X
সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
১৬ আষাঢ় ১৪৩২

ক্ষতচিহ্নিত হাড়মাংস অথবা নিছকই আত্মজনের কথা

গৌতম গুহ রায়
০৯ জুলাই ২০২৪, ১৪:২০আপডেট : ০৯ জুলাই ২০২৪, ১৪:২০

২২তম পর্ব


“আমরা মৃত্যু চাই না। যে পৃথিবী মৃত্যু দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয় এমন পৃথিবীর বদলে আমরা চাই ভালোবাসার বাস্তবতা এবং আনন্দে পরিপূর্ণ এক পৃথিবী।”
—গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ

এই পর্বটা যখন লিখছি তখন সীমান্তের অন্যদিকে, অন্য দেশ হয়ে যাওয়া আমারই দেশের, আমার মায়ের প্রতিরূপ এক মায়ের কন্যা স্নিগ্ধা বাউলের কান্না আমাকে শোকস্নাত, বিপর্যস্ত করে চলছে। আমার ওই বোনের অনেকটা জুড়ে থাকা তাঁর দাদার মৃত্যু, তাঁকে এক অমানুষ অনেক মানুষের চোখের সামনে প্রহারে মৃত্যু দিয়েছে। স্তব্ধ, নিশ্চুপ, নিষ্ক্রিয় দর্শক ওই মানুষেরা এই দৃশ্য দেখেছে।  বিনা অপরাধে, বিনা কারণে একটা তরতাজা নিষ্পাপ যুবকের মৃত্যু তারা কি উপভোগ করছিলো? তবে শোক শব্দটি কী শুধুই ব্যক্তিগত হয়? স্নিগ্ধার দাদার শিশু সন্তানের শোক, তার মায়ের শোক, তার বন্ধুদের শোক, তার সহকর্মীদের শোক...সব কি আলাদা আলাদা? এই সমস্ত জিজ্ঞাসার সামনে আমার শুধু কান্না পাই, নিজের অন্তরে। বিন্দু বিন্দু কান্নার ভেতর দেখি আমার স্বজন হারানো ব্যথার অনির্বাপিত দাগগুলো।

মানুষ আসলে মৃত্যুর সূচিকর্মেই জীবনের নকশিকাঁথা রচনা করে। গোটা জীবন এই মৃত্যুর সুচারু শিল্পের কারুকাজ দেখতে দেখতে আজ মৃত্যুকে অবশ্যম্ভাবী জেনে নিজস্ব শোক-হরণের শক্তি অর্জন করেছি। মহাভারতে পাই, ‘পৃথিবীতে আশ্চর্য কী?’ এই জিজ্ঞাসার উত্তরে বকরূপী ধর্মের কাছে যুথিষ্ঠির-এর স্মরণীয় উক্তি— ‘প্রাণিগণ প্রত্যহ মৃত্যুর ডাকে মরণের কাছে চলে যাচ্ছে, তবুও মানুষ ভাবে আমি বাঁচব।’ সব আশ্চর্যের রেশ একদিন স্তিমিত হয়ে আসে, ফুরিয়ে যায় তার ভোগ আকর্ষণ। কিন্তু মরণের অবশ্যম্ভাবী সত্যের বিকল্প নাই জেনেও জীবনের আশায় বাঁচে মানুষ। একবিংশ শতকে এসে আমরা মৃত্যুকে উদাসীন শীতলতায় অস্বীকার করে যাচ্ছি, তবুও শোক থেকে নিস্তার পাই কোথায়!

মৃত্যু কষ্টের স্মৃতি হাতড়ানো এই কথনে সমারসেট মম-এর একটি গল্পের কথা মনে আসছে। বাগদাদ শহরে এক ধনী বণিক তাঁর ভৃত্যকে কিছু সামগ্রী ক্রয়ের জন্য বাজারে পাঠালেন।   কিছুক্ষণ পরে ভীত-সন্ত্রস্ত-আতঙ্কিত মুখে সেই ভৃত্য মনিবের কাছে ফিরে এসে বলল— ‘আমি বাজারের মধ্যে এক ভীষণদর্শন স্ত্রীলোকের দেখা পেলাম। তার ভয়ংকর চাহনিতে বুঝেছি সে সাক্ষাৎ মৃত্যু। আমি আর এখানে থাকতে চাই না। আমাকে একটি ঘোড়া ও প্রাপ্য অর্থ দিয়ে বিদায় দিন। এই মুহূর্তে আমি সুদূর সোমারিয়াতে চলে যাব’। ঘোড়ায় চড়ে ভৃত্য চলে যাওয়ার পর ব্যবসায়ীটি নিজেই বাজারের মধ্যে গিয়ে হাজির হলেন। দেখা হল সেই ‘মৃত্যু রূপণী’ নারীর সঙ্গে। তিনি তাকে জিজ্ঞাসা করলেন— ‘তুমি আমার ভৃত্যকে ভয় দেখিয়েছ কেনো?’ উত্তরে সেই নারী বললেন— ‘আমি তো তোমার ভৃত্যকে ভয় দেখাই নি। আমি তাকে এই বাগদাদ শহরে দেখে অবাক হয়েছিলাম। কারণ তার সঙ্গে আজ রাত্রে আমার সোমারায় দেখা হওয়ার কথা।’ মৃত্যুর অবশ্যম্ভাবিতা, রহস্যময়তা নিয়ে অনেক কল্পনা ও কথা, কবিতালেখা হলেও মৃত্যুর ভয়ে সে আতঙ্কিত ভীত থাকে। দুর্লঙ্ঘ্য মৃত্যু অতিক্রম করা যায় না, তবুও স্বজন হারানোর ক্ষত অনেকের কাছে আমৃত্যু রয়ে যায়।

শৈশবে প্রিয় বন্ধুর আত্মহত্যা, আমার বটবৃক্ষ ঠাকুরমার মৃত্যু, পাড়ার ক্রীড়াপ্রিয় নীলদার মৃত্যু,  সামাজিক মানুষ হিসাবে সত্তরের ‘বসন্তের বজ্রনির্ঘোষের সময় প্রতিদিন আদর্শবাদী যুবকদের মৃত্যুর খবরে দুঃখ ছিলো অতলান্ত, এইসমস্ত দুঃখই একদিন জীবনের অন্তহীন পাঠ দিয়েছিল আমাকে। রবীন্দ্রনাথের মতো আজ বলতে ইচ্ছে করে— ‘হে মহাজীবন/হে মহামরণ। লইলু স্মরণ’। শ্রীমদ্ভগবতগীতার ভাষ্যে আশ্রয় চাই— ‘বাসাংসি জীর্ণানি’। স্বজন হারানো মৃত্যুর কথা লিখতে গিয়ে নচিকেতার কথা মনে আসছে। মৃত্যু ও ভয়, বিনাশ ও অবিনশ্বরতাকে নিয়ে বাহাসপ্রিয় নচিকেতাকে সমাজ ও পরিবারের দ্বন্দ্বগুলো পীড়িত করতো। সুবিধাবাদী আপোসের পথে না গিয়ে সে চাইত দ্বন্দ্বের মুখোমুখি মোকাবিলা করতে। যজ্ঞের বলিদানকে কেন্দ্র করে নচিকেতার খটকায় পিতা ক্ষুব্ধ হয়ে নচিকেতাকে যমালয়ে পাঠিয়েছিলেন। অন্তরের জিজ্ঞাসাকে এড়িয়ে না যাওয়ার প্রত্যয় তাকে বিপন্নতার দিকে নিয়ে যায়। সাক্ষাৎ মৃত্যুর সামনে দাঁড়িয়েও তিনি মেরুদণ্ড টানটান করে যমের মুখোমুখি হন। সংযমনীতে দাঁড়িয়ে শমনের মুখোমুখি নচিকেতা জিজ্ঞাসা রাখেন আত্মা ও অস্তিত্ব বিষয়ে। যম তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পরিবর্তে ধন-বিত্ত-নারী-পরিবার-পুত্র সহ সামাজিক সুখের মুষ্টিটা দিতে চেয়েছিলেন। নচিকেতাকে তাড়িত করেছিল তার অন্তরের জিজ্ঞাসা—আত্মা ও অস্তিত্ব বিষয়ক জিজ্ঞাসা—পাইয়ে দেওয়া তত্ত্বে বিভোর না থেকে এবং এড়িয়ে যাওয়াকে অতিক্রম করার শক্তি নিয়েই সে প্রত্যাখ্যান করেছিল সামাজিক সুখ ও মর্যাদার প্রলোভনকে। আজ, একদম অন্য সময়ে, অন্য প্রেক্ষিতে দাঁড়িয়েও আমার বিশ্বাস এই প্রত্যাখ্যানের শক্তিই মানুষের প্রকৃত অর্জন, অন্য যাবতীয় কিছু ভঙ্গুর, অসমাপ্ত, অস্থায়ী। জীবনকে প্রত্যাখ্যান করা যায়—মৃত্যুকে নয়। হয়ত তাই কবি লিখতে পারেন এমন মৃত্যুর কবিতা—

“যা কিছু জন্মায় সবই মৃত্যুর অধীন। তবু
কত আর জন্ম ঋণ, কত আর ত্রাহি কণ্ঠে বলা যায়
এই মৃত্যু, সেই মৃত্যু নয়। পথে পথে পাপের গুহায় ঢুকে
আদিম টোটেম হিম গলিত লাভায় জমা অধঃপতনের রাহু
যে মৃত্যুকে গ্রাস করে, এই মৃত্যু সেই মৃত্যু নয়।
এটা তার বিপরীত ব্যাকুল দ্যোতনা।”

মৃত্যুকে প্রত্যক্ষ ভাবে গোটা জীবনভর মানুষ দেখে যায়, আমরা এর ব্যতিক্রম নই। আমাদের বটবৃক্ষ আমার ঠাকুরমা যখন মারা যান তখন তাতে শূন্যতার হাহাকার ছিল কিন্তু শোকের আঘাত ছিল না। রবীন্দ্রনাথের মা যখন মারা যান তখন তার বয়স ছিল চোদ্দ বছর, আমার বটবৃক্ষ যেদিন মারা যান তখন আমর বয়স চোদ্দ। রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন— “...সেদিন প্রভাতের আলোকে মৃত্যুর যে রূপ দেখিলাম তাহা সুখসুপ্তির মতোই প্রশান্ত ও মনোহর। জীবন হইতে জীবনান্তের বিচ্ছেদ স্পষ্ট করিয়া চোখে পড়িল না। কেবল যখন তাঁহার দেহ বহন করিয়া বাড়ির সদর দরজার বাহিরে লইয়া গেল এবং আমরা তাঁহার পশ্চাৎ পশ্চাৎ শ্মশানে চলিলাম তখনই শোকের সমস্ত ঝড় যেন একেবারে এক-দমকায় আসিয়া মনের ভিতরটাতে এই একটা হাহাকার তুলিয়া দিল যে, এই বাড়ির এই দরজা দিয়া মা আর একদিনও তাঁহার নিজের এই চিরজীবনের ঘরকরনার মধ্যে আপনার আসনটিতে আসিয়া বসিবেন না।...ইহার পরে বড়ো হইলে যখন বসন্তপ্রভাতের একমুঠা অনতিস্ফুট মোটা মোটা বেলফুল চাদরের প্রান্তে বাঁধিয়া খ্যাপার মতো বেড়াইতাম— তখন সেই কোমল চিক্কণ কুঁড়িগুলো ললাটের উপর বুলাইয়া প্রতিদিনই আমার মায়ের শুভ্র আঙুলগুলি মনে পড়িত— আমি স্পষ্টই দেখিতে পাইতাম, যে স্পর্শ সেই সুন্দর আঙুলের আগায় ছিল সেই স্পর্শই প্রতিদিন এই বেলফুলগুলির মধ্যে নির্মল হইয়া ফুটিয়া উঠিতেছে; জগতে তাহার অন্ত নাই— তা আমরা ভুলিই আর মনে রাখি।’

আমাদের যৌথ পরিবারের গাঁথনিতে বিক্রমপুরের মালখানগর থেকে ভিটাচ্যুত আমার দাদামশাই জ্যোতিষচন্দ্র রায়ের পঞ্চপুত্রের অষ্টাদশ সন্তানের এক উঠান ছিল। এই আষ্টাদশের মধ্যে ‘পিঠাপিঠি’ ভাই ছিলাম আমি ও আমার সেজ জ্যেঠার ছেলে পার্থ। স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের বেড়ে ওঠা ছিল একই ছাঁচে ঢালা। বর্ষায় জমাজলের কাদামাঠে ফুটবল খেলার পর দুজনে খালি গায়ে পানা পুকুরে স্নান, ডাংগুটি খেলতে খেলতে ঢেঁকিশাকের গুটি হারিয়ে দুজনের প্রবল ঝগড়া। স্কুল থেকে ফেরার পথে দুজনের এবাড়ি ওবাড়ির পেয়ারা, জামরুল পারা। একদিন ওর চুপিচুপি পলান বুড়ার বাড়ির পেয়ারা গাছের উপর আমি, গাছে তলা থেকে পেয়ারা কুড়িয়ে নিয়ে ভোঁ ভোঁ পালানো। আমি বেচারা বুড়োর হাতে ধরা পরি, বাড়িতে নালিশ এলো। সেই রাতে আমার পড়ার টেবিলে ও নামিয়ে রাখল ভাগের ৫ টা পেয়ারা। বর্ষায় আমাদের গলির রাস্তায় জল না জমলেও পুকুরগুলো জলে থই থই করত।  আমাদের সে এক দারুণ মজার সময়। স্কুলে ‘রেইনি ডে’। বইপত্র যথাস্থানে রেখে হৈহৈ করে জলজমা মাঠে নেম পড়া। এরপর পানা পুকুরে স্নান। একদিন ‘আবিষ্কার’ হল যে কচুরিপানা জমা করে স্তূপ করে জলে ভাসালে তা ডুবে না। ব্যাস! আমাদের সেই সবুজে রঙের অদ্ভুত ভেলা তৈরি হল। ডোবার প্রায় সমস্ত কচুরিপানা এক জায়গায় স্তূপ করে তা বাঁশের লাঠি দিয়ে ঠেলে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হল। এরপর লাফ দিয়ে তাতে সওয়ার হওয়া। সে এক তুরীয় মজা! একে একে দুই তিন চার পাঁচ—পাঁচজন চড়লেই ‘অদ্ভুত সেই ভেলা টলমল’।  কচুরিপানার মধ্যে পা ডুবে যাওয়ায় পতনের শুরু। এই ‘আশ্চর্য জলযান’-এর প্রধান রূপকার ও পতনেরও নাবিক হত পার্থ। লোকজনের বিপদে আপদে জাহির হওয়া থেকে অফুরন্ত দুষ্টামির জন্য পার্থকে এক ডাকে সবাই চিনত। রবি ঘোষ তখন এক সিরিয়াস ও মজাদার ফিল্মি চরিত্র, পার্থকে পাড়ার মিত্র জ্যেঠু একদিন ‘গল্প হলেও সত্যি’ দেখে এসে পার্থর নাম দিল ‘রবি ঘোষ’। সেই থেকে সবাই ওর পার্থ নামটা ভুলতে শুরু করল, মহাভারতের মধ্যম পাণ্ডব থেকে সে হয়ে উঠল রবি ঘোষ।

আমাদের উদ্বাস্তু কলোনির ৫ নম্বর গলির মিত্রবাড়ি একাত্তরের যুদ্ধের সময় আর্থিক দিক দিয়ে চকচকে হয়ে উঠছিল। কথায় বলে কারো সর্বনাশ, কারো পৌষমাস। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিযোদ্ধাদের আমাদের শহর ও শহর সন্নিহিত এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের অনেক প্রশিক্ষণ শিবির করা হয়েছিল। আমাদের শহরের অধিকাংশ মানুষ মানসিক ভাবে শুধু নয় তাদের যাবতীয় সামর্থ্য নিয়ে বাংলার সেই স্বাধীনতা যোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়ান। পরবর্তীকালে এই শিবির বা ক্যাম্প নিয়ে আমি অনেক খোঁজ-খবর সংগ্রহ করি। আবার বেশ কিছু মানুষ এই যুদ্ধের টালমাটাল অবস্থার সুযোগ নিয়ে নিজস্ব ধন-সম্পত্তি বাগিয়ে নেওয়ার ধান্দায় নেমেছিল। জলপাইগুড়ি শহরের একদল প্রভাবশালী যুবকের সেই সময় সীমান্ত পার হয়ে ‘হাবিব ব্যাংক ডাকাতি’ এক চর্চিত বিষয় ছিল। সে নিয়ে ও তার পরিণতি নিয়ে পরে লেখা যাবে। এখন আমি আমার বাল্যকালে সবসময়ের সঙ্গী ভাইয়ের কথাই বলি। আমাদের সেই ‘মিত্র বাড়ি’র সুধাংশু মিত্র বাংলাদেশের হাবিব ব্যাংক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন বলে কানাঘুষো শোনা যাচ্ছিল। তাদের বাসায় নতুন একটা জিপ গাড়ি এল। পাড়ায় প্রথম ব্যক্তিগত চার চাকা। পাড়ায় প্রথম রান্নার গ্যাস এল ওই বাড়িতে—অর্থ নিয়ে আসে দাপট। কয়েকটি যাত্রী পরিষেবার বাস গাড়িরও মালিক হলেন তিনি। একদিন ওই বাড়িতে কলকাতার একগাদা ফিল্ম আর্টিস্ট এলেন। গাড়ি দেখার, গ্যাসের ভ্যান দেখার আগ্রহকে ছাপিয়ে গেল সেদিনের ভিড়। আমাদের অনেকেরই সেই প্রথম ‘রূপালী পর্দার নায়ক’দের মুখোমুখি দেখা । জানা গেল কলকাতার এক প্রেক্ষাগৃহ বা যাত্রাদল কিনে নিয়েছেন মিত্র জ্যেঠু। মিত্রকাকুর ডাকা নামের সেই আমাদের ‘রবি ঘোষ’ একদিন ফিল্মি কায়দায় মিত্র জ্যেঠুদের জিপগাড়িতে ঝুলতে গিয়ে চলন্ত গাড়ি থেকে ছিটকে পড়ল পাকা রাস্তায় উপর। আমরা ছুটে গিয়ে দেখি মাথা-মুখে রক্তাক্ত পার্থ সংজ্ঞাহীন হয়ে রাস্তায় পড়ে আছে। সেই জিপে করেই তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। মাথায় গুরুতর চোট। বেশ কিছুদিন হাসপাতালে থেকে সুস্থ হয়ে ফিরে এল সে। মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা এই পার্থ অনেক স্থির, চুপচাপ ও দুর্বল। তার সমস্ত হট্টগোল হুল্লোড় যেন সেই জিপ গাড়ির চাকার নিচে থেঁতলে গেছে। মাঝে মাঝে ওর জ্বর আসে, ডাক্তার বলে— ছেলে মানুষ, জ্বর তো হবেই। এর পরের বর্ষায় একদিন স্কুল থেকে প্রবল জ্বর নিয়ে ফিরল সে। এমন জ্বর হামেশাই হয়, তাই তখনই ডাক্তার ডাকা হয়নি সেদিন। মধ্যরাতে জ্বর আরো বাড়তে থাকল। থার্মোমিটার বগলে দেওয়া হল। ১০৪ ডিগ্রি। এত রাতে কী করা যায় ভাবতে ভাবতে জ্বর আরো বাড়তে থাকল। অ্যাম্বুলেন্স ডাকা হল। অবশেষে প্রায় দুই ঘণ্টা পরে হাসপাতাল থেকে অ্যাম্বুলেন্স এল। এম্বুলেন্সে তোলার আগেই বিছানাতেই হঠাৎ মাথা চেপে ধরে প্রবল চিৎকার করে একদম  চুপ করে গেল সে। ততক্ষণে ওর দেহ ঠান্ডা হতে শুরু করেছে। সদর হাসপাতাল আমাদের উদবাস্তু কলোনি থেকে দুই কিলোমিটারের মতো দূরত্বে। ইমার্জেন্সিতে থাকা ডাক্তার ঘুমোচ্ছিলেন, ডাকাডাকির পর ঘুম চোখে উঠে এলেন। অ্যাম্বুলেন্সেই এসে পার্থের নাড়ি টিপলেন— ‘আর কিছু করার নেই’। আমরা স্তম্ভিত হয়ে সেই সাদা এম্বুলেন্সটাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলাম। ডাক্তার সবকিছু শুনে পার্থের দেহটা উলটে পালটে দেখলেন। বললেন, ‘হয়ত মাথায় রক্তক্ষরণে মারা গেছে, খুব দেরি করে ফেলেছেন’। তিনি এরপর বললেন, ‘এখানে ভর্তি দেখালে পোস্টমর্টেম করতে হবে, যেহেতু হাসপাতালে আসার আগেই মৃত্যু তাই এটা নিয়ম।’

আমরা কয়েকজন থেকে গেলাম। বড়রা বাড়ি ফিরে গেলেন। অ্যাম্বুলেন্স থেকে পার্থর দেহটা মর্গের সামনে নামিয়ে রেখে এম্বুলেন্সটাও চলে গেল। মর্গের সামনের প্রাচীন ইট পাকা চাতালটায় সাদা কাপড়ে মোড়া একটা দেহ মাত্র সে তখন। জন্ম ও মৃত্যুর মাঝে কয়েকটা ঘণ্টা মাত্র। ক্রমশ রাতের অন্ধকার ফিকে হয়ে আসছিল। প্রভাতের নরম আলোয় কাপড়ে মোড়া পার্থর মুখটা বড্ড মায়াবী লাগছিল। চোখ মেলে ওই মুখটা দেখতে পারছিলাম না। নিয়ম আছে মৃতদেহ একা একা ফেলে রাখতে নাই, স্বজনকে ছুঁয়ে থাকতে হয়। চোখ বন্ধ করে আমি ওর দেহ ছুঁয়ে বসে থাকলাম। আমার বন্ধ চোখের ওপাড়ে দিঘির ঘন কালো জল, তাতে কচুরিপানার সবুজ স্তূপ। পার্থ বাঁশের লাঠি দিয়ে পুকুরের জলে আঘাত করে সেই অলৌকিক ভেলা জলে ভাসিয়ে দিচ্ছে আর মাঝ পুকুরের দিকে ভেসে যাচ্ছে সেই ভেলা। ভেলা থেকে ও হাত নাড়ছে, একা। পাড় থেকে আমরা ডাকছি পুকুরপাড় থেকে, ও অট্টহাস্যে আমাদের হাত নেড়ে টাটা দিচ্ছে। আমাদেরও পায়ের কাছে জমাট কচুরিপানা, তার কালো শেকড়ের রোম, ক্রমশ বুঝতে পারছি যে পায়ের নীচ থেকে জমাটবদ্ধ কচুরিপানা সরে যাচ্ছে। আমাদের পা কচুরিপানার মধ্যে ঢুকে যাচ্ছে, আমরাও ডুবে যাচ্ছি ক্রমশ। জলের সীমান্তে ক্রমশ ছোট হতে হতে মিলিয়ে যাচ্ছে পার্থ। মৃত্যুদূতের সাথি হয়ে যাবতীয় সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ভোগকে প্রত্যাখ্যান করে যাওয়া পার্থ কি নচিকেতার মতো যমের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করতে পারবে— কেনো জীবনের যাবতীয় অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ না দিয়ে সময়ের অনেক আগেই মানুষকে মৃত্যু দেওয়া হয়?

দুপুর হয়ে গেল পার্থর দেহ নিয়ে পাড়ায় ফিরতে ফিরতে। তখন গোটা কলোনির মানুষ আমাদের গলিতে দাঁড়িয়ে। মাত্র পনেরো ষোল বছরের একটা তাজা প্রাণ ঝরে গেলে সেই শোক জনতার মধ্যে দ্রুত সঞ্চারিত হয়। কিন্তু শোকের আয়ু ক্ষণস্থায়ী। একদিন শুধু কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতি ও ব্যক্তি শোক হয়ে রয়ে যায় এই ‘মানব সন্তান’। স্বজন হারানো কষ্টকে জয় করেই রবীন্দ্রনাথ তাই লিখতে পেরেছিলেন— ‘সংসারের বিশ্বব্যাপী অতি বিপুল ভার জীবনমৃত্যুর হরণ পূরণে আপনাকে আপনি সহজেই নিয়মিত করিয়া চারিদিকে কেবলই প্রবাহিত হইয়া চলিয়াছে, সে-ভার বদ্ধ হইয়া কাহাকেও কোনোখানে চপিয়া রাখিয়া দিবে না—একেশ্বর জীবনের দৌরাত্ম্য কাহাকেও বহন করিতে হইবে না—এই কথাটা একটা আশ্চর্য নূতন সত্যের মতো আমি সেদিন প্রথম উপলব্ধি করিয়াছিলাম’।

"জেগে জেগে যা জেনেছ—
জেনেছ তা— জেগে জেনেছ তা,
নতুন জানিবে কিছু হয় তো বা ঘুমের চোখে সে!
সব ভালোবাসা যার বোঝা হ’ল- দেখুক সে মৃত্যু ভালোবেসে।"
—জীবনানন্দ দাশ


চলবে

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
রুশ হামলায় ইউক্রেনের এফ-১৬ পাইলট নিহত
রুশ হামলায় ইউক্রেনের এফ-১৬ পাইলট নিহত
জামায়াত কর্মী পরিচয়ে মামলা বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ, পুলিশ বলছে ‘অভিযোগ নেই’
জামায়াত কর্মী পরিচয়ে মামলা বাণিজ্য ও চাঁদাবাজির অভিযোগ, পুলিশ বলছে ‘অভিযোগ নেই’
গোপালগঞ্জে ভ্যান চুরির মীমাংসা করতে বসে উল্টো সংঘর্ষ, আহত অর্ধশতাধিক
গোপালগঞ্জে ভ্যান চুরির মীমাংসা করতে বসে উল্টো সংঘর্ষ, আহত অর্ধশতাধিক
নতুন আলোচনার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে হামলার চিন্তা বাদ দিতে হবে: বিবিসিকে ইরান
নতুন আলোচনার আগে যুক্তরাষ্ট্রকে হামলার চিন্তা বাদ দিতে হবে: বিবিসিকে ইরান
সর্বাধিক পঠিত
ঘরে ঢুকে নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা, যুবককে পিটিয়ে হত্যা এলাকাবাসীর
ঘরে ঢুকে নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা, যুবককে পিটিয়ে হত্যা এলাকাবাসীর
এনবিআরের শীর্ষ ৬ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক
এনবিআরের শীর্ষ ৬ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক
এনবিআরের সব চাকরি ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা
এনবিআরের সব চাকরি ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা
ব্যাগে গুলির ম্যাগাজিন পাওয়ার বিষয়ে যা জানালেন উপদেষ্টা আসিফ
ব্যাগে গুলির ম্যাগাজিন পাওয়ার বিষয়ে যা জানালেন উপদেষ্টা আসিফ
এইচএসসি পরীক্ষা দিতে গিয়ে নিখোঁজ ছাত্রী সাভারে উদ্ধার
এইচএসসি পরীক্ষা দিতে গিয়ে নিখোঁজ ছাত্রী সাভারে উদ্ধার