X
বুধবার, ০১ মে ২০২৪
১৮ বৈশাখ ১৪৩১
কনফুসিয়াসের ‘‌লুন-য়্যু’

রাজ্য পরিচালনা বলতে কী বোঝায়?

জাহেদ সরওয়ার
২৭ এপ্রিল ২০১৮, ১৪:৩১আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০১৮, ১৪:৩৩

রাজ্য পরিচালনা বলতে কী বোঝায়?
কনফুসিয়াসের কথোপকথন ‘‌লুন-য়্যু’ বইটির বয়স প্রায় আড়াই হাজার বছর । এই  বইটি প্লাটোনীয় আঙ্গিকে লেখা। গুরুদেব ও তাঁর শিষ্য ৎস-কুংয়ের সংলাপধর্মী প্রশ্নোত্তরপর্ব। কনফুসিয়াসও একজন মানুষ খুঁজে বেড়ান। তিনি একজন মানুষের অবয়ব গঠন করেন। তবে কনফুসিয়াসের মানুষ ঠিক লালন কিংবা লাউৎসের সহজ মানুষ নন। কনফুসিয়াস তাঁর নাম দেন ভদ্রসন্তান। কনফুসিয়াসের মানুষ প্লেটোর আদর্শ রাষ্ট্রের নাগরিকদের মতো খানিকটা। এখানে বলে নেয়া ভালো হাজার বছর ধরে কনফুসিয়াসের এই কথোপকথন ধর্মী শিক্ষা শুধু চীন নয় মঙ্গোলয়েড দেশগুলো তথা দূরপ্রাচ্যে প্রভাব বিস্তার করেছে। দূরপ্রাচ্যের আজকের যে উন্নতি চোখে পড়ে। এত উন্নতি সত্ত্বেও তাদের ভিন্নদেশ বা ভিন্ন সংস্কৃতির প্রতি যেই শ্রদ্ধাবোধ সেটাও এসেছে কনফুসিয়াসের কাছ থেকে। আর কনফুসিয়াস সবসময় চলমান প্রবাহের মতো গতিময়। চিন্তার এই গতিময়তা নিয়ে আসে জীবনের গতিময়তা। অবশ্য কনফুসিয়াস ছাড়াও দূরপ্রাচ্যে বুদ্ধের প্রভাব রয়েছে। কনফুসিয়াস বুদ্ধের সঙ্গে সাংঘর্ষিক নয়। দূরপ্রাচ্যে আরো রয়েছে মার্কসিজমের প্রভাব। তবে চীন প্যাকটিকেলি মার্কসের তত্ত্বকে ধরে রাখেনি। যুগের সঙ্গে সাংঘর্ষিক অংশটুকু বলা যায় এড়িয়ে গেছে।

কনফুসিয়াসের সব সংলাপই গ্রাহ্য করবার মতো নয় আজকের দুনিয়ায়। কিছু কিছু সংলাপ তাঁর সম্পর্কে ভুল তথ্য দেয়। মাঝে মাঝে মনে হতে পারে যে তিনি বুঝি রাজতন্ত্রের পক্ষে। তিনি সামন্তীয় সমাজ টিকিয়ে রাখার পক্ষে। আবার তিনি শাসকের চরিত্র সম্পর্কেও কটাক্ষ বা সেটার একটা স্ট্রাকচারও তৈরি করেন । শিষ্য ৎস-কুং এর প্রশ্ন ‘রাজ্য পরিচালনা বলতে কী বুঝায়?’ এর জবাবে গুরুদেব বলেন, পর্যাপ্ত খাদ্য, পর্যাপ্ত রণসম্ভার, এবং বিশ্বস্ত জনগণ। পরে ৎস-কুং বলেন, একটিকে যদি বাদ দিতে বলা হয় তাহলে কোনটা বাদ দিবেন? গুরুদেব বলেন রণসম্ভার। শিষ্য বলেন, দুটি থেকে যদি একটি বাদ দিতে বলা হয় তবে কোনটা? গুরুদেব বলেন, খাদ্য বাদ দাও। কারণ মানুষের মৃত্যু স্বাভাবিক আমরা দেখে এসেছি। বিশ্বস্ততা ছাড়া মানুষ খাড়া থাকতে পারে না।

তাহলে দেখা যাচ্ছে যে তিনি শেষ পর্যন্ত মানুষের কাতারে এসে দাঁড়ান। কারণ মানুষ না থাকলে খাদ্য আর যুদ্ধের কোনো গতি হবে না। রাষ্ট্রপ্রধানের চরিত্র আর তার আচার আচরণ সম্পর্কেও তিনি অনেক মন্তব্য করেন। শিষ্যের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার সুখ আর কিছু নয় কেবল তার ওপর আর কেউ কথা বলতে পারবে না। প্রধানের কথা যদি উচিত কথা হয় তবে সেটা মেনে নেয়া ভালো। কিন্তু রাষ্ট্রপ্রধান যদি অনুচিত কথা বলেন—আর তার বিরুদ্ধে যদি কেউ কথা না বলে, তবে এই একটি বাক্য থেকেই দেশটির সর্বনাশ হতে পারে।

শিষ্য প্রশ্ন করেন, ভালোর জন্য মন্দের হত্যা বিষয়ে আপনার মতামত কী? গুরুদেব বলেন, রাজ্য পরিচালনার ব্যাপারে আপনি হত্যার আশ্রয় কেন গ্রহণ করবেন? যদি রাজা মহৎ হয় তাহলে জনগণও মহৎ হবে, যদি রাজা চোর হয় তাহলে জনগণও চোর হবে। যদি রাজা হত্যার মধ্য দিয়ে রাজ্য টিকিয়ে রাখেন, তাহলে রাজ্যে হত্যা লেগেই থাকবে। যদি রাজা অনিরাপদ হন তাহলে রাজ্যে ধর্ষণ দুর্নীতি লুটপাট বেড়ে যাবে। রাজার চরিত্র হচ্ছে হাওয়া আর জনগণের চরিত্র হচ্ছে ঘাস, ঘাসের উপর দিয়ে হাওয়া যখন বয়ে যায় তখন সব ঘাসেই সে হাওয়া এসে লাগে।

শিষ্যের আরেক প্রশ্নে তিনি বলেন, যারা উঁচুতে তারা যদি ভদ্রতা পছন্দ করে—তবে সাধারণ মানুষ অশ্রদ্ধা করতে সাহস করবে না। যারা উঁচুতে তারা যদি সাধুতা পছন্দ করেন তবে সাধারণ মানুষ উদ্ধত হতে সাহস করবে না। যারা উঁচুতে তারা যদি বিশ্বাস পছন্দ করেন—তবে সাধারণ মানুষ অবিশ্বাসী হতে সাহস করবে না।

এ কথা এখন স্বীকৃত যে অপরাধীকে হত্যার মধ্যে দিয়ে অপরাধের বিনাশ করা যায় না। আগে খুঁজে বের করতে হবে অপরাধের উৎস কোথায়? যতক্ষণ পর্যন্ত না শাসক সচেতন সৎ জনগণের পাশে ততক্ষণ আসলে রাজ্যে কোনো অপরাধ হতে পারে না। সুতরাং শাস্তি দিয়ে অপরাধের বিনাশ সম্ভব না। শাসক একটা রাজ্যের দেহের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সেখানে পচন ধরলে গোটা রাজ্যে ছড়িয়ে পড়ে সে পচন। এই জন্য শাসকের চরিত্র একটা জরুরি বিষয়। আর শাসকের চরিত্র নিয়ে অনেক কথাই বলেছেন বইটিতে কনফুসিয়াস। তিনি বলেন, যে মানুষ সত্যনিষ্ট সে হুকুম দেবার আগেই সবাই তার অনুগত হয়, আর সে নিজে যদি নিষ্ঠাচারী না হয় তবে হুকুম দিয়েও সে কাজ চালাতে পারবে না।

রাজ্যের আইনকানুন সম্পর্কে শিষ্যের এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, মানুষকে শিক্ষাদান না করে বিচারের নামে হত্যা একেই বলে নিষ্ঠুরতা। আগে থেকে সাবধান না করে তাদের কাছে পুরো কাজ আশা করা একেই বলে নির্দয়তা। নরম হুকুম দিয়ে সেই হুকুম পালনে কঠোরতার প্রকাশ হচ্ছে ডাকাতি আর মানুষকে তার প্রাপ্য দেবার সময় তা কমিয়ে দেওয়া হচ্ছে একজন ছোটলোক কেরানির মতো ব্যবহার।

রাজ্য শাসন সম্পর্কে আলোচনা করতে গিয়েই কনফুসিয়াস সম্ভবত ভদ্রসন্তানের প্রসঙ্গে ভেবে থাকবেন। তার পুরো আলোচনা জুড়ে উল্লেখযোগ্য অংশ তিনি এক ভদ্রসন্তান খুঁজে বেড়ান। সেই ভদ্রসন্তানের কী কী গুণ থাকবে—তা তিনি বিস্তারিত আলোচনা করেন। তিনি বলেন, ভদ্রসন্তান দয়ালু হবেন, কিন্তু অমিতব্যয়ী হবেন না। কাজের ভালো দেবেন কিন্তু দেখবেন তাতে মানুষ যেন বিরক্ত হয়ে না ওঠে। তাঁর ইচ্ছা লোভে পরিণত হবে না, গাম্ভীর্য দাম্ভিকতায় পরিণত হবে না, তাঁর প্রতাপ কখনো ভয়ংকর হয়ে উঠবে না।

ভদ্রসন্তানের অন্য সিমট্রম সম্পর্কে তিনি বলেন, ভদ্রসন্তানের মধ্যে তিনটি পরিবর্তন হয়। দূর থেকে তাঁকে কঠোর বলে মনে হয়, কাছে গেলে মনে হয় শান্ত আর কথা বলেন যখন তাঁর ভাষা হয় সংযমী।

তিনি আরও বলেন, কারিগর কাজ শেখে কারখানাতে আর ভদ্রসন্তান জ্ঞানের ভিতর দিয়ে সত্যে উপনীত হন। ক্ষুদ্র পথেও লক্ষ করার মতন কিছু থাকতে পারে কিন্তু সেই পথে বেশি দূর অগ্রসর হলে কাদার মধ্যে আটকে যাবার সম্ভাবনা আছে। অতএব ভদ্রসন্তান সে পথে চলেন না। ভদ্রসন্তান সত্যকে সবচেয়ে উঁচুতে স্থান দেয়। যে ভদ্রসন্তান সত্যপন্থী নয় অথচ সাহসী তিনি হয়ে উঠেন বিদ্রোহী। যে ক্ষুদ্রলোক সত্যপন্থী নয় অথচ সাহসী সে হয়ে উঠে ডাকাত।

তবে নারী আর মজুরদের ব্যাপারে কনফুসিয়াসের দৃষ্ঠিভঙ্গিও সেকেলে। তিনি বলেন, কেবলমাত্র মেয়েদের আর চাকরদের লালন করাই হচ্ছে শক্ত। যদি তাদের দাও তাহলে তারা বশে থাকবে না, আর যদি তাদের দূরে ঠেলে দাও তাহলে তারা অসন্তুষ্ট হবে।

গুপ্তচরবৃত্তিকে তিনি ঘৃণা করেন। তিনি বলেন, যারা গুপ্তচরবৃত্তিকে জ্ঞান আহরণ করা ভাবে আমি তাদের ঘৃণা করি, যারা হঠকারিতাকে সাহস ভাবে আমি তাদের ঘৃণা করি, যারা গুপ্তকথা প্রকাশ করে ভাবে তারা সাধু আমি তাদেরও ঘৃণা করি।

কবিতা ও সংগীতকে মানবমনের উন্নয়নে তিনি অনেক গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন । এক্ষেত্রে তিনি প্লেটোর মতো রক্ষণশীল নন। তিনি বলেন, কাব্য মনকে জাগিয়ে তোলে, চোখ ফুটিয়ে দেয়, সমাজে মিশতে শেখায়, মনের ক্ষোভ দমন করতে শেখায়। শেখায় পাখি পশু আর গাছপালার নাম।

বিদ্বানদের সম্পর্কে তিনি বলেন, যে বিদ্বান আরামপ্রিয় সে বিদ্বান নামের উপযুক্ত নয়।

শিক্ষা ধর্ম ও ভদ্রসন্তানদের চরিত্র সম্পর্কে আরও অনেক সমৃদ্ধ উক্তি আছে বইটিতে। বিশটি অধ্যায়ে বিভক্ত বইটি। একই অধ্যায়ে নানা বিষয়ে কথা বলেছেন বৈঠকি ঢঙে। কনফুসিয়াস উপাধি তাঁর নাম হচ্ছে খুং-ফুৎস। খ্রিস্ট পূর্ব ৫৫১ সালে তিনি চীনদেশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি রাজকর্মচারী ছিলেন। অনেকে বলেন তিনি প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন তবে সেটা নিয়ে বিতর্ক আছে। সম্রাটের আজ্ঞাধীন থাকা বা আদেশ মানা নিয়ে তাঁর বেশ কয়েকটি উক্তি আছে। তবে তাঁর বৈপ্লবিক উক্তিগুলোর কাছে সেসব কিছু না।

লেখক : কবি ও ভাবুক।

 

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
আজও সর্বোচ্চ তাপমাত্রা যশোরে, পথচারীদের জন্য শরবত-পানির ব্যবস্থা
কমলাপুর স্টেশন থেকে নিরাপত্তাকর্মীর মরদেহ উদ্ধার
কমলাপুর স্টেশন থেকে নিরাপত্তাকর্মীর মরদেহ উদ্ধার
যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনপন্থি ও ইসরায়েলপন্থি প্রতিবাদকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ
যুক্তরাষ্ট্রে ফিলিস্তিনপন্থি ও ইসরায়েলপন্থি প্রতিবাদকারীদের মধ্যে সংঘর্ষ
চীনে সড়ক ধসে নিহত ১৯
চীনে সড়ক ধসে নিহত ১৯
সর্বাধিক পঠিত
চকরিয়ার সেই সমাজসেবা কর্মকর্তা ও অফিস সহকারী বরখাস্ত
চকরিয়ার সেই সমাজসেবা কর্মকর্তা ও অফিস সহকারী বরখাস্ত
সাতক্ষীরার ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড 
সাতক্ষীরার ইতিহাসে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড 
কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টিতে ভেঙেছে ঘরবাড়ি, ধানের ক্ষতি
কালবৈশাখী ঝড়ের সঙ্গে শিলাবৃষ্টিতে ভেঙেছে ঘরবাড়ি, ধানের ক্ষতি
রুনা লায়লার নতুন গান, সঙ্গে দুই তরুণ
রুনা লায়লার নতুন গান, সঙ্গে দুই তরুণ
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’
‘মানুষের কত ফ্রেন্ড, কাউকে পাশে পাইলে আমার এমন মৃত্যু হইতো না’