X
শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪
৬ বৈশাখ ১৪৩১

রফিক আজাদের সাক্ষাৎকার

সাক্ষাৎকার গ্রহণ : জব্বার আল নাঈম
১২ মার্চ ২০২০, ১৬:৫৩আপডেট : ১৩ মার্চ ২০২০, ১৩:২০

রফিক আজাদ বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান কবি। দেশমাতাকে রক্ষা করার জন্য একাত্তরের রণাঙ্গণে অস্ত্র হাতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন যুদ্ধের মাঠে। ‘অসম্ভবের পায়ে’, ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ ও ‘মৌলভীর মন ভালো নেই’ রফিক আজাদের অন্যতম প্রধান কাব্যগ্রন্থ। ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪১ সালে টাঙ্গাইল জেলার ঘাটাইলে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। ২০১৬ সালের ১২ মার্চ না ফেরার দেশে পাড়ি জমান। তার মৃত্যুর বেশ আগে এই সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করা হয়েছিল। রফিক আজাদের সাক্ষাৎকার

প্রথমে জানতে চাইবো, লেখালেখি জীবনের শুরুতে অনুরসরণীয় অগ্রজ লেখক কারা কারা ছিলেন? যাদের সঙ্গে আপনার ভালো সম্পর্ক ছিল।

সেসময় অনেকেই ছিল। শহীদ কাদরীর কথা বলব, শামসুর রাহমান, সৈয়দ শামসুল হক, আল মাহমুদ। আরেকজন ছিলেন সৈয়দ আলী আহসান। তিনি আরেকটু সিনিয়র ছিলেন। আবদুল মান্নান সৈয়দ, আবুল হাসান, গুণ (নির্মলেন্দু গুণ), ফরহাদ মজহার, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস এরা সবাই আমাদের সময়ের।

শহীদ কাদরী ছিল আমার ওস্তাদের মতো। সে আমাকে অনেক পরামর্শ-টরামর্শ দিত। এখনো মাঝে মধ্যে কথা হয় তার সঙ্গে। গতকাল রাতে ফোন দিয়েছিল। আগের অনেক কথা হয়েছিল। শামসুর রাহমানও আমাকে ভালোবাসতেন। আল মাহমুদের সঙ্গেও অনেক আড্ডা দিয়েছি। লোকটা সুবিধার ছিল না। রবীন্দ্রনাথের পর আল মাহমুদের কবিতা আমার বেশি পছন্দ। সেইসময় দিনরাত কবিতা চাষ করে বেড়াতাম। ভালো সঙ্গ ফেলে সাহিত্যও ভালো হয়। আল মাহমুদ একটা সময় আমাকে অনেক ভালো পরামর্শ দিতেন।

 

এখন আল মাহমুদের ও ফরহাদ মজহারের সাথে যোগাযোগ হয়?

না। নেই। একটা সময় ফরহাদ ভালো চিন্তা করেছিল। এখন আর করতে পারে না।

 

না পারার কারণ কী বলে মনে হয়, রফিক ভাই?

আমরা অনেকে অনেক পরিচয়ে পরিচিত। আমি মোছলমান। তুমি হিন্দু। আসলে হিন্দু হবে না। হবে সনাতন। আবার খ্রিস্টান বা বৌদ্ধ। সবাই এই পরিচয় দেয়। তাহলে দেশের দরকার কী? আমি মনে করি আগে বাঙালি। আগে জাতীয়তাবাদ। পরে ধর্মের পরিচয়। ফরহাদ এইদিকে এখন ফারাক হইয়া গেছে।

 

এই দেশে কী কেউ বিশুদ্ধ রাজনীতি করেন? বা হয় বলে মনে করেন?

বিশুদ্ধ রাজনীতির অভাব সারা পৃথিবীতে আছে। এখানেও একই রকম। তবে, আমাদের উচিত আরও সচেতন হওয়া।

 

দেশের বর্তমান রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?

সঠিক কথা বলতে গেলে অনেকেই রাগ করে। সত্যও বলা আমরা ভুলে গেছি। ভারতের সংস্কৃতি আমাদের চেয়ে উন্নত। কিছু কিছু ক্ষেত্রে। তারা ওপেন কথা বলতে পারে। আমরা পারি না। এইটা উন্নয়ণের প্রধান প্রতিবন্ধক। গ্রহণযোগ্য মতামত গ্রহণ করতে হবে। না করলে বিপদে পড়ব ভবিষতে।

 

রাজনীতি ও সাহিত্য দুটিই মানুষের জন্য সমানভাবে প্রয়োজনীয়?

সবকিছুই মানুষের জন্য। এই যে আমি জীবিত মানুষের জন্য। মরে গেলেও মানুষের জন্য। সবকিছুই মানুষের। সাহিত্য ও রাজনীতি আলাদা। দুইটারে এক করা ঠিক না। রাজনীতির কথা তো বললাম। সেখানে সরাসরি অংশগ্রহণ করে কাজ করা যায়। বলা যায়। সাহিত্যে বলা যায়। করাটা কঠিন। করতে গেলে নানাজনে নানা কথা বলে। লেখকের কাজ, আগামী দিনের কথা ভেবে লিখতে বসা। রাজনীতিও একই। দুইটাতে আরও তফাৎও থাকতে পারে। পক্ষেও থাকতে পারে।

এক্ষেত্রে সাহিত্যিককেই এগিয়ে রাখব। সাহিত্য শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে মানুষের কাছে থাকে। ওই জন্যই সাহিত্যিকরা ভবিষ্যতের কথা বেশি বলতে চায়।

 

অনেক বছর ধরে কবিতা লিখছেন আপনি, আপনার কী মনে হয় আপনার কোন চাওয়া-পাওয়া, খেদ বা দুঃখ আছে? অথবা থাকতে পারে?

(কিছুক্ষণ চুপ থাকার পর)। না। নেই। কীসের ক্ষোভ থাকবে? যুদ্ধ করে দেশটা স্বাধীন করেছি। এখন মরার সময়। তেমন পরিবর্তন দেখছি না। শেষ বয়সে আরেকটু পরিবর্তন দেখতে পারলে ভালো লাগত।

 

কেমন পরিবর্তন?

অনেক পরিবর্তন। সময় এখনও আছে। এই সরকার মুক্তিযুদ্ধের সরকার। স্বাধীনতার পক্ষের সরকার। তাই দায়িত্ব বেশি। বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত কাজ সমাপ্ত করার দায়িত্বও এদের। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলছে। একটা ভালো উদ্যোগ। যুদ্ধাপরাধ ঘরে-বাইরে আরও আছে। সবার বিচারই হওয়া দরকার। পক্ষপাত নয়।

 

আপনি স্যাড জেনারেশন আন্দোলনের পুরোধা ছিলেন। সেই আন্দোলনের ইশতেহারও সম্ভবত আপনারই লেখা ছিল, সেখানে লিখেছিলেন, ‘আমরা গতানুগতিকতাবিরোধী, সমাজবিচ্ছিন্ন, আত্মধ্বংসী, মৃত্যুপরায়ণ, বিষণ্ন। আমাদের একমাত্র বিশ্বস্ত বন্ধু সিগারেট, আমাদের রক্তের মধ্যে বিস্ফোরণোন্মুখ ডিনামাইট, (জীবন নিরর্থক জেনে) আমরা নিঃশেষিত, বিব্রত, ক্লান্ত এবং বিষণ্ন।’ আমার প্রশ্ন হলো, আপনি আপনার সেই আদর্শের ওপর কতদিন ছিলেন বা আছেন?

সবকিছুরই একটা কারণ থাকে। তখন রাষ্ট্রীয় শাসন ব্যবস্থা তেমন ভালো ছিল না। খুব খারাপ একটা সময় আমাদেরকে পার করতে হয়েছে।(আমাকে এক গ্লাস পানি দাও। পাশে পানির বোতল ছিল, সেখান হতে কবিকে পানি ঢেলে দিলাম। পানি পান শেষে কিছুক্ষণ চুপ রইলেন)। আমি সেই আদর্শের উপর আছি কি না? (আমি বললাম, হ্যাঁ) এখন কি আর সেরকম পরিস্থিতি আছে? নেই। পরিস্থিতি আগের চেয়ে কিছুটা উন্নত। তাই না। আসলে সে সময়ের অনেক কথা আমার মনে আসছে না।

 

রফিক ভাই, অন্য প্রসঙ্গে আসি, একটা রিউমার আছে, পত্রিকায় আপনি নাকি চুমুর বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন?

হাহাহা... তোমরা কতো খবর রাখো। তখন আমি বাংলা একাডেমিতে চাকরি করতাম। শাহাদাৎ না-জানি কী নাম! সম্ভবত শাহাদাৎ চৌধুরী হবে। সে আমার কাছে ব্যতিক্রম ধরনের বিজ্ঞাপন আইডিয়া চেয়েছে। আমি হাসতে হাসতে বললাম আমি চুমুর বিজ্ঞাপন দেই। চুমুর বিনিময়ে কবিতা উৎসর্গ। আসলে আমার উদ্দেশ্য ছিল মানুষের অনুভূতি জানার। মেয়েরা বুঝল আমি মেয়েদের ঠোঁটে চুমু দেওয়ার কথা বলেছি, কী লজ্জার ব্যাপার! মিরপুর থেকে এক মেয়ে আমাকে চিঠি লিখেছে। এভাবে আরও অনেক মেয়ে আমাকে চিঠি লিখতে শুরু করে। আমাকে বিব্রত করে নাদিরা মজুমদার নামের একটি মেয়ে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল। বাংলা একাডেমিতে আমার অফিস রুমে প্রবেশ করে। আমাকে বলে আমি চুমু খেতে রাজী। আমি কি তাকে হতাশ করতে পারি! আমি তো কবি। আমি বললাম, আপনার হাত বাড়িয়ে দিন, আপনার হাতে চুমু খাই। আমি নাদিরার হাতে চুমু খেলাম। চুমু খাওয়ার পর নাদিরা চলে যায়। এরপর নাদিরার সাথে আমার ভালো বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক হয়। পরে সে ইউরোপে চলে যায়। মাঝে মাঝে ফোন করে আমার খোঁজ খবর নেয়। ঘটনাটি ছিল এরকম।

 

আপনি অনেক বিখ্যাত বিখ্যাত প্রেমের কবিতা লিখেছেন। আপনার প্রেমের আপনার কবিতা পড়ে মেয়েরা কখনো প্রেমের প্রস্তাব দিয়েছিলো?

(মুখে ডান হাতের তর্জনী এনে, ইঙ্গিত দিয়ে বুঝালেন এসব এখন বলবে না।) এখন আমার বয়স হয়েছে। ছেলেমেয়ে আছে। নাতী-নাতনী আছে। পুত্রবউও আছে। প্রেম-টেম করেছি।

 

রফিক ভাই, নারী পুরুষের এই প্রেমকে আপনি কীভাবে দেখেন?

আসলে আমি কীভাবে দেখি সেইটা বড় কথা নয়। পৃথিবীর শুরু থেকেই নারীর প্রতি পুরুষের আবার পুরুষের প্রতি নারীর এক ধরনের মোহ ছিল। মোহটাই প্রেম। মোহ না থাকলে প্রেম আসবে কোথা থেকে? প্রেম না থাকলে পুরুষ মহিলা একসঙ্গে থাকা অসম্ভব।

 

বলছিলেন, জীবনে অনেক অনিয়ম করেছেন। কেন?

এই অনিয়ম করেই করেই শরীরটা এখন বেশি খারাপ। সুস্থ হতে পারছি না। এর কোন কারণ নেই। এমন না যে কারো উপর রাগ কইরা তা করতাম।

 

অনেকেই ভাবে আপনি বিদ্রোহী মনোভাবের কবি? এর কোনো উত্তর আছে?

 ‘ভাত দে হারামজাদা’ কবিতাটি লেখার কারণে হইতে পারে। আমি সেটাকে খারাপভাবে দেখি না। আমি প্রয়োজনের কথা বলেছি মাত্র। ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ও একই রকম। তবে, আমার অনেক প্রেমের কবিতা আছে। আমি চাই আমার প্রেমের কবিতাগুলো টিকে থাকুক। প্রেমের কবিতাগুলো বিশুদ্ধ কবিতা। প্রেমের কবিতা অনেক আবৃত্তিশিল্পীও আবৃত্তি করেছেন। অনেকে আমাকে বাজিয়ে শুনাইছে।

 

আপনার আরেকটি কাজ আছে,জাতীয় কবিতা পরিষদের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ছিলেন।

১৯৮৭ সালে কথা। তখন এরশাদ সাহেব ক্ষমতায় ছিলেন। স্মরণীয় হওয়ার জন্য এটা কোনো কাজ? এরশাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে গিয়ে জাতীয় কবিতা পরিষদের জন্ম। সেসময় এরশাদও কবিতা লেখা শুরু করেন। কবি স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য সমাজে সে বিভাজন তৈরির চেষ্টা করে। একদল কবিকে নিয়ে এরশাদ গঠন করে কবিকণ্ঠ। তাদের বিপরীতে নিরুপায় আমরা শামসুর রাহমানকে সামনে রেখে গড়ে তুলি জাতীয় কবিতা পরিষদ। সংগঠনের মধ্যেই এটাকে আটকে না রেখে ফেব্রুয়ারি মাসের ১ ও ২ তারিখে সারাদেশের কবিদের জন্য কবিতা পাঠের আয়োজন করি। সেই সংগঠনটি এখনও আছে দেখে আমার খুব ভালো লাগে। জাতীয় কবিতা পরিষদ হলো স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের প্রতীক।

 

রাজনৈতিক ব্যক্তিদের কার সঙ্গে আপনার ভালো সম্পর্ক আছে? আপনার খোঁজ-খবর কে কে নেয়?

ওরকম কেউ নাই। অনেকের সাথে জানাশোনা আছে। এখন আর তেমন দেখা সাক্ষাৎ নাই। বয়সের কারণে তেমন একটা বের হওয়া না হলে যা হয়। কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে আমার ভালো সম্পর্ক আছে সেটা আগেও বলেছি। সে খুব ভালো মানুষ। মনে একদম অহংকার নাই। তবে, তেজী পুরুষ। বীরযোদ্ধা ছিল। রনাঙ্গণে একাই এক’শ। কাদের সিদ্দিকী শেখ সাহেবকে খুব ভক্তি করত। বাপ ডাকত। শেখ হাসিনাকে বোন। আওয়ামী লীগের কিছু নেতা তাকে আওয়ামী লীগে টিকতে দেয় নি। ওর মতো নিবেদিত নেতা কে ছিল? শেখ সাহেবের মৃত্যুর পর ঘরে ফিরে নাই। আবার যুদ্ধের ডাক দিছিল। সেই নেতা তাদের দলে নাই! তার লগে আঠার হাজার সশস্ত্র সৈন্য ছিল। তারপরও সে শেখ সাহেবেরে নেতা মেনেছে। কত বড় আনুগত্য। এই সৈন্য লইয়া এগার তারিখে টাঙ্গাইল দখলমুক্ত করেছে।

 

‘অসম্ভবের পায়ে’, ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ ‘মৌলভীর মন ভালো নেই’। আপনার বইয়ের নামগুলো অন্য সব কবিদের বইয়ের নামে চেয়ে আলাদা, এই বিষয়ে আপনার বক্তব্য কী?

ব্যাখ্যা আছে। সব মানুষকেই গুরুত্ব দিতে জানতে হয়। মৌলভীদের মন আছে। আছে না? এখন অনেকেই মৌলভীরে নেগেটিভ বুঝে। মৌলভীরাও আমাদের মতো মানুষ। আমি মৌলভীদেরকে অন্যভাবে দেখি। তারা প্রেম করে। তাদের মন আছে। ছেলেমেয়ের প্রতি টান আছে। মৌলভীরা যে আল্লাহ-নবী, মসজিদ লইয়া সারাক্ষণ পইড়া থাকে, তেমন না। প্রবল প্রেমের টানে তারাও দূর থেকে কাছে আসে। আর ‘চুনিয়া আমার আর্কেডিয়া’ দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে লেখা। সম্ভবত ১৯৭৬ সালে। ওইটা টাঙ্গাইলের মধুপুরের জঙ্গল। চুনিয়াতে কয়েকজন বন্ধু মিলে গিয়েছিলাম। বাংলা একাডেমির ডিজি শামসুজ্জামান খান গিয়েছিল তখন। হাবিবুল্লাহ সিরাজীও গিয়েছিল। কথা ছিল সবাই চুনিয়া নিয়ে লিখবে। কিন্তু সেটা পরে হয়নাই।

 

সাহিত্য বিচারে কলকাতার কবিতা এবং বাংলাদেশের কবিতার মধ্যে কোনটাকে এগিয়ে রাখবেন আপনি?

পার্থক্য আমার অপছন্দ। সাহিত্যে পার্থক্য সঠিক হয় না। সবার ধরণ আলাদা আলাদা। কলকাতার কবিতা কলকাতাদের মতো। আমাদের সাহিত্য আমাদের মতো। আমাদের কবিতায় আছে পাওয়া না-পাওয়ার ইতিহাস। মুক্তির কথা। স্বাধীনতার কথা। আমাদের কবিতা আমরা লিখেছি রক্ত দিয়া। কলকাতারা তা পারে নাই। এই জায়গায় কবিতায় প্রাণ আছে, ঘ্রাণ আছে। যা অন্য কোনো ভূ-খণ্ডের কবিতায় আমি পাই নাই। আমার কাছে পার্থক্য এইটাই।

 

রফিক ভাই, গল্প বা উপন্যাস নিয়ে কাজ করার কোন ইচ্ছা আছে?

ওসব আমার তেমন ভালো লাগে না। কবিতাই আমার ভালো লাগে। একবার ভেবেছি আত্মজীবনী লিখব। পরে বাদ দিয়েছি। এখন প্রায়ই অসুস্থ থাকি। লেখার এত সময় কই? আত্মজীবনী লিখতে আরও বড় সময় লাগে। ভাবনায় কতো কী আসে। সব কি আর লেখা সম্ভব? মানুষ যা ভাবে তা করে শেষ করতে পারে না। শেষ করতে আরেকটা জীবন লাগে। ৭০-৮০ বছর খুবই সংক্ষিপ্ত সময়। প্রস্তুতি নিতে গেলেই সময় লাগে। ঘুরতে ঘুরতেই সব সময় চলে যায়। তাহলে, কাজের সময় কই? এজন্য বললাম, ৭০-৮০ বছর তেমন কোনো সময় না। মাঝে মাঝে নতুন চিন্তা যে হয় না, তা নয়। হয়, তবে, চিন্তাগুলো গুছিয়ে লিখতে পারছি না।

 

আপনার পছন্দের কবি কারা ছিলেন? পছন্দের কবিতা সম্পর্কে জানতে চাই।

আমার কোন কিছুতেই নির্দিষ্টতা নাই। অনেককে আমার পছন্দ আবার অনেককে আমার অপছন্দও। আসল কথা হল বোধ, চিন্তা আর কবির দৃষ্টিভঙ্গিই মূলত প্রধান, তবে, অনেক কবি আছে যাদের চিন্তায় একটা পরিবর্তন আছে। সুন্দর একটা শৈলীভাব আছে। যা সাহিত্যের জন্য অনেক দরকার বলে ভাবি। সময়টা নতুনের বলে নতুনদের কবিতাও আমার কাছে নতুন লাগে। একটু ব্যতিক্রম। ব্যতিক্রম কিন্তু সুন্দর। অন্যরকমই বলা যায়। তবে, কবিতা কখনই এক জায়গায় আটকে যায় না। সামনের দিকে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তাই কবিতাকে কবির হাতে ছেড়ে দেওয়া উচিত। এসব ভালো। তবে, সাহিত্য ধীরপায়ে অগ্রসর হয়। আস্তে আস্তে সামনের দিকে যায়। সাহিত্য লাফঝাঁপে এগোবে না। আমরা অনেক সময় ভাবি কেউ একজন এসে সাহিত্যকে পুরো পাল্টাইয়া দিছে। আসলে ব্যপার তা না, ব্যপারটি হল, যে এসে পরিবর্তন করে দিলো সেও কিন্ত দীর্ঘ দিনে তৈরি হয়ে এসেছে। বুঝে এসেছে। একজন ক্রিকেট বোলার দলে এসে যখন ৫ উইকেট নেয় কিংবা একজন ব্যাটসম্যান এসেই সেঞ্চুরি হাকায়, এমন না যে সে জীবনের প্রথম এই ম্যাচ খেলতে নামছে। আজকের এই পজিশনের জন্য তাকে অনেক পথ অতিক্রম করতে হইছে। তাই না? তবেই সফলতা।

এই যে সফলতার শুরু মানেই একটা পরিবর্তন। এখানে চিন্তার পরিবর্তন আসবে। ভাব, ভাষা ও কল্পনার পরিবর্তন আসবে। প্রকৃতিকে সাধারণ দশজন যে স্বাভাবিকভাবে দেখে সে হয়ত আরও ভিন্ন দৃষ্টিতে অস্বাভাবিকভাবে দেখতে থাকবে। তবে, ভালো এবং বড় কবিরা ন্যাচারাল। তাই না? আমি আগেও বলেছি, এখনও বলি, কবিতা তো আর উড়ে আসে না, কবিতা প্রত্যাহিক মানুষের জীবনেরই অংশই। জীবনের গভীর থেকে উঠে আসে। আবার শিল্প-সাহিত্যও জীবনের অংশ। কোনটাকে বাদ দেয়া যায় না। লেখালেখি যাঁরা করেন তারা তাদের জীবনই লেখেন। আমিও আমার জীবনদর্শন লিখি। আজকের যে তরুণ লেখা শুরু করেছে তার বেলাও একই কথা প্রযোজ্য হবে। তাদের অভিজ্ঞতা ও চিন্তা চেতনার স্তর ক্রমান্বয়ে ভারী হতে থাকবে। আর কবিতা হতে থাকবে আরও সুন্দর ও দাপুটে। দাপুটে বলার কারণ হল, তখন সেটাতে বর্তমান, অতীত ও ভবিষ্যৎ মুহূর্তের মধ্যে চলে আসবে। তবে, বর্তমান সময়টাই বিশেষ করে প্রধান।

 

কবিতা সবসময়ই সময়কে ধারণ করেই চলে। কিন্তু, শব্দ, ছন্দ, উপমা, চিত্রকল্প নিয়ে আপনার ভাবনার কথা জানতে চাই

এগুলোর বাইরে তো কবিতা না। এসব নিয়েই কবিতা। ছন্দ ছাড়া কবিতা হয় না। এক’শর বেশি ছন্দ আছে। কবিতা কোনো না কোনো ছন্দে পড়ে থাকবে। শুধু স্বরবৃত্ত, মাত্রাবৃত্ত বা অক্ষরবৃত্ত নিয়ে আটকে থাকতে চাইব কেন? এ সময়ে যারা কবিতাচর্চা করে তাদের সামনে নির্দিষ্ট করে কিছু বেঁধে দেয়া ঠিক হবে না। তারা সব নিয়ম বোঝার পর সেখানে আটকে থাকবে না ভেঙে বের হবে তা তারাই ঠিক করবে। পাঠকে শ্রুতিমধুর করে ছন্দ, শব্দ বাক্য ও ভাষার বিন্যাস করে। আবার উপমা, চিত্রকল্প হল একজন কবির টেকনিক বা কৌশল। কবিতা এসবের কোন কিছুকে বাদ না দিয়ে বরং যোগ করে। সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করে। 

 

রফিক ভাই, লেখালেখিটা এখন নিয়মিত করেন? সর্বশেষ কবে লেখার টেবিলে বসেছেন কিছু মনে আছে?

ইদানিং স্মৃতিশক্তি লোপ পেয়েছে। অনেককিছু মনে করতে পারি না। বয়স হয়েছে। বয়সের ভারে কিছুটা ক্লান্ত। ছেলেমেয়ে নাতি-নাতনীদের নামও মনে থাকে না। অনেকদিনের পরিচিত খুব কাছের বন্ধুদের নামও ঠিকভাবে মনে থাকে না। এই মনে না থাকার কারণে কিছু লেখতে ইচ্ছে করে না। আমার সম্পর্কে আমি কী বলব আর তোমাকে? বুঝতে পারছি না। আমার মনে থাকে না। এই না থাকাটাও একটা রোগ। হতে পারে বয়সের কারণে। হতে পারে শারীরিক অসুস্থতার কারণে। আমাকে নিয়ে অনেকেই লিখেছে : তারাপদ রায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, ভারতের অশোক, আরও লিখেছে শামীম রেজা। লেখাগুলো কলকাতার দেশ পত্রিকায় এবং বাংলাদেশের কালি ও কলম পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। আরও অন্য কোথাও প্রকাশ হয়ে থাকতে পারে। যা আমার মনে নেই।

সুনীল আমাকে নিয়ে অনেক বড় একটা লেখা লিখেছিল। সে আমার খুব কাছের বন্ধু ছিল। অনেক জানাশোনা থাকার কারণে লিখেছিল। ওগুলো খুঁজলে আরও অনেক কিছু পাবে হয়ত। নতুন করে অনেককিছু চিন্তা করি সত্য, কিন্তু সেই চিন্তাগুলো কেন জানি কলমের মাথায় করে খাতায় সাজাতে পারছি না। আসলে মনে রাখতে খুব কষ্ট হয়।

 

লেখালেখির শুরুতে সমবয়সী সাহিত্যিকদের কার সঙ্গে বেশি সখ্যতা হয়েছিল সেসময়?

সখ্যতা অনেকের সাথেই হয়েছিল। ঢাকা কলতাকাতা মিলিয়ে অনেকের সঙ্গেই আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। আসল কথা কী, কারো সাথেই তো আমার খারাপ সম্পর্ক ছিল না! সবার সাথেই ভালো সম্পর্ক ছিল। শৈশবের অনেক বন্ধু ছিল যাদের কথা মনে হলে খারাপ লাগে। দুঃখের বিষয় এদের বেশিরভাগ নাম স্মরণ করতে পারছি না।

কলকাতার সুনীলের সাথে আমার ভালো সম্পর্ক ছিল। আমরা একসঙ্গে পৃথিবীর অনেক দেশে গিয়েছি। একবার জাপানেও গিয়েছিলাম। সেই সফরে হায়াৎ মামুদ ছিল। আরেক জন ছিল...(বারবার স্মরণ করার চেষ্টা করছিলেন) ও মনে হয়েছে আশীষ। আশীষ সান্যাল গিয়েছিল আমাদের সাথে। আমরা এই চারজন বাদে আর কেউ মনে হয় যায় না। সেই সফরে খুব মজা হয়েছিল। একসাথে অনেক আড্ডা দিয়েছি। সাহিত্য নিয়ে অনেক জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করেছি। আবার, হাসি ঠাট্টাও করেছি। জাপান বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ সোসাইটির দাওয়াতে গিয়েছিলাম। কিছু ঘটনা মনে থাকে। (হাসি) যেমন এটা। চলবে

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শিশু হাসপাতালে তিন দিনের ব্যবধানে দুবার আগুন!
শিশু হাসপাতালে তিন দিনের ব্যবধানে দুবার আগুন!
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যাংককে চীনের দাবাড়ুকে হারালেন মনন
ব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
এনার্জি মাস্টার প্ল্যান সংশোধনের দাবিব্যয়বহুল প্রযুক্তি আর ক্ষতিকর জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার বন্ধের এখনই সময়
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিহতের সংখ্যা ৩৪ হাজার ছাড়িয়েছে
সর্বাধিক পঠিত
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
আমানত এখন ব্যাংকমুখী
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
বাড়ছে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানি, নতুন যোগ হচ্ছে স্বাধীনতা দিবসের ভাতা
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
উপজেলা চেয়ারম্যান প্রার্থীকে অপহরণের ঘটনায় ক্ষমা চাইলেন প্রতিমন্ত্রী
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরানে হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল!
ইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান
ইস্পাহানে হামলাইরান ও ইসরায়েলের বক্তব্য অযৌক্তিক: এরদোয়ান