X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১
হারুকি মুরাকামি

আমার চরিত্রগুলোর উৎস কোথায় ।। শেষ পর্ব

অনুবাদ : সাজিদ উল হক আবির
০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১৩:২৪আপডেট : ০৩ ডিসেম্বর ২০২২, ১৩:২৭

আমার উপন্যাস কাফকা অন দ্য শোরের মাঝপথে এসে আমি যখন নামপুরুষে লেখা শুরু করি, উপন্যাসের উদ্ভট বুড়ো নাকাতা এবং রুঢ় তরুণ ট্রাক ড্রাইভার হোশিনোর চরিত্রদুটো তৈরি করতে গিয়ে হাঁফ ছেড়ে বাঁচি। এই নামপুরুষে লেখা অংশটুকুর ক্ষেত্রে আমি নিজেকে ভাগ করে ফেলে বাহ্যিক একজন মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিতে উপন্যাসের বিষয়বস্তুর ওপর দৃষ্টিপাত করতে সক্ষম হই, বিশেষ করে এইজন্যে যে- যেন আমি আমার ব্যক্তিসত্তাকে ভাগ করে ফেলার মাধ্যমে তৃতীয় কোনো মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকেও বিশ্বাস এবং ব্যবহার করতে পারি- উপন্যাসের বয়ানে। ফলশ্রুতিতে আমার উপন্যাস বয়ানের কৌশল নানা জটিল ভাগে ছড়িয়ে পড়ে নানা পথে।

এ কথা শুনে অনেকে এও বলে যে -"তাই যদি হয়ে থাকে, তবে আপনি আরও আগে কেন উত্তমপুরুষ থেকে নামপুরুষে উপন্যাস রচনার চেষ্টা করলেন না? তাহলে আপনি আরও দ্রুতগতিতে ঔপন্যাসিক হিসেবে উন্নতি করতে পারতেন,"কিন্তু আমি আসলে এতো সহজে বদলগুলো আনতে পারি না। ব্যক্তিগত জীবনেও আমি পরিবর্তন পছন্দ করি না, আর আমার উপন্যাস লেখার কৌশল পরিবর্তন আমার কর্মপন্থাকে মৌলিকভাবে বদলে দেয়ারই নামান্তর। এই ধরনের রুপান্তরের জন্য আমার উপন্যাস রচনার কিছু সুনির্দিষ্ট কৌশল এবং একই সঙ্গে শারীরিক সক্ষমতা অর্জনেরও প্রয়োজন ছিল। এ কারণেই আমি পরিবর্তনটা দ্রুত গতিতে আনতে পারিনি, ধীরে ধীরে ধাপে ধাপে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেছি, প্রত্যেক ধাপকে নিবিড় পর্যবেক্ষণের মাঝে রেখে। অবশেষে ২০০০ সালের শুরুর দিকে যখন আমি এই নতুন কৌশলে উপন্যাস রচনার সক্ষমতা অর্জন করলাম, এবং সক্ষম হলাম আমার উপন্যাসগুলোকে নিয়ে আরও নতুন নতুন অনাবিষ্কৃত দিগন্ত উন্মোচনের, এটা ছিল প্রায় নিজের স্বাধীনতা অর্জনের মতো এক অভিজ্ঞতা। যেন আমাকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে রাখা এক দেয়াল ধীরে ধীরে অদৃশ্য হয়ে গেলো।

একজন ঔপন্যাসিককে তার উপন্যাসের চরিত্রগুলো এমনভাবে নির্মাণ করতে হয় যাতে করে পড়লে মনে হবে যে তারা বাস্তব দুনিয়ার অংশ, এবং একই সঙ্গে দারুণ আকর্ষণীয়। তাদের কথা, আচার আচরণ হতে হবে সাধারণ্যের চে' ভিন্ন। যে উপন্যাসের চরিত্রগুলো গড়পড়তা মানুষের মতোই কথা বলে এবং কাজ করে- সে উপন্যাস পাঠককে টানে না। অনেকেই আবার এ মতবাদেরও অনুসারী যে- যেই উপন্যাসের চরিত্রগুলো সাধারণ হয়, এবং সাধারণ্যের মতোই কথা বলে ও আচরণ করে সে উপন্যাসগুলোই প্রকৃতপক্ষে অসাধারণ, কিন্তু (আমার ব্যক্তিগত পছন্দ অনুযায়ী) আমি আসলে এই ধরনের বইয়ের প্রতি আকৃষ্ট হই না।

উপন্যাসের একটি চরিত্রের বাস্তব, মন্ত্রমুগ্ধকর, সাধারণ্যের অনুমানের বাইরে হবার পাশাপাশি চরিত্রটি উপন্যাসের গল্পকে সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে কতটুকু সাহায্য করলো- আমার মতে এ ব্যাপারটাও বিবেচনায় রাখা জরুরী। নিঃসন্দেহে চরিত্রগুলো তৈরি হয় একজন লেখকের হাতেই, কিন্তু সাহিত্যিক বিবেচনায় সে চরিত্রগুলোই জীবন্ত হয়ে ফুটে ওঠে, যারা লেখকের নিয়ন্ত্রণের বাইরে বেরিয়ে গিয়ে স্বাধীনভাবে আচরণ করে। আমিই একমাত্র লেখক নই যিনি এমনটা বোধ করেন। বরং ব্যাপারটা এমন না হলেই উপন্যাস লেখাটা এক কঠিন যন্ত্রণাদায়ক অভিজ্ঞতায় পরিণত হয়। যদি উপন্যাস সঠিক রাস্তায় থাকে, তবে তার চরিত্রগুলো নিজস্ব জীবনলাভ করে, গল্প নিজের মতো গড়গড়িয়ে এগিয়ে চলতে থাকে, ঔপন্যাসিক নিজেও মানসিকভাবে খুব শান্তিতে থাকেন, কারণ তার দায়িত্ব তখন থাকে কেবল তার সামনে যা কিছু ঘটে চলেছে স্রেফ তাদের লিপিবদ্ধ করা। কখনও কখনও একটা চরিত্র নিজেই লেখকের হাতে ধরে তাকে সামনে এগিয়ে নিয়ে চলে, এমন গন্তব্যের দিকে- যার ব্যাপারে লেখক হয়তো শুরুতে মোটেই ওয়াকেফহাল ছিলেন না।

আমি উদাহরণ দিতে চাই এমন একটি উপন্যাসের, যার জাপানি ভাষায় লেখা প্রথম পাণ্ডুলিপিটা আমি শুরুতে ধরে নিয়েছিলাম যে সর্বোচ্চ ৬০ পাতা লম্বা হবেঃ কালারলেস টিসুকুরু তাজাকি অ্যান্ড হিস ইয়ার্স অফ পিলগ্রিমেজ নামের সে উপন্যাসে সারা কিমোতো নামে একটি চরিত্র থাকে। উপন্যাসটির সারাংশ এরকমঃ উপন্যাসের প্রধান সে চরিত্র, টিসুকুরু তাজাকির নাগোয়ায় কাটানো হাইস্কুল জীবনে চারটি খুব ভালো বন্ধু থাকে, যারা হঠাৎ একদিন তাজাকিকে বলে যে তারা তাজাকির সঙ্গে আর কখনোই কোনরকমের যোগাযোগ রাখতে চায় না। এবং এই সিদ্ধান্তের পেছনে কোনো কারণও তারা তাজাকিকে জানায় না। পরবর্তীতে সে টোকিওর একটা ইউনিভার্সিটি থেকে গ্রাজুয়েশন শেষ করে, এক রেলওয়ে কোম্পানিতে চাকরি নেয়, উপন্যাসের গল্প যখন শুরু হয়, তখন তার বয়স ৩৬। সবচে ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের তার সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়ার ব্যাপারটা তাকে গভীরভাবে আহত করে, কিন্তু সে তার কষ্ট চেপে রেখে নিরবচ্ছিন্ন শান্তিময় একটি জীবন-যাপন করতে শিখে যায় ততদিনে। তার চাকরি জীবন থাকে সুন্দর, কর্মক্ষেত্রে মানুষজনের সঙ্গেও থাকে ভালো বনিবনা, এছাড়াও জীবনে এ পর্যায় পর্যন্ত তার প্রেমের সম্পর্কও হয় বেশ কয়েকজন রমণীর সঙ্গে, যদিও তাদের কারো সঙ্গেই তার খুব গভীর কোনো বন্ধন থাকে না। ঠিক এ পর্যায়ে এসে তার সারার সঙ্গে পরিচয় হয়, যে বয়সে তার চে' দু'বছরের বড়। তারা ডেট করা শুরু করে।

একদিন হুট করেই তাজাকি সারাকে তার সেই চারজন হাইস্কুল বন্ধুদের কথা বলে। সারা বিষয়টি নিয়ে ভাবে, এবং তাজাকিকে বলে যে তার নাগোয়া গিয়ে খুঁজে বের করা উচিৎ যে ১৬ বছর আগে কি এমন ঘটেছিল যার ফলশ্রুতিতে সে সম্পর্কচ্যুতি ঘটেঃ "তুমি যা দেখতে চাইছ, সেটা দেখবার জন্য ফিরে যাওয়া নয়; বরং যা তোমাকে দেখতে হবেই, তার জন্য ..."

সত্যি বলতে, সারা চরিত্রটির মুখ দিয়ে এ সংলাপ বেরিয়ে আসার আগে তাজাকির যে পুনরায় তার কৈশোরের শহরে ফিরে গিয়ে বন্ধুদের খুঁজে বের করা উচিৎ- এ চিন্তা লেখক হিসেবে আমার দূরতর কল্পনাতেও ছিল না। আমার পরিকল্পনা ছিল সে শান্ত সমাহিত রহস্যময় এক জীবন কাটিয়ে দেবে- কখনো বন্ধুদের সঙ্গে তার বিচ্ছেদের কারণ উৎঘাটন ছাড়াই- এরকম পটভূমিতে একটা ছোটগল্প লেখা। কিন্তু সারার ও কথা বলার পর (আমার ভূমিকা এক্ষেত্রে সারার মুখ দিয়ে স্রেফ ঐ লাইনটা বের করা ছাড়া আর কিছু ছিল না, প্রাথমিকভাবে), আমি তাজাকিকে প্রথমে নাগোয়ায় এবং শেষমেশ ফিনল্যান্ড পাঠাতে বাধ্য হই। তাছাড়া আমার সেই চারবন্ধুর চরিত্রগুলোকেও পরে আরও নতুন করে ঝেড়েমুছে তৈরি করা লাগে, এটা প্রদর্শন করার জন্য যে তারা আসলে কেমন ছিল। তাদের জীবনের খুঁটিনাটি নানা বর্ণনাও আমার তৈরি করা লাগে।

কাজেই, প্রায় চোখের পলকে সারার একটি বক্তব্য আমার গল্পের পথ, প্রকৃতি, সম্ভাবনা, এবং কাঠামোকে বদলে দেয়। ব্যাপারটা ছিল আমার জন্য ঘোরতর বিস্ময়কর। চিন্তা করে দেখলে, আসলে সে কথাটা যতটুকু না গল্পের নায়ককে বলেছিল, ঠিক ততোটুকুই সে গল্পকার, তথা আমাকেও বলেছিল। "তোমাকে আরও লিখতে হবে এ বিষয়ে," সে যেন বলেছিল আমাকে। "এই গল্পের পৃথিবীতে পা রেখেছ তুমি, তোমার যথেষ্ট শক্তি আছে গল্পটিকে সামনে টেনে নিয়ে যাওয়ার।" কাজেই সারা ছিল আমারই সত্তার অপর এক অংশ, আমারই এক অবচেতন চেতনা যে আমাকে বলছিলে যেখানে পরিকল্পনা করেছি, সেখানেই হুট করে থেমে না যেতে। সে বিবেচনায় কালারলেস টিসুকুরু তাজাকি অ্যান্ড হিজ ইয়ার্স অফ পিলগ্রিমেজ আমার জন্য ছোটখাটো কোনো বিষয় নয়। আনুষ্ঠানিকভাবে এটাকে একটি বাস্তব প্রেক্ষাপটে রচিত উপন্যাস বলা চলে, কিন্তু তবুও এরমাঝে অনেক সূক্ষ্ম প্রতীকী বক্তব্য মূল স্রোতের নীচে চোরাস্রোত হিসেবে খুঁজে পাওয়া সম্ভব।

কাজেই আমার উপন্যাসের চরিত্রগুলোই আমাকে, অর্থাৎ তাদের লেখক/স্রষ্টাকে অনুপ্রাণিত করে গল্প সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে। এটা আমি গভীরভাবে অনুভব করেছি যখন আমি উপন্যাস 1Q84 এ আওমামি চরিত্রটির কাজ ও বক্তব্য তৈরি করছিলাম। পেছনে তাকালে আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করি, বেশীরভাগ সময়ই আমার জন্য পুরুষ নয়, বরং নারী চরিত্রগুলো আমাকে পথ দেখিয়েছে, সামনে টেনে নিয়ে গিয়েছে। কি কারণে এমনটা হয়েছে, আমার তা জানা নেই।আমি যেটা বলতে চাইছি, তা হল- যখন একজন ঔপন্যাসিক একটি উপন্যাসের জগত তৈরি করতে থাকে, তখন সেই উপন্যাসও উল্টোভাবে ঔপন্যাসিককে নিজের মতো করে নির্মাণ করতে থাকে।

আমাকে সময়ে সময়ে এই প্রশ্নও করা হয়েছে যে- "আপনি আপনার নিজ বয়সী চরিত্রদের নিয়ে কেনো উপন্যাস লেখেন না?" আমি যেহেতু মাঝবয়সী নই মোটেই, কাজেই প্রশ্নটি হল, কেন আমি বুড়ো মানুষজনদের নিয়ে লিখি না? উত্তর হচ্ছে, এটা আমার বুঝে আসে না যে, কেন একজন লেখককে তার সমবয়সী লোকজনদের নিয়ে লিখতে হবেই। কেন ব্যাপারটাকে সবাই এতো স্বাভাবিক করে দেখাতে চায়? আগেই বলেছি, আমার উপন্যাস লিখবার এক মুখ্য কারণ হল, আমি যে চরিত্র হতে মন চায়, উপন্যাস লেখার ছলে সে চরিত্রে পরিণত হতে পারি। এই অসাধারণ সুযোগ আমি ছেড়ে দেবো কেন?

যখন আমি কাফকা অন দা শোর লিখছিলাম, তখন আমার বয়স পঞ্চাশ ছাড়িয়েছে মাত্র, তবুও আমি উপন্যাসের প্রধান চরিত্র হিসেবে বেছে নিই পনেরো বছর বয়সের এক ছেলেকে। উপন্যাসটি লিখবার পুরো সময় জুড়ে আমি পনেরো বছর বয়স্ক এক ছেলের মতোই অনুভব করেছি। অবশ্য সেই পনেরো বছর বয়স্ক ছেলে এই যুগের পনেরো বছর বয়স্ক ছেলে নয়। বরং আমার বয়স যখন পনেরো ছিল, আমার তখনকার মানসিক অবস্থাকে আমি প্রবাহিত করে দিয়েছি উপন্যাসের কাল্পনিক "বর্তমান" এ। তবুও, উপন্যাসটি লিখবার সময় আমি আমার পনেরো বছর বয়সকালের সমস্ত অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে পুনরায় যেতে পেরেছি। লিখবার ক্ষমতার দ্বারা আমি সেই বয়সের আবেগ অনুভূতি, যা দীর্ঘদিন ধরে আমার মাঝে চাপা পড়েছিল, তাদের ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হয়েছি। এটা ছিল এক অসাধারণ অভিজ্ঞতা। এমন এক অভিজ্ঞতা, যার ভেতর দিয়ে কেবল ঔপন্যাসিকদেরই যাওয়া সম্ভব হয়।

তবে আমি একাকীই যদি এসমস্ত আনন্দময় অভিজ্ঞতার স্বাদ নিই, তবে তো সেটা সাহিত্যকর্ম বলে বিবেচিত হবে না। এটাকে এমনভাবে সাজিয়ে গুজিয়ে উপস্থাপন করা লাগবে যেন পাঠকও সে স্বাদ নিতে সক্ষম হয়। এ কারণেই আমি ৬০ বছর বয়স্ক চরিত্র নাকাতাকে এ উপন্যাসে প্রবেশ করাই। নাকাতা সে হিসেবে আমার সত্তার অপর এক অংশ, আমারই ছায়া প্রক্ষেপণ। সমান্তরাল দুই পৃথিবীতে কাফকা এবং নাকাতা একে অপরের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে ভিন্ন ভিন্ন কাজ করে চলেছে- এই ব্যাপারটা উপন্যাসে এক স্বাস্থ্যকর ভারসাম্য এনে দেয়। অন্তত উপন্যাসটি লিখবার সময় আমি এই ভারসাম্য অনুভব করতে পেরেছি, এবং এখনো আমি এ ব্যপারে নিশ্চিত।

ভবিষ্যতে কখনো হয়তো আমি আমার সমবয়সী এক মুখ্য চরিত্রকে উপজীব্য করে একটি উপন্যাস লিখবো, তবে এই মুহূর্তে আমি তার কোনো অকাট্য প্রয়োজন অনুভব করছি না। উপন্যাস লিখবার ক্ষেত্রে সবার আগে আমার মাথায় একটা আইডিয়া ভেসে ওঠে। তারপর, সে আইডিয়ার সূত্র ধরে আমার উপন্যাসের শাখা প্রশাখা বিস্তৃত হয়। যেমনটা আমি শুরুতেই বলেছি, উপন্যাসের গল্পই নির্দিষ্ট করে দেয় যে তাতে কি কি চরিত্র লাগবে না লাগবে। লেখক হিসেবে আমার দায়িত্ব হল এক নির্ভরযোগ্য অনুলিপিকারকের মতো শুধু সে পথ অনুসরণ করে চলা।

গল্পের প্রয়োজনে কখনো আমি পরিণত হই ২০ বছর বয়সী এক লেসবিয়ান, তথা সমকামী নারীতে। কখনো পরিণত হই ৩০ বছর বয়সী বেকার ঘরজামাইয়ে। যে সাইজের জুতোই আমাকে দেয়া হয়, আমি তাতে পা গলাই, তাতে নিজের স্বাচ্ছন্দ্য তৈরি করে নেবার চেষ্টা করি, সেটা পরেই কাজ করা আরম্ভ করি। এটাই লেখক হিসেবে আমার কর্মপন্থা। আমি আমার পায়ের সাইজ অনুযায়ী জুতো খুঁজি না। বাস্তবে এভাবে কাজ করাও সম্ভব না, তবে যদি বছরের পর বছর ধরে উপন্যাস লেখার কাজটি নিয়ে আপনি কসরত করতে থাকেন তাহলে হয়তো এক পর্যায়ে এসে সে দক্ষতা জন্ম নেয়। যাইহোক, দিনশেষে আমাদের কারবারটাই কল্পনার জগত নিয়ে। আর কল্পনার জগতের সঙ্গে সাযুজ্য খুঁজে পাওয়া যায় স্বপ্নের সঙ্গে। স্বপ্নের জগত- তা সে ঘুমের ঘোরেই সৃষ্টি হোক, বা জেগে থাকা অবস্থায়, সে জগতে কি ঘটবে না ঘটবে, তার ওপর আমাদের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আমিও সেভাবে স্রোতের টানে ভেসে ভেসেই এগোই। আর যতক্ষণ আমি স্রোতের সঙ্গে ভাসতে থাকি, আমার পক্ষে সম্ভব হয় স্বাধীনভাবে এমন সব কাজ করার যা বাস্তবে অসম্ভব মনে হয়। এটাও, ঔপন্যাসিক হবার আরও এক বিশেষ আনন্দ।

কাজেই যতবার আমাকে আমি আমার সমবয়সী চরিত্রদের মুখ্যচরিত্রের জায়গায় স্থাপন করি না কেন- এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়, আমি এভাবে উত্তর দেয়ার চেষ্টা করি। তবে এটাও ঠিক যে, আমার উপর্যুক্ত ব্যাখ্যা বেশ লম্বা, এবং সবাই যে বুঝবে আমি সেটাও আশা করি না, কাজেই অনেক সময় আবার আমি একটা ভাসাভাসা উত্তর দিয়ে দায় সম্পন্ন করি। আমি হেসে উত্তর করি যে- "ভালো প্রশ্ন করেছেন। লিখবো হয়তো সামনে কোনো একদিন।" সত্যি বলতে নিজের বর্তমান অবস্থানকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে নৈর্ব্যক্তিক ও নিখুঁতভাবে পর্যবেক্ষণ করা খুব-খুব কঠিন একটা কাজ। হয়তো এই কারণেও আমি নিজের পায়ের মাপ বাদ দিয়ে অন্য সমস্ত সাইজের জুতোতে পা গলাই। এর মাধ্যমে আমি আরও বিস্তৃত উপায়ে নিজেকে আবিষ্কার করতে সক্ষম হই, অনেকটা ত্রিকোণমিতির সূত্র প্রয়োগে জ্যামিতিক উপায়ে অবস্থান নির্ণয় করার মতো।

এখনো আমার মনে হয়, আমার উপন্যাসের চরিত্রগুলির ব্যাপারে আমার অনেক কিছু জানা, শেখা বাকি। একই সঙ্গে আমার উপন্যাসের চরিত্রগুলো থেকেও আমার ব্যক্তিগতভাবে অনেক কিছু শেখা বাকি। ভবিষ্যতেও আমার লক্ষ্য থাকবে আমার উপন্যাসের মাধ্যমে আরও অনেক অদ্ভুত, এবং রঙিন চরিত্রের মাঝে প্রাণ সঞ্চার করা। প্রতিবার নতুন একটি উপন্যাসের কাজে হাত দেয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমি উত্তেজনা বোধ করি এই চিন্তা করে যে- কে জানে কি ধরনের চরিত্রের সঙ্গে আমার এ যাত্রা দেখা হতে যাচ্ছে!

(হারুকি মুরাকামির অফিশিয়াল ফেসবুক পেইজে শেয়ার করা এ লেখাটি ২০২২ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিতব্য গ্রন্থ নভেলিস্ট অ্যাজ এ ভোকেশন বইয়ের একটি অধ্যায়ের ইংরেজি অনুবাদ থেকে বঙ্গানুবাদ। ইংরেজি অনুবাদ করেছেন ফিলিপ গ্যাব্রিয়েল এবং টেড গসন।)  

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ভোট গণনা প্রক্রিয়ায় কোনও পরিবর্তন হবে না: ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
ঘোড়াঘাটে মালবোঝাই দুই ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে ২ জন নিহত
নির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
শনিবার জাতীয় পার্টির বর্ধিত সভানির্বাচনের সময় জাপায় কী হয়েছিল, জানাবেন জিএম কাদের
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
১০ কোটি টাকা অনিয়মের অভিযোগে অগ্রণী ব্যাংকের ৩ কর্মকর্তা আটক
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
খুলনায় এযাবৎকালের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ