X
শনিবার, ০৪ মে ২০২৪
২০ বৈশাখ ১৪৩১
আন্দামান ভ্রমণ

কালাপানির কেচ্ছা ।। পর্ব ১০

মুহম্মদ মুহসিন
০৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৪৩আপডেট : ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯, ১৪:৫৬

কালাপানির কেচ্ছা ।। পর্ব ১০ আন্দামান হোমে ইংরেজরা গ্রেট আন্দামানিজদের তদারকির কাজে নিযুক্ত করলেন সেই সকল কয়েদিকে যারা ইংরেজদের ধারণায় অনেক দিন ধরে ইংরেজদের সংস্পর্শে থেকে সভ্য (?) হয়ে উঠেছিল। এই সভ্যরা (?) আন্দামানিজদেরকে সভ্যতার মারাত্মক সব উপহারাদিতে ভূষিত করলো। এই সভ্যরা দিনে দিনে আন্দামানিজদেরকে তামাক ধরালো, আফিম ধরালো, সিফিলিস ধরালো এবং গনোরিয়া পর্যন্ত ধরিয়ে ছাড়লো। সেই সব উপহারাদি নিয়ে সভ্যতার সুখ সইতে না পেরে আন্দামান হোমের আন্দামানিজরা হোম থেকে একে একে সব পালিয়ে গেল। সাথে নিয়ে গেল সিফিলিসরূপ মৃত্যুর দূত সারা আন্দামানে ছড়িয়ে দেয়ার জন্য। ইংরেজদের অতবড় ব্যাটেলিয়ন তাদের সব অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে যা করতে পারেনি আন্দামান হোমের তত্ত্বাবধায়ক একজন দণ্ডপ্রাপ্ত কর্মচারী যার নাম ছিল শেরা। তিনি একাই সেই কাজটি করে দিলেন। আদিবাসী আন্দামানিজ মেয়েদের সিফিলিস ধরিয়ে দিয়ে উত্তর, মধ্য এবং দক্ষিণ আন্দামানের প্রায় সমস্ত আদিবাসী নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার ব্যবস্থা হলো।

ইংরেজ সংস্পর্শে এসে আদিবাসী আন্দামানিজরা অন্যসব কিছুর সাথে যে সকল রোগ উপহার পেলো তার মধ্যে সিফিলিস ও গনোরিয়া ছাড়াও রয়েছে অপথ্যালমিয়া, হাম ও মাম্পস। ১৮৭৬ সালে অপথ্যালামিয়ায় অনেক আদিবাসী অন্ধ বা প্রায় অন্ধ হয়ে যায়। ১৮৭৭ সালের মার্চ মাসে দেখা দেয় হাম। হামে গ্রেট আন্দামানে আদিবাসিরা সংখ্যায় অর্ধেক হয়ে গিয়েছিল। ১৮৮৮ সালের আগেই এলো মাম্পস। তারপরও রক্ষা হলো না। ১৮৯০ সালে হানা দিলো ইনফ্লুয়েঞ্জা। আর সবশেষে ১৮৯২ সালে আন্দামান হোমের শেষ অবদান ছিল গনোরিয়া। রেভারেন্ড করবিন ও পরবর্তীতে এম. ভি. পোর্টম্যানের পরিচালিত আন্দামান হোমে একশো পঞ্চাশেরও অধিক শিশু জন্মগ্রহণ করেছিল যার একটি শিশুও ২ বছরের অধিক বাঁচেনি। আন্দামান হোমের এতসব কীর্তিকাণ্ডের শেষে শেষ পর্যন্ত চিফ কমিশনার কর্নেল ডগলাস আন্দামান হোম বন্ধ করে দেন। এরপর উনবিংশ শতকও শেষ হলো আর আদি গ্রেট আন্দামানিজ ও ওঙ্গিরাও আন্দামানের মাটি থেকে শেষ হয়ে গেল। বিংশ শতকে এসে আন্দামানের আদিবাসীদের মধ্যে যারা বেঁচে রইলো তাদের মধ্যে রয়েছে কয়েকশো জারোয়া জনজাতির সদস্য আর হয়তো শ’খানেক সেন্টিনেলিজ। এই দুটি জনজাতির এই কজন সদস্য এখনো বেঁচে থাকতে পেরেছে কারণ তারা কখনো ইংরেজদের সভ্যতা শেখার স্কুলে ভর্তি হয়নি।

পৃথিবীর ইতিহাসের শেষ গ্রেট আন্দামানিজ সন্তানগণকে দেখে এসে সঞ্জীব চট্টোপ্যাধায় একটি চমৎকার বর্ণনা দিয়েছিলেন। বর্ণনাটি এখানে উদ্ধৃত করার লোভ সামলাতে পারছি না : ‘স্ট্রেটস আইল্যান্ড। . . . মনে হলো রূপকথার তীরে এসে উঠেছি। যার কোণাটা শুধু একটু বাস্তব ছুঁয়ে গেছে। রামায়ণের কিস্কিন্ধা। একটা মোটা নারকেল গাছের শোয়ানো গুঁড়ির ওপর বসে আছেন—রাজা আর রানী। রাজার নাম ‘লোকা’। রানীর নাম ‘জীরা’। আসল আন্দামানি। রাজার বয়স হবে নব্বই বছর। রাণীর ষাট কি পঁয়ষট্টি।...রাজার মাথায় আফ্রিকানদের মতো এক মাথা গুঁড়িগুঁড়ি চুল। দুজনে বসে সমুদ্র দর্শন করছেন। পেছনেই শ-খানেক গজ দূরে রাজমহল। রাজমহলের সামনে তোরণটা প্রকৃতই তোরণ। বাঁশের তৈরী। আন্দামানিজদের রাজত্বে প্রবেশের জন্য সাদর আমন্ত্রণ। রাজার রাজত্বে জনসংখ্যা মাত্র বাইশ। রাজ্যসীমা বিশাল। তবে তিনের চার অংশে শুধু জঙ্গলই রাজত্ব করেছে। . . . এই বাইশটি মানুষের একটি সম্প্রদায়কে বাঁচানোর কী আপ্রাণ চেষ্টা! . . . ইংরেজ আমলে পেয়েছে সভ্য ব্যাধি আর নেশা করার প্রবণতা। জাপানি আমলে পেয়েছে অকথ্য অত্যাচার। ইংরেজদের গুপ্তচর সন্দেহে। এখন অবলুপ্তির শেষ ধাপে এসে পাচ্ছে জামাই আদর।

‘এখন কুড়িয়ে বাড়িয়ে সকলকে এনে জড়ো করা হয়েছে এই স্বর্গীয় দ্বীপে। সুন্দর সুন্দর কুটির তৈরী করে দেয়া হয়েছে। মাসোহারার ব্যাবস্থা রয়েছে। ফ্রি রেশন, ফ্রি জামাকাপড়, ওষুধপত্র, চিকিৎসা, অল্পস্বল্প শিক্ষার সুযোগ। পুরো ব্যাপারটাই যেন...ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটে ২২টি হার্টের রোগী।

‘জীরা কপালে, নাকে, গালে রসকলি করে, গাউন পরে নিজেকে রানী বলে দাবী করলেও সে নাকি আসল রানী নয়। রাজা লোকার স্ত্রী বহুদিন আগে মারা গেছে। জীরা একজন ডিভোর্সি। এই দ্বীপে সরকারী ব্যবস্থাপনায় বসবাস করতে আসার আগে এরা সকলেই থাকতো পোর্টব্লেয়ারে। ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা জাপানি বাঙ্কারে। নেচে গেয়ে জুয়া খেলে যা রোজগার হত তাই দিয়ে সামান্য গ্রাসাচ্ছদনের ব্যবস্থা। সেই নর্তকী জীরা এই ষাটোত্তর বয়সে আধা উন্মাদ। সারাদিন সমুদ্রের ধারে বসে থাকে। অতীতের দিন যদি পিছু হটে সরে আসে ।

‘আন্দামানে সভ্যতার প্রথম শিকার এই প্রজাতির বাঁচার আশা খুবই কম। মৃত্যুর পরোয়ানা ঝুলছে মাথার উপর। প্রত্যেকে অসুস্থ।  বংশানুক্রমিক সিফিলিসের জীবাণু রক্তে। যক্ষ্মায় ফুসফুস জীর্ণ। ম্যালেরিয়া। তার ওপর ড্রাগ এ্যাডিকশন। দ্বীপের নাম রাখলে হয় ওপিয়াম আইল্যান্ড। আফিম খেয়ে খেয়ে এদের আর নড়বার-চড়বার ক্ষমতা নেই।  প্রজনন শক্তিও লোপ পেয়েছে। অথচ সরকার চান, নৃতাত্ত্বিকরা চান এরা বংশবৃদ্ধি করুক। করুক বললেই তো আর করা যায়না। বাইশটি প্রাণীর মধ্যে সাতজন বয়স্কা নারী। আটজন বয়স্ক পুরুষ। সাতজন মহিলার মধ্যে মাত্র দুজনের সন্তান ধারণের বয়স আছে। বাকী সকলের সে বয়স পেরিয়ে গেছে। ‘ইলফা’ আর ‘বোরো’ সবচেয়ে আদরনীয় দম্পতি। . . .  এরা দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে জন্ম দিয়েছে। দুটিমাত্র মহিলার ওপর আজ পুরো গ্রেট আন্দামানিজ জাতির থাকা না থাকা নির্ভর করেছে। এ যেন দুরূহ এক টেস্ট ক্রিকেট। দুজন ব্যাটসম্যানের স্কোরের উপর নির্ভর করছে জয় পরাজয়।’

সঞ্জীব চট্টোপ্যাধায় ১৯৭৮ সালের মার্চ মাসে দেখে এসেছিলেন এই অমীমাংসিত টেস্ট খেলাটি। আমরা ২০১৮ সালের আগস্ট মাসে দেখে আসলাম খেলার ফলাফল নির্ধারিত হয়ে গেছে। আজ আর আন্দামানে বিশুদ্ধ গ্রেট আন্দামানিজ জনজাতির একজনও নেই। ২০১০ সালের জরিপে গ্রেট আন্দামানিজ হিসেব যে বায়ান্নো জনের নাম লিখিত হয়েছে তাদের কেউই বিশুদ্ধ আন্দামানিজ রক্তের নন।  তারা অনেকটা নৃতাত্ত্বিক প্রয়োজনে সংকরায়িত বা চাষ-করা আন্দামানিজ মাত্র।

আন্দামানিজদের পরে আন্দামানে যে, আদিম মানুষ্য প্রজাতিটি হারিয়ে গেছে সেটি ওঙ্গি। ওঙ্গিদের দেবতা ও আমাদের সাঁওতালদের দেবতা অকেটা এক—‘বোয়াঙ’ আর ‘বোঙ্গা’। আচারেও মিল আছে। তাই অনেকে মনে করেন এরা বঙ্গ, আরাকান, বার্মা ইত্যাদি অঞ্চল থেকে হয়তো কোনো কালে আন্দামানে পৌঁছেছিল। আন্দামান হোমের দ্বিতীয় পরিচালক এম. ভি. পোর্টম্যান এদেরকে খুব ভদ্র ও নিরীহ গোছের বলে বর্ণনা করলেও এক সময় এরাও ইংরেজদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ করেছিল। ১৮৭০ সালে আন্দামানের তৎকালীন সুপারইনটেন্ডেন্ট মেজর জেনারেল ভি. এম. স্টুয়ার্ট এদের সাথে বন্ধুত্ব বা দোস্তি পাতাতে গিয়ে কোনোভাবে মরতে মরতে বেঁচে গিয়েছিলেন। আর সাথের একজনকে হারাতেই হয়েছিল। এদের অঞ্চলে যখন ইংরেজরা প্রথম ঢুকতে সমর্থ হলো তখন দেখলো চারিদিকে ছড়িয়ে আছে ডুবে যাওয়া বার্মিজ জাহাজের নাবিকদের মৃতদেহ—কঙ্কাল। সেই থেকে অনেকে অনুমান করলো যে এরাও নরাখাদক। কিন্তু সত্যিকারে আন্দামানের কোনো জনগোষ্ঠিই নরখাদক নয়।

ইংরেজরা সম্পর্ক স্থাপনের পরে বরং দেখেছে ওঙ্গিরা আন্তরিক প্রকৃতির মানুষ। তবে সভ্যতার সংস্পর্শে এসে তারাও হারাতে বসেছে তাদের অস্তিত্ব। ১৯৭১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী তাদের ১২২জন সদস্য জীবিত ছিল। তারা বর্তমানে বাস করছে তাদের জন্য নির্ধারিত সরকারি রিজার্ভ ডুগংক্রিকে এবং লিটল আন্দামানে। ২০০১ সালের আদম শুমারিতে তাদের সংখ্যা ১০০ তে নেমেছে। এখন তারা পশু শিকারী জীবনে নেই। তাদের  খাদ্যাভ্যাসও পাল্টে গিয়েছে। তারা এখন কাপড় পরে। খাদ্যাভ্যাস হোক কিংবা অন্য কোনো কারণে হোক তাদের নারীদের মধ্যে এসেছে ব্যাপক বন্ধ্যাত্ব। ২৮ বছরের আগে তাদের কোনো নারীরে গর্ভে এখন সন্তানই আসে না। এই বন্ধ্যাত্বের বদৌলতেই হয়তো গ্রেট আন্দামানিজদের মতো এরাও কিছুদিনে হারিয়ে যাবে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে।

আন্দামানের আদিবাসীদের মধ্যে যার সবশেষে সভ্য দুনিয়ার সংস্পর্শ কবুল করেছে তারা হলো জারোয়া। তবে জারোয়ারা এই সংস্পর্শ কবুল করলেও তারা এখনো তাদের স্বীয় জীবনযাত্রায় স্থির থেকে জাতি হিসেবে স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রেখে প্রস্তর যুগের মানবসভ্যতাকে এখনো ধরে রেখেছে। তারা এখনও উলঙ্গ থাকে। এখনও টাকার ব্যবহার তারা জানে না এবং খোদার দুনিয়া ভাগ করে করে এক এক জনে এক এক টুকরা জমির মালিক হওয়ায় অলীক পদ্ধতি এখনো তাদের জ্ঞানের বাইরে। দীর্ঘদিন তারা লড়াই করেছে ইংরেজদের বিরুদ্ধে এবং সভ্যতার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে। তবে আন্দামানিজরা ১৮৫৯ সালে যখন আবেরদিনে ইংরেজদের সাথে যুদ্ধ করে তখন জারোয়ারা মোটেই সে যুদ্ধে অংশ নেয়নি। এর পিছনে দুটি কারণ ছিল। প্রথমত, গ্রেট আন্দামনিজরা ছিল জারোয়াদের চির শত্রু। তাই শত্রু সাথে যুক্ত হয়ে আরেক শত্রু বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার সভ্য (?) দুনিয়ার দূতিয়ালিসুলভ শঠতা তারা তখনো শেখেনি। ফলে এই যুদ্ধে গ্রেট আন্দামানিজদের পক্ষে তারা যোগ দেয়নি। দ্বিতীয়ত, তারা প্রথম দেখায়ই কাউকে শত্রু ভাবতে আগ্রহী নয়। ফলে ইংরেজদেরকে তখনো খুব শত্রু হিসেবে তারা নেয়নি। কিন্তু যখন তারা একবার বুঝেছে যে, এই ইংরেজ এবং তাদের সভ্যতা জারোয়াদের অস্তিত্বের জন্য শত্রু, তখন থেকে  ইংরেজদের এবং সভ্য জগতের কোনো দোস্তির প্রস্তাবই তারা গ্রহণ করেনি। ইংরেজদের সাথে এবং সভ্যতার সাথে জারোয়াদের লড়াইয়ের ইতিহাস তাই বেশ দীর্ঘ।

আবেরদিনের যুদ্ধের কিছু দিন পর থেকেই গ্রেট আন্দামানিজরা আন্দামান হোমে জায়গা নিয়ে ইংরেজদের অন্য সব প্রলোভনের বস্তু সামগ্রী কবুল করে ইংরেজদের অনেকটা অনুগ্রাহী ও বশংবদ হয়ে উঠেছিল। গ্রেট আন্দামানিজদের শত্রু জারোয়ারা এবার ইংরেজদের শত্রু হয়ে ওঠে। গ্রেট আন্দামানিজরা এদেরকে জারোয়া বলে দেখে ইংরেজরাও এদেরকে জারোয়া বলতে শুরু করে। অথচ এটি তাদের নাম নয়।। তাদের জাতিগত নাম ‘অঙ’। আন্দামানিজরা তাদেরকে ‘অঙ’ নামে না ডেকে ব্যঙ্গার্থে তাদের কে জারোয়া বলে ডাকতো। ‘জারোয়া’ অর্থ হলো আক্রমনকারী। সে অর্থে মূলত জারোয়া ছিল গ্রেট আন্দামানিজরা যারা ইংরেজদের ওপর প্রথম আক্রমণ করেছিল। অথচ সেই গ্রেট আন্দামানিজদের দেয়া ব্যঙ্গার্থক নামই এই জাতিগোষ্ঠীর সারা দুনিয়াব্যাপী পরিচয়ের নাম হয়ে গেল।

আন্দামান হোম প্রতিষ্ঠার পরে ইংরেজরা গ্রেট আন্দামানিজদের যেমন আদর করে আন্দামান হোমে আনতে চেয়েছে,  গ্রেট আন্দামানিজদের শত্রু জারোয়াদেরকেও তেমনি আদর করে আন্দামান হোমে আনতে চেয়েছে।  জারোয়াদের সাথেও ইংরেজরা তেমন বন্ধুত্ব  স্থাপনের চেষ্টা করেছে যেমন বন্ধুত্ব তারা স্থাপন করেছিল ওঙ্গিদের সাথে। কিন্তু এ লক্ষ্যে ইংরেজদের সকল চেষ্টা ব্যর্থ হয়। যদিও জারোয়ারা ইংরেজদের ওপর সরাসরি আক্রমণে যাওয়ার পক্ষপাতী ছিল না। তবে ১৮৭২ সালে ইংরেজ সরকার যখন কয়েদিদের দ্বারা জঙ্গল পরিষ্কার করে আন্দামান ট্রাঙ্ক রোড বানিয়ে জারোয়াদের বসতির অভ্যন্তরে পৌঁছতে শুরু করলো অর্থাৎ পোর্টব্লেয়ার থেকে ম্যাকফারসন স্ট্রেইট পর্যন্ত রাস্তা বানাতে শুরু করলো তখন জারোয়ারা এই রাস্তার কর্মীদের ওপর প্রথম আক্রমণ করলো। কর্মীরা কাজ করছে এমন এক সময় সমস্ত কর্মীদের উলঙ্গ জারোয়ারা ঘিরে ফেললো। কর্মীরা তাদেরকে ছেড়ে দিতে জারোয়াদের প্রতি অনেক অনুনয় বিনয় করলো কিন্তু কাজ হলোনা। জারোয়ারা কাউকে হত্যা না করে সকল মালামাল ও কাপড় চোপড় কেড়ে নিয়ে পুরোপুরি উলঙ্গ করে তাদের সভ্য জগতে পাঠিয়ে দিলো।

জারোয়াদের পরবর্তী আক্রমণটি সশস্ত্র। ১৮৯০ সালের ১০ আগস্ট। কয়েকজন কয়েদি জারোয়া-অধ্যুষ্যিত জঙ্গলে শিকারে গিয়েছিল। জারোয়ারা তাদের ওপর তীরধনুক নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কয়েদিদের দুজন নিহত হলেন। এ ঘটনায় উপনিবেশ কর্তৃপক্ষ ক্ষেপে গিয়ে সিদ্ধান্ত নেয় যে, এখন থেকে জারোয়া এলাকায় আক্রমণ করে জারোয়াদের ধরে  আনা হবে এবং এজন্য সশস্ত্র পুলিশ ও পুনর্বাসনপ্রাপ্ত কয়েদিদের ব্যবহার করা হবে। কিন্তু ইংরেজদের এসকল দমনপীড়নেও কাজ হলো না। ১৮৯৬ সালের মার্চ মাসে জারোয়ারা আবার কিছু কয়েদিকে হত্যা করলো। তখন আন্দামান হোমের পরিচালক এম. ভি. পোর্টম্যান সাজেশন দেন জারোয়াদের ধরে আনা হোক, কিছু হিন্দুস্তানি ভাষা শেখানো হোক আর ধূমপান শেখানো হোক; তাহলে তারা ধীরে ধীরে কর্তৃপক্ষের উপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। জোর করে অনেককে ধরে এনে পোর্টম্যান তাদেরকে আন্দামান হোমে রেখে অনেক রকম পরীক্ষা চালালেন। কিন্তু কোনো জারোয়াই ইংরেজদের মিত্রতা গ্রহণ করলো না। সভ্য জগতে দাসত্ব না করে বরং গভীর অরণ্যে স্বাধীন জীবন-যাপনকেই তারা জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করলো।

শেষ পর্যন্ত ইংরেজরা এই ঘাড়োয়া জারোয়াদেরকে শায়েস্তা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলো। ১৯০৫ সালে এদেরকে শায়েস্তা করার লক্ষ্যে বুশ পুলিশ অর্থাৎ জঙ্গলের জন্য পুলিশ বাহিনী তৈরি করা হলো। এই বাহিনীর কাজ হলো জারোয়া দমন এবং জঙ্গল  থেকে পলাতক কয়েদিদের ধরে আনা। বুশ পুলিশ ১৯১০ সালে এক শাস্তিমূলক অভিযানে জারেয়াদের বেশ কিছু কুটির ধ্বংস করে দেয়। ১৯১৮ সালে বুশ পুলিশ জারোয়াদের ওপর আরো একটি নিপীড়নমূলক অভিযান পরিচালনা করে। এইসব অভিযানের পরে জারোয়ারা মরিয়া হয়ে ওঠে। তারা আন্দামানে পুনর্বাসনপ্রাপ্ত মানুষদের ওপর রাস্তায় ও মাঠে আক্রমণ করতে শুরু করে। এই সকল আক্রমণে ১৯২১ সাল থেকে ১৯২৫ সাল পর্যন্ত জারোয়ারা ২১ জন পুনবার্সনপ্রাপ্ত কয়েদি হত্যা করে।

আবার শুরু হয় দমন অভিযান। ক্যাপ্টেন ওয়েস্ট এর নেতৃত্বে ১৯২৫ সালে ৩৬ জন কাঞ্চি মিলিটারী পুলিশ কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে কয়েকটি জারোয়া এলাকায় হামলা চালায়। তারা ৩৭ জন জারোয়াকে হত্যা করে। এতসব দমন পীড়নেও যখন জারোয়াদেরকে বশে আনা যাচ্ছিল না তখন ১৯৩৯ সালে লে. কর্নেল ম্যাকার্থির নেতৃত্বে আবার কিছু সংখ্যক জারোয়া ধরে এনে বশ করার কর্মসূচি নেয়া হয়। এই অভিযানে ম্যাকার্থির নেতৃত্বে পাঞ্জাব পুলিশ বারাটাং দ্বীপে জারোয়া ধরার অভিযানে চালায়। প্রায় সবাই পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। মাত্র এক জারোয়া মহিলা তার ২ কন্যা ও ১ পুত্র সহ ধরা পড়ে। তাদের পোর্টব্লেয়ারে নিয়ে আসা হয়। জারোয়া মহিলার এক মেয়েকে লোকজন তপসী বলে ডাকতে শুরু করে। বিশপ জন রিচার্ডসন তপসীকে নিকোবারে নিয়ে যান। সেখানে এক নিকোবরী যুবকের সাথে তার বিয়ে দেন। তপসী ১৯৯৮ সালে মারা গেছে।  তার ভাইকে স্কুল শিক্ষার জন্য রাঁচী পাঠানো হয়েছিল। হতভাগ্য জারোয়া বালক কিছুদিন পর নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সেখানেই মারা যায়। তপসীর অন্য বোনটিকে ব্রিগেডিয়ার ফ্রান্সিস দক্ষিণ আন্দামানের একটি গ্রামে নিয়ে এসেছিলেন। সেখানে সে হিন্দি বলতে শেখে এবং ব্রিগেডিয়ার অফিসে কাজ করতে শেখে। বেশ কিছুদিন পরে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় সে তার অরণ্যের কুটিরে ফিরে যেতে চায়, নাকি এখানে থাকতে চায়। সে ফিরে যেতে চাইলে তাকে বারাটাং দ্বীপে তার কুটিরে আবার দিয়ে আসা হয়। সেখানে কয়েক মাস পরেই মেয়েটি মারা যায়। জারোয়া বশীভূতকরণের এই পদ্ধতি কিছুদিন না এগোতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় সব ওলটপালট হয়ে যায়। ১৯৪২ সালে জাপানিরা পুরো দ্বীপ তাদের দখলে নিয়ে নেয়। ১৯৪৫ সালে ইংরেজরা এই দ্বীপ পুনরুদ্ধার করলেও ১৯৪৭ এর আগেই তারা স্থায়ীভাবে চলে যায়। অত্যন্ত লক্ষণীয় বিষয় হলো ইংরেজ রাজ তাদের ২০০ বছরের রাজত্বের ইতিহাসে সারা ভারতে সকল জাতি উপজাতিকে তাদের অধীন করে নিতে পারলেও একমাত্র আন্দামানের জারোয়া ও সেস্টিনেলিজদের মোটেই বশীভূত করতে পারেনি।  এই দুশো বছরে সারা ভারতে একমাত্র স্বাধীন জনগোষ্ঠী ছিল এই প্রস্তুরযুগীয় মানুষগুলো। চলবে

আরো পড়ুন : কালাপানির কেচ্ছা ।। পর্ব ০৯

//জেডএস//
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ছেলের মৃত্যুর ৪ দিনের মাথায় চলে গেলেন বাবা, গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া
ছেলের মৃত্যুর ৪ দিনের মাথায় চলে গেলেন বাবা, গ্রামজুড়ে শোকের ছায়া
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গাজা ও ইউক্রেনে যুদ্ধ বন্ধে যুক্তরাজ্যের সঙ্গে কাজ করতে চায় বাংলাদেশ: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
অনেক নার্ভাস ছিলেন সাইফউদ্দিন
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
বকশিবাজার মোড়ে বাসের ধাক্কায় পথচারী নিহত
সর্বাধিক পঠিত
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
মুক্তি পেলেন মামুনুল হক
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
যশোরে আজ সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
২৫ জেলার সব মাধ্যমিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা শনিবার বন্ধ
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
কেমন থাকবে আগামী কয়েকদিনের আবহাওয়া?
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা
নদীতে ধরা পড়ছে না ইলিশ, কারণ জানালেন মৎস্য কর্মকর্তা