X
বৃহস্পতিবার, ০৩ জুলাই ২০২৫
১৯ আষাঢ় ১৪৩২

রিজিয়া রহমান : যে নক্ষত্রের আকাশ ভরা আলো

পাপড়ি রহমান
১৮ আগস্ট ২০১৯, ১৪:৩৫আপডেট : ১৮ আগস্ট ২০১৯, ১৪:৫২

রিজিয়া রহমান গত ১৬ আগস্ট মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি বাংলাদেশের একজন খ্যাতনামা ঔপন্যাসিক। জন্মগ্রহণ করেছেন ১৯৩৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর, কলকাতায়। ষাটের দশক থেকে তিনি গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, রম্যরচনা ও শিশুসাহিত্য লিখেছেন। তিনি বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং একুশে পদক লাভ করেছেন।

রিজিয়া রহমান : যে নক্ষত্রের আকাশ ভরা আলো

পৌষের রোদ্দুর তখন বিকেলের পথে দুই-এক কদম ফেলেছে কি ফেলেনি! সোনালি আলোর ঢেউ নিয়ে সামান্য হীম হীম বাতাস বয়ে যাচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘরের খোলা আঙিনায়। বিজয় দিবস উদযাপন করতে ‘গাঁথা সাহিত্য সংগঠন’ জড়ো হয়েছে এই মধ্য ডিসেম্বরে। অন্যদের মতো আমিও পড়বো মুক্তিযুদ্ধের গল্প। ভয়ে বুক ঢিপঢিপ করছে। এত বড় মঞ্চ! তাছাড়া বরাবরই আমার মঞ্চভীতি তীব্র। সেই সঙ্গে রয়েছে প্রচণ্ড জেনোফোবিয়া! আমার এতসবের মাঝেই তিনি এলেন। এলেন যথারীতি স্ব-চলনে! পরনে কোরা রঙের শাড়ির সংগে লাল ব্লাউজ। মুখভর্তি পান নিয়ে বসলেন মঞ্চে।

এর আগেও তাঁকে বহুবার দেখেছি। কিন্তু আজ ওনার সামনে নিজের গল্প পড়বো—ভেবেই সংকোচ লাগছে। বনস্পতির সামনে আমি এক নিছক চারাগাছ! ধূলির চাইতেও অধিক ক্ষুদ্র এক ধূলিকণা!

শুরু হলো অনুষ্ঠান। এবং আমি ভীরু পরীক্ষার্থীর মতো কম্পিত বক্ষে পড়ে গেলাম  আমার সবেধন নীলমণি—‘মধ্যরাতের ট্রেন’ গল্প থেকে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আমার তখন ওই একটিই গল্প। এখনও অব্দি খুব যে অগ্রসর হতে পেরেছি তেমন নয়। ওই এক কষ্টেমষ্টে তিনে এসে ঠেকেছে। তিনের চাইতে বেশি আমি আগাতে পারিনি। আদতে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়টিই আমার কাছে এতটাই গুরুত্ববহ ও সেনসেটিভ যে, আমি তাকে ঠিক সেভাবে যেন গল্পের ক্যানভাসে আঁকতে বরাবরই অক্ষম।

যাই হোক। আমাদের পাঠ শেষ হলে তিনি গম্ভীর ও ধীর গলায় অনেক কিছুই বলে গেলেন। বললেন আমাদের বীরাঙ্গনা ও যুদ্ধশিশুর কথা। অকপটে বলে গেলেন, এই সময়ে কে কে ভালো লিখছে তাদের নাম। এবং সঙ্গে এই অধমের নামও! আমি ভাবতে চাইলাম—আমার শোনার ভুল! কিন্তু তিনি দুই/তিনবার করে বললেন—নতুনদের মাঝে পাপড়ি খুব ভালো লিখছে!

আমি অনুভব করি, আমার দুইগাল উষ্ণ ঠেকছে। তখন সন্ধ্যা সমাসন্ন প্রায়। হীম হাওয়ার প্রকোপ তীব্র হয়ে উঠেছে। আর পশমি-শাল গায়ে জড়িয়ে আমি বিনবিনিয়ে ঘেমে চলেছি!

দুই

প্রারম্ভ আশির সময়কালে আমার ভারি পড়বার নেশা ছিল! সর্বভুক তেলেপোকার মতো খেয়ে চলেছি যেখানে যা পাচ্ছি। রাশান থেকে শুরু করে জাপানিজ, জাপানিজ থেকে চাইনিজ এবং চায়নিজ থেকে সর্বভারতীয়—সবই পড়ছি! পড়ছি নয় যেন গিলছি, জল ছাড়া ছাতুর মতো! তখন পত্রমিতালীর যুগ চলমান। আমারও জুটেছে একজন সমঝদার! তিনি সাহিত্যরসিক আবার ডাক্তার! তো সোনায় সোহাগা হতে কালবিলম্ব হলো না। শুরু হলো এক সাহিত্যযাত্রা। তিনি থাকেন নদীর ওইপারে আর আমি এই পারে! অর্থাৎ তিনি সিলেটে আর আমি ঢাকায়। তাতে কী? মাঝখানে জল বয়ে যায় নিরবধী। সেই জলে একদিন ভেসে এলো ‘বং থেকে বাংলা’। এক জীবন্ত ইতিহাস! প্রাচীন বাংলা থেকে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ আমাদের চোখের সামনে দৃশ্যমান হয়ে উঠতে লাগল। আমরা পরিচিত হতে লাগলাম নির্মেদ এক ভাষা-শৈলীর সঙ্গে। আমরা বুঝতে পারলাম এরকম লেখনীর সঙ্গে আমাদের ইতোপূর্বে পরিচয় ঘটেনি। তাঁর লেখনী ঝর্নার স্বচ্ছ জলের মতো বেগবান। কিন্তু ওই জলের সাথে ভেসে চলেছে ঝকঝকে অসংখ্য নুড়িপাথর।

তিন

তিনি ছিলেন একেবারে আধুনিক ও অসম্ভব ব্যক্তিত্বসম্পন্ন লেখক। একজন ভালো লেখক নিভৃতচারী হবেন এবং থাকবেন সমস্ত ডামাডোলের বাইরে, এটাই তো স্বাভাবিক। আমি অন্তত তাই মনে করি। তিনি কেন ছুটে মরবেন পুরস্কার নামক ফালতু রাজনীতির ঘোড়ার পেছনে? তিনি কেন ঘন ঘন নিজের ব্যক্তিত্বকে টিভি পর্দার জারিজুরির কাছে খেলো করে তুলবেন? তাঁর কীসের দরকার এত? একজন লেখকই ভালো জানেন—তিনি কী লিখছেন এবং কী নয়? তাঁর চাইতে ভালো কে আর জানে—কোন কোন কুলুঙ্গিতে তিনি জমা রাখছেন তাঁর নিজস্ব কিছু আলো। জমা রাখছেন কিছু কিছু অন্ধকার বইয়ের পাতার ভাঁজে ভাঁজে। অথবা হয়তো কিছুই রেখে যাচ্ছেন না! এসব জানা একজন লেখকের জন্য জরুরি। এসব একজন ভালো লেখককে জানতে হয়। তাই তিনিও সেসব স্পষ্ট করেই জানতেন। তাই এতকাল বাদে এ বছরই পেলেন একুশে পদক। কী-ই বা তাতে এসে গিয়েছে তাঁর? তিনি লিখে গেছেন অবিরাম। বিষয় ধরে ধরে লিখেছেন। তাঁর লেখাপত্র কোনো আবেগসর্বস্ব আবর্জনা নয়। তাঁর এক একটা উপন্যাস এক একটা ডকুমেন্টশন। সিরিয়াস সব বিষয় নিয়ে বেছে বেছে লিখেছেন। দেহজীবীদের নিয়ে লিখলেন ‘রক্তের অক্ষর’। আমাদের এই পোড়ার দেশ কী নারীর প্রতিভাকে ধারণ করার জন্য আজও প্রস্তুত হয়েছে? স্বীকৃতি দূরে থাক, আমাদের সমাজ প্রতিভাধর নারীকে আগলে রাখার মতো উদারও তো হয়ে উঠতে পারেনি। ‘রক্তের অক্ষর’ লেখার পরে রিজিয়া রহমানকে তাই ফোনে শুনতে হয়েছে নানান অপ্রিয় প্রসঙ্গ। তিনি নিজেই আমাদের বলেছেন সেসব কথা। আমার প্রশ্ন হলো, যখন একজন পুরুষ ওই বিষয় নিয়ে লেখেন, তখন তাকে কেনো শুনতে হয় না সেসব অপ্রিয় বচন? কেনো তাকে দাঁড়াতে হয় না জবাবদিহিতার কাঠগড়ায়?

যেখনে যা কিছুই ঘটুক বা ঘটেছে তিনি নিরন্তর লিখে গেছেন। ধ্যানমগ্ন সন্নাসীর মতো লিখে গেছেন। এই ধ্যান একজন প্রকৃত লেখকের জন্য জরুরি। তাই আমরা তাঁর কাছ থেকে পেয়েছি ‘উত্তর পুরুষ’, ‘সূর্য সবুজ রক্ত’, ‘ধবল জ্যোৎস্না’, ‘শিলায় শিলায় আগুন’, ‘ঘর ভাঙা ঘর’, ‘হে মানব মানবী’,‘ নদী নিরবধি’, ‘ঝড়ের মুখোমুখি’ ইত্যাদির মতো কালজয়ী উপন্যাস।

কথাশিল্পী রিজিয়া রহমানের অসামান্য গদ্যশৈলীর একটা নমুনা দিচ্ছি—‘সকালটা এখানে অকেজো নেশাখোরের মতো ঝিম ধরে পড়ে আছে। পলেস্তরা খসা ইট বের করা দেওয়ালে সরু রোদের রেখা বিনে পয়সার খরিদ্দারের মতো বেহায়াভাবে লুটোপুটি খাচ্ছে। ময়লা উপচানো ড্রেনের ধারে কয়েকটা শালপাতার ঠোঙা আর ছেঁড়া তেল-চপচপে কাগজ নিয়ে গৃহ বিবাদে রত একদল লোক। একটু দূরেই একটা ঘেয়ো কুকুর কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমোচ্ছে। আর কোনো শব্দ নেই।

কুসুম উঠেছে সকালেই। সবার আগে এ পাড়ায় সে ওঠে। তখনো বকুল, জাহান আরা, সখিনা, মর্জিনা, সবাই হাত-পা ছড়িয়ে বিশ্রীভাবে ঘুমিয়ে থাকে। গলির ভেতর মান্নানের দোকান ঝাঁপ খোলে না। শুধু রাস্তার ও-ধারে ডালপুরি আর গোলগোল্লার দোকানের ছোকরাটা সবে চুলোয় আঁচ ধরায়। [রক্তের অক্ষর]

চার

এবছর জুনের মাঝামাঝি কোনো একদিন ওনার সঙ্গে আমার কথা হয়। সাহিত্য ও সামাজিক সংগঠন ‘কালি’ থেকে সংবর্ধনা দেবার কথা জানালে তিনি সানন্দে রাজি হন। বলেন, শরীরটা বেশি ভালো যাচ্ছে না। সুস্থ থাকলে অবশ্যই আসব।

সম্মতির সঙ্গে মৃদু তিরস্কারও করলেন আমায়। বলেন—এত সংগঠন নিয়ে মেতে থাকলে তোমরা লিখবে কখন?

আমি বলি—আপা আমরা টিমের সবাই কাজ ভাগ করে নিয়েছি, তাই আমাদের কারো উপরই তেমন চাপ পড়ে না।

জুলাইয়ের প্রথম দিকে ওনার সঙ্গে আমার শেষ কথা হয়। সদ্য হাসপাতাল থেকে ফিরেছেন। বললেল, কিছুতেই অনুষ্ঠানে আসতে পারছেন না।

কালির সদস্যরা ওনার বাসায় পৌঁছে দেয় সংবর্ধনা স্মারক।

একজন অত্যন্ত আত্মমর্যাদাবোধ সম্পন্ন ও মেধাবী লেখকের প্রয়াণ ঘটলো। লোকান্তরিত হলেন তিনি। কিন্তু আমাদের জন্য রেখে গেলেন তাঁর অমর সৃষ্টির অজস্র সম্ভার।

যদিও আমার চোখে ঢের নদী ছিল একদিন/ পুনরায় আমাদের দেশে ভোর হলে,/ তবুও একটি নদী দেখা যেতো শুধু তারপর;/ কেবল একটি নারী কুয়াশা ফুরোলে/ নদীর রেখার পার লক্ষ্য করে চলে;/ সূর্যের সমস্ত গোল সোনার ভিতরে/ মানুষের শরীরের স্থিরতার মর্যাদার মতো/ তার সেই মূর্তি এসে পড়ে/ সূর্যের সম্পূর্ণ বড় বিভোর পরিধি/ যেন তার নিজের জিনিস।/ এতদিন পরে সেইসব ফিরে পেতে/ সময়ের কাছে যদি করি সুপারিশ/ তাহলে সে স্মৃতি দেবে সহিষ্ণু আলোয়/ দু-একটি হেমন্তের রাত্রির প্রথম প্রহরে;/ যদিও লক্ষ লোক পৃথিবীতে আজ আচ্ছন্ন মাছির মতো মরে—/ তবুও একটি নারী ‘ভোরের নদীর জলের ভিতরে জল চিরদিন সূর্যের আলোয় গড়াবে’/ [জীবনানন্দ দাশ]

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভোট ছাড়াই চেয়ার দখল করতে বগুড়া চেম্বারের কার্যালয়ে তালা
বগুড়া চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিভোট ছাড়াই চেয়ার দখল করতে বগুড়া চেম্বারের কার্যালয়ে তালা
ফিরে দেখা: ৩ জুলাই ২০২৪
ফিরে দেখা: ৩ জুলাই ২০২৪
টিভিতে আজকের খেলা (৩ জুলাই, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৩ জুলাই, ২০২৫)
কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় এনসিপির তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ
কার্যালয়ের সামনে ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনায় এনসিপির তাৎক্ষণিক বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
নবম পে-কমিশন গঠনের কার্যক্রম শুরুর আশ্বাস অর্থ উপদেষ্টার
সংযুক্ত কর্মচারী প‌রিষ‌দের জরু‌রি সভানবম পে-কমিশন গঠনের কার্যক্রম শুরুর আশ্বাস অর্থ উপদেষ্টার
বরখাস্ত হলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট তাবাসসুম ঊর্মি
বরখাস্ত হলেন সেই ম্যাজিস্ট্রেট তাবাসসুম ঊর্মি
পরীক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তদন্তে কমিটি
পরীক্ষার প্রশ্নে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, তদন্তে কমিটি
কার দোষে শ্রমবাজার বন্ধ হয় জানালেন আসিফ নজরুল
কার দোষে শ্রমবাজার বন্ধ হয় জানালেন আসিফ নজরুল
কেমন কেটেছিল ডিবি হেফাজতে ছয় সমন্বয়কের সাত দিন
কেমন কেটেছিল ডিবি হেফাজতে ছয় সমন্বয়কের সাত দিন