X
শনিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

গন্তব্য

সারোয়ার রাফি
১৮ এপ্রিল ২০২০, ১৮:০১আপডেট : ১৮ এপ্রিল ২০২০, ১৮:০১

করোনায় আমরা ভীত নই। বরং মোকাবেলা করছি গৃহে অন্তরীণ থেকে। এতে হয়ত কিছুটা বাড়তেও পারে মানসিক চাপ। তাই আসুন, খুলে দেই মনঘরের জানালা। নিজেকে চালিত করি সৃজনশীলতায়। আপনি নিয়মিত লিখছেন, বা এটাই হতে পারে আপনার প্রথম গল্প। লিখুন ফেসবুকে। চটজলদি ৫০০ শব্দের গল্প, বাংলা ট্রিবিউনের জন্য। একইসঙ্গে নমিনেট করুন আপনার পছন্দের আরও ১০ জন লেখককে। সেরা ১০ জন লেখক পাচ্ছেন কাগজ প্রকাশনের বই। আর অবশ্যই হ্যাশট্যাগ দিন #বাংলাট্রিবিউনসাহিত্য গন্তব্য রোজই তো এই রাস্তা দিয়ে যাই, আসি তবুও আজ কেন এই ঝড়ের সন্ধ্যায় এমন হতে হলো তা আমার এই ক্ষুদ্র জ্ঞানে আসছে না। হতে পারে তা নিয়তি কিন্তু তাই বলে আজ? এতদিন পর? যখন আমি এই রাস্তার একজন চিরাচরিত মুখ। পাশে কারখানার শব্দ, সামনে ইপিজেড ফেরত মানুষদের কোলাহল, অটোরিকশার সম্মিলন, মানুষকে নিজদের গাড়িতে ওঠাতে নানান হাঁকডাকাধূলির আস্তরণে ঝাপটে থাকা এই এলাকার কাছে তো আমি ব্যাকডেটেড। পুরনো। তবে আমার সঙ্গেই বা এমন কেন হলো আচমকা? হতে পারে যারা এমনটা করেছে তারা নতুন নয়তো আমিই তাদের কাছে অচেনা মুখ। বুঝতে পারেনি, লোভে মেরে দিয়েছে।

মাতাল, অসহায়, বিপন্ন আর বিষণ্ণ ব্যতীত তো আর কেউ দোদুল্যমান নৌকার মতন নিজের কাছে দুলতে পারে না তবুও আমার আজ কী হলো বুঝতে পারিনি। ক্লাস শেষে নির্দিষ্ট গন্তব্যের বাসে খাতা রেখে সেখান থেকে নেমে পড়েছি।  বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা শেষে আবার বাসে গিয়ে বসেছি, গান শুনেছি, বই পড়েছি তারপর ফের বাস থেকে নেমে পড়েছি। এরকম কয়েকবার চলল, মনে হচ্ছিল নিজের মধ্যে চরম এক অস্থিরতা। চৈ চৈ করা বারবার। অহেতুক দোলা সেই দোদুল্যমান নৌকার মতন অথচ আমিতো মাতাল, অসহায়, বিপন্ন, বিষণ্ণ নই। 

বাসে বসে আমি মোবাইলের স্ক্রিনে থাকা বাবার ছবি দেখছি। তিনি তাকিয়ে আছেন আমার দিকে। শাদাকালো চোখগুলো আমার রঙিন চোখের দিকে তাকিয়ে। অবশ্য বাবার ছবিটি ছিল তরুণ বয়সের। তখন পড়ালেখা করছেন, পাশাপাশি রোগী দেখছেন, প্র্যাকটিস করছেন। ইচ্ছে করেই বাবার ৬৯ বছর বয়সের ছবি রাখিনি কারণ, চাইতাম আমি বুড়ো হয়ে গেলেও বাবা চিরতরুণ থাকুক। আর এইভাবে মোবাইলের হোম স্ক্রিনে ছবি থাকার ফলে ভরসা পাই। মনে হয়, বাবা সবসময় দেখছেন আমাকে। মনে হয়, ৬৯ বছর বয়সি বাবা আমার অনেক দূরে, দূরে আরও অনেক দূরে। আমার স্মৃতিতে সেই ত্রিশ বছর বয়সি বাবাই থাকুক। বাবা আমার সঙ্গে আছেন, বড়ই শান্তি লাগে। মোবাইলের স্ক্রিনটার দিকে তাকিয়ে এসব এলোমেলো কথাই ভাবছিলাম। যার কোনো অর্থ নেই, গন্তব্য নেই। বাস থেকে নেমে আমি টিউশনের জন্য চলেছি।

বিদ্যুৎ চলে গেছে তখন। আমিও টিউশন শেষে হেঁটে আসছি। গাড়িতে চড়তে ভালো লাগছিল না কারণ তখন বেশ হাওয়া বইছিল। সারাদিন কাঠফাটা রোদের বিপরীতে যখন বিদ্যুৎ চমকানো আকাশ চোখটিপ মেরে ঝড়ের পূর্বাভাস হিসেবে হাওয়া বইয়ে দেয়, তখন মনে হয় শরীরের সব ঘাম এই মুহূর্তটার জন্যই প্রতীক্ষা করে আছে। উবে যায় সব ক্লান্তি, জরা। তেমনি আমারও উবে গিয়েছিল সব। শুধু রাস্তার ধূলির ঝাপটা চোখেমুখে এসে লাগছিল। চুলে আটকে যাচ্ছিল কণাগুলো। সে কী অদ্ভুত দেখতে। রাস্তায় উন্নয়নের কাজ চলছে। এইতো, কতটুকুই বা পথ? দুকাইক ফেললেই জনপদ, বাড়ি, সারাদিনের ক্লান্তি ঠেলে বিছানায় গড়াগড়ি। তারপর এক ঘুম। ঘুমের ভেতরে ডুবসাঁতার। নাহ্, এসব কী ভাবছি। আগেতো এই পথটুকু পেরিয়ে নিই।

‘ঐ, এগুল আয়।’

‘কী?’

‘এগুল আইতি কইছি।’

‘আচ্ছা, বলুন কী?’

‘যা আছে দে। দে, শালা, দে। যা আছে বাইর কর।’

‘আরে ভাই করছেন কী? কী ভাই?’

বুঝতে পারছি, এই লোডশেডিংয়ে আমাকে চার-পাঁচজন জাপটে ধরে আছে। কেউ শার্টের কলারে, কেউ গলায়, কেউ হাতে, কেউ জড়িয়ে। ছুটে পালাব কীভাবে? টের পাচ্ছি আমার শরীরে আষ্টেপৃষ্টে বাঁধানো ছুরি। ধারাল। নড়লেই কেটে যাবে। মনে হয়েছে, আমি শেষ। বিগত কয়েক দিনে শহরে ছিনতাইয়ের ঘটনায় কয়েকজনই বেঁচে ফিরতে পেরেছে। হায়, আমিই বা বাঁচি কী করে?

‘দে শালা, দে—মোবাইলডা দে। অই ল রে, ল রে, ল, দে।’

‘আরে ভাই একটাই, একটা—আরে ভাই, করেন কী?’

আমি দেখছি, স্ক্রিনে বাবার ছবি। তরুণ বয়সের। আমার বাবা দূরে, দূরে সরে যাচ্ছে। আমি বাঁচাতে পারছি না। নাহ্।

‘আরে ভাই, ছাড়েন।’ আরও জোরে জাপটে। তখনও পারিনি, এখনও না। তরুণ বয়সের ফটোটাকে নিয়ে যাচ্ছে। মোবাইলটার হোম স্ক্রিন। ছিনতাইকারীরা আজরাইল হয়ে এসেছে।

‘ল রে, ল রে, গিয়া অটোত উঠ, ল। তাত্তাড়ি।’

আমার জ্ঞান লোপ পাচ্ছে। যেন কোনো অশরীরী বলছে, পায়ের দিকে তাকা। ছুরি মেরেছে। তাকা। রক্ত।  জলের মতো। হাত দিয়ে চাপা দে। তাকা জলদি।

ওরা সবাই চলে গেল। আমার চোখ বেয়ে জল পড়ছে। সঙ্গে ডান পায়ে হাত দিয়ে দেখি আসলেই গড়গড় করে রক্ত বেরুচ্ছে। গড়গড়। গড়গড়। আমি হাত দিয়ে আটকানোর চেষ্টা করছি তবুও জল-রক্ত-বাঁধ মানবে কেন?

আমি মানুষের দিকে তাকাচ্ছি এই লোডশেডিংয়ের রাস্তায়।

একাকী।

ভয়।

অসহায়ত্ব।

জল।

রক্ত।

এখনও অশরীরী জাপটে ধরে আছে আমাকে...

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
মন্দিরে সেলফি তুলতে গিয়ে প্রদীপে দগ্ধ নারীর মৃত্যু
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
প্রতিবন্ধী শিল্পীদের আয়োজনে মঞ্চস্থ হলো ‘সার্কাস সার্কাস’ নাটক
‘শো মাস্ট গো অন’
চিকিৎসা সুরক্ষা আইন জরুরি‘শো মাস্ট গো অন’
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
ছাদে আম পাড়তে গিয়ে নিচে পড়ে শিশুর মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
মৌসুমের সব রেকর্ড ভেঙে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা চুয়াডাঙ্গায়
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!
হোটেল রুম থেকে এই ৫ জিনিস নিয়ে আসতে পারেন ব্যাগে ভরে!