X
রবিবার, ২৮ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১
বিজয় সরকার জীবনীনাট্য

দয়াল তোমার আসল নামটা কী || পর্ব-৩

সাইমন জাকারিয়া
০৫ মে ২০১৬, ১২:৩৮আপডেট : ০৫ মে ২০১৬, ১৪:১৭

চারণকবি বিজয় সরকার

পূর্ব প্রকাশের পর


প্রথম পক্ষ

জ্ঞান অস্ত্রে তোর ধার বেড়েছে শাস্ত্রের ঘর্ষণে

যেন নিজের অস্ত্রে নিজে কেটে, মরিস না অসাবধানে॥

জ্ঞান যদি হয় বাক্যের বাহক কর্মেতে নাকাল
কাজে শূন্য কথায় ধন্য তারে কয় বাচাল
সে নিজেকে রাখিতে সামাল, পারবে নাকো সাধনে॥

আমার বিপক্ষের গায়ক এই গানের কথার মতোই ‘কাজে শূন্য কথায় ধন্য’। তিনি নিতান্ত বাচালের ভূমিকায় কথার প্রকৃত মর্মকে বাদ দিয়ে শুধু অপথে ঘুরেছেন, কিন্তু সত্যিকার অর্থে বিজয়ের কবিগান শিক্ষার কোনো পরিচয় তিনি দিতে পারেননি। তবে, তাঁর কথার মধ্যে আমি সাধক বিজয়ের সাধনা জগৎ সম্পর্কে কিছু নির্দেশনা পেয়েছি। তা এখানে প্রাসঙ্গিক ভেবে প্রকাশ করছি।
তিনি বলেছেন— বিজয় তাঁর কবিগান শিক্ষার প্রথম জীবনে দ্রুত সরকার হবার বাসনায় কাপালিক এক সাধুর খপ্পরে পড়ে প্রায় মৃত্যু মুখে পতিত হয়েছিলেন। কিন্তু তিনি ঘটনার প্রয়োজনীয় অংশের অনুপুঙ্খ বিবরণ দেননি। তারও অবশ্য কারণ আছে। কারণটা আর কিছু নয়, সে বিবরণ দিলে যে সাধক বিজয়ের পরিচয় বেরিয়ে আসে। ঠিক আছে, তিনি যখন দেননি, আমিই দিচ্ছি।
বিজয় পরদিন দুপুরের স্নানের পর মনোহর গ্রামের লোকদের ডেকে বললেন—

— এই গ্রামের নিকটে কোনো সাধুর আশ্রম আছে নাকি? গতরাত্রে আমার এই ছেলেটিকে সে গোপনে তার আশ্রমে নিয়ে গিয়েছিল।

মনোহর সরকারের মুখে সমস্ত ঘটনা শুনে কালিবাবু বললেন—

— আমাদের এখান থেকে প্রায় মাইল দেড়েক দূরে একজন তান্ত্রিক সাধু শ্মশানে থাকেন।
— সেই সাধুকে আমি চাই। যে প্রকারে হোক, তাকে এখানে উপস্থিত করা চাই।

মনোহর সরকারের কথা মতো সাতজন লোক ছুটে চলল সেই শ্মশানে। তারা গিয়ে দেখেন সেখানে সেই সাধু নেই। তিনি আসন বসন ফেলে চলে গেছেন কোথাও। লোকগুলি ফিরে মনোহর সরকারকে তা জানাতেই তিনি বিজয়কে বললেন—

— বিজয়, তুমি কোন দৈবশক্তির জন্য বেঁচে গেছ, নইলে ওই সাধু তোমাকে শবাসনে করে কালী সাধনায় সিদ্ধিলাভ করতে চেষ্টা করেছিলেন। ভাগ্যগুণে এ যাত্রায় রেহাই পেয়েছ, আমাকে না বলে এক পা’ও কোথাও যাইতে পারবে না। তোমার জীবনের সব দায়িত্ব আমার উপর রয়েছে, তাই বুঝে চলো।

এখানে মনোহর সরকার যে দৈবশক্তির ইঙ্গিত দিয়েছেন, তার কথা বিজয় নিজেও কি বলেন নাই? নিশ্চয় বলেছেন— যখন সাধু তাকে শবাসনে নেবার চেষ্টা করছিলেন। তখন বিজয়ের মনে পড়েছিল— তিনি চাঁদড়ার লোকনাথ ফকিরের ভাবাপন্ন। এই লোকনাথ ফকির ছিলেন কালী সাধনায় সিদ্ধ। তাই তিনি ভক্ত বিজয়ের বিপদের সময় দৈবশক্তিতে সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। আর তা দৃষ্টে সেই সাধু তাকে ছেড়ে দেন। অতএব, বিজয় ছিলেন প্রথম থেকেই সাধক পথের মানুষ এবং সাধনায় সিদ্ধ পুরুষ, না হলে সেদিন ওই তান্ত্রিক উপাসকের হাতেই তাঁর জীবনাবসান ঘটতো সেই শ্মশানে।
এখানে দাঁড়িয়ে সাধক বিজয় গেয়েছেন—

লোক ঠকানো সংগ্রহ তোর শাস্ত্রাদি ঘেঁটে
পরের যাত্রা নষ্ট করিস নিজের নাক কেটে
ও তুই বেহিসাবী খাটনি খেটে, কি পেয়েছিস জীবনে॥

বেদ-বেদান্ত পড়ে যদি না জাগে বেদন
দেবতা নিবে না তার নৈবেদ্য নিবেদন
তার ভজন-সাধন, যজন-যাজন, সবই বৃথা ভুবনে॥

বিপক্ষের গায়ক আমার প্রতি মোট দুইটি প্রশ্ন রেখেছেন— তার প্রথম প্রশ্ন হলো— বিজয় সরকারের আসল নাম কি? এ কথার উত্তর অতি সোজা— বিজয় সরকারের আসল নাম হচ্ছে— বিজয়কৃষ্ণ বৈরাগী। যৌবনে বিজয়কৃষ্ণ তাঁর পৈত্রিক পদবী বৈরাগীর পরিবর্তে অধিকারী ব্যবহার করতে শুরু করেন, বৈরাগী ও অধিকারী সমার্থক শব্দ।
এবার তার দ্বিতীয় প্রশ্ন হচ্ছে— কেন তিনি নিজের আসল নাম বাদ রেখে ‘সরকার’ উপাধি গ্রহণ করলেন, সকলে কেনইবা তাঁকে বিজয় সরকার বলে ডাকে? অতি উত্তম কথা। কিন্তু এই কবিগানের সরকার উপাধি তিনি নিজে কোনোদিনও কৃষ্ণ ও অধিকারীর পরিবর্তে ব্যবহার করেছেন বলে আমাদের জানা নেই। বিভিন্ন চিঠিপত্রে, এমনকি কবিগানের বায়নাপত্র বা স্বীকৃতিপত্রের সাক্ষরে তিনি সম্পূর্ণরূপে শ্রীবিজয়কৃষ্ণ অধিকারী নামটিই ব্যবহার করেছেন; তবে পুরো নামের ডান পাশে প্রথম বন্ধনীর মধ্যে তিনি সরকার উপাধি লিখেছেন এটা সত্য। তাই তাকে কবিয়াল বিজয় সরকার বলাটা সমীচীন মনে করি না, এতে সত্যের অপলাপ হয়। আর তাঁর সাধক পরিচয় বাদ পড়ে যায়।
এখনও নড়াইল অঞ্চলের বিভিন্ন বাড়ি গেলে দেখা যায়, বিজয়কৃষ্ণ অধিকারীর ছবিতে ফুল চন্দন দিয়ে, সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালিয়ে ভক্তি অর্পণ করা হয়; তিনি যদি শুধুই কবিয়াল হতেন— এই মর্যাদা কোনোদিনই তিনি পেতেন না, তিনি একজন সিদ্ধিপ্রাপ্ত সাধক হিসেবে নিজের পরিচয় সমাজে রাখতে পেরেছেন বলেই তো তিনি সাধারণ মানুষের কাছে দেবতার মতো আরাধ্য সাধক হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন।
তাই আমি তাকে সাধক বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী হিসেবেই উল্লেখ করতে চাই। তাঁর চেতনার গভীরে সাধকসত্তা এমন গভীরভাবে ঢুকে পড়েছিল যে, তিনি কোনোদিন পৃথিবীবাসকে স্থায়ীবাস বলে ভাবতে পারেননি, এমনকি বিস্মৃতও হননি। তার গানে এ কথার অসাধারণ প্রকাশ দেখা যায়, যেমন— একটা গানের কথা বলা যাক :

এই পৃথিবী যেমন আছে তেমনি ঠিক রবে
সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে।
সেই নগদ তলব তাগিদপত্র নেবে আসবে যবে।

আমার যখন মহাঘুমে বুজিবে দুই চোখ
পাড়া পড়শী প্রতিবেশী পাবে কিছু শোক
শেষে আমি যে এই পৃথিবীর লোক, ভুলে যাবে সবে॥

যত বড় হোক না কেন রাজা-জমিদার
পাকাবাড়ী জুরিগাড়ি ঘড়ি ট্রান্জিস্টার
তখন থাকবে না তার কোনো অধিকার, বিষয় বৈভবে॥

চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা আকাশ-বাতাস-জল
যেমন আছে তেমনি সবই রইবে অবিকল
মাত্র আমি আর রইব না কেবল— জনপূর্ণ ভবে॥

শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস, গন্ধ বন্ধ হলে জেনো
এই পৃথিবীর অস্তিত্ববোধ রইবে না আর হেন
পাগল বিজয় বলে সেইদিন যেন এসে পড়ে কবে॥

এই যে জীবনবোধ, এ কি কবিগানের ছড়া, পাঁচালী কাটা কোনো সাধারণ কবিয়ালের হতে পারে! যদি না তাঁর চেতনায় সাধনপথের কোনো গূঢ়-গূহ্য ইশারা থাকত; যদি না কোনো প্রকৃতজ্ঞান, প্রত্যক্ষ উপলব্ধি, অনুভব বা বাস্তব অভিজ্ঞান তাঁর না-ই থাকত। আর কে না জানে এ সকল জ্ঞানানুভূতি সাধনার পথ ছাড়া অর্জন করা যায় না। বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী তা চূড়ান্তভাবে অর্জন করেছিলেন বলেই এমন কথা প্রকাশ করতে পেরেছিলেন। পৃথিবীতে আরও তো বহু কবিয়াল ছিলেন, আছেন, কই তাঁদের মধ্য থেকে কেউ তো এমন কথা বলতে পারেননি, পারছেনও না। অতএব, আমার বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী সাধক ছিলেন, ভাবুক ছিলেন, ছিলেন মহাদার্শনিক। এর প্রমাণ আমি তাঁর রচিত গানের উদারহণ দিয়ে আরও দিতে পারবো। এখন সেদিকে যাচ্ছি না, এখন আমি আমার প্রতিপক্ষের গায়কের কাছে জানতে চাই— আমার বিজয়কৃষ্ণ অধিকারী, যাকে আপনি কবিয়াল বিজয় সরকার হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছেন, কিন্তু আপনি কি বলতে পারবেন— বিজয় তাঁর জীবনে কবিগানের কোনো পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা গ্রহণ করেছিলেন কিনা?
কবিগানে অনেক শাস্ত্রবিদ্যা, বেদ-উপনিষদ-কোরআন-পুরাণ নিয়ে আলোচনা করতে হয়, আপনার কবিয়াল বিজয় সরকারের আদৌ কি সেই শিক্ষা ছিল? সেই সঙ্গে এও জানতে চাই, শিক্ষা তখনই পূর্ণাঙ্গতা পায়, যখন শিক্ষাগুরুর অনুমতি নিয়ে শিষ্য বিদ্যা প্রকাশ করতে অগ্রসর হয়, কিন্তু আপনার কবিয়াল বিজয় সরকার কি সেই পথ অবলম্বন করেছিলেন? বলবেন সবিস্তারে।

দ্বিতীয় পক্ষ
যে নামে জেনেছে যেজন সেই নামেতে ডাকো
ধর্ম জেনে কর্ম মেনে সত্যের পথে থাকো
হিন্দু-মুসলমান; জাতি-ধর্ম দরদী
জৈন-শিখ-বৌদ্ধ-খৃষ্টান, আরো জাতি ইহুদি
সবার আসা যাওয়া একই বিধি, বিধির বিধান দেখো॥

— এটা কবিয়াল বিজয় সরকারের একটি গান। আমাকে প্রশ্ন করা হয়েছে— তিনি কবিগানের পূর্ণাঙ্গ শিক্ষা পেয়েছিলেন কিনা? নিশ্চয়, তিনি সেই শিক্ষা পেয়েছিলেন। তা না হলে তিনি কী করে সকল ধর্মমতের ঊর্ধ্বে উঠে এমন কথা বলতে পারলেন—

আল্লা-হরি-খোদা কিংবা বলে ভগবান
গড বলে কেউ, কেহ তারে বলে পাথিয়ান
যদি মর্মে থাকে ধর্মের ইমাম, বিফল হবে নাকো॥

একই আকাশ, একই বাতাস, একই গাছের ফল
একই অন্নে পালিত, একই নদীর জল
ওরে কে বুঝবে সেই বিধাতার কল মনের খাতায় আঁকো॥

— প্রকৃত কবিয়াল হলেই এ ধরনের মুক্তমনের, মুক্তবুদ্ধির কথা বলা যায়। বিজয় সরকার সেই প্রকৃত কবিয়াল যিনি সকল ধর্মের বিধানকে সমান চোখে দেখে, তার অন্তর্নিহিত কথার ঐক্যকে প্রকাশ করেছেন জীবনভর, গেয়েছেন—

জল পানি আর ওয়াটার বলে মানুষের ধারণ
যে নামে সে জানে মানে পিপাসার কারণ
যদি পিপাসা হয় নিবারণ বিভেদ কেন রাখো॥

পাগল বিজয় বলে বিশ্বকর্তা একই সত্তা জানি
শশা ফেলে খোসা লয়ে আমরা করি টানাটানি
তার জ্ঞান প্রেমের ভক্তি রওশানী নয়ন পাতে রাখো॥

ব্যক্তিগত জীবনে আমরা প্রত্যেকে প্রায় ধর্মের ভেদ করি, তা করতে গিয়ে এক এক ধর্মের চোখ দিয়ে স্রষ্টাকেও আলাদা চোখে দেখি, যুক্তির চোখ দিয়ে বিচার না করে— বিশ্বকর্তার একক সত্ত্বা নিয়ে গণ্ডগোল বাধাই।
কিন্তু কবিয়াল বিজয় সরকার তা করেননি। তিনি তার বদলে বহুমাত্রিক ধর্মকথার মধ্যে ঐক্য স্থাপন করেছেন। কিন্তু আমাদের মনে প্রশ্ন আসে— এই কাজটি তিনি করলেন কীভাবে? আসলে, এ কথার উত্তর জানলেই কবিয়াল বিজয় সরকারের কবিগান শিক্ষার পূর্ণাঙ্গ পরিচয় পাওয়া যাবে। তাই এবার আমি প্রতিপক্ষ দলের গায়কের প্রশ্নের উত্তরে সেই দিকেই গমন করছি।
আগেই বলা হয়েছে যে, কবিয়াল বিজয় সরকারের কবিগান শিক্ষার প্রথম শিক্ষাগুরু হলেন— কবিয়াল মনোহর সরকার। তিনি কীভাবে আসরে দাঁড়িয়ে বিজয়কে কবিগানের শিক্ষা দেবার কাজটি করেছিলেন তাও আমরা দেখেছি।
এবার আরেকটু বলতে চাই। কেননা, মনোহর সরকারই কবিয়াল বিজয় সরকারের একমাত্র গুরু নন। তিনি মনোহর সরকারের সঙ্গে থেকে বাংলাদেশের ফরিদপুর, খুলনা, গোপালগঞ্জ, ঢাকা, নোয়াখালী প্রভৃতি স্থানে ঘুরে কবিগানের ছড়া-পাঁচালী ও গান রচনা ও পরিবেশনার কৌশল আয়ত্ত্ব করেন। একটানা দুই বছর তিনি মনোহর সরকারের কাছ থেকে কবিগানের শিক্ষা গ্রহণ করেন।
এরই মধ্যে একদিন এক নির্জন মাঠের মধ্যে অপরাজেয়; অদ্বিতীয় সরকার শ্রীরাজেন্দ্রনাথের সাথে বিজয়ের দেখা হয়ে যায়। বিজয় তাঁকে সবিস্তারের মনোহর সরকারের কাছে কবিগানের প্রাথমিক শিক্ষার ব্যাপারটি বলেন। সেই সঙ্গে এও বলেন—

— দাদা, কবিগানের কলা-কৌশল তো কিছু শিখেছি। এখন আমার কি করা কর্তব্য?
— শোনো বিজয়, এখন দেশ-কাল-সমাজ যেভাবে প্রস্তুত হচ্ছে, সেভাবে বহুমুখী জ্ঞানের কথা রপ্ত না করতে পারলে, আর কবিগানের পরিবেশনায় সেই বহুমাত্রিক জ্ঞানের কথা প্রকাশ না করতে পারলে আজকাল কবিগান কেউই পছন্দ করবে না।
— আমি জানি, আপনার কাছেই সেই বহুমাত্রিক জ্ঞান পাওয়া যাবে। তাই আমি মনস্থির করছি আপনার চরণে।
— বিজয়, তুমি যদি একটি বৎসর আমার সঙ্গে থাক, তারপর তুমি নিজের পথ নিজেই করে নিতে পারবে, এই আমার ধারণা।
— ঠিক আছে, আমি তাতেই রাজি।

এরপর বিজয় মনোহর সরকারের দল ত্যাগ করে রাজেন্দ্র সরকারের দলে যোগ দেন। তিনিই বিজয়কে বহুমাত্রিক জ্ঞানের মধ্যে ঐক্যের অপূর্ব চোখ খুলে দেন। বিজয়কে গানের আসরে যাবার আগে তিনি বলেন—

— বিজয়, আমাদের যদিও কালীমন্দির, নাটমন্দির ইত্যাদি স্থানেই বেশি কবিগান করতে হয়, কিন্তু মনে রাখবে, আসরের দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান সবাই আছে, সবার মন বুঝে কথা বলতে হবে, সবারে মিলাতে হবে একসূত্রে। যেভাবে ঋষি কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ফকির লালন সাঁই সকল ধর্মের মধ্যে সেতুবন্ধন রচনা করেছেন, আমাদের গান, কথা হতে হবে তাঁদেরই সমান্তরাল।
— তা কি সম্ভব গুরু!
— কেন সম্ভব নয়, জ্ঞান চোখ খুলে দেখ— যত ইষ্ট নাম সবই সমান। ওরে ভেবে দেখ যে কেষ্ট, সেই খ্রিষ্ট, মোহাম্মদ অথবা বুদ্ধ, কোনোখানে নাই দ্বন্দ্ব। আজ আসরে গাইবি আমার সঙ্গে, ঘুচে যাবে তোর মনের দ্বন্দ্ব।

রাত্রি হলে আসরে দাঁড়িয়ে নবীন শিক্ষার্থী বিজয়কে পাশে নিয়ে রাজেন্দ্র সরকার দর্শক-শ্রোতাদের বললেন—

— আজ আমার পাশে যে ছেলেটিকে দেখতে পাচ্ছেন, সে আমার নবীন শিক্ষার্থী। আপনাদের সাক্ষাতে খুলে দিতে চাই তার জ্ঞানচক্ষু, যদি দেন আপনারা তার সম্মতি।

দর্শন-শ্রোতাগণ একবাক্যে চিৎকার করে সম্মতি দেন— ‘হ্যাঁ, আমাদের আছে সম্মতি।’

— আপনাদের পেয়ে সম্মতি, আমি হলাম ঋণী আপনাদের প্রতি। এবার ওহে বিজয় বাবা, কণ্ঠ রাখো আমার কণ্ঠে, অন্যদিকে নাহি যাবা। এসো এসো, গাও বাবা—

জপ ইষ্টনাম, কৃষ্ণ-খ্রিষ্ট নাম
মোহাম্মদ বুদ্ধ
হবে জপিলে চিত্ত শুদ্ধ।
পড় গীতা, পড় চণ্ডী, পড় কোরাণ
ছাড় গণ্ডী।
পর খঞ্জ সূত্র মালা দণ্ডি
দেখবে পরম প্রকাশ...॥

— এ কি বললেন গুরু!
— মন্দ তো বলি নি!
— কিন্তু এমন কথা প্রকাশ্যে!
— বিজয়, কবির ভূমিকা তো এটাই, প্রকৃতির প্রকৃত ঘটনাকে মানব সমাজের সামনে খুলে দেওয়া। তোমাকেও এমন গান গাইতে হবে, যদি তুমি প্রকৃত কবি হতে চাও!
— আমি চাই গুরু, আমি প্রকৃত কবিই হতে চাই!
— তাহলে, এখনও কেন কৃষ্ণ, খ্রিষ্ট, মোহাম্মদ, বুদ্ধকে আলাদা চোখে দেখছো! ওই তো চোখের মধ্যে নানা সন্দেহ দেখছি, দূর করো, দূর করো, দৃষ্টিকে উদার করো, প্রসারিত করো। কবিগানের যুক্তির বাখানে।
— তবে, গুরু স্রষ্টার এতো নামের কারণ কী!
— এ প্রশ্নের উত্তর তোমাকে অন্বেষণ করতে হবে। তাহলেই তুমি সাধক হতে পারবে, কবিগানের সরকার হতে পারবে।

রাজেন্দ্র সরকার এভাবেই বিজয়ের জ্ঞানচক্ষুকে খুলে দিলেন, সহজভাবে মিলিয়ে দেখালেন সকল ধর্মের মহামিলনের সম্ভাবনা। বিজয়ের মনে তা স্থায়ী হয়ে গেঁথে গেল।
রাজেন্দ্র সরকারের দলে গান গাইতে গাইতে বিজয়ের ভেতর কবিত্বসত্তার স্ফুরণ ঘটতে থাকে। তাঁর চেতনার গভীরে আলোড়ন উঠল স্রষ্টার নামের ভেদ কী! একদিন কবিগানের আসরে তিনি সেই প্রশ্নবিদ্ধ ভেদের কথা প্রকাশ করলেন এভাবে—

আমি জানতে চাই দয়াল তোমার আসল নামটি কী?
আমরা বহু নামে, ধরাধামে, কত রকমে ডাকি॥

কেহ তোমায় বলে ভগবান, গড বলে কেউ করিছে আহ্বান
কেহ খোদা, কেউ যিহুদা, কেউ পাথিয়ান
গাইলাম জনম ভরে মুখস্থ গান, মুখবোলা টিয়াপাখি॥

যে ভাগবান-ঈশ্বর, আল্লাহ-খোদা, হরি, বুদ্ধ বা গড কত নামে আমরা স্রষ্টার বন্দনা করে যাচ্ছি; তাঁর নাম প্রকাশিতে নানা দ্বন্দ্বে, জাতি-বিভেদে, সংঘর্ষে মানবভুবনে উত্তপ্ত রেখেছি, কিন্তু এই কী মানুষের করণ হতে পারে? তাই সেই স্রষ্টার কাছেই আমার এই জিজ্ঞাস্য—

সকল শাস্ত্রে শুনিতে যে পাই, তোমার নাকি পিতা-মাতা নাই
তোমার নামকরণ কে করিল, বসে ভাবি তাই!
তুমি নামী কি অনামী হে সাঁই, আমরা তার বুঝি বা কি?

কেহ পিতা কেহ পুত্র কয়, বন্ধু বলে কেউ দেয় পরিচয়
তুমি সকলের সকল কিছু আবার কিছু নয়
দয়াল তোমার আসল যে পরিচয়, কে জানে তা কি না কি?

পাগল বিজয় বলে মনের কথা কই
আমি খাঁটি ভাবের পাগল নই
গোল বেঁধেছে মনের মাঝে কাজেই পাগল হই
আমার বুকে যা নাই, মুখে তাই কই, কাটা কান চুলে ঢাকি॥

বিজয়ের এই গান শুনে আসর জুড়ে বিস্ময় ছড়িয়ে পড়ে, তাঁর সহ-গায়ক, কবিয়াল, বাদ্যকর, দোহারগণ থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শক-শ্রোতারা পর্যন্ত বিজয়কে ধন্য মানতে থাকে। দর্শক-শ্রোতাদের মধ্যে বিজয়ের জনপ্রিয়তা এবং তাঁর কবিত্ব প্রতিভার প্রতি আকৃষ্ট হয়ে রাজেন্দ্র সরকারের কবিগানের দলের কয়েকজন গোপনে বিজয়কে প্রলুব্ধ করেন নতুন কবিগানের দল গঠনের জন্য। বিজয় তার প্ররোচনায় “গুরুনাথ কবি পার্টি” নাম দিয়ে নিজের একটি কবিগানের দল গঠন করেন এবং বায়না নিয়ে কবিগান পরিবেশন শুরু করেন।
বিজয় সরকারের দলের প্রথম বায়না হয় গোপালগঞ্জ জেলার ভেন্নবাড়ি বারোয়ারী খোলায়। প্রথম আসরে তাঁর প্রতিপক্ষের কবিয়াল ছিলেন মোল্লাহাট থানার কাঠাদুরা গ্রামের মহিমাচরণ সরকার।
প্রথম আসরেই বিজয় সরকারের দল গানে ও ছড়া-পাঁচালীতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেন এবং সেই গ্রামে বার্ষিক হিসেবে তাঁর বাধা বায়না হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, একজন কবিয়ালের জীবন কখনো খুব মসৃন হয় না। বিজয়ের বেলাতেও তা হয়নি। কেননা, বিজয় সরকারের এই দল গঠন ও কবিগান পরিবেশনার সংবাদ যখন রাজেন্দ্র সরকারের কানে পৌঁছে তখন তিনি রেগে অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠেন এবং প্রকাশে ঘোষণা করেন—

— বিজয়কে যেখানে দেখতে পাবো, তাকে জুতা না মেরে আমি অন্ন গ্রহণ করবো না।

কানে কানে এই কথা যখন বিজয় সরকারের কাছে পৌঁছাল, তখন বিজয় একদিন তাঁর কবিগানের দলের সদস্যদের সঙ্গে নৌকা পথে কাঁফি নদী দিয়ে রাজেন্দ্র সরকারের বাড়ির কাছে গিয়ে নদীর কূলে নেমে পড়লেন। বিজয়ের এই কাণ্ড দেখে দলের হারমোনিয়াম মাস্টার নগেন বলে উঠলেন—

— আরে আরে, কোথায় যাচ্ছো? রাজেন্দ্র সরকার তোমাকে দেখলে জুতা মারবেন— সে কথা কি তোমার মনে নাই!
— আছে মাস্টার মশাই!
— তবে, আমাদের সঙ্গে নিয়ে যাও, আমরা তোমাকে রক্ষার জন্য প্রস্তুত আছি।
— আপনাদের কাউকে রক্ষা করতে হবে না। আমার জীবনে সরকার মহাশয়ের ইচ্ছাই পূর্ণ হোক। তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করতেই আমি তাঁর বাড়ি যাচ্ছি, আপনারা এখানেই অপেক্ষা করুন।

এই বলে বিজয় সরকার তাঁর গুরু রাজেন্দ্র সরকারের বাড়ি গিয়ে দেখেন— তিনি স্নান করে সবে ভাত খেতে বসেছেন। বিজয় সেই মুহূর্তে গুরু রাজেন্দ্র সরকারের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই, তিনি বিস্ময়ে বলে ওঠেন—

— বিজয়, তুই এখানে! তুই কি জানিস না, আমি তোকে জুতা না মেরে খাব না?
— জানি গুরু, জানি। আজ আপনার সেই প্রতিজ্ঞা পূরণের জন্যেই তো আমি এখানে এসেছি।
— এদিকে আয়।

বিজয় তাঁর নির্দেশ মতো কাছে যেতেই তিনি একখানা জুতা বিজয়ের কপালে ঠেকিয়ে তাঁকে বুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে লাগলেন। তারপর বললেন—

— আয় আমার সঙ্গে বসে ভাত খা।

ভাত খাওয়া শেষ হলে তিনি বিজয়কে বললেন—

— শোন বিজয়, তুই যখন আমার দল ভেঙে দিয়ে নিজেই দল গঠন করেছিস তখন তোকে সহজে ক্ষমা করা যাবে না।
— তাহলে আমার প্রায়শ্চিত্ত কী?
— আমার রচিত কোনো গান তোর দলে গাওয়াতে পারবি না। এখন থেকে তোর সঙ্গে আমার কোনো গানের যোগাযোগ থাকবে না। পারিস তো নিজে গান রচনা করে গাওয়াবি। আরেকটি কথা...
— কী?
— আমার অন্তরঙ্গ সরকার যারা তাদের সাথেও তোকে গান গাইতে দিবো না।

এর ঠিক ৬ মাস পরে রাজেন্দ্র সরকারের বাড়িতে বার্ষিক উৎসব ও কবি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে খুলনা, যশোর, ফরিদপুর ও অন্যান্য স্থানের সরকারগণ উপস্থিত হন। রাজেন্দ্র সরকার তাঁদের সকলকে আহ্বান করে বলেন—

— আগত ও আমন্ত্রিত কবিবৃন্দ! আপনাদের সকলের চরণে ভক্তি! আজ আপনাদের সকলের কাছে আমার একটি আন্তরিক নিবেদন রয়েছে। আপনারা অবগত আছেন যে, বিজয় মনোহর সরকারের পর কবিগান শেখার জন্য আমার শিষ্যত্ব বরণ করেছিল। কিন্তু সে অতিশয় গর্হিত কর্ম করেছে, অল্প শিক্ষা গ্রহণের মধ্যে সে অকস্মাৎ আমার দলে ভাঙন সৃষ্টি করেছে এবং আমার দলের দোহার-বাদ্যকর নিয়ে নিজের দল গঠন করেছে। তার এ ধরনের দুর্ব্যবহারে আমি অত্যন্ত মনোক্ষুণ্ন হয়েছি। তাই আপনাদের নিকট আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ, যদি কোনো সরকার আমার অন্তরঙ্গ দরদী থাকেন, তবে বিজয় সরকারের সঙ্গে কেউ গান করতে পারবেন না। আপনার কি সকলে আমার সাথে একমত?
— নিশ্চয়, আমরা সহমত।
— আমি বিজয়ের প্রথম গুরু মনোহর সরকার, আমিও প্রতিজ্ঞা করছি, রাজেন্দ্র সরকারের মতো একজন বিদগ্ধ কবির সাথে যিনি প্রতারণা করতে পারেন, আমি তাঁর সাথে কোনো গান করবো না।
— আমি নিশিকান্ত সরকার, তেমন খ্যাতি হয়তো আমার নেই, কিন্তু এই মত আমি সমর্থন করি না। বিজয় সরকার যদি অনুতপ্ত হয়ে থাকেন, তো তার সাথে আমার গান গাইতে কোনো আপত্তি নেই।
— না, আমরা কেউ রাজেন্দ্র সরকারের অপমানকে মেনে নিতে পারি না। আমরা বিজয় সরকারকে পরিত্যাগ করছি।
— আমরা বিজয় সরকারের মতো অকৃতজ্ঞ, অভদ্র লোকের সাথে কবিগান করতে পারি না।
— বিজয়, তুমি হয়তো আমায় তেমনভাবে চেনো না, জানো না, আমি শ্যামল সরকার, আমি তোমার গান শুনেছি। তুমি এদের কথায় মন খারাপ করো না। এরা বড় বড় সরকার। এদের কথার কেউ প্রতিবাদ করবে না। এখানে তোমার আর থাকার দরকার নেই। তুমি চলো আমার সাথে, একটা উপায় ঈশ্বর নিশ্চয় তোমার জন্য রেখেছেন, চলো।

...........................................................................................

আরো পড়তে ক্লিক করুন :

দয়াল তোমার আসল নামটা কী || পর্ব-১

দয়াল তোমার আসল নামটা কী || পর্ব-২

 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
সিলেটে ট্রাকের ধাক্কায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
সিলেটে ট্রাকের ধাক্কায় ৩ মোটরসাইকেল আরোহী নিহত
আবারও জীবিত দুই জিম্মির ভিডিও প্রকাশ করেছে হামাস
আবারও জীবিত দুই জিম্মির ভিডিও প্রকাশ করেছে হামাস
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
টিভিতে আজকের খেলা (২৮ এপ্রিল, ২০২৪)
টিভিতে আজকের খেলা (২৮ এপ্রিল, ২০২৪)
সর্বাধিক পঠিত
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
যুদ্ধবিরতি প্রস্তাবে ইসরায়েলের প্রতিক্রিয়া পেলো হামাস
তাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
প্রাক-প্রাথমিক বন্ধই থাকছেতাপপ্রবাহে যেভাবে চলবে শ্রেণি কার্যক্রম
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
ইমিগ্রেশনেই খারাপ অভিজ্ঞতা বিদেশি পর্যটকদের
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
বিক্রি না করে মজুত, গুদামে পচে যাচ্ছে আলু
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই
আজকের আবহাওয়া: দুই বিভাগ ছাড়া কোথাও বৃষ্টির আভাস নেই