X
শুক্রবার, ০৪ জুলাই ২০২৫
২০ আষাঢ় ১৪৩২

প্রিয় দশ

কুমার চক্রবর্তী
১৮ জুন ২০২৩, ১৪:১৬আপডেট : ১৮ জুন ২০২৩, ১৪:১৮

প্রতিটি সঙ্গমের শেষে

প্রতিটি সঙ্গমের শেষে ক্লান্তি জেঁকে বসে
মনে হয় অর্থহীন, মুহূর্তনির্ভর, শুধু জৈববাস্তবতা
আরম্ভের দশচক্র, দাহিকা সে নিজে নিজে
নর তার দাহিত সাধক।
তবু সে নতুন, কামকলা শিল্প বুঝি, তাই তার
দিগ্বিজয়ে ব্যস্ত পুরুষেরা, খেতে পারে অল্প
চায় পুরুটাই, নারী তো নিমিত্ত মাত্র,
যে আগুন জ্বেলে দেয় পুরুষসুন্দর, তার তাপে সে-ই তো পালায়
অবশেষে, জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধ নারী―কায়ক্লেশে, অবেলায়


প্রত্যাবর্তন

চলে যাওয়ার সময় হলো বুঝি
এখন তো আর কিছুই যে নেই বাকি,
স্তব্ধভাবে তোমাকে তাই খুঁজি
মুদ্রিত মন তোমার ছবিই আঁকি,

ফিরিয়ে দিলে তো ডাকলে না আজও তুমি
রণভূমে তাই একাগ্র মনোভার
শুধু আসা-যাওয়া সময়ের খাপ খুলে
স্তব্ধতাটুকু আজ শুধু যে আমার

তুমি চলে গেছো রেখে গেছো প্রতিঘাত
দূর্বাতৃণেতে জমেছে বৃত্তখণ্ড
তোমার কাছে তো জীবন দুর্নিবার
আমার কাছে তা প্রতিপদ, আর দণ্ড!


কবি

ব্যর্থ করো নিজেকে তুমিও
প্রার্থনা ও প্রেমের সন্ধিতে,
করো ব্যর্থ যাপনে-যন্ত্রণায়,
প্রত্যাহার করো তুমি আবারও নিজেকে
বীর্যপাত এবং বেদনায়।
তোমার শিশ্নেতে মুখ ঘষে
আফ্রোদিতে দ্রুত ছুটে যায়
ছায়াচ্ছন্ন ঘোরে ও তামসে
কামের সিন্ধুতে মানুষ তো অসহায়
তুমি তাকে তৃপ্ত করো সুখে।
অর্থকড়ি কুড়িয়েছে যারা
তারা আজ কুবেরের দাস
তুমি তো চাওনি হতে তা-ই
তবে কেন মিছে এ বাহাস
কেন তবে খুঁজে ফেরো এসব দাওয়াই?
তার চেয়ে মন দিয়ে শোনো
তুমি নও বদ্ধ হাহাকার
তোমার নিকটে আছে যারা
তাদের সঞ্চিত অন্ধকার
তোমার সৃষ্টির কাছে দগ্ধ আজ তাদের দম্ভরা।


সমুদ্র এক ফাঁদ

যুদ্ধ শেষ হলে তুমি ফিরে গেলে তোমার জাহাজে
সঙ্গে নিয়ে গেলে তোমার উদ্ভাবিত ট্রয়ের ঘোড়াগুলো
অতঃপর ফেলে দিলে―সমুদ্রের গভীর অতলে,
হায় ওদুসসেউস, তুমি কি জানতে, ছোটো ফাঁদগুলোকে
বিসর্জন দিলে বড়ো এক ফাঁদে আর তাতেই
শুরু হলো তোমার ধাঁধা, তোমার অন্তহীন বিমূঢ়তা।

জীবন এক ফাঁদ যার অন্ধ্রেরন্ধ্রে খেলা করে গোপন সমুদ্র
তুমি তার আত্মকেন্দ্রে খুঁজে ফিরলে কাঠের ঘোড়াগুলো,
জানলে না, একবার যা হারায় ফিরে আসে না তা আর, এমনকি
জোড়াতাড়া স্বপ্নেও, অতএব প্রত্যাহার করলে নিজেকে, আর
মনোভার নিয়ে ত্রিকালদর্শীর মতো ছুটে বেড়ালে ফাঁদ থেকে ফাঁদে।

এখন বুঝেছো, জীবন এমন এক ফাঁদ যা সমুদ্রেরই মতো তোমাকে
একা করে ফেরে, আর তুমি একা হতে হতে অবশেষে হলেই নির্জন
যা তোমাকে এখন আবার অন্য এক সমুদ্র করে তোলে।


ঝরে যাব বলে

তোমার কাছেই আছি চুপচুাপ
বলিনি তো কিছু এতকাল, বলেছি কি?
গোপনে গোপন ঝড় আসে, ঝড় চলে যায়
কে যেন একাকী এসে বলে যায়:
থেকে যাও, থেকে যাও, থেকে যাও আরও কিছু কাল,
আমি বলি, নশ্বরতা এখন তো রয়েছি
ঝরে যাব বলে―আসছে কাল


অন্ধগাছ

তোমার কাছেই আছি।
এই তো নৈঃশব্দ্য আর হলুদ পাতার গান
মাঠ ভরে আছে বাতাসের সাদা কপিকলে,
এভাবেই অবাস্তব ছলে
আমার কাছে তুমি এসেছিলে
তুমিকেন্দ্রিক ছায়া আজ পড়ে আছে আমার নিকটে।

তোমার কাছেই, এই তো আমি
এই তো এক অন্ধগাছ পাতা ঝরালো নীরবতায়, মৃদু শব্দ করে।

আমি একটি সবুজ সাইকেলে চড়ে
এইবার গাছটার চারপাশ ঘুরে আসি
আর বলি:
এবারের শীতে আমরা দুজন
পাতাহীন দুটি অন্ধগাছ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকব আজীবন!


খনন

সঞ্চয় থাকে না কিছু
জমে আর গলে, আর
ঝরে পড়ে যায়।

বিকাল হলেই আমি দীর্ঘ হতে থাকি,
ভাবি―নির্জন হব
তোমার গোপন ছোঁব;
ভাবি―কবিতা লিখতে গিয়ে
কতকাল একা হয়ে রব!

প্রবণতা জেগে ওঠে জীবনের
সংঘবদ্ধতায়। নিস্তব্ধ প্রদেশে এসে
স্থির হয়ে রই, ভাবি, অস্তচাঁদ
কী ভূমিকা রেখে গেছে একা
অরণ্যের ঠিকানায়?

আমার ভেতরে কে-এক নৈঃশব্দ্য এসে
অবশেষে খনন চালায়?


বৃষ্টি ২

প্রতিদিনই পৃথিবী প্রতিদিনই ধ্রুপদি রীতির বৃষ্টি
অভিব্যক্তি অনুগত শুধু জলের অন্তরঙ্গতা
লাগাতার
বিস্মিত হবার মতো ভেদবুদ্ধি―কাচের অস্পষ্ট ছায়ারেখা
আজ সমতল করে দেয় মৃত্তিকার নির্জনতায়

বিকেলের একটি সময় ঋজু
অপেক্ষা করে পদক্ষেপহীন
অনুভব করে আলোরহিত দিনের উপস্থিতি

বৃষ্টি...ধ্রুপদি রীতির বৃষ্টি সুপ্ত স্মৃতিবিষ
ভেসে উঠবে জীবন শব্দকে বিলুপ্ত করে
কবিতাতে...সংক্রামিত সকল বাস্তবে...
নির্জন পথেঘাটে মানচিত্র মুছে মুছে
গিলে নিয়ে ভ্রান্তি আর বিস্মরণ
বাড়িগুলোকে ক্লান্ত করে
ধ্রুপদি রীতির বিষ্টি... বিষ্টি...

আজ রাতে মৃত্যু হবে আমার


বিমূঢ়তা

বিমূঢ়তা তোমার নিকটে এসে বসি, ভাবি
আমি কেন্দ্রহীন, তুমিও রাখোনি চিহ্ন―
হাহাকারধ্বনি, উদ্বিগ্নতা ছিল অপ্রতিম
বুঝি আমি―জীবন প্রবাহগামী, মৃত্যু
তাকে স্থির করে দেয়, লুপ্ত উপস্থিতি এক
এপিটাফে উজ্জ্বল বিস্মিত

আমরাও মৃত্যুময়, দেখি অদৃশ্যের ঘর
ঝরে-পড়া চিরন্তনতার লুপ্তপাঠ, মৃত্যু
নিজ হাতে রাখে স্মৃতি ও সময়―
একান্ত অনিবারণীয়

যেতে হয়, বৃক্ষকেও শুনতে হয় আত্মার
পতনধ্বনি, যেভাবে পাখিরা রাখে
ডানার নিজস্ব ব্যাকরণ―
দৃশ্য আর অদৃশ্যের খেলা

বিমূঢ়তা, এইখানে চলে অদ্ভুত অপ্রচলিত অবহেলা


ভালোবাসা

ভালোবাসতে গেলে প্রয়োজন সিঁড়ির। অথবা
একটি ছাদ যেখানে আকাশের ছায়া এসে দাঁড়াবে আর
তোমাকে দেবে কতিপয় রঙিন উদ্ভাস।

জানালার ফাঁক দিয়ে নরম বিকেল এসে পড়ে।
অনবদ্য এচিং আর কাঠখোদাইয়ের জীবন, হায়
যে নদী ধীরে ধীরে সাজায় তার গোপন ধ্বনিরাশি।

মোমবাতিগুলো লুকিয়ে রাখি পরবর্তী আলোর জন্য, যারা
আমাকে দেবে স্বস্তি, দেবে সবুজ দর্পণের অহংকার।
একটি স্থিরচিত্র অথবা পোর্ট্রটে যে তাকিয়ে থাকে
নিজস্ব মানুষটির দিকে যখন ভাসমান বস্তুসকলের প্রতি
তার পক্ষপাত দ্বিধাহীন।

ভালোবাসতে গেলে প্রয়োজন

                        একটি জীবন

            অথবা

                        দুটো মৃত্যু


...

কুমার চক্রবর্তী কবি, প্রাবন্ধিক, অনুবাদক। জন্ম ২ চৈত্র ১৩৭১ বঙ্গাব্দ, কুমিল্লা, বাংলাদেশ। প্রকাশিত গ্রন্থ: কবিতা: লগপুস্তকের পাতা (১৯৯৮), আয়না ও প্রতিবিম্ব ( ২০০৩), সমুদ্র, বিষণ্নতা ও অলীক বাতিঘর (২০০৭), পাখিদের নির্মিত সাঁকো (২০১০), হারানো ফোনোগ্রাফের গান (২০১২), তবে এসো, হে হাওয়া হে হর্ষনাদ (২০১৪); প্রবন্ধ: ভাবনাবিন্দু (২০০২), ভাবনা ও নির্মিতি (২০০৪), মাত্রামানব ও ইচ্ছামৃত্যুর কথকতা (২০০৫/২০০৬), অস্তিত্ব ও আত্মহত্যা (২০১২), শূন্যপ্রতীক্ষার ওতপ্রোতে আছি আমি, আছে ইউলিসিস (২০০৯), মৃতদের সমান অভিজ্ঞ (২০০৯), কবিতার অন্ধনন্দন (২০১০), নির্বাচিত প্রবন্ধ (২০১৫), শ্রেষ্ঠ কবিতা (২০২২); অনুবাদ: আমি শূন্য নই, আমি উন্মুক্ত: টোমাস ট্রান্সট্যোমারের কবিতা (১৯৯৬/২০০২/২০১২), নির্বাচিত কবিতা: ইহুদা আমিচাই (২০০৫/২০১৩), মেঘ বৃক্ষ আর নৈঃশব্দ্যের কবিতা: চেসোয়াভ মিউশ (২০১৪)।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
টি. এস. এলিয়টের 'জে. আলফ্রেড প্রুফরকের প্রেমগীতি'
আনা কাস্তিলোর কবিতা
রূপকুমারী নদীর চুম্বন
সর্বশেষ খবর
সমস্যা মানেই অসুখ নয়: মেডিক্যালাইজেশন কি বাংলাদেশের নতুন ব্যাধি?
সমস্যা মানেই অসুখ নয়: মেডিক্যালাইজেশন কি বাংলাদেশের নতুন ব্যাধি?
দুই ভাইয়ের বিরোধে মুরাদনগরের সেই ঘটনার ভিডিও ছড়ানো হয়: র‌্যাব
দুই ভাইয়ের বিরোধে মুরাদনগরের সেই ঘটনার ভিডিও ছড়ানো হয়: র‌্যাব
গাজায় যুদ্ধবিরতির নতুন প্রস্তাবের নিশ্চয়তা চায় হামাস
গাজায় যুদ্ধবিরতির নতুন প্রস্তাবের নিশ্চয়তা চায় হামাস
জুলাই আন্দোলনে নিহত ৬ সাংবাদিক: কেমন আছে তাদের পরিবার
জুলাই আন্দোলনে নিহত ৬ সাংবাদিক: কেমন আছে তাদের পরিবার
সর্বাধিক পঠিত
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
সরকারি চাকরি অধ্যাদেশের দ্বিতীয় সংশোধন উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
এনবিআর নিয়ে ‘কঠোর’ সরকার, আতঙ্কে শীর্ষ কর্মকর্তারা
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
সচিবালয়ে দখলের দ্বন্দ্ব : আন্দোলনের নেতৃত্বে বিভক্তি
খেলাপিতে ধসে পড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান: বিপদে আমানতকারীরা
খেলাপিতে ধসে পড়ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠান: বিপদে আমানতকারীরা
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল
প্রশ্নপত্রে ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের বাড়ির গল্প, পরীক্ষা বাতিল