেখানেই আমিনুল ইসলামের প্রেমের কবিতা শিল্পসৌন্দর্যে মহিমা পেয়েছে। তার প্রেমের কবিতার আরও একটি বৈশিষ্ট্য হলো- প্রেমানুভূতিকে তিনি পরিপার্শ্ব থেকে আহরিত চিত্রকল্পের নানাবিধ পটভূমিকায় আবিষ্কার করেন। ফলে তার প্রেম একটা দৃশ্যমানতাকে মান্য করে চলে তবে ভাবালুতার অহেতু উদ্গীরণ তার প্রেমের কবিতাকে কোনো কোনো সময় পরিপক্ক হতে দেয়নি। আবার এ-ও ঠিক বিদেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা তার প্রেমানুভূতিকে ভৌগলিক সীমানার বাইরে যেতে সহায়তা করেছে। বহুমুখী চিন্তনের জায়গা দিয়েছে। যদিও চিন্তার চেয়ে আবেগ ও চিত্রকল্পের মেলবন্ধন তার কবিতার বিশেষত প্রেমের কবিতার প্রধান বিশেষত্ব ।
আমিনুল ইসলাম তার কবিতায় প্রকৃতিকে বহুবিধ ব্যঞ্জনায় তুলে ধরেছেন তার কবিতায়। তার প্রকৃতি প্রাণপ্রাচুর্যে ভরপুর। সাবলীল এবং দৃষ্টির সহজতায় রুঢ়তা বর্জিত। তার কবিতায় প্রকৃতি কখনো ভ্রমণ বিলাসীর তাৎক্ষণিক বিস্ময়ে জাগরূক নয়। মনে হয় প্রকৃতি তার যাপিত জীবনের পটভূমি । সেই প্রকৃতি আবার বাংলাদেশের ভেজা আবহে মায়াবী হয়ে ওঠে। ফলে নাগরিক জীবনের বিচ্ছিন্নতার বোধের মধ্যেও প্রকৃতির প্রতি তার সহজাত লোলুপ দৃষ্টি শিল্পিত আবেগ পাঠককেও সম্পৃক্ত করে ফেলে। কিন্তু সর্বেশ্বরবাদীর মতো তিনি প্রকৃতির গভীরে কোনো সত্তার উপস্থিতি অবলোকনে আগ্রহী নন। ফলে তার প্রকৃতিচিন্তা কোনো নৈতিক মানদণ্ড নিরূপণ করতে চায় না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে তিনি যতটা দার্শনিক তার চেয়ে বেশি কাব্যিক। গ্রাম বাংলার কোনো প্রাকৃতিক উপাদানই যেন তার দৃষ্টি এড়িয়ে যেতে পারেনি। জীবনানন্দের ধানসিঁড়ি বা আল মাহমুদের তিতাসের মতো তার নদী বিধৌত জীবনের প্রতীক হয়ে আছে মহানন্দা। শুধু মহানন্দা নয় অন্যান্য নদীর সঙ্গে তার আত্মিক সমন্ধ সচেতন পাঠকের দৃষ্টি এড়াবার নয়। তার শৈশব, জীবনের মধ্যভাগ এবং পরিণতির সকল স্তরে নদী, নিসর্গ তথা প্রকৃতির স্বচ্ছন্দ অভিসার তার কবিতাকে এক অর্থে ‘চিত্ররূপময়‘ করে তুলেছে। নানা দেশ ভ্রমণের ফলে ভিনদেশীয় প্রকৃতির সঙ্গে তিনি তুল্য করে তুলেছেন বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে। নাগরিক জীবন যাপনের মধ্যেও প্রকৃতির স্মৃতিসংহতি তার কবিতাকে যান্ত্রিক হতে দেয়নি। স্ফূর্ত আনন্দের জায়গা করে দিয়েছে। তার কবিতা যেন খণ্ড খণ্ড বাংলাদেশ।
কিন্তু তার এই স্বাদেশিকতা প্রকৃতি বন্দনায় সীমাবদ্ধ নয়। রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ সকল ঘটনা ও দুর্ঘটনা তার কাব্যিক অভিব্যক্তিতে স্ফূর্ত হয়ে উঠেছে। বিশেষত আমাদের মুক্তিযুদ্ধ, স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন এবং ২১ শে আগস্টের হামলার পর জর্জ মিয়া নাটকসহ বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় বিষয়াদি তার কবিতায় এমনভাবে পরিস্ফুট হয়েছে যে, সমসাময়িক ঘটনা পুঞ্জে তার মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিপাত সহজেই আঁচ করা যায়। বলা বাহুল্য নব্বই দশকে আবির্ভূত কবিদের মধ্যে সম্ভবত এ ক্ষেত্রে আমিনুল ইসলামই ব্যতিক্রম। কেননা নব্বইয়ের কবিতায় স্বকাল ও সমসাময়িকতার বিস্তৃত স্বাক্ষর নাই বললেই চলে। সময়ের মধ্যে থেকেই সময় ডিঙাতে হয়। এই আপ্ত কথন আমিনুল ইসলাম হৃদয়ে ধারণ করেন বলেই নিজের সময়কে কবিতার অঙ্গনে সম্পৃক্ত রেখে মহাকালের দরজায় টোকা দিয়েছেন । সে ক্ষেত্রে কোথাও কোথাও বহু বিস্তৃত ন্যরেটিভ নান্দনিকতার চাইতেও ঘটনার ধাবারাহিকতাকে গুরুত্ব দিয়েছে বেশি। প্রগল্ভ হয়ে উঠেছে কবিতা। কবিতায় এই শিথিল নৈরাজ্য জাতীয়তা তথা জাতীয় সঙ্কটের প্রশ্নে মেনে নিলেও শিল্পের প্রশ্নে মেনে নেওয়া কঠিন।
উপর্যুক্ত কথার প্রেক্ষিতে আমিনুল ইসলামের কবিতার বিশ্লেষণে আরও একটি বিষয় গুরুত্ব পেতে পারে। সেটি হলো শুধু স্বদেশের ঘটনাপুঞ্জেই নয় বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে নানা ঘটনার সঙ্গে তার মানবিক সংহতি। এ ক্ষেত্রে তিনি জাতীয়তাবাদী নন, মানবতাবাদী। স্বদেশী নন, আন্তর্জাতিক। বিশ্বায়নের প্রতিক্রিয়ার সৃষ্ট বানিজ্যিক শোষণ প্রক্রিয়া, পরিবেশ বিপর্যয় ফিলিস্তিন সহ পৃথিবীর অপরাপর জায়গায় মানবতার ওপর চাপানো ধ্বংসলীলা, জাগতিক অবক্ষয়, জগৎজুড়ে আধ্যাত্মিকতাহীন মনস্তত্ত্ব ইত্যাকার বিষয়ে আমিনুল ইসলামের পোয়েটিক রিয়েকশন ব্যক্তিনিষ্ঠতাকে ছাপিয়ে বস্তুনিষ্ঠ মননশীলতাকে উচ্চমার্গীয় করে তোলে। তাই বলা যায় তার কবিতায় বিশেষ আর নির্বিশেষের সমন্বয় প্রকিয়া সুস্পষ্টরূপে ক্রিয়াশীল ।
আমিনুল ইসলামের কবিতায় বোহেমিয়ান জীবনাচারের লক্ষণ নাই। ইতিবাচক অর্থেই এটি তার কবিতার একটি দিক নির্দেশ করে। কবিতায় তিনি গৃহী। সংসারের ভারবাহী মায়ের জীবনকে তিনি মহিমান্বিত করেছেন। সম্পর্কের সূত্র ধরে শেকড় সন্ধানী প্রবণতা আমাদের কাব্যিক ঐতিহ্যর অন্তর্ভুক্ত এমনকি তিরিশের আধুনিক কবিদের মধ্যেও এই প্রবণতা দৃষ্টিগোচর হয়। আধুনিকতার অবক্ষয়জনিত বিচ্ছিন্নতার বোধ আমিনুল ইসলামকে তাড়িত করেনি। পিতৃভক্তির হৃদয়াবেগ তাই তার কবিতায় প্রাঞ্জল। পারিবারিক সম্পর্কের কাব্যিক মূল্যায়ন তাকে বোদলেয়ার কথিত ‘অচেনা’ মানুষ হতে দেয়নি। তিনি তার শেকড় ও রক্তের প্রতি টান অনুভব করেছেন। এখানেই তিনি দেশজ। এই দেশজ অনুভূতি থেকেই উদ্ভূত হয়েছে তার মরমী চিন্তা। Mystic অর্থে মরমী নয়। মর্ম থেকে উত্থিত হৃদয়াবেগ তার কবিতাকে ঋদ্ধ করেছে বলেই তাকে মরমী বলা যায়। নইলে মরমী বলতে যে সহজিয়া আধ্যাত্মিক প্রণোদনা বাংলার ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোত তা আমিনুল ইসলামের কবিতায় প্রায় অনুপস্থিত। কিন্তু কবিতায় তিনি আধ্যাত্মিক না হলেও বৈশ্বিক। নিজের মর্ম থেকে উঠে আসা মানবীয় দৃষ্টিপাত তার কবিতায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে।
বলা হয়ে থাকে কবিতার ইতিহাস তার টেকনিকের ইতিহাস। এই সূত্র মেনে নিলে ‘কী বললাম নয়‘ বরং গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে ‘কীভাবে বললাম‘। অর্থাৎ কবিতার কনটেন্ট বা বিষয়বস্তুর চেয়ে কবিতার কৌশল বেশি জরুরী মনে হয়। বিশেষত আধুনিকতার ব্যাপারটি যখন প্রধান আলোচ্য বিষয়। এ ক্ষেত্রে আমিনুল ইসলামের কবিতা ভাবসম্পন্ন এবং কম টেকনিকেল। তাই তার কবিতায় নির্মিতির গুণের চেয়ে স্বভাবগুণ বেশি । এটি তার কবিতার পক্ষে একই সঙ্গে ঝুঁকিপূর্ণ এবং ইতিবাচক। দোষ এবং গুণ উভয়ই । দোষ কেননা স্বভাবজাত কবিতার সারল্য প্রকরণ চেতন হয় না। গুণ কেননা নির্মিতির কাঠিন্য নেই বলে তার কবিতা কৃত্রিম হয়ে ওঠেনি। তার কবিতা স্বতঃস্ফূর্ত ও সাবলীল। পাঠক নিমিষে গহিনে ঢুকতে পারে।
একজন কবির কবিতাসমগ্র পাঠ করে সার্বিক মূল্যায়ন সবসময় বিশ্বাসযোগ্য হয়ে ওঠে না। কেননা পাঠক ব্যক্তি চৈতন্য তথা ব্যক্তি অভিজ্ঞতার বাইরের কেউ নয়। তাই পাঠকের মূল্যায়ন লব্ধ জ্ঞানের আলোকে সীমাবদ্ধ হতে পারে। আর যেকোনো সমালোচকই শেষ পর্যন্ত প্রাগ্রসর পাঠক ছাড়া কিছু নন। কাজেই কবিতার সত্যিকারের মূল্যায়ন করতে পারে মহাকাল। কবিতা টিকে থাকা বা না থাকার সমাধান ঠিক ওই মহাকালে। কাজেই কাব্যের মূল্যায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। শেষ পর্যন্ত কোনো কবির কবিতা কোথায় গিয়ে ঠেকে তা ভবিতব্য জানে। কবি আমিনুল ইসলামের ক্ষেত্রেও একথা সত্য। তবে একটি কথা নির্জলা সত্যের মতো মনে হয় যে, আমিনুল ইসলামের কবিতায় জীবনের প্রতিটি স্তরের অনুপ্রবেশ আছে। আছে সকল শ্রেণির মানুষের অন্তর্ভুক্তি। যেকোনো শ্রেণির পাঠক জীবনের যেকোনো পর্যায়ের অভিব্যক্তি তার কবিতার মধ্য দিয়ে শেয়ার করতে পারবেন। শৈশব, যৌবন এমনকি পৌঢ়ত্বের হাসি, কান্না ও সঙ্কটের অনুষঙ্গ একাকার হয়ে আছে তার কবিতায়। কখনো মনে হয় না কবিতা তার যাপিত জীবনে বাইরের কোনো শৌখিন শিল্প হিসেবে টিকে আছে। বরং মনে হয় কবিতা তার প্যাশন। বিরহ, যাতনা ও আনন্দঘন জীবনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষাচূড়া। সেই চূড়ায় উঠে প্রত্যক্ষ দৃষ্টান্ত পেতে চাইলে পাঠক আমিনুল ইসলামের কবিতা সমগ্র পড়ে দেখতে পারেন। পাঠকের সুবিধার্থে বহুদিন আগে করা তার ‘পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি’ কাব্যগ্রন্থের ওপর আমার নাতিদীর্ঘ আলোচানা এখানে তুলে ধরা হলো। আচেনার শিরোনাম পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি: প্রাণ প্রেম ও প্রকৃতির প্রণোদনা।
ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছিলেন, কবিতা হচ্ছে শক্তিশালী অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। আর প্রশান্তির অনুস্মৃতি নির্ভর আবেগই হচ্ছে তার উৎসস্থল। কবি আমিনুল ইসলাম-এর পথ বেঁধে দিল বন্ধনহীন গ্রন্থি কাব্যগ্রন্থটি মূলত ওয়ার্ডসওয়ার্থ কথিত ‘শক্তিশালী অনুভূতি’র সংরাগে আবেগের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশকেই উপজীব্য করেছে। কিন্তু সেই অনুভূতি ব্যক্তি আবেগের নির্জলা প্রকাশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং তা প্রাণ প্রেম ও প্রকৃতির প্রণোদনায় বিশেষ হয়েও নির্বিশেষে পাঠককে আহ্বান করে একটি সাংগীতিক মোহনায় যেখানে ব্যক্তি উত্তীর্ণ হয় নৈর্ব্যক্তিকতায়, স্বাদেশিকতা তার স্থূল জাতীয়তার সীমানা ডিঙিয়ে আন্তর্জাতিকতায় একীভূত হয়ে যায়। তাই তার ঐতিহ্য বিশ্বপরিমণ্ডলে নিজেকে জাহির করে এক অনবদ্য মিথষ্ক্রিয়ায় যেখানে সুস্পষ্টভাবে তিনি বাঙালি কিন্তু বিশ্ব নাগরিক। তাই তার নির্ভীক প্রকাশ: ‘বহুব্যবহৃত তুর্কি ঠোঁটে আমার বঙ্গীয় ঠোঁট এঁকে দিতে পারে/ ওয়াটার কালার এমবুশ কিস; ঠান্ডা আপেলের রস নয়, আমার অধরে/ প্রবাহিত গন্দমফলকে হার-মানানো ল্যাংড়া আমের সঘন স্বাদ...’। যদিও তিনি জানেন ‘ভালোবাসার প্রতিপক্ষ সবাই’ তবু সেই ভালোবাসা তথা প্রেমের সন্তরণে তার হৃদয় প্রকৃত কবির মতোই উদ্বেল। আশির দশকের পর থেকে যে প্রেমের কবিতা বাংলা কবিতা থেকে প্রায় উধাও হয়েছিল, সেই প্রেমকেই উপজীব্য করে অনবদ্য করে রাখলেন তিনি চিরন্তন হৃদয়ের সংরাগ বিশেষত এই গ্রন্থে অন্তর্ভূক্ত ‘তুর্কি মেয়ের জন্য’, ‘সাবিহা-তোমার কাছে’ অথবা এরকম আরও অনেক কবিতায়। আর প্রেমের স্বভাব ধর্ম অস্থিরতা এবং সংশয়- এই দুই মনস্তত্ত্বকে অসাধারণ উপমায় ধারণ করলেন: ‘দ্যাখো-দড়িবাঁধা বাছুরের মতো অস্থির আমার বাসনা/ .... তুমি মুক্তাহারা ঝিনুকের মতো খোলস হয়ে যাওনি তো?’ আমিনুল ইসলামের প্রেম তাই প্রাণ প্রাচুর্যে দ্বিধাহীন। কষ্টকল্পিত তাত্ত্বিক বাসনায় আড়ষ্ট নয়। এই সহজিয়া রীতিটিই বরং বাংলা কবিতার হাজার বছরের ঐতিহ্য। প্রকৃতির সংস্পর্শ তার কবিতাকে দিয়েছে অন্যরকম সজীবতা। তিনি জানেন, ‘প্রকৃতির হাতে মাকু; জুড়ে নিচ্ছে সুতো/ অচিরেই শুরু হবে কুয়াশার জাল বোনা; / পায়ের নিকট নদী- জালে পা দিবে না...’ (হেমন্তের সংবাদ)। কিন্তু প্রকৃতির এই প্রণোদনায় তিনি কিন্তু বিভোর হয়ে যাননি। তিনি সচেতন সময়ের অভিঘাত সম্পর্কে। তাই গ্লোবালাইজেশনের বাণিজ্য প্রতারণায় তার বেদনা উপচে পড়ে: ‘জলের সিঁড়ি বেয়ে/ ইলিশ বেদনা উঠে আসছে ডাঙ্গায়/ বাণ্যিজ্যবায়ু ধরে আছে তার হাত!’ (ইলিশ উপাখ্যান)
ইতিহাস ও ঐতিহ্য চেতনায় আমিনুল ইসলাম এই কাব্য গ্রন্থে নিজেকে উত্তীর্ণ করেছেন এক অনন্য বিশিষ্টতায়। নান্দনিকতার বিভায় ছাড়িয়ে গেছেন নিজেরই অন্য কাব্য গ্রন্থগুলোকে। কিন্তু তার ইতিহাস চেতনা জীবনানন্দ দাশের মতো নয়। জীবনানন্দ দাশ অবচেতনার সংরাগে মনস্তাত্ত্বিক অভিঘাত কাজে লাগিয়েছেন তার ইতিহাস চেতনায়। আমিনুল ইসলাম করেছেন সচেতন পরিভ্রমণ। আক্ষরিক অর্থেই বরেন্দ্রভূমি, পুন্ড্রনগর থেকে শুরু করে বাংলার ঐতিহাসিক বিবরণ শিল্পিত মহিমায় উজ্জীবিত তার কবিতায়। বিশেষত এই গ্রন্থের সুদীর্ঘ ‘নাম’ কবিতাটিতে ইতিহাস তার সোনালি অতীত এবং ক্ষয়িষ্ণু বর্তমানের ধারাপাতে গেরুয়া বেদনায় জ্বল জ্বল করে: ‘কথায় কথায় আমরা এসে গেছি পাহাড়পুর। পাহাড় নেই/ পর্বত নেই। আছে শুধু পাহাড় সমান অতীতের সোনালি গৌরব। অথবা দ্যাখো- আমরা পার হয়ে এসেছি যমুনা; পা ঠেকেছে প্রাচীন/ এক নগরীর ধ্বংসাবশেষে। মাটি খুঁড়ে তোলা কোনো নামহারা/ সভ্যতার ধূসর কঙ্কাল’ (নাম কবিতা)! এছাড়াও রয়েছে চলনবিলের চাতাল, গন্ধেশ্বরীর ঘাট, সত্যপীরের ভিটা, মাৎস্যন্যায়, গোপালের সোনালি সুদিন, উয়ারীবটেশ্বর, ময়নামতির বাড়ি, সমুদ্রগুপ্তের অশ্বমেধ ইত্যাকার নানা ঐতিহাসিক প্রসঙ্গ। কিন্তু ইতিহাস তার লক্ষ্য নয়, উপলক্ষ মাত্র। লক্ষ্য হলো একটি কাব্যিক তথা নান্দনিক জাগৃতির ভিতর দিয়ে নিজের জাতীয় অবস্থানকে জানান দেয়া। আর এর ভিত্তিমূলে রয়েছে প্রেম। সেই প্রেম কৃত্রিমতা বর্জিত। হৃদয় সঞ্জাত বলেই তার এই পরিভ্রমণ তাই উপাদেয়: ‘আর আমাদের/ লাগেজ টিকেটের ও প্রয়োজন হবে না, কারণ আমরা ওয়েটিং রুমে/ ফেলে এসেছি প্রেমের মোড়ক আঁটা স্বার্থপরতার যাবতীয় লাগেজ’ (নাম কবিতা)। এই কাব্যগ্রন্থটি পাঠ করতে গিয়ে পাঠক অনেক অসাধারণ উপমার সন্নিবেশ লক্ষ্য করবেন, যেমন : ফিরিয়ে নেয়ার ড্রেজার খানা/ মুসার লাঠির মতো চাপা পড়ে আছে; রবীন্দ্রনাথের মতো দাঁড়িয়ে দুয়ারে/ হে ভূগোল, খুলে ফেলো পাষাণের ভুল; স্বর্গচ্যুত আদমের মতো ছটছট করবো আমি? শুধু একটি তামাদি আকাঙ্খা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যর্থতার/ মতো ঝুলে থাকবে...; সাঁতাল মেয়ের হাতের ছোঁয়ায় নামাজির/ মতো নুয়ে আসে সোনালি ধানের শীষ’। এ ছাড়াও ‘নবুওয়ত’, ‘ইয়াজুজ মাজুজ’, ‘আল্লাহর দোহাই’ ইত্যাকার ধর্মীয় শব্দ তিনি অনন্য দক্ষতায় ব্যবহার করেছেন। কোনো সাম্প্রদায়িক লক্ষ্য তো নাই-ই বরং অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত এই কবি রানী ভবানীকে অঙ্কন করেন প্রাণের দরদ মেশানো ভালবাসায়: ‘আমরা এখন নাটোরে-এই যে প্রাসাদ-এর সাথে জড়িয়ে/ আছে রানী ভবানীর নাম। কত বন্যা, কত তাপ, কত মারী/ শাসকের বুকে প্রেমও থাকা চাই; শাসক হলে জননীমনা,/ সে শুধু মানুষ নয়, হয়ে ওঠে মানুষেরও বাড়া। ভবানী ছয়াময়ী প্রকৃতির অন্য এক নাম; সবুজের সূর্য ঘিরে নৈশ/ ষড়যন্ত্র বিস্তারিত হলে, সূর্য প্রেমী সৈন্যদের পাশে এগিয়ে/ আসেন ভবানী’।...
এছাড়াও ওপেন মার্কেট, ই-মেইল অ্যাড্রেস, স্টাডিট্যুর, সেলফোন, ওয়াটার কালার, কসমোপলিটান, ওভার ব্রিজ, ঈদবোনাস ইত্যাকার প্রচল শব্দ ব্যবহারে তিনি সিদ্ধহস্ত। নতুন শব্দবন্ধ তৈরীতে তার পক্ষপাত কাব্যিক স্বাতন্ত্র্যকে উসকে দেয়। কাব্য পরিক্রমায় কোথাও এসব শব্দের ব্যবহার বেমানান মনে হয়নি। সরকারি চাকুরিজীবী হওয়া সত্ত্বেও আমিনুল ইসলামের কবিতা কোনো জটিলতায় আড়ষ্ট হয়নি; বরং এক নির্ভেজাল প্রাণের ছোঁয়ায় অনুভূতি মহৎ হয়ে ওঠে। ছন্দ মানা বা না-মানা সব মিলিয়েই স্বকীয় সিদ্ধির দিকে তার অভিগমন। তবে আমিনুল ইসলাম-এর কাছে আরও প্রকরণ চৈতন্য আমরা আশা করি। কারণ কবিতার ইতিহাস তার টেকনিকেরও ইতিহাস। আঙ্গিকের দিকে আরও একটু অবাধ দৃষ্টির প্রয়োজন আছে বলে মনে হয়। তার নাম কবিতায় কোথাও কোথাও একটু আল মাহমুদীয় প্রণোদনা কাজ করেছে। কিন্তু প্রসঙ্গের ভিন্নতা দিয়ে তিনি তার স্বকীয়তাকে বজায় রাখতে চেষ্টা করেছেন। সর্বোপরি বলা যায়, হৃদয়বৃত্তির সংস্থাপনায় দীক্ষিত মননের সংযোগ ঘটিয়ে যারা কবিতায় স্বাতন্ত্র্য নির্মাণে অগ্রসর, এই কাব্যগ্রন্থে আমিনুল ইসলাম নিজেকে তাদের দলেই অন্তর্ভুক্ত করেছেন।