X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

সপ্তপর্ণী

সাথী শাহনাজ
০৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৭:৩২আপডেট : ০৮ নভেম্বর ২০২৩, ১৭:৩২

আশ্বিনের মাঝামাঝি থেকেই অপেক্ষা করছি এক নিঃশব্দচারীর জন্য। খুব হালকা সবুজ-সাদা মিশেলে, গুচ্ছে গুচ্ছে গাঢ় সবুজের ফাঁকে সে উঁকি দেবে। বছর দুয়েক আগে তাকে খুঁজে পেয়েছি। কত বছর ধরে শত শত সবুজ সকালে তার ছায়া আমায় ছুঁয়ে ছুঁয়ে গেছে, আমি জানিনি। এ যেন ‘নয়ন তোমারে পায় না দেখিতে রয়েছো নয়নে নয়নে।’

আমি তার ঘ্রাণ পেয়েই চোখ বুজেছিলাম, স্মৃতিতে উঠে এসে জানান দিলো বগুড়া মেডিকেল কলেজের লেকচারার কোয়ার্টারের হেমন্ত সন্ধ্যারা। আমিই সেই, সবুজ ঘাসের সরু পথ ধরে সন্ধ্যায় তুমি যে হাঁটতে, আমি সেই মাতাল করা সুগন্ধী হাওয়া, তোমার নিকষ কালো চুল আর ওড়নার প্রজাপতি আঁচল আলতো করে উড়িয়ে নিতাম।

তারপর চোখ মেলে দেখি, সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পেছনে কলেজ বিল্ডিংয়ে ঢুকবার যে পথটি রয়েছে, মেহগনির ছায়ায় ঢাকা, তারই ফাঁকে চুপটি করে দাঁড়িয়ে আছে আমার মদোমাতাল সুবাস ছড়ানো অ্যালস্টোনিয়া স্কলারিস, আমার সপ্তপর্ণী, ছাতিম গাছ।

‘ওই যে ছাতিম গাছের মতোই আছি,

সহজ প্রাণের আবেগ নিয়ে মাটির কাছাকাছি,

ওর যেমন এই পাতার কাঁপন, যেমন শ্যামলতা

তেমনি জাগে ছন্দে আমার, আজকে দিনের সামান্য এই কথা।’

এত কাছে, অথচ ঘ্রাণ পাওয়ার আগে আমার চোখ এড়িয়ে গেছে। যাবেই তো। ও যে অবয়বে নিজেকে প্রবলভাবে প্রকাশ করে না, কখনো কখনো ৩০-৪০ ফুট উচ্চতায় পৌঁছায়। তবে তার কাণ্ড থেকে পরতে পরতে পাতারা এমনভাবে বেরোয়, দূর থেকে চন্দ্রাতপের আচ্ছাদন মনে হয়। পাতারা যেন অঙ্কবিদ, তিন পাঁচ বা সাতটি করে গজায় তারা। বাকল থেকে কষযুক্ত তিক্ত স্বাদের যে দুধ মেলে, তা দীর্ঘদিনের ডিসেন্ট্রি বা চর্মরোগের মহৌষধ বলে লোকমুখে প্রচলিত। ছাতিমের কাঠ খুব হালকা, নরম। তাই ভারি কোনো আসবাবপত্র বানানো হয় না, দরজা জানালা, দেশলাই কাঠি কিংবা ব্ল্যাকবোর্ড তৈরি হয়; শ্রীলংকার মতো কোনো কোনো দেশে কফিন। শিক্ষার কাজে ব্যবহৃত হয় বলেই তাকে স্কলারিস নাম দেয়া হয়েছে। আর অ্যালস্টোনিয়া নেয়া হয়েছে প্রখ্যাত বোটানিস্ট সি আর্লস্টনকে সম্মান দেখিয়ে। আশ্বিনের প্রায় প্রতিটি সকালে মেহগনি সারির নিচে এসে আমি দু-পা থামি। ছাতিম ডালের পাতার ফাঁকে ফুলকলিদের হালকা সবুজ শিহরন খুঁজতে থাকি। শেষ সপ্তাহের কটা দিন একটু ব্যস্ততা বেড়ে গিয়েছিল, কিছুটা আনমনাও ছিলাম হয়তোবা। কার্তিকের শুরু, বেশ তাড়াতাড়ি সন্ধ্যা নামছে যেন। আমার মা বলতেন কার্তিকে কাত (পাশ ফেরা) ফিরতেই দিন শেষ। হেমন্তের আভাস পেয়ে মনে পড়ে গেল সপ্তপর্ণীকে। কলেজ যাবার সময় মাথা উঁচিয়ে চোখ মেলতে চমকে উঠলাম, ফুলে ফুলে ভরা গাছ, উজ্জ্বল সবুজ পাতার আড়ালে লুকিয়ে আছে যেন। নিজেকে তুলে ধরবে সে হেমন্ত সন্ধ্যায়। তীব্র সুবাস রাতের প্রহরকে ভুলিয়ে দেবে নিজের অস্তিত্ব। বহুদূর অবধি আচ্ছন্ন করে রাখবে চরাচর।

গম্ভীর ছাতিমতলায় গভীর প্রশান্তির শীতল ছায়া মেলে। যা হাতছানি দিয়ে ডেকেছিল মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরকে। রবির জন্মের পরের বছরগুলোর কথা। রায়পুরের জমিদার পরিবারে নিমন্ত্রণ রক্ষার জন্য যাবার পথে বিশ্রাম নিতে চাইছিলেন তিনি। মাঝে বিশাল ধু-ধু ভুবনডাঙার মাঠ। দুটি ছাতিম পাশাপাশি দাঁড়িয়ে। মৃদুমন্দ হাওয়ায় গাছের নিচে বসে মহর্ষি যেন ধ্যানস্থ হলেন। তাঁর মনে এলো, ‘এখানে প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি।’

মহর্ষি কলকাতা ফেরার পরও মনপ্রাণ জুড়ে রয়ে গেল সঘন ছাতিমতরুর সবুজ ছায়াটুকু। মনে হল এমন একটি নিরিবিলি মাটির কোলঘেঁষা জায়গা তিনি খুঁজে ফিরছেন বহুদিন ধরে। ১৮৬৩ সালে রায়পুরের জমিদারবাবুকে মনের ইচ্ছেটুকু জানালেন এবং নামমাত্র মূল্যে প্রায় বিশ একর জমি কিনে নিলেন তিনি।

সেকালে ভুবনডাঙার মাঠ প্রসিদ্ধ হয়েছিল ডাকাতির জন্য। ডাকাতরা দলবেঁধে মাঠের কাছাকাছি গ্রামে থাকত। জমিদারের সাথে পরামর্শ করে ডাকাত সর্দারকে নিরাপত্তার ভার দিলেন দেবেন্দ্রনাথ। আর কোনো দুর্ভাবনা করতে হলো না তাঁকে। স্বয়ং ডাকাত সর্দার যখন ত্রাণকর্তা! তারপর এই ছাতিম তলা হয়ে উঠল মহর্ষির প্রাণের কুটির, ধ্যানের মন্দির, শান্তি নিকেতন। রবীন্দ্রনাথ প্রথম বার বাবার সাথে এসেছিলেন দশ/এগারো বছর বয়সে দার্জিলিং যাবার পথে। পরে ১৮৮৮-তে ব্রহ্মচর্যাশ্রম বিদ্যালয় তৈরি করেন তাঁরা।

১৯২৩ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়। তারপর থেকে ছাতিমতলায় প্রতিটি সমাবর্তন উৎসব অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে এবং এই অনুষ্ঠানে প্রত্যেক ছাত্র-ছাত্রীর হাতে সপ্তপর্ণী (সাতটি পাতার) গুচ্ছ তুলে দেয়া হয়। মহর্ষির সময়কার সেই গাছ দুটি মরে গেছে। পরে আবার দুটি গাছ লাগানো হয়েছে। ছাতিম যেন পবিত্রতার প্রতীক। দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের নিবিষ্ট মনে আরাধনার স্মৃতিমুগ্ধ শান্ত শীতল ছায়া অপেক্ষা করে থাকে আর আহ্বান জানায় সুঘ্রাণ ছড়িয়ে। যেমনটি রয়েছে আমাদের তুলশীগঙ্গা নদীর তীর ছোঁয়া গ্রাম শ্রীকৃষ্ণপুরে।

গ্রামের নামটি অবশ্য আর পোশাকি নেই। সবাই ‘চিকিষ্ট পুর’বলে। সেই গ্রামের একপাশে কয়েকগুচ্ছ বাড়ি নিয়ে আছে ঘোষপাড়া। রসগোল্লা, ছানা আর দই বানায় তারা। ঘোষদের বাড়ি আর আমার নানাবাড়ির মাঝ বরাবর অনেক অনেক যুগ আগের এক বিশাল ছাতিম। এটি ‘ছাতিম তলি’নামে চেনে সবাই। আমার শৈশবে দেখেছি, নবান্নের ধান গোলায় এলে শেষ বিকেলে চাড়িতে (বিশাল মাটির গামলা) তা ভিজিয়ে রাখা হত। তারপর ফজরের আজানের সময় দুই হাঁড়িতে ভরে মাটির জোড়া চুলোয় সিদ্ধ করা হত। ছাতিম তলির উঠোন নিয়মিত নিকানো হত। সকালের রোদে উঠোন ভরে গেলে সিদ্ধ ধান শুকাতে দেয়া হত। প্রায়শই আমি ধান পাহারা দিতাম। আমার খালাতো মামাতো ভাইবোনরা কেউ রাজি হত না ধান শুকানো অবধি বন্দী থাকতে হবে বলে। লম্বা লাঠি হাতে হাঁসমুরগী তাড়াতে হতো আর ঘণ্টাখানেক পর পর ধান উল্টিয়ে দিতে হত, পা দিয়ে অথবা ‘প্যারা’(কাঠ ও বাঁশ দিয়ে তৈরি) দিয়ে। আমি সবকিছু খুশি খুশি মনে করতাম নানির ট্রাঙ্কভরা বই পড়বার লোভে। বঙ্কিম রচনাবলীর সাথে আমার ছাতিম তলিতেই পরিচয়। বিশাল গাছের গোড়ায় দুটি দেবীমূর্তি ছিল, তাদের চরণ জুড়ে শোভা পেত ভোরবেলার পুজোর ফুল, বেলপাতা। সে প্রায় চল্লিশ বছর আগের কথা। একসময় দেবী চুরি হয়ে যায়। এখনো পুজো হয় নীরবে নিভৃতে। লাল পাড় শাড়ির আঁচল মাথায় দিয়ে আজও ঘোষবউরা পূজার নৈবেদ্য দেয় নীরব ভোরবেলায়।

ইংরেজিতে ছাতিমের নাম ডেভিল'স ট্রি। আমাদের দেশেও হয়ত ভূত-পেত্নীরা বসবাসের জন্য যে-সব গাছ পছন্দ করে, তাতে ছাতিম আছে। কবি সিকান্দার আবু জাফর লিখেছেন, ‘তবুও তোমার ওদিকটাতে যেতে বিষম মানা। ছাতিম গাছে লুকিয়ে আছে মুণ্ডুকাটা ডানা।’

রাজশাহী শহরে গ্রেটার রোডের ফুটপাত ধরে বেশ কিছু ছাতিম লাগানো হয়েছে। এবার ফুল ফুটেছে, সুগন্ধে ম ম করছে চারদিক।

রাজশাহী শহরে গ্রেটার রোডের ফুটপাত ধরে বেশ কিছু ছাতিম লাগানো হয়েছে। এবার ফুল ফুটেছে, সুগন্ধে ম ম করছে চারদিক।
আমার ‘আসা যাওয়ার পথের ধারে’ ধানমন্ডি লেকের পাশ দিয়ে, কলাবাগান মাঠের কাছে, রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুলের রাস্তায় এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে সন্ধ্যার পর থেকে শুধু ছাতিমের সুবাস। শরতের শেষ সপ্তাহ থেকে শুরু করে পুরো হেমন্ত আচ্ছন্ন হয়ে থাকবে সে সুবাসে।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
বার্সেলোনার ‘প্রতিশোধ’ মাদ্রিদ ওপেনে নিলেন নাদাল
বার্সেলোনার ‘প্রতিশোধ’ মাদ্রিদ ওপেনে নিলেন নাদাল
অস্ত্র ও গুলিসহ ৫ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটক
অস্ত্র ও গুলিসহ ৫ রোহিঙ্গা সন্ত্রাসী আটক
পরীমণির মাদক মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ পেছালো
পরীমণির মাদক মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ পেছালো
রুমায় জঙ্গলে পড়ে ছিল গুলিবিদ্ধ দুই মরদেহ
রুমায় জঙ্গলে পড়ে ছিল গুলিবিদ্ধ দুই মরদেহ
সর্বাধিক পঠিত
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে