X
শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪
১৫ চৈত্র ১৪৩০

রূপান্তর

মোঃ সাইফ
০৫ মার্চ ২০১৬, ১৪:১৪আপডেট : ০৫ মার্চ ২০১৬, ১৪:১৫

 

সেরা দশ গল্প

 

শহরের সকলের এখনও সকাল হয়নি। রাস্তায় যানজট নেই। ভোরের হালকা কুয়াশা কেটে যে আলোর দেখা পাওয়া যায় এই আলোতে একটা অদ্ভুত রকমের স্নিগ্ধতা থাকে। সাধারণত রাতে ঘুম না হলে সকালের দিকে শরীরটা ভারি হয়ে যায়, ঘুম আসলে সেটা অনেক প্রকট হয়। স্নিগ্ধ সকাল ঘুমের উপর কাটিয়ে দেওয়া চলে না। তাই বের হলাম বাসা থেকে। নীলক্ষেতের হাইস্কুল,থানার রাস্তা ধরে একা একা হাঁটি। কিছু কিছু দোকান খুলতে শুরু করেছে সবে। পাশের এক চা দোকান থেকে একটা বেনসন আর চা নিলাম। এসব খেয়ে হাঁটা যাবে কিনা ভাবছি। সকাল বেলা খালিপেটে তামাক, চা একসাথে খেলে নিম্নচাপ অনুভূত হয় পেটজুড়ে। যাহোক,আবারও হাঁটা শুরু করলাম।

কাটাবনের পাখির দোকানগুলো খোলা থাকলে ভালো হতো। এত সকালে অবশ্য খোলার কথা না। পাখি এবং গাছের সাথে কথা বলার মধ্যেই সবচেয়ে বেশি শান্তি। এরা মন দিয়ে কথা শুনে। আমি হাঁটতে হাঁটতে শাহবাগ চলে আসি। চাররাস্তার এ মোড়ে সবসময় প্রাণ থাকে। ফুলের দোকান, হাসপাতাল এসব এ মোড়ে থাকায় মানুষের অভাব নেই এখানে। হাতে তেমন কাজ নেই বলে সিদ্ধান্ত নিলাম ফুটওভারব্রিজের উপর কিছুক্ষণ দাঁড়াবো।

ওভারব্রিজের উপর দু’তিনজন মানুষ কাঁথা গায়ে জড়িয়ে শুয়ে আছে। এদের স্থায়ী ঠিকানা কি এরা হয়ত জানে না। অস্থায়ী ঠিকানা এই ওভারব্রিজের উপর শুয়ে বসেই এরা এদের ক্ষণস্থায়ী জীবন পার করে দিচ্ছে। আমি শাহবাগের ফুট-ওভারব্রিজের ওপর থেকে মানুষের ব্যস্ততা, সিএনজি, বাস, রিক্সা পাওয়ার তাড়াহুড়োগুলো দেখতে থাকি।

ফুটওভারব্রিজের ওপর দিয়ে অনেকেই যাচ্ছে,আসছে। আমার দিকে কৌতূহলী দৃষ্টি দিয়ে বুঝার চেষ্টা করলো ব্যাপার-টা কি ! এ ছেলে একা একা কেনও দাঁড়ায় আছে! আমি আমার মতোই উদাস হয়ে গাড়ি গুণি...২২৮....২৬৯...মানুষের কৌতূহলের কারণ হতে বোধহয় সবারই ভালো লাগে !!

এর মধ্যে একজন শ্যুট-বুটেড নিপাট ভদ্রগোছের মধ্যবয়সী মানুষ এসে আমার থেকে কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে তামাক ধরালেন। গাড়ি গোণার ফাঁকে ফাঁকে তাকে লক্ষ করছি। তামাক পান শেষ হবার কিছুক্ষণ পর উনি উনার শুট-বুট খুলে ফেলতে লাগলেন। সেসব ব্যাগে রেখে ব্যাগের ভেতর থেকে ময়লা রংচটে পুরনো শার্ট বের করে পরলেন। আমার মধ্যে অবাক হওয়ার ব্যাপার কম। সব কিছুতেই মোটামুটি অভ্যস্ত বলা যেতে পারে। তবে ভদ্রস্থ গোছের মানুষটির তাৎক্ষনিক এই বাহ্যিক পরিবর্তন এর দৃশ্য আমাকে অবাক করালো !

এতক্ষণ যে আমি উনাকে পর্যবেক্ষণ করছি এটা উনার চোখ এড়িয়ে গেলো না। আমাকে দেখে উনি বুঝলেন আমি উনার সম্পর্কে কিছু একটা ভাবছি। সপ্রশ্ন দৃষ্টির উত্তর দেবার জন্যে নিজেই ব্যাখ্যা শুরু করলেন তার ঘটনা...

ঢাকা শহরে আমরা বিভিন্ন ফুটপাতে হরেকরকম জিনিস নিয়ে বসে থাকতে দেখি বিভিন্ন মানুষকে। উনি তাদের মতোই একজন ভাসমান ফেরিওয়ালা। ফেরি করে বিভিন্ন সিজনে বিভিন্ন জিনিস বিক্রি করেন। এখন সিজন হচ্ছে গিফট আইটেমের। লাভ খুব কম হয়। যে পরিমাণ আয় হয় তা দিয়ে ব্যয়বহুল এই নগরীতে চলাটা খুব কস্টের। সেটা তিনি পরিবারকে বুঝতে দেন না। ধার কর্জ করে হলেও তিনি তার পরিবারকে সম্মানের সাথে বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করে যাচ্ছেন।

এক সময় তিনি ভালো একটি কোম্পানিতে চাকরি করতেন এবং শেয়ার বিজনেস ও করতেন টুকটাক। শেয়ার বাজার ধ্বসের বছরে অন্যান্য ছোটখাটো বিনিয়োগকারীদের মতো তিনিও তার পুঁজি হারিয়েছেন। চাকরিটা ছিলো বলে অবস্থা সামাল দিতে পেরেছিলেন। তবে সামলিয়ে রাখতে পারেননি চাকরিটাই। কোম্পানিটাতে তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের অভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে চাকরিচ্যুত হয়েছেন বহুদিন হয়েছে।

তার যে এখন চাকরি নেই একথা তার পরিবারকে জানাতে পারেননি। দুই ছেলে,এক মেয়ে এবং তার স্ত্রীর জীবন সম্পূর্ণরুপেই তার উপর নির্ভরশীল। তাদের সম্মান, তাদের কাছে তার নিজের সম্মান সব কিছুই তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ। ফেরিওয়ালার ছেলে পরিচয় দিলে স্কুলে তার ছেলের সাথে কেউ মিশবে না,ফেরিওয়ালার বউ পরিচয় দিলে আশে পাশের দশ পরিবারের সামনে তার বউ কথা বলার মতো পাত্তাটুকুও পাবে না।

সবচেয়ে বড় কথা,তার স্ত্রী কিভাবে বলবে তার স্বামী রাস্তার কিনারায় বসে হাবিজাবি বেঁচে খায়, তার ছেলেরা কি মেনে নেবে তাদের বাবা ফেরি করে জীবন চালায়। তার নিজেরও তো একটা সম্মান আছে। একারণে চাকরির দিনগুলোর অভ্যাস স্যুট,বুট ছেড়ে দেননি। ওসব তার দুর্বলতা আড়াল করে।

খরচের টাকা সব মাসে ওঠে না। জীবনের নিয়মে জীবন চলে,ঠেকে,আটকায় কিন্তু থেমে থাকে না...আগের মতো সব আবদার পূরন করতে পারেন না। তবে এই অপারগতার কথা মুখ ফুটে মুখের ওপর বলেও তো দিতে পারেন না। তাই ব্যস্ততা এটা সেটার ভান করে অভিনয় করে যান অক্ষমতা ঢাকার। এটাই কি সত্যিকারের ভালবাসা নয় !! যে ভালবাসা দুঃখ আড়াল করে রাখতে পারে। আপন মানুষগুলোকে ছোট না করাই তো বড় ভালবাসা। আবদারগুলো পূরণের জন্যে কতটা কষ্ট তিনি করে যান সেটা আড়াল করে সুখী থাকার যে ভান করা, সেটা কয়জন পারে !

তিনি কোনও কোনও রাতে ভীষণ স্বপ্নবিলাসী হন। রাতে ঘুমুবার আগে অনেকগুলো গল্প করেন, ভবিষ্যতের গল্প। একদিন গাড়ি হবে,ছোট একটা বাড়ি করবেন, ছেলেটার জন্য লাল টুকটুকে বউ আনবেন...

দিনের আলো ফুটার আগেই মানুষ নিজেকে বদলে ফেলে। গত রাতের কথা ভোর হবার আগেই ফুরিয়ে যায়। যে মানুষটা গত রাতে স্বপ্নের কথা শুনিয়েছিলো এ মাস গেলে আর দুঃখ থাকবে না সেও সকাল হলে বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে একটা টোস্ট আর কড়া লিকারের এক কাপ চা দিয়ে দিন শুরু করে দেয়। আমার ভাসমান ফেরিওয়ালা ও জানেন,স্বপ্নের কথা রাতে শুনাতে হয়, দিনের আলোতে ওসব গল্প জমে না। দিনের আলো বাস্তবতার কাঠগড়ায় আমাদের দাঁড় করায়.....হন হন আব্দুর রহমান ব্যাগ কাঁধে নিয়ে চলে গেলেন, পেছনে ফিরে তাকাননি। পেছনে ফিরে তাকানোর সময় এখন না,তাকে অনেকদূর যেতে হবে। 

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
যুক্তরাষ্ট্রের টি-টোয়েন্টি দলে নিউজিল্যান্ডের সাবেক অলরাউন্ডার
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
‘আ.লীগকে বর্জন করলেই অন্য পণ্য বর্জনের প্রয়োজন হয় না’
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
বিজিএপিএমইএ’র নির্বাচনের প্যানেল ঘোষণা, শাহরিয়ার নতুন প্যানেল নেতা
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
রাশিয়ার হামলায় ইউক্রেনের বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ক্ষতিগ্রস্ত
সর্বাধিক পঠিত
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
প্রথম গানে ‘প্রিয়তমা’র পুনরাবৃত্তি, কেবল... (ভিডিও)
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
নেচে-গেয়ে বিএসএমএমইউর নতুন উপাচার্যকে বরণে সমালোচনার ঝড়
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!
শাকিব খান: নির্মাতা-প্রযোজকদের ফাঁকা বুলি, ভক্তরাই রাখলো মান!