বানু মুশতাকের লেখা ‘হার্ট ল্যাম্প’ গল্পটি নারীর হৃদয়ের গভীরতম যন্ত্রণা, আত্মমর্যাদা ও প্রতিরোধের এক জ্বলন্ত আলেখ্য। নিছক পারিবারিক দুঃখগাথা নয় বরং এক আত্মসম্মানবোধ সম্পন্ন নারীর আত্মসমর্পণ ও নতুনভাবে জেগে ওঠার গল্প। একজন নারীর শরীর, মন, আকাঙ্ক্ষা, সমাজের চোখ, সংসারের ভেতরকার নিপীড়ন ইত্যাদি সবকিছুকে ছুঁয়ে গল্পটি ধীরে ধীরে বিস্তৃত ও গভীর হয়ে ওঠে।
গল্পের শুরুতেই দেখা যায়, মেহরুন নামের এক নারী তার কোলের শিশু সন্তানকে নিয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে এসেছে। কিন্তু এই প্রত্যাবর্তন তাকে স্বস্তি দেয় না। এই ঘর যেন তার নিজের নয় বরং এক অদৃশ্য আদালত। যেখানে প্রতিটি নিঃশ্বাস, প্রতিটি কান্না বিচারের মুখোমুখি হয়েছে। বাবা, ভাই, প্রতিবেশী—সবাই যেন নীরব অবজ্ঞায় তাকে সংকুচিত করে তুলে। তারা শুধু একটি কথা বুঝে—পরিবারের মান-সম্মান। এর বাইরে মেহরুনের কষ্ট, অবমাননা, অবহেলা কারও গা ছোঁয় না। এখানে মেহেরুনের পরিবারের আচরণ বুঝিয়ে দেয়, নারীর ব্যথা বোঝার জায়গাটি সমাজে আজও অবধি তৈরি হয়নি। তার বিয়ে ভেঙেছে, তাই তাকে দায়ী করা হচ্ছে। স্বামী যেমন খুশি তেমনভাবে জীবন কাটাতে পারে, প্রেম করতে পারে, সংসার এড়িয়ে যেতে পারে—তবু সে দায়মুক্ত। কিন্তু মেহরুন প্রতিবাদ করায় সে হয়ে যায় অপরাধী।
মেহরুন ছোটবেলায় উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখেছিল, লেখাপড়ায় আগ্রহী ছিল কিন্তু বিয়ের নাম করে তাকে সংসারে বেঁধে দেওয়া হয়। সমাজের চোখে সেটাই নাকি নারীর পূর্ণতা। কিন্তু সেই বিয়ে তাকে কোনো ভালোবাসা দেয়নি, দেয়নি সম্মান। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বামী দূরে সরে গেছে, তার চোখে মেহরুন হয়ে উঠেছে ক্লান্ত, ভারী, জীর্ণ—যাকে পাশে রাখা মানে বিরক্তির বোঝা বইবার মতো। এই জায়গাটিতে নারীর দেহ, যৌবন ও মাতৃত্ব—সবকিছুকেই সমাজ এক বিশেষ পণ্য মনে করে। সে যদি মা হয়, তবে তাকে অশ্রাব্য বলা হয়। সে যদি ক্লান্ত হয়, তবে তাকে অকেজো বলা হয়। অথচ একজন নারী শুধু তার শরীর নয়, তার মন, তার ভালোবাসা, তার পরিশ্রম—সবকিছু মিলিয়ে পূর্ণ একজন মানুষ। এই গল্প সেই পূর্ণ মানুষটির বিচ্যুতি ও প্রত্যাবর্তনের গল্প।
মেহরুন বাবার বাড়ি ফিরে এসেছিল আশ্রয়ের আশায় কিন্তু বাবার বাড়িটিও তাকে নিজের মতো করে থাকতে দেয় না। তাকে নিয়ে শুরু হয় কুৎসা, হিসাব, চুপচাপ স্বামীর বাড়িতে ফেরত পাঠানোর পরিকল্পনা। ভাইয়েরা কেউ তাকে বোঝে না। তারা ভাবে, স্বামীর বাড়ি থেকে সে ফিরে আসার কারণে সে হয়ে গেছে বোঝা। নারী যেন এক বস্তু, যা সমাজে ঠিকঠাক চললে তাকে স্থান দেওয়া হয় আর ক্ষতিগ্রস্ত হলে ফেলে দেওয়া হয়। ঠিক এই জায়গায় নারী সমাজে কতটা একা—তা গভীরভাবে ধরা পড়ে। মেয়েরা যেখানে জন্মায়, সেই ঘরেও তারা নিরাপদ নয় এবং যাদের সঙ্গে বিয়ে হয়, তাদের ঘরেও তারা অস্থায়ী। নারী যেন সর্বত্র ‘অতিথি’, যার আসল জায়গা কোথাও নেই।
স্বামী যখন দূরে সরে যায়, তখন তা শুধু সম্পর্ক ভাঙার বিষয় নয় বরং সেখানে দেহ রাজনীতির নির্মমতা আছে। নারী শরীরকে যতদিন আকর্ষণীয় মনে হয়, ততদিন সে গ্রহণযোগ্য। তার গায়ে বয়স, মাতৃত্বের ক্লান্তি, মানসিক অস্থিরতা এলেই পুরুষ তার আসন ছেড়ে দেয়। নারীর আত্মত্যাগ, তার মা হওয়া, সংসার গড়া—সবকিছুকেই তখন নিরর্থক করে তুলে। এখানে মেহরুন যেন সেইসব নারীর প্রতীক হয়ে ওঠে—যারা স্বামীর চোখে পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে কেবল বয়স, ক্লান্তি বা সন্তানের জন্মের কারণে। যেন নারীর সম্মান ও ভালোবাসা পাওয়া নির্ভর করে তার শরীরের আকৃতি ও সৌন্দর্যের ওপর।
এই গল্পের সবচেয়ে তীব্র ও বেদনাময় মুহূর্ত আসে যখন মেহরুন আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেয়। সে কেরোসিন ঢেলে শরীরে আগুন ধরাতে চায়। এই সময়টিতে যেন তার হৃদয়ের প্রদীপ নিভে যেতে বসে। কিন্তু ঠিক তখনই তার বড় মেয়ে সালমা এসে মাকে মমতা দিয়ে আঁকড়ে ধরে, সে কাঁদে, জিজ্ঞেস করে—তাহলে তাদের কী হবে?
এই মুহূর্তেই গল্প এক নতুন বাঁকে মোড় নেয়। ভালোবাসার মায়ায় হৃদয়ের আলো আবার জ্বলে ওঠে। মায়ের ভেতরের সমস্ত ভাঙাচোরা, অপমান, ক্লান্তি—সবকিছুকে ছাপিয়ে ওঠে এক অন্যরকম শক্তি। সে শক্তি কোনো আদর্শবাদ নয়, কোনো সমাজ পরিবর্তনের ঘোষণা নয়—তা একেবারে অন্তর্জাগতিক স্নেহ, যা সন্তানকে জড়িয়ে ধরে নিজেকেও বাঁচিয়ে তুলে।
এই গল্পে মাতৃত্ব দুর্বল নয় বরং এক দৃঢ়তা। মেহরুন আত্মসম্মান হারিয়েছে, সমাজের চোখে সে অবজ্ঞিত, পরিবার থেকে প্রত্যাখ্যাত, তবু সে মা। সন্তানদের ভবিষ্যৎ চিন্তায় তার ভেতরে যে শক্তি জেগে ওঠে, তা তাকে মৃত্যুর পথ থেকে ফিরিয়ে আনে। এই গল্প আমাদের বলে—নারী যখন জীবনের সবকিছু হারায় তখনও সন্তানের মুখে খুঁজে পায় নতুন পথ। সন্তানের মুখ তার ভবিষ্যৎ, তার জেদ, তার আত্মার চেতনা।
বানু মুশতাক এই গল্পে সমাজের এক গভীর ক্ষতকে তুলে ধরেছেন—নারী যে সবসময় পরিবারের, সমাজের, স্বামীর দয়ার ওপর নির্ভরশীল নয় বরং সে সময়ের প্রয়োজনে নিজের হৃদয়ের আলো দিয়েই পথ খুঁজে নিতে পারে। গল্পের প্রতিটি স্তরে নারীর ভাঙা, দগ্ধ হওয়া আবার নিজেকে গড়ে তোলার চিহ্ন এঁকেছেন তিনি। ‘হার্ট ল্যাম্প’ একজন নারীর আত্মহননের গল্প নয় বরং হৃদয়ের গভীরে জমে থাকা এক আলোর গল্প। সেই আলো কখনো কখনো নিভে যায় কিন্তু তাতে চিরস্থায়ী অন্ধকার নামে না। কারণ ভালোবাসা, মাতৃত্ব, আত্মিক শক্তি—এই সবই আবার সেই নিভে যাওয়া আলোকে জ্বালিয়ে দেয়।
এই গল্পে বানু মুশতাক দক্ষ হাতে তুলে ধরেছেন সমাজের সেই নির্মম বাস্তবতা—যেখানে নারীর স্বপ্ন ও স্বাধীনতা বারবার পিতৃতান্ত্রিক কাঠামোর কাছে বলি হয়। পরিবার মেহরুনের আশ্রয় না হয়ে দাঁড়িয়ে যায় এক অদৃশ্য কারাগার। তার স্বামীর কুকর্ম আড়াল করে বরং মেয়ের স্বাধীনচেতা মনকেই দোষারোপ করা হয়। এখানেই গল্পটি কেবল একটি পারিবারিক ট্র্যাজেডি নয় বরং নারীর বিরুদ্ধে বহমান সামাজিক নির্মাণের গভীর সমালোচনাও। স্বামী ইনায়েতের দৃষ্টিভঙ্গিতে নারী অবমাননার এক ভয়াবহ রূপ উদ্ঘাটিত হয় এখানে। “তুমি এখন আমার মায়ের মতো”—এই সংলাপে শুধু একটি নারী নয় বরং মাতৃত্ব, বয়স এবং নারী শরীরকে ঘিরে সমাজের যৌন রাজনীতির নির্মম চেহারা প্রকাশ পায়। একই সঙ্গে ভাইয়েরা যখন বলে, “তুই যদি আত্মহত্যা করতি, তবে ভালো হতো”—তখন পাঠক স্পষ্ট দেখতে পায় সেই সমাজকে, যেখানে নারীর মৃত্যু মেনে নেওয়া যায় কিন্তু তার প্রতিবাদ নয়।
তবে গল্পের মোড় ঘুরে যায় মেহরুন ও তার বড় মেয়ে সালমার আবেগমথিত সম্পর্কের মাধ্যমে। আত্মহননের মুহূর্তে মেয়ের কান্না ও আলিঙ্গন মেহরুনকে ফিরিয়ে আনে জীবনের দিকে। এই দৃশ্যেই ‘হার্ট ল্যাম্প’ নামটি তার প্রতীকী তাৎপর্য লাভ করে—যেখানে হৃদয়ের নিভু নিভু আলো, সন্তানের ভালোবাসায় আবার দীপ্ত হয়ে ওঠে।
এখানে বানু মুশতাক কেবল সমাজের বিরুদ্ধে একটি বক্তব্য রাখেননি, বরং আন্তোনিও গ্রামশি-এর 'অর্গানিক প্রতিরোধ' ধারণার আলোকেও গল্পটিকে পাঠ করা যায়। কোনো বৃহৎ বিপ্লব নয় বরং একজন মায়ের নিজ সন্তানকে ভালোবাসা থেকেই তৈরি হয় তার জীবনের নতুন আশ্রয়—এই গল্পের প্রতিরোধ একেবারে অন্তরভিত্তিক, আত্মিক এবং মানবিক।