X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০
সাক্ষাৎকার

আমি প্রতিদিন কবিতা কুড়োই : অরুণাভ রাহারায়

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জাহিদ সোহাগ
১৯ মে ২০২২, ১৫:৫৭আপডেট : ১৯ মে ২০২২, ১৬:০২

অরুণাভ রাহারায়। জন্ম ১৯৯১ সালে, পশ্চিমবঙ্গের আলিপুরদুয়ারে। পড়াশোনার জন্য কলকাতায় আসা। ভারতীয় তুলনামূলক সাহিত্যে এমফিল। ২০১১ সালে কলেজে প্রথম বর্ষের ছাত্র থাকার সময় ‘দেশ’ পত্রিকায় প্রথম কবিতা প্রকাশ। কবিতার বই পাঁচটি—‘সবুজ পাতার মেঘ’ (২০১০), ‘দিনান্তের ভাষা’ (২০১৫), খামখেয়ালি পাশবালিশ (২০১৮), 'স্নিজার সঙ্গে জোড়াসাঁকোয়' (২০২০), ছদ্মবেশ ধরে আছে কবিতাসকল (২০২২)। গদ্যের বই 'মধুর তোমার' (২০২২)। যোগ দিয়েছেন ঢাকা লিট ফেস্টে, অল ইন্ডিয়া ইয়ং রাইটার্স মিটে।

 

প্রশ্ন : তোমার বাবা কবি ছিলেন—মানে একটা অনুকূল পরিবেশ ছিল নিশ্চয়ই—তাই আমার কৌতূহল, তোমার জীবনে প্রথম পঙক্তির স্ফূরণ ঘটল কীভাবে?
উত্তর : আমি যখন ক্লাস নাইন-টেনে পড়ি তখন বাবার লেখার খাতা খুলে তাঁর কবিতা পড়তাম। কাটাকুটি ভরা পাণ্ডুলিপি। আশ্চর্য অভিজ্ঞতা হতো। পাণ্ডুলিপিতে দেখতাম, একটি কবিতার মধ্যে ঢুকে পড়েছে অন্য কবিতা। কখনো একটা ২৯ লাইনের কবিতা ভেঙে হয়তো দুটো কবিতার জন্ম হয়েছে। এসব দেখে আমার খুব বিস্ময় হতো। এভাবে কবিতার জন্ম হয় বুঝি? বেশিরভাগ পৃষ্ঠায় দু-তিন লাইন—অর্থাৎ অসমাপ্ত কবিতা। হয়তো ওই তিন লাইন সম্ভাবনাময় মনে হয়েছে একজন কবির। তিনি লাইনগুলোকে ফেলে রেখেছেন বছরের পর বছর। হয়তো-বা একদিন চতুর্থ লাইনটি লেখা হবে কিংবা হবে না! বাবার তেমনই একটি কবিতার খণ্ড থেকে দু-তিনটি শব্দ তুলে নিয়ে আমার জীবনের প্রথম পঙক্তির স্ফূরণ ঘটেছিল। সন্তান যেমন মায়ের নাভি থেকে জন্ম নেয়। মনে আছে, কচুপাতার ওপর একবিন্দু জল পরিবহনের মতো যত্নে ও সচতেনভাবে আমি বাবার কবিতার থেকে দু-তিনটি শব্দ বয়ে এনে লিখেছিলাম জীবনের প্রথম লাইন। তবে লাইনটি এখন আর মনে নেই!

প্রশ্ন : ‘বাবার কবিতা পড়ি, প্রেতলোকে জাগি’ তোমার এমন একটি পঙক্তি কোথাও পড়েছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল একজন তরুণ কবি তার বাবার কবিতা কীভাবে পাঠ করেন? তখন এও মনে পড়ছিল, জ্যা পল সার্ত্রে তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন, ‘পৃথিবীতে সফল বাবা বলে কিছু নেই।’ কথাটার মানে এমন ভেবেছিলাম, সন্তান বড় হলে নিজের বাবাকেই প্রথম ব্যর্থ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত করে।
উত্তর : এ কথার সঙ্গে আমি একমত। একটা বয়স ছিল, যখন বাবার বিরোধিতা করাই হয়ে উঠেছিল আমার প্রধান লক্ষ্য। তাতে হয়তো বাবা কষ্ট পেয়েছে ভিতরে ভিতরে। কিন্তু মুখে কোনো দিন প্রকাশ করেছি। আমার কবিতা লেখা নিয়ে তিনি খুব আনন্দিত ছিলেন এবং কবিতা লেখার জন্য আজীবন আমাকে উৎসাহিত করেছেন। ছোটবেলা থেকেই বাবার সঙ্গে আমার সুসম্পর্ক। কখনো কোচবিহারের রাসমেলা, কখনো হ্যামিল্টনগঞ্জের কালীপুজোর মেলা—বাবার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে দেখেছি। যেমন ধরো, অষ্টমী স্নানের মেলায় বাবার সঙ্গে কালজানি নদীতে স্নান করতে যেতাম। গিয়ে দেখতাম বাবা বালি দিয়ে দাঁত মাজছেন। আবার ছট পুজোর ঘাটে এক মনে জলে প্রদীপ ভাসানো দেখছেন। তখন থেকেই তিনি আমার মন গঠন করে দিয়েছিলেন। কিন্তু নাইনে পড়ার সময় প্রবলভাবে রক গানে ঝুঁকে পড়েছিলাম আমি। আর বাবা ছিলেন পিন্টু ভট্টাচার্য, স্বাগতালক্ষী দাশগুপ্তর গানের অনুরাগী। তাই, এই নিয়ে বাবার সঙ্গে আমার একটা দূরত্ব তৈরি হয়। পরে অবশ্য আমি পুরোপুরি কবিতার জগতে চলে আসায় সেই দূরত্ব ঘুচে যায়। বাবার জীবনের শেষ তিন বছর আমি তাঁর ভীষণ কাছাকাছি ছিলাম। তোমাকে সত্যি বলছি জাহিদ, একটা কবিতা লেখার পর আমি যে আনন্দ পাই, অসুস্থ বাবার বিছানার মশারি টাঙানোর সময় আমি ঠিক একই রকম আনন্দ পেয়েছি।
গত ৩১ ডিসেম্বর বাবার প্রয়াণের পর নানাজনের কাছ থেকে শোকবার্তা পেয়েছি। ভারতের সুপরিচিত কবিকে সচ্চিদানন্দন থেকে শুরু করে সিতাংশু যশশ্চন্দ্র—সেই সময় আমার শোকের ওপর প্রলেপ দিয়েছিলেন। জার্মানির হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং বাঙালির পরম আত্মীয় হান্স হার্ডার আমাকে বলেছেন, তাঁর এতকালের অভিজ্ঞতায় মনে হয়েছে বাবা সব সময় আমাদের সঙ্গে থেকে যান। এই কথাটা আমি অনুভব করতে পারি কলকাতা থেকে ৭২০ কিলোমিটার দূরে আমার জন্মভূমি আলিপুরদুয়ারে গেলে। এই মফস্বলেই বাবার সঙ্গে আমার অনেক স্মৃতি!
কিছুদিন আগেই প্রয়াত হয়েছেন নাট্যব্যক্তিত্ব শাঁওলি মিত্র। তুমি হয়ত জানো, মৃত্যর আগে তিনি একটি ইচ্ছাপত্র লিখেছিলেন। সেই ইচ্ছাপত্রে শাঁওলি দেবী, জানিয়েছেন মৃত্যর পর যত দ্রুত সম্ভব তাঁর মরদেহ যেন দাহ করা হয়। তিনি তাঁর বাবা শম্ভু মিত্রের মতোই নিথর দেহে ফুলভার বহন করতে চান না। এ ভাবেও ভাবা যায়! এ ঘটনা জানার পর আমার মনে পড়ে সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের লাইন, 'ফুলগুলো সরিয়ে নাও, আমার লাগছে'। আমি শম্ভু মিত্রর অভিনয় দেখিনি। কিন্তু তাঁর সম্পর্কে সামান্য ধারণা আছে। তিনি শেষজীবনে নাট্যসমাজের থেকে, তাঁর হাতে গড়া শিষ্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিলেন। একা হয়ে পড়েছিলেন। এটাই বোধ হয় একজন প্রকৃত শিল্পীর নিয়তি! আমার বাবাকেও আমি শেষজীবনে একা হয়ে যেতে দেখেছি, কবিতাসমাজে তাঁর 'প্রিয়জন'দের থেকে! ঠিক সেই সময় (তাঁর জীবনের শেষ তিন বছর) আমি তাঁর পাশে পাশে ছিলাম।

প্রশ্ন : তুমি বাংলা সাহিত্যের শিক্ষার্থী ছিলে। ওই আনুষ্ঠানিক শিক্ষা নিয়ে শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা কিভাবে সাহিত্যের সঙ্গ লাভ করে? তুমি নিজে বাণিজ্যের ছাত্র হলে কি ক্ষতিবৃদ্ধি কিছু হতো?
উত্তর : দেখো জাহিদ, স্কুলজীবনে আমার শিক্ষালাভ আলিপুরদুয়ার হাই স্কুলে। শিক্ষকরা আমাদের পড়াশোনার পাশাপাশি মূল্যবোধও শেখাতেন। প্রধান শিক্ষক শান্তনু দত্ত বিজ্ঞানের মানুষ হয়েও সাহিত্যে নিবেদিত প্রাণ। মনে আছে, একদিন ক্লাসে এসে তিনি বিজ্ঞান পড়ানোর বদলে আমাদের অনুরোধেই পড়িয়েছিলেন সত্যজিৎ রায়ের 'বঙ্কুবাবুর বন্ধু' গল্পটি। অ্যাং চরিত্রটি নিয়ে আশ্চর্য ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তিনি—যা আজও ভুলতে পারিনি। ক্লাসের বাইরেও তিনি আমার মধ্যে সাহিত্যের বীজ বুনে দিতেন নানা সময়। আজও তাঁর কাছ থেকে উৎসাহ পেয়ে চলেছি।
এরপর কলকাতায় এসে বঙ্গবাসী ইভনিং কলেজে ভর্তি হলাম। বাবা চেয়েছিলেন আমি যেন আলিপুরদুয়ার কলেজে ভর্তি হই। এই নিয়ে কিছুটা দোলাচল পর্বের পর, আমার প্রবল ইচ্ছায় এবং তদুপরি মায়ের সমর্থনে কলকাতায় এলাম। কিন্তু ততদিনে দেরি হয়ে গিয়েছে অনেকটা! এসে দেখি, সেবারের শিক্ষাবর্ষের জন্য একাধিক কলেজে ভর্তির তারিখ পেরিয়ে গিয়েছে। মানে, আমি চাইলেও আর আমার ইচ্ছে মতো কলেজে ভর্তি হতে পারব না। তখনও আমহার্স্ট স্ট্রিট সিটি কলেজ (ডে) আর শিয়ালদায় বঙ্গবাসী ইভনিং কলেজে বাংলা অনার্সে ভর্তির জন্য আবেদনের সময় ছিল। আবেদন করলাম। দুই কলেজেই সুযোগ পাই। কিন্তু ভর্তি হই বঙ্গবাসীতে এবং এর জন্য আমি আমার ভাগ্যকে কৃতজ্ঞতা জানাই। কেননা সেখানে পেয়েছিলাম চারজন গুণী অধ্যাপককে। সুব্রত বাবু, স্বাতী ম্যাম, রাণু ম্যাম আর মনোরঞ্জন বাবু অত্যন্ত যত্ন নিয়ে আমাদের বাংলা সাহিত্য পড়াতেন। মনোরঞ্জন সরদারের সঙ্গে আজও যোগাযোগ আছে। আজও পড়াশোনার ব্যাপারে তাঁর থেকে সহযোগিতা পাই। বাকিদের সঙ্গে যদি যোগাযোগ রাখতাম তারাও নিশ্চয়ই আমাকে নানাভাবে ঋদ্ধ করতেন এখনও।
চারজনেরই অগাধ পাণ্ডিত্য। তাঁরা আমাদের কানে মন্ত্রের সুরে ঢেলে দিতেন বাংলা সাহিত্যের রস। স্বাতী ম্যাম পড়াতেন শেষের কবিতা, সুব্রত বসাক পড়াতেন বঙ্কিমচন্দ্রের চদ্রশেখর। কবিতা পড়াতেন রাণু ম্যাম আর স্ক্যান করে ছন্দ শেখাতেন মনোরঞ্জন স্যার। আমি ব্যক্তিগতভাবে প্রত্যেকের ক্লাস থেকেই জ্ঞানার্জন করেছি। প্রত্যেককে আমার প্রণাম জানাই।
আমি বাণিজের ছাত্র হলে কী হতো তার ধারণা নেই। তবে আমার বাবা কমার্সের ছাত্র ছিলেন। চাকরি করতেন স্বাস্থ্য বিভাগে। কবিতার সঙ্গে জীবনটা কাটিয়ে দিতে তাঁর তো কোনও অসুবিধে হয়নি!

প্রশ্ন : তোমার কতিায় লক্ষ করি স্বতঃস্ফূর্ত সরলতা। তোমার কণ্ঠে যখন শুনি মনে হয় মন্ত্রের মতো নিজের সীমার মধ্যেই থাকছে। তোমার ভাবনার জগৎ কি এমনই?
উত্তর : আমার যাপনের প্রতিফলন পড়ে কবিতায়। নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে প্রতিদিন শব্দ গেঁথে কবিতা গড়ি ঠিকই, কিন্তু কখনোই নিজেকে ছাপিয়ে যেতে চাই না। আমি হয়তো-বা একদিন তোমার থেকে বড় হতে পারব, তবে কোনও দিনই নিজের থেকে বড় হতে পারব না। আমি যেটুকু, আমার কবিতার সীমাও ততখানিই!

প্রশ্ন : ‘স্নিজার সঙ্গে জোড়াসাঁকোয়’ পড়ছিলাম। স্নিজাকে নিয়ে তোমার আবেগ, স্বপ্ন এবং একইসঙ্গে শহুরে জীবনে তাকে দেখা, কখনো সেই দেখা আব্দুল মান্নান সৈয়দের ভাষায় ‘তোমার চেয়ে ভালোবাসি তোমার উপমা’ পর্যায়ের। যে কিনা আবার কাছে এলে বোধিজন্ম লাভ হয়। এ কি তোমার ‘মানস সুন্দরী’? ‘স্নিজার সঙ্গে জোড়াসাঁকোয়’ এই পর্বে এসে তোমার কবিতায় প্রাত্যহিক জীবনযাপন দেখি।
উত্তর : জাহিদ তুমি ঠিকই বলেছ (হাসি)। ‘তোমার চেয়ে ভালোবাসি তোমার উপমা’ ব্যাপারটাকে এভাবে ভাবা যেতেই পারে। ২০১৭ সালে একটি অনুষ্ঠানে স্নিজা দাশগুপ্তর কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনে প্রেমে পড়েছিলাম। মানে, তারচেয়েও বেশি তার গানের প্রেমে পড়েছিলাম। অপূর্ব গায়কি। করোনাকালের আগেও নানা অনুষ্ঠানে তার গান নিয়মিত শুনেছি। কখনো আইসিসিআরে, কখনো কলকাতা বইমেলায় আবার কখনো প্রবল শীতের মধ্যে লিলুয়া বইমেলার মাঠে। রবীন্দ্রসঙ্গীত ছাড়াও নানা ধারার গান শুনে মুগ্ধ হয়েছি। তার কাছ থেকে কি খানিক প্রশ্রয়ও পেয়েছি? বাড়ি ফিরে কিংবা বাসে দাঁড়িয়ে অথবা রাস্তায় হেঁটে হেঁটে কবিতাগুলো লেখা হয়েছিল। প্রতিদিনের দিনলিপিই হুবহু ধরা পড়ে সেইসব লেখায়। সত্যিই সেই সময় আমার 'বোধিজন্ম' হয়েছিল। ‘স্নিজার সঙ্গে জোড়াসাঁকোয়’ পর্বের সব কবিতার প্রথম পাঠক স্বয়ং স্নিজা! আমি আজও সুযোগ পেলে তার গান শুনতে যাওয়ার চেষ্টা করি। আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতার ভাষায় বলতে পারি 'তোমাকে যখন দেখি তার চেয়ে বেশি দেখি যখন দেখি না'।

প্রশ্ন : তোমার কবিতাযাপন কেমন? কবিতার প্রতিই কি তুমি সমর্পিত?
উত্তর : হাট থেকে, নদী থেকে, শহরেরে পাঁচতারা হোটেলের করিডোর থেকে, লঞ্চে পদ্মা পেরনোর সময় চারপাশে দেখা মানুষের মুখ থেকে, ধাক্কা আর অপমান থেকে, ভিড় বাসের হাতল থেকে আমি প্রতিদিন কবিতা কুড়োই।
২০১০ সালের জুন মাসে একবার নবদ্বীপ থেকে মায়াপুরে যাচ্ছিলাম নৌকোয়, দেখলাম চাঁদের আলো পড়েছে জলে। সেই আলোর ওপর দাঁড় গেঁথে গেঁথে এগিয়ে চলেছেন মাঝি। রাতে ফিরে এসে লিখেছিলাম—‘অথই বর্ষার নীলে ভিজে গেলে তিমির/ গঙ্গাবক্ষে তখন যখম হচ্ছে জ্যোৎস্না।’ এভাবেই প্রতিদিনের জীবন থেকে আমার লেখারা উঠে আসে।
কবিতার প্রতি সমর্পিত কিনা তা বলার আমি কেউ নই। বরং তুমি এর বিচার করতে পারো।
 
প্রশ্ন : তুমি জ্যেষ্ঠ কবিদের অন্তরঙ্গ সঙ্গ লাভ করেছ, তা তোমাকে আলোড়িত করেছে?
উত্তর :
আর বোলো না (হাসি)। এখানকার এক বন্ধু আমাকে একবার মস্করা করে বলেছিল—এমন কোনও অগ্রজ কবি নেই আমি কিনা যার সঙ্গ লাভ করিনি! ভাবো তো! কথাটা খানিক ঠিক বটে। দুই-বাংলার জ্যেষ্ঠ কবিদের সঙ্গে গভীরভাবে মিশেছি, তাঁদের স্নেহ পেয়েছি, বকা খেয়েছি। কবিসঙ্গ পেয়ে ঋদ্ধ হতেই চেষ্টা করেছি আমি। তাঁরা আমাকে আলোড়িত তো করেইছেন, প্রভাবিতও হয়েছি আমি। একদিন দেখলাম, এভাবে আমার জীবনের আঠারো থেকে আঠাশ বছর কেটে গিয়েছে! কিন্তু তিরিশ পেরিয়ে এবার আমি একটা স্পেস খুঁজছি...।

প্রশ্ন : প্রশ্নটি নিজেকেও করি, কেন আমরা কেন্দ্রমুখি?
উত্তর :
অদৃশ্য সুতোর টানে। ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’র মতো জীবন যেন আমাদের টেনে রাখছে কেন্দ্রের দিকে।
অথচ রাস্কিন বন্ড মসৌরির ল্যান্ডোরে কি সুন্দর দিন কাটিয়ে দিচ্ছেন। ভিড় থেকে দূরে... শুধুই লেখার কাছাকাছি? প্রতি শনিবার বিকেলে মুসৌরি ম্যালে কেমব্রিজ বুক শপে দুঘণ্টা বসেন। আর পাহাড়ে বেড়াতে আসা পর্যটকরা ভিড় করেন তাঁকে দেখার জন্য। এটাই তো কেন্দ্র থেকে দূরে থাকার জন্য তোমার-আমার কাছে একটা শিক্ষা! শেষ তিন বছর আলিপুরদুয়ারে থেকে দেখেছি সারাবিশ্বের শিল্প-সাহিত্য আমাকে ছুঁতে পারছে। তাও যেন কিছুটা অভ্যাস বশে, ফের, কলকাতায় ফিরে এলাম। এ শহর থেকেও তো আমি অনেক ভালোবাসা-অপমান পেয়েছি।

প্রশ্ন : তোমার কবিতায় যে প্রকৃতি দেখি, যে জনজীবন তা কি স্মৃতিনির্ভর?
উত্তর :
শুধুই স্মৃতিনির্ভর নয়। আমি প্রকৃতিপ্রেমিক। মাটির কাছাকাছি থাকতে ভালোবাসি। ধরো, দেশের বাড়িতে থাকলে ছুটির দিন বক্সার ওপরের পাহাড়ি গ্রাম লেপচাখায় চলে যাই। গ্রাম দেখতে ভালো লাগে। আবার হয়তো একদিন বঞ্চুকামারি পেরিয়ে চলে গেলাম কোনও এক নাম না-জানা গ্রামে। খেতে বোনা শস্যের সামনে দাঁড়িয়ে মনে পড়ল কবি অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর লাইন—আমি যত গ্রাম দেখি মনে হয় মায়ের শৈশব। কী অপূর্ব! লাইনটি পড়লেই বোঝা যায় কবির মায়ের শৈশব কেটেছে কোনও এক নির্মল গ্রামে! আমি তো প্রকৃতির মাঝেই বেড়ে উঠেছি আমার জীবনের প্রথম আঠারো বছর। তারপর কলকাতায় এলাম। কোভিডের সূচনাকালে আমি আবার ফিরে গিয়েছিলাম আলিপুরদুয়ারে। গিয়ে দেখলাম, এই শহরে আমার জীবনটা সেই আঠারো বছরেই থেমে আছে। আর এতেই মন হয়ে উঠল চনমনে। একটি ব্যাপার লক্ষ করি যে, প্রতিদিন যেমন আমরা নিজেকে একটু একটু করে গড়ে তুলি, মানে ঋদ্ধ হই, অপরদিনে আমাদের মধ্যে সমান্তরালভাবে ভাঙন চলে। হয়তো কাছের বন্ধুর কাছে থেকে পাওয়া কোনও অপ্রত্যাশিত অপমান। তা থেকে তৈরি হওয়া ভাঙন। এরই মধ্যে দিয়ে প্রতিদিন এগিয়ে চলা। জনজীবন আমার লেখায় হয়তো-বা প্রত্যক্ষভাবেই উঠে আসে। প্রকৃতি থেকে যে অনন্ত সবুজ আমি সংগ্রহ করি তা দিয়ে ভরে ওঠে আমার কবিতার ভূমি।

প্রশ্ন : দেশভাগ তোমার বাবার জীবন ওলোটপালট করে দিয়েছে, তুমি তার প্রভাব কিভাবে দেখো জীবনে?
উত্তর :
বাবার মুখে তাঁর দেশের বাড়ির গল্প ছোটবেলা থেকেই শুনেছি। বাবার জন্ম রংপুর জেলার উলিপুর গ্রামে। অল্পবয়সে পশ্চিমবঙ্গে এসেছিলেন বলে বেশি স্মৃতি নেই। ২০১৬ সালে প্রথম বার বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। বুড়িমারি বর্ডার পেরিয়ে যখন গাড়িতে রাজশাহীর দিকে দীর্ঘ যাত্রা করছি, সেই সময় এক জনবহুল এলাকায় হঠাৎ দেখি দোকানের সাইনবোর্ডগুলোর নীচে রংপুর লেখা। মানে আমি পিতৃভূমিতে এসে পড়েছি। কিন্তু বিশেষ কোনও আলোড়ন তৈরি হয়নি ভেতরে। বরং দেশভাগ আমাকে প্রথম নাড়া দিলো ২০২০ সালে লকডাউনের অবসরে তানভীর মোকাম্মেলের তথ্যচিত্র 'সীমান্তরেখা ১৯৪৭' দেখার পর।
আমি তখন বাবার কাছে তাঁর দেশের বাড়ির কথা আরও বেশি করে জানতে চাইলাম। বাবা বিস্তারিত জানালেন, রংপুরের কুড়িগ্রামের উলিপুরে কাশিমবাজার এস্টেটের কথা। মুর্শিদাবাদের মহারাজা শ্রীশচন্দ্র নন্দীর রাজবাড়ি ছিল সেখানে। সেখানে তাঁরা থাকতেন। আমার ঠাকুরদা ছিলেন রাজার নায়েব। সঠিক কিনা জানি না, তবে আমাদের অনুজ বন্ধু মুশফিকুর রহমান আমাকে খোঁজ নিয়ে জানিয়েছে, সেই রাজবাড়িটা নাকি এখনও আছে। তাকে মুন্সিবাড়িও বলে এবং সেই বাড়ি এখন ভ্রমণক্ষেত্র! এমনকি ছবিসহ ইউটিউবের লিঙ্কও পাঠিয়েছে মুশফিকুর! যেহেতু ভ্রমণক্ষেত্রে, অনেকে সেখানে বেড়াতে গিয়ে ভিডিয়ো বানিয়েছে। একটা ভিডিয়ো দেখিয়েছি বাবাকে। তিনি স্মৃতি ঘেঁটে মনে করতে পারলেন এই সেই বাড়ি! নিজের পুরনো বাড়ি দেখে বাবার চোখে জল এল। পাশে দাঁড়িয়ে মনে হলো, আমি যেন পুণ্য অর্জন করলাম। ভাই মুশফিকুর রহমানকে আমার কৃতজ্ঞতা! আগামী দিনে তোমার সঙ্গে সেই বাড়িতে বেড়াতে যাব।

প্রশ্ন : কবিতা তুমি নিয়মিতই লেখো, প্রায় প্রতিদিনই বলা যায়, তোমার সঙ্গে থেকে দেখেছি তুমি সকালবেলা প্রার্থনার মতো করে কবিতা পাঠ করো। ব্যাপারটা সম্পর্কে তোমার অনুভূতি জানতে চাই।
উত্তর : হ্যাঁ, ঠিকই। প্রতিদিন সকালবেলা আমি কবিতার সঙ্গে সময় কাটাই। যদিও সারা দিনই কবিতার সঙ্গে আমার কথোপকথন চলতে থাকে। কিন্তু লেখার সময় শুধু সকালবেলাই। কেবল স্নিজা পর্বের লেখাগুলো ব্যতিক্রম। ওই যে বললাম, 'বোধিজন্ম' হয়েছিল তখন। সকাল ছাড়াও বিকেলে রাতে লিখতে পারতাম। ঘটনার স্ফূরণ থেকে যখন-তখন কবিতার জন্ম হতো। কবিতা লেখা ছাড়াও অন্যান্য কাজ আমাকে বাধ্যতামূলক ভাবেই করতে হয় সারা বছর। "দশটা একান্ন বাজে যেতে হবে অফিসে এখন/ অথচ মাথায় লেখা ঘোরে সারাক্ষণ" লিখেছিলাম একবার। তাই শুধু সকালেই লেখার সঙ্গে সময় কাটাবার সুযোগ হয়। লেখার কি আদৌ কোনও নির্দিষ্ট সময় থাকা উচিত? এর উত্তর অবশ্য আমার কাছে নেই।

প্রশ্ন : লিখতে লিখতে বইয়ের রূপরেখা বা ইমেজ হাজির হয়, নাকি কোনো একটি ভাবনাবিন্দু থেকে লেখা শুরু করো?
উত্তর : গ্রন্থ পরিকল্পনা করে একে একে কবিতা লিখতে আমি কখনোই পারি না। আশ্চর্য ব্যাপার, এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম 'স্নিজার সঙ্গে জোড়াসাঁকোয়' বইটি! আমার বাকি চারটে বই—সবুজ পাতার মেঘ, দিনান্তের ভাষা, খামখেয়ালি পাশবালিশ এবং সদ্য প্রকাশিত ছদ্মবেশ ধরে আছে কবিতাসকল বইয়ের কবিতাগুলো স্বতস্ফূর্তভাবে লেখা হয়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশ পায়। পরে পাণ্ডুলিপি সাজিয়ে গ্রন্থ নির্মাণ করি। তবে প্রথম থেকেই ইচ্ছে ছিল প্রেমের কবিতাগুলো নিয়ে একটা পূর্ণাঙ্গ বই হবে।
তাই বলব, একটি ভাবনাবিন্দু থেকেই আমার কবিতার জন্ম হয়। কীভাবে? তোমাকে বলি : আমি তো তিন বছর আলিপুরদুয়ারে কাটিয়ে কলকাতায় ফিরে এলাম গত ফেব্রিয়ারি মাসে। অনেক (সবাই নয়) সমবয়সি কবিবন্ধুর মুখে প্রায় একটাই প্রশ্ন, 'অরুণাভ, আলিপুরদুয়ারে কবে ফিরবেন?' আমি মনে মনে ভাবি আমার ফেরা নিয়ে তাদের এত ভাবনা কেন? এ ঘটনার চূড়ান্ত পর্যায় হলো সেদিন কলেজ স্কোয়ারে, নববর্ষের বইমেলায়। আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ-দেখা কলেজ স্কোয়ারের গেটে। আমাকে দেখামাত্রই লক্ষ করলাম তার স্থূল শরীরে একটা বিদ্যুৎচমক খেলে গেল...। এবং মূহূর্তে সে আমাকে চিনতে না-পেরে বলল—'পরে পরে'! এর মানে কী আমি জানি না। হয়তো-বা 'পরে কথা হবে' বলতে চেয়েছিল! ব্যস্ততা থাকতেই পারে। কিন্তু আমি আঘাত পেলাম বন্ধুর আচরণে। সে আমাকে দেখে চিনতেই পারল না! এমনকি তার চোখেমুখে একটা অস্থির ভাব! অথচ তার সঙ্গে আমার নিয়মিতই ফোনে কথা হয়েছে গত তিন বছর। অর্থাৎ যেই আমি কলকাতায় পা রাখলাম পুনরায় বসবাসের জন্য, তখনই যেন হয়ে উঠলাম তার কমপিডিটার! এটা ভেবেই ধাক্কা খেলাম আমি। আর এই ধাক্কা থেকেই দেড় বছর পর আমার নতুন কবিতার পর জন্ম হলো। পরের দিন আবার লিখলাম। তার পরের দিন আবার। আমি যেটুকু নিজেকে চিনি—তা থেকে বলাই যায়, আরও কিছু লেখা উঠে আসবে বন্ধুর কাছ থেকে পাওয়া অপ্রত্যাশিত অপমান থেকে। এভাবেই হয়ে উঠবে আমার আরও একটি কবিতার পর্ব!

প্রশ্ন : বাংলাদেশের কবিতা পাঠের ক্ষেত্রে কোনো অভ্যস্ততা? যেমন অনেকেই বলেন, বাংলাদেশের জনজীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকায় অনেকেই বাংলাদেশের কবিতা রিলেইট করতে পারেন না, তোমার অভিজ্ঞতা কী?
উত্তর : ‘বাংলাদেশের জনজীবন ও সংস্কৃতি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকা’ এ কথাটি আমার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য কি? এমনিতেই তিনবার বাংলাদেশে গিয়েছি। গ্রামে গঞ্জে ঘুরেছি। তোমাদের সঙ্গে আড্ডা হয়েছে শহরে। এছাড়া আমি পশ্চিমবঙ্গে বসে তোমাদের দেশের শিল্প-সাহিত্য, রাজনীতি, ক্রিকেট, বিশেষ করে নাটক, এমনকি হুজুরদের ওয়াজ-মেহফিলও নিয়মিত ইউটিউবে শুনি। নিজের তাগিদেই বাংলাদেশ সম্পর্কে আপডেট থাকার চেষ্টা করি।
শামসুর রাহমান আমার প্রিয় কবিদের একজন। আল মাহমুদ, বেলাল চৌধুরী, মহাদেব সাহা, ফরহাদ মাজহার, নির্মলেন্দু গুণ, কামাল চৌধুরী, শামীম রেজা, শেলী নাজ, মাসুদার রেহমান প্রমুখের কবিতা নিয়মিত পড়ি। তরুণ কবিদের মধ্যে তোমার কবিতা আমাকে বিশেষভাবে আলোড়িত করেছিল ২০১৫ সালে। তবে এখন তোমাকে আর তরুণ কবি বলা যায় কিনা জানি না (হাসি)।

প্রশ্ন : দেশভাগ প্রসঙ্গে আরেকটি প্রশ্ন যোগ করি, তুমি কি নিজেকে শিকড়হীন মনে করো, মানে উদ্বাস্তু? [আমি দেশ না ছেড়েও তা করি, তাই বললাম]
উত্তর :
আমি নিজেকে শিকড়হীন মনে করি দেশভাগের প্রসঙ্গ ছাড়াই। শঙ্খ ঘোষের একটি বইয়ের নাম 'সীমান্তবিহীন দেশে দেশে' আবার শামীম রেজার একটি বইয়ের নাম 'দেশহীন মানুষের দেশ'। বছর দুয়েক আগে করোনার লকডাউনের সময় 'পরিযায়ী শ্রমিক' শব্দবন্ধটি আমাদের সামনে উঠে এসেছিল। ভারতের একটি মর্মান্তিক ঘটনা আমাকে বিপর্যস্ত করেছিল। তা হলো, লকডাউনে যখন বাস ট্রেন প্রায় বন্ধ তখন রেললাইন ধরে বহু দূর থেকে বাড়ি ফিরছিল কয়েকজন পরিযায়ী শ্রমিক। খিদেয়, ক্লান্তিতে তাদের চোখে ঘুম আসে এবং রেললাইনেই ঘুমিয়ে পড়েন তারা। একটি ট্রেন এসে তাদের শরীর ছিন্নভিন্ন করে চলে যায়। এ খবর শোনার পর আমি ঘুমোতে পারিনি, কবিতা লিখতে পারিনি বহুদিন।
আমি যে ভূমিতে জন্মেছি, পেশার টানে সে ভূমির থেকে বাইরে থাকা মানেই আমি শেকড়হীন একজন পরিযায়ী শ্রমিক।

/জেডএস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ধারণার চেয়ে কম সেনা প্রয়োজন ইউক্রেনের: সিরস্কি
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
ফিরেই ফর্টিসকে বিধ্বস্ত করলো মোহামেডান
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
লঞ্চঘাটের পন্টুন থেকে পদ্মা নদীতে পড়ে যুবকের মৃত্যু
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
রাশিয়ায় বন্ধ হলো জাতিসংঘের নজরদারি সংস্থার কার্যক্রম
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
চিয়া সিড খাওয়ার ৮ উপকারিতা
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’
‘ভারতের কঠোর অবস্থানের কারণেই পিটার হাস গা ঢাকা দিয়েছেন’