[বিস্মিতি— সব মানুষই অগস্ত্য মুনি। একবার গেলে আর ফেরে না।]
আরতি
মূর্ছাভঙ্গের পর, মাধবী দেয়ালে হেলান দিয়ে বসে আছে। তার চোখেমুখে অভিভূতি আর বিস্মিতি প্রকট হয়ে ফুটে আছে; একটা মানুষ ছাই হয়ে গেল! নাই হয়ে গেল! মাঝে থেকে, থেকে গেল মাধবী ছাইপ্রধান পৃথিবীতে, নাইপ্রধান পৃথিবীতে।
[ঊরুনদীর ঢেউ শেষ। ভুরুনদীর ঢেউ শুরু।]
মানুষ ইচ্ছেমূলকভাবে কৃপণ জীব। মানুষ কিছুই খরচ করতে চায় না; সবকিছুই ধরে রাখতে চায়। সে তার রূপলাবণ্যকে, যৌবনকে ধরে রেখে দিতে চায়। টাকা পয়সা ধনদৌলত জমিয়ে রেখে দিতে চায়।
কিন্তু মানুষ বাধ্যতামূলকভাবে খরুচে জীব। সবকিছুই তার খরচ হয়ে যায়। হঠাৎ এমন অসুখে বা বিপদে পড়ে গেল যে, তার সব টাকা পয়সা শেষ হয়ে গেল; ধনপতি পেয়ে গেল ভিখারির দশা।
মানুষ তার দেহ-ভাণ্ডে রূপ মজুত করে রাখতে পারে না, যৌবন মজুত করে রাখতে পারে না, শক্তি মজুত করে রাখতে পারে না। অনেক সময় টাকা পয়সার মজুত তহবিল হয়তো থেকে যায়; টাকা পয়সার মজুতদারি হয়তো করা যায় কিন্তু রূপ যৌবন শক্তির মজুতদার কখনোই হতে পারে না মানুষ। এগুলো ধীরে ধীরে খুলে পড়েই দেহ থেকে। রূপলাবণ্যের বন্য ডানা আছে; যৌবনের বন্য ডানা আছে; উড়ে পালাবেই কোনোমতেই পোষ মানে না।
মানুষ হঠাৎ একদিন খেয়াল করে; আরে দেহে শক্তি কই, রূপ কই, যৌবন কই?
রূপকূপ, শক্তিকূপ কীভাবে শুকিয়ে গেল?
কোথায় কোন কাজে এগুলো খরচ হয়ে গেল?
হাহাকার আর হা-হুতাশের বাতাস তার হৃদয় দখল করে নেয়। সে তার টাকাপয়সার দিকে, সোনারুপার দিকে, জমিজিরাতের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায়। টাকাপয়সা তার দিকে তাকিয়ে হি-হি করে হাসে। ধনসম্পদ তার দিকে তাকিয়ে হো-হো করে হাসে। মাটি-বসতবাটী তার দিকে তাকিয়ে হা-হা করে হাসে। গয়নাগাটি পোশাকআশাক খিলখিল করে হাসে। গাছপালা, আকাশবাতাস, জল মাটি, শেয়াল কুকুর পোকামাকড় সবাই একসাথে নানা ভঙিমায় হাসে। সোনাদানাকে আগুনের লকলকে জিহ্বা মনে হয়, মাটিজমিকে মনে হয় গোরস্থানের তিনহাত। রূপ যৌবন শক্তিকে মনে হয় সেই মুগ্ধকর বন্ধু বা বউ বা স্বামী বা ভাই যে বা যারা বিশ্বাসঘাতকতা করে সব মধু চুষে নিয়ে ছেড়ে চলে গেছে। মানুষই মানুষের জন্য বিশ্বাসঘাতক, মানুষই মানুষের জন্য আশ্বাসঘাতক, মানুষই মানুষের জন্য নিঃশ্বাসঘাতক; কিন্তু তার চেয়ে আরো বড়ো ঘাতক নিজেরই শরীর, শরীরের অঙ্গ আর তার লাবণ্য। তবু এই ভাইবেরাদারদের, বউ-স্বামী-বন্ধুদের কেউ কখনো ফিরে আসতে পারে কিন্তু রূপ-যৌবন চলে গেলে আর কোনোভাবেই ফেরে না।
প্রৌঢ় আর বৃদ্ধ মানুষ বিশ্ব ছেড়ে নতুন এক বিশ্বে প্রবেশ করে— স্মৃতিবিশ্বে। স্মৃতিবিশ্বে স্মৃতি ছাড়া আর কিছু নেই। প্রৌঢ় আর বৃদ্ধ মানুষের শেষ শ্বাসটি পর্যন্ত খরচ হয় নিজের শক্তি আর রূপের বিরহে বিলাপ করতে করতে।
অন্যসকল বিরহজ্বালা থেকে মুক্তি পায় মানুষ কিন্তু এই বিরহ থেকে মুক্তি নেই। তরুণ তরুণীর জন্য বা তরুণী তরুণের জন্য যে বিরহব্যথা পায় সেটা প্রকৃতপক্ষে তরুণের জন্য তরুণীর বা তরুণীর জন্য তরুণের নয়; এ বিরহ আসলে নিজেরই ভোগ বঞ্চিত/বঞ্চিতা হবার বিরহ। বয়সীদের বিরহ দেখলেই ব্যাপারটা আরো ভালো করে বোঝা যায়; বয়স্ক-বয়স্কারা বিরহযাপন করে নিজের চলে যাওয়া যৌবনের জন্য; সঙ্গীর জন্য বা সঙ্গীর যৌবনের জন্য নয়।
এসব ব্যাপার বাদ দিলেও আরো করুণ ব্যাপার আছে মানুষের জীবনে; এক শরীর আরেক শরীরের মুখস্থ হয়ে যাওয়া। নারীর স্তন, নারীর যোনী, নারীর নিতম্বের দোল, নারীর রূপ একদিন পুরুষের মুখস্থ হয়ে যায় তখন আর তাকে ভালো লাগে না। সে যতই পদক পাওয়া সুন্দরী হোক না কেন!
পুরুষের শরীরের গঠন, সৌন্দর্য, শরীরের শক্তি, শিশ্নের ঘাত, শুক্রের গন্ধ যখন মুখস্থ হয়ে যায় তখন নারীরও তাকে আর ভালো লাগে না। মানুষ তার শরীরের জন্য নতুন শরীরের মানুষ চায়। নতুন শরীরের জন্য টান মানুষের সীমাহীন। শরীরের কাছে শরীর পুরাতন হয়ে গেলে একঘেয়েমি চলে আসে।
তবে পাহাড়বৎ একঘেয়েমি নিয়েও কি থাকে না বহুকাল পর্যন্ত অনেক সংসার? থাকে তো। চাপে থাকে। সামাজিক-ঈশ্বর বলে একটা কথা আছে তারই চাপে থাকে। মানুষ ধর্মের ঈশ্বরকেও অনেক সময় অমান্য করতে পারে, অস্বীকার করতে পারে। কিন্তু সমাজরূপ ঈশ্বরকে সহজে অমান্য-উপেক্ষা করতে পারে না। যদি করে সমাজ ঝাঁপিয়ে পড়ে তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। আর সমাজবিরোধীতা করে যদি টিকে যেতে পারে কেউ কখনো তখনই সেটা ঘটনা হয়ে ওঠে, ইতিহাস হয়ে ওঠে। সেসব ঘটনা মানুষের মুখে মুখে রটে থাকে, বইয়ে বইয়ে চোখ মেলে তাকিয়ে থাকে; ভালো উদাহরণ হয়ে বা খারাপ উদাহরণ হয়ে।
এইসব ঈশ্বর নতুন শরীরের প্রতি নতুন শরীরের টান আটকাতে পারে অনেকসময় কিন্তু মনকে তো আর আটকাতে পারে না। মন ঠিকই আটকানো শরীর থেকে বের হয়ে নতুন শরীরের স্বাদ নেয় নিজের শরীরে; মনে মনে।
পিরিত করে বিয়ে করার পরেও স্বামী-স্ত্রী সংগমকালেও চোখ বন্ধ করে অন্য শরীরের কথা কি ভাবে না?
সিনেমা থিয়েটারে দেখা কোনো নায়ক বা নায়িকার কথা?
পাড়ারই বা পাশের গ্রামের কোনো যুবক বা যুবতির কথা?
সংগুপ্ত এই সুখখেলা সকল দম্পতির ভেতরেই নেই কি?
আরতি ভাবে, আর শরীরকেই বা কতটুকু আটকাতে পারে সামাজিক ঈশ্বর; এত ভয়ভীতির পরেও এ গাঁয়ে কটা নারীপুরুষই বা পাওয়া যাবে যারা স্বস্বামী বা স্বস্ত্রী ছাড়া অন্তত একজন হলেও, একবারের জন্য হলেও অন্য শরীরের সাথে মিলেনি; অন্তত একটা চুমু দেয়নি? শরীরে থাকা যৌবন এমনই এক অবাধ্য জীব; বন্যজীব; এ জীবন কোনো মানুষকেই সুস্থির থাকতে দেয় না; ভূতের মতো দিবসে নিবসে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় শিংয়ের গুতোয়। এ বন্যজীব সকল পুণ্যপ্রীতি, সকল ভয়ভীতি, সকল নরকগীতি, সকল ধর্মনীতি ছিঁড়ে-ফেড়ে ফালাফালা করে দেয়। নিজের ভেতরের শুভবোধ, অশুভবোধ, মানবোধ, অপমানবোধ, দায়বোধ, কর্তব্যবোধ সবকিছুকে পেঁজাতুলার মতো উড়িয়ে দেয়, ভেজাতুলার মতো ফেলে দেয় ভাগাড়ে।
কয়েক মাসের মধ্যেই আরতির রূপযৌবন মধুমৌবন রমজান ডাক্তারের মুখস্ত হয়ে গেল। ফলে তাকে তাড়িয়ে দিল। তবে তাড়ানোতে শুধু রমজান ডাক্তারের হাত ছিল না। তার বড়ো ছেলেমেয়েরাও জোর দিয়েছিল তাকে তাড়িয়ে দেবার ব্যাপারে। রমজান ডাক্তারের সবচে বড়ো ছেলেটাই আরতির সমবয়সী। রমজান ডাক্তারের ছেলেমেয়েদের ভয় ছিল, আরতি মানে মানসুরার গর্ভে কোনো সন্তান জন্মে গেলে সম্পদ-সম্পত্তির অংশভাক বেড়ে যাবে, নতুন সন্তানকে ভাগ দিতে হবে।
নারীর অঙ্গকে উমা বৌদি বলত ‘ঊরুনদী’ আর চোখকে বলত ‘ভুরুনদী’। এসব সে বলেছিল আরো দুবছর আগে যখন নন্দীপাড়ার গোতমি ধরা পড়েছিল একই পাড়ার এক যুবকের সাথে। গোতমিকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। তার স্বামী তাকে গ্রহণ করেনি আর। উমা বৌদি বলেছিল, ‘ঊরুনদীর জলের সুখ শেষে ভুরুনদীর জলের স্রোত শুরু হয়। গোতমি এখন কেঁদে বেড়াবে।’
হয়েওছিল তাই। আরতিরও তাই হলো; ঊরুজাত সুখ বন্ধ হলো; ভুরুজাত জল শুরু হলো; গৃহহীন গ্রহ হয়ে গেল সে।
[নিগ্রহ। গৃহহারা গ্রহ।]
আরতিকে হিন্দুসমাজও গ্রহণ করল না। সে ঘরছাড়া হবার পরেই সমাজের লোকজন বসেছিল পুরারি মুখুজ্জের বৈঠকখানায়। পুরারি মুখুজ্জে হিন্দুসমাজের মোড়ল। বেশিরভাগ লোকজন ছিল খুবই উত্তেজিত। একটা দাঙ্গা দাঙ্গা ভাব; দাঁতভাঙা জবাব দেবার ভাব।
যুবক জোয়ানরা দম্ফ করে লম্ফ দিচ্ছিল কথায় কথায়— ‘মণ্ডলমশাই, আমাদের আজ্ঞা দেন, মুসলমানদের একটা ঠ্যাঙানি দিয়ে আসি, ওরা বহুবারই আমাদের অপমান করে, আমাদের মেয়েদের ভাগিয়ে নিয়ে যায়।’
কোন কোন হিন্দু মেয়েকে নিয়ে গেছে তার একটা ফিরিস্তিও মুখে মুখে দেয় তারা। সাথে সাথে খিস্তি খেউর করে। তারা আরতি আর রমজান ডাক্তারের ব্যাপারটাকে পুরো হিন্দু আর মুসলমানমণ্ডলীর সম্প্রদায়গত ব্যাপার হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করছিল।
কিন্তু উত্তেজনা সবজনার ভেতর কাজ করছিল না; বিবেচনাও কাজ করছিল; বিশেষ করে বয়স্ক লোকজনের ভেতর; তারা বুঝতে পারছিল এই ইউনিয়নে হিন্দু মুসলমান প্রায় সমান সমান হলেও ব্যাপারটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় রূপ নিলে আশেপাশের মুসলমানেরাও যোগ দেবে; পাড়ার পর পাড়া জ্বালিয়ে দেবে; বহু লহু ঝরে যাবে; হিন্দু রক্তে ভিজে যাবে মাটি। তাছাড়া আরতি-রমজানের এ ঘটনার ভেতর ধর্মের কোনো বালাই নাই।
লোকজন কথা বলছিল আর কোনো কথা না বলে চুপচাপ তামার কল্কেতে তামাক খাচ্ছিল পুরারি মোড়ল। এই তামার কল্কে কয়েকপুরুষ ঘুরে তার হাতে পড়েছে। লোকজনের যখন আর কিছু বলার ছিল না তখন তারা পুরারি মোড়লের মুখের দিকে তাকিয়েছিল। তার মুখ থেকে কথার বদলে ধোঁয়া বেরুচ্ছে যেন তার ভেতর কথার ক্ষেতে, কথার খলানে আগুন লেগে গেছে তারই ধোঁয়া বেরুচ্ছে; কথাশস্য পুড়ছে।
পরে, পুরারি মুখুজ্জে সংক্ষেপে বলে— ‘তার তকসির আমাদের শির নিচা করে দেছে এটা ঠিক তবু ঝগড়াফ্যাসাদে দরকার নাই। গোঘাদের দল ভারি। তারচেয়ে ঠাকুরমশাইকে জেনে দেখ, এই জাতিভ্রষ্টার পাপ থেকে পুরো সমাজকে রক্ষার শাস্ত্রবিধি।’
পাড়ার মন্দিরের পুরোহিত অমরেশ্বর চট্টোপাধ্যায়। সে আসে। তার বেশ একটা মনঃক্ষুণভাব থাকে ভেতর ভেতর সবসময়; ঠাকুরপুরোহিতদের আগের মতো কেউ গা করে না; প্রথমেই ডাক পড়ে না; ডাক পড়ে পরে। অন্য সমস্যাও আছে; গাঁয়ের পুরোহিত বলে খুব একটা দামও দেয় না এই মণ্ডলের মণ্ডলীরা; অন্যগ্রামের পুরোহিতদের সাথে ঠিকই মানমর্যাদা দিয়ে, সম্মানসম্ভ্রম দিয়ে কথা বলে। অথচ সে শাস্ত্রজ্ঞানে অন্যকোনো গাঁয়ের পুরোহিত ঠাকুরদের চেয়ে কম নয়। তার গুরু কলকাতার সোমনাথ চৌবে; তিনি চারবেদে সমান দক্ষ; অন্যান্য শাস্ত্রেও পারদর্শী। এখানকার ঠাকুরদের একজনও কি বেদবিদ সোমনাথ চৌবের মতো শাস্ত্রজ্ঞানীর কাছে শিক্ষা পেয়েছে; তার চৌপাঠিতে পাঠ পেয়েছে? বেদবেদাঙ্গ, বেদবেদান্ত শিখেছে?
অমরেশ চাটুজ্জে আসার পর কিছুক্ষণ গম্ভীর হয়ে বসে থাকে; এমনভাবে এবং এমনভাব নিয়ে বসে থাকে, যেন সে নিজেই বেদজ্ঞ সোমনাথ চৌবে। তার চুপে সকলেই চুপ থাকে। একজনের কথায় যেমন অনেকজন কথা বলে ওঠে তেমনভাবে কখনো কখনো একজনের চুপে অনেকজন চুপ করেও থাকে। বেশকিছুক্ষণ পর সে তার চুপ থাকা শেষ করে, যেমনভাবে মানুষ কথা বলা শেষ করে চুপ থাকা শুরু করে। তেমনই একটা শাস্ত্রবেত্তাভাব মুখে মাখিয়ে অমরেশ ঠাকুর কয়েকটা সংস্কৃত শ্লোক আওড়ায়। আওড়ানো শ্লোকের কেউ কিছু না বুঝলেও তার দিকে সবাই শ্রদ্ধা নিয়ে তাকিয়ে থাকে। কেউ কিছু বলে না।
‘এ অপরাধ ক্ষন্তব্য নয়’ বলে প্রথমেই মন্তব্য করে ঠাকুর।
তারপর যুবকদের দিকে তাকিয়ে বলে— ‘সবচে ভালো হতো যদি পাপাশয় রমজান ডাক্তার আর আরতিকে যমদণ্ড দেয়া যেত। এটাই শাস্ত্রবিহিত এ কিন্বকর্মের শাস্তি।’
পুরারি মোড়ল ঠাকুরের দিকে ঠান্ডা চোখে তাকায় শুধু; সে চুপ ছিল। এখনো চুপ রইল কিন্তু চুপের ভেতর যে কথা বলে দিল অমরেশ ঠাকুরকে তার ভার বহন করা ঠাকুরের জন্য কঠিন। মোড়লের ঠান্ডা চোখ দেখে অমরেশ্বর ঠাকুর একটু ভ্যাবাচাকা খায়; তার সেই গম্ভীরভাব উবে গেল ভেতর ভেতর; তবু মুখের ওপর গম্ভীরতার ঠাটটা বজায় রাখার চেষ্টা করে; বলে— ‘যেহেতু সে উপায় নাই সেহেতু এখন পাপীয়সী আরতিকে মৃত বলে ঘোষণা দিতে হবে; তার ব্যবহৃত সকল বেশবাস শ্মশানঘাটে নিয়ে পুড়িয়ে ফেলতে হবে; শাস্ত্রানুমতে মৃতের জন্য যেমন শ্রাদ্ধ করতে হয় তেমনই শ্রাদ্ধ করতে হবে। পরে মন্দিরে সকলে সমবেত হয়ে আমরা পাপযোগ থেকে সমাজকে রক্ষাকল্পে রক্ষামন্ত্র পাঠ করব; পাঁজিপুঁথি দেখে শুভদিনে শুভলগ্নে রক্ষাকালী মায়ের পূজা দেব। আরতি যদি কখনো ফিরেও আসে তাকে প্রেতিনিবৎ তাড়িয়ে দিতে হবে; সমাজে নেওয়া যাবে না; কোনো সাহায্য করা যাবে না। জীবিতা হিসেবে তার নাম মুখেও নেওয়া যাবে না।’
শেষ পর্যন্ত তাই হলো। শ্রাদ্ধিক সবকিছু হয়েছে। সমাজের সংস্ক্রিয়া করে নিয়েছে; সমাজকে রক্ষা করে নিয়েছে তারা। আরতি হিন্দুদের চোখে এখন মৃত আর নরকস্থ আত্মা। শাস্ত্রের ধার বড়ো নির্মম। কেটে যায় মানুষ।
[জীব: যে জড় নড়ে। জড়: যে জীব নড়ে না।]
আরতির কলির সন্ধ্যা শুরু হয়ে গেছে। সে কেঁদে কেঁদে পথেঘাটে ঘুরে বেড়াতে লাগল। শুধু সন্ধ্যা হলে ফিরে আসে আর ইউনিয়ন পরিষদের পরিত্যক্ত বিল্ডিংয়ের বারান্দায় শুয়ে থাকে। শুয়ে শুয়ে সন্ধ্যাতারা দেখে, চাঁদ দেখে। চাঁদের মুখে একদিন নিজের মুখ দেখতে পেত আরতি।
আকাশে মুখচাঁদ সে নিজে দেখেনি, কথার জাদু দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিল রমজান ডাক্তার— ‘চাঁদের দিকে চেয়ে দেখ, চাঁদের মুখে তোমার মুখ।’
আরতি চাঁদের দিকে তাকিয়ে সত্যি সত্যি দেখতে পেয়েছিল; আয়নাতে গিয়ে নিজের চোখে দেখেছিল চাঁদ। এখন চাঁদের মুখে আর তার মুখ নেই, চাঁদের মুখে অন্যকারো মুখ, যে মুখকে হয়ত শিকার করেছে আবার রমজান ডাক্তার।
মানুষ তো দুরকম— মধুজিহ আর বিষজিহ। এর মধ্যেই যে আরেকধরনের জিহ্বাওয়ালা মানুষ থাকতে পারে তা তার জানা ছিল না। এরকম মানুষও আছে যারা তাদের জিহ্বাকে হাতের মতো উল্টে নিতে পারে; হাতের চেটোর দিক একবার ওপরে একবার নিচে যেমন করা যায় তেমন তারা জিহ্বাকে ঘুরিয়ে নিতে পারে। রমজান ডাক্তারকে সে মধুজিহ মানুষ মনে করেছিল। কিন্তু সে জিহ্বা উলটানো মানুষ। মধুজিহকে ইচ্ছেমতো বিষজিহ করতে পারে। নাগরপনা করার আগে তার জিহ্বা মধু, খায়েস মিটে গেলেই বিষ।
শ্রীদামই ছিল প্রকৃত মধুজিহ মানুষ। কোনোদিন বকা দিলেও তার বকাও ছিল মিঠে; তার বকুনিও ছিল বকুলফুলের মতো নরম। আরতি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে; মানুষ দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে ফুসফুস থেকে কিন্তু আরতি দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে একেবারে ভেতর থেকে— মাংসের ভেতর থেকে, হৃৎপিণ্ডের ভেতর থেকে, হাড়ের ভেতর থেকে, মজ্জার ভেতর থেকে। দীর্ঘশ্বাসের সাথে সব বেদনা বের করে দিতে চায়; দীর্ঘশ্বাস বের হয় বেদনা বের হয় না।
আরতি ইউনিয়ন পরিষদের পুরাতন আধভাঙা বিল্ডিংয়ের বারান্দায় শুয়ে আছে। একটু দূরেই নতুন বিল্ডিং। নতুন বিল্ডিংয়ের দেয়ালে দেখতে পেল একটা টিকটিকি একটা তেলাপোকার দিকে নরম পায়ে ভয়ংকর মনোভাব নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে; কিন্তু তেলাপোকা নড়ছে না যেন সে ভয়ডর শূন্য। কিন্তু আসলে পোকাটা ভয়শূন্য নয়; সে ভয়াবহ পরিস্থিতিটা আঁচ করতে পারছে না। জানতে না পারা, আঁচ করতে না পারা, বুঝতে না পারাটাই মরণমুখী জীবকে জীবনমুখী করেছে। তেলাপোকাটা এখন পর্যন্ত শুঁড় নেড়ে নেড়ে ভেবে চলেছে তার ভাবী পরিকল্পনা কিন্তু সে বুঝতে পারছে না আর মাত্র মুহূর্ত তার আয়ুকাল একটা মাত্র ছোঁয়ের অপেক্ষা।
টিকটিকি শুধু জানে আর উপলব্ধি করে তাকে খেতে হবে কিন্তু যাকে খাবে তার ব্যথা কেমন হবে তা জানে না; উপলব্ধি করতে পারে না। উপলব্ধি করতে পারলেও তার কিছু করার নেই। তার দেহের গঠন তেলাপোকাকে ভক্ষণ করা থেকে বিরত রাখতে পারে না, তেলাপোকার দেহের গঠন টিকটিকির ভক্ষণীয় হবারই যোগ্য শুধু আর যোগ্য যতদিন টিকটিকির খাবার না হতে পারছে ততদিন শরীরকে টিকটিকির খাবার উপযোগী করে তোলার জন্য মানুষের ভাঁড়ারে আর ভাগাড়ে খেয়ে বেড়ানো। টিকটিকিরও দেহ পোকাকে ভক্ষণ করার উপযোগী— উপোস-যোগী নয়। টিকটিকি যেদিন তেলাপোকাকে খাবে সেদিনই তেলাপোকার জীবনসার্থক। টিকটিকি যেদিন মাটিতে মিশবে গাছের রস দিতে সেদিন তার জীবন সার্থক। কত জঘন্য জগতের ছক।
ঘৃণায় আরতি টিকটিকির দিক থেকে, তেলাপোকার দিক থেকে তার চোখপোকাকে টেনে নেয়। তার চোখপোকাকে আরেক দেয়ালে হাঁটায়; যদি অন্যদৃশ্য দেখা যায়। তার চোখপোকা সে দেয়ালে মাকড়সার জালে গিয়ে আটকে যায়। আরতি দেখে একটা মাকড়সা বিনারঙের লালাসুতা দিয়ে জাল বুনছে। বিনিরঙের সুতার জাল, আলোরঙের সুতার জাল, জল-রঙের সুতার জাল বুনা শেষে জালের মাঝখানে গিয়ে একটা ছোট্ট একটা পাথরটুকরোর মতো নিশ্চল বসে গেল। জীবমাকড়সা এখন পাথরমাকড়সা, জড়মাকড়সা।
একটা নীল মাছি আরতির পায়ের ওপর বসে আছে আবার উড়ছে আবার বসছে। জীবমাছি। মাছিটার হঠাৎ কী মনে হলো উড়তে উড়তে গিয়ে পড়ল মাকড়সার লালাতন্তুর জালে। জড়মাকড়সা সাথে সাথে জীবমাকড়সা হয়ে গেল। মাছিটা প্রাণপণে পাখনা ঝাপটে বের হতে চাইল। লালাসুতা মাছিটাকে জড়িয়ে-জাপটে ধরে রাখল। বাতাসে পেতে রাখা জালে একটা মাছি পড়েছে দেখে জালের মাঝখান থেকে মাকড়সাটা দ্রুত এসে মাছিটাকে আরো শক্ত করে লালাপাশে জড়িয়ে ফেলল। এখন মাছি পাথর। জড়মাছি। এবার মাকড়সা জীব।
সে আরেকদিকে তার চোখপোকাকে নিয়ে গিয়ে যা দেখে তাতে তার মনে হয় পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি জুড়ে এই একই দৃশ্য। আগে এগুলোকে আলাদা আলাদা দৃশ্য মনে হতো এখন আর তার মনে হয় না। সকল দৃশ্যকে একই দৃশ্য মনে হচ্ছে। যেদিকেই চোখ নিয়ে যাচ্ছে আরতি সেদিকেই একই দৃশ্য; পিঁপড়ে টেনে নিয়ে যাচ্ছে মরা টিকটিকি; ব্যাঙের জিহ্বায় আটকে যাচ্ছে পিঁপড়ে; ব্যাঙের ঠ্যাং ধরা পড়ে আছে সাপের দাঁতে; মাছি মারা পড়ছে মাকড়সার তাঁতে। জীবজীবীজীবময় জগৎ।
‘মাছিমারা কেরানি’ বলে যে কথা আছে তা শুনে বা এরকম কোনো কেরানি দেখে হাসার বা অবজ্ঞা করার কারণ আছে বলে তার মনে হয় না। জগতটাতে যা ঘটছে তাতে জগতটাই এক বিরাট ‘মাছিমারা কেরানি’। প্রজন্মের পর প্রজন্ম জড়ের ভেতর, জীবের ভেতর এই নির্মম খেয়োখেয়ি, খাওয়াখাওয়ি, চিবাচিবিরই চঙ্ক্রমণ চলছে। এর বাইরে জীবেরা কিছুই করতে পারছে না; ভগবান বা আল্লাও কিছুই করতে পারছে না ঐ মাছি মারা কেরানির মতো ধরাধরি ছিঁড়াছিঁড়ির একই আর একঘেয়ে ব্যাপার ঘটাতেই আছে।
জীব বলে আলাদা কিছু নেই জড়ই জীব। জড় বলে কিছু নেই জীবই জড়। নড়লে জীব, না নড়লে জড়। যেমনভাবে জীবমাছি জড়মাছি হয়ে যাচ্ছে, জড়মাকড়সা জীবমাকড়সা হয়ে যাচ্ছে ঠিক তেমনভাবে পৃথিবীর আদিতে হঠাৎ করেই জড়ের ভেতর কিছু জড় নড়েচড়ে বলে উঠল— ‘আমরা জীব।’
তারা জীব হলো। নড়াচড়া শেষ হতেই তারা আবার জড়। জীব মানে নড়াচড়া আর জড় মানে নড়াচড়া না করা, এই-ই মাত্র ফারাক আর কিছু নয়।