X
শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪
৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

মেনির মা

আইয়ূব আল আমিন
২০ এপ্রিল ২০২০, ১৩:০০আপডেট : ২০ এপ্রিল ২০২০, ১৩:০০

করোনায় আমরা ভীত নই। বরং মোকাবেলা করছি গৃহে অন্তরীণ থেকে। এতে হয়ত কিছুটা বাড়তেও পারে মানসিক চাপ। তাই আসুন, খুলে দেই মনঘরের জানালা। নিজেকে চালিত করি সৃজনশীলতায়। আপনি নিয়মিত লিখছেন, বা এটাই হতে পারে আপনার প্রথম গল্প। লিখুন ফেসবুকে। চটজলদি ৫০০ শব্দের গল্প, বাংলা ট্রিবিউনের জন্য। একইসঙ্গে নমিনেট করুন আপনার পছন্দের আরও ১০ জন লেখককে। সেরা ১০ জন লেখক পাচ্ছেন কাগজ প্রকাশনের বই। আর অবশ্যই হ্যাশট্যাগ দিন #বাংলাট্রিবিউনসাহিত্য মেনির মা বাড়ির পুবদিকে উঁচা উঁচা কলমি ঝাড়ের ফাঁক দিয়ে মেটে সাদা জ্যোৎস্না উঠলে ঘুটঘুটে অন্ধকারটা কেটে গিয়ে আবার চারপাশটা ফর্সা হতে থাকে। কদমগাছ থেকে থপথপ শব্দ করে দক্ষিণ দিকে উড়ে যায় একদা বাদুড়। অনেক দূরে খেয়াপাড়ে তখনও হালখাতার মাইকে গান বাজছে; আবাল কালের সওদাগর...

শীত চলে গেলেও শিরশিরে ভাবটা আছেই। আমাদের ছনের ঘরের সামনে একচিলতে বারান্দায় আমি আসমার পাশে বসে আছি জলচৌকির এক কোণায়।

আঙিনায় আম্মা বড় পাতিলে ধান সেদ্ধ করছে আমাদের পাশেই। ধান সেদ্ধ করা এতবড় পাতিল অবশ্য আমাদের নেই। সন্ধেবেলা মাস্টার চাচার বাড়ি থেকে আনা হয়েছে। এই পাতিলটা ভরার মতো ধানও নেই আমাদের। তিন ধরা ধানে এর অর্ধেকটাও ভরেনি। সিসার পাতিলটার নিচে তিনটা ইট খাড়া করে আম্মা একটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে খড় ঠেলে ঠেলে দিচ্ছে আর মরমর করে পুড়ে যাচ্ছে আউশধানের শুকনো খড়গুলো। পাতিলের দুইপাশ দিয়ে লাল আগুনের শিখা অনেক উপরে উঠছে আর আম্মার মুখটা তখন বিজলি চমকানোর মতো লাল হয়ে যাচ্ছে।

আমি সেইদিকে তাকিয়ে থাকি। তার বিষণ্ণ মুখটা এই দেখি, এই দেখিনা। খড়ের ছাইগুলো উড়ে উড়ে শরীরে এসে পড়ে আর আমি ফুঁ দিয়ে দিয়ে ঝেড়ে ফেলি। পাশেই কচি লাউয়ের ডগা আগুনের ধোঁয়ায় একবার এদিকে দুলে একবার ওদিকে। চাঁদটা আরও উপরে উঠলে ঘরের লম্বা ছায়াটা আস্তে আস্তে ছোট হয়। বাবা তখনও ফেরেনা।

আমি আসমার কপালে হাত দেই। এইটুকু কপালটা গমগম করছে জ্বরে। আম্মা ধানের জ্বাল নিভিয়ে কলসি ভরে পানি নিয়ে আসে। একটা বড় পলিথিন মাথার নিচে রেখে মগ দিয়ে আম্মা আসমার মাথায় পানি ঢালে। কপাল বেয়ে দু-এক ফোঁটা পানি চোখের ওপর চলে আসলে আসমা ভুরু কুঁচকায়। আমি একহাত দিয়ে মুছে দেই সেই পানি আরেক হাতে কুপির দোয়াত ধরে থাকি। আসমার চুল বেয়ে পানি সাপের মতো গড়িয়ে গড়িয়ে আঙিনার এই মাথা থেকে ওই মাথায় চলে যায়। জ্যোৎস্নার আলো পড়ে চিকচিক করে সেই পানি।

সেদ্ধ ধানের ভেতর দেয়া মিষ্টি আলু বের করে একটুখানি আসমার মুখে ধরে আম্মা। তার শুকনো পাতলা ঠোঁট তিরতির করে কাঁপে। খায়না।

আম্মা আমাকে বলে তুমি খাও।

ওকে আমরা ঘরে নিয়ে যাই। ধীরে ধীরে রাতের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে আসমার জ্বরও বাড়তে থাকে।

আম্মা আসমাকে বুকে নিয়ে হাউমাউ করে কাঁদে। তার কান্না শুনে ও বাড়ির আবু চাচার মা উঠে আসে। বাইরে দাঁড়িয়েই বলে—এ্যাদ্দিন হয়ে গেল ছেড়ির জ্বরডা কমে না। ওষুধপাতি কী খাওয়ায় কে জানে! অরে হাসপাতালে নেও না ক্যান তুমরা বউ? এইদিনের জ্বর কিন্তুক ভালা না, একটা কিছু হইলে তখন টের পাবা...

পরের দিন সকাল সকালে আমি আর বাবা গাইয়ের দুধটা ছেঁকে বাছুরসহ নদী থেকে ভালো করে গোসল করিয়ে আনি। বাঁশঝাড় থেকে বাশের পাতা ছিঁড়ে খেতে দেই। সরিষার তেল হাতে মেখে আব্বা গাইয়ের শরীরে শিংয়ে মুছে দেয়। তাতে ঘিয়ে রঙের পশমগুলো আরও চিকচিকে হয়ে ওঠে।

আমাদের এই গাইটার নাম মেনির মা। আর দুইমাসের টকটকে লাল বাছুরটার নাম মেনি।

আমাদের দুইভাইবোনের চেয়ে এই মেনি আর তার মাকে আম্মা বেশি ভালোবাসে। আমাদের খাবার সময় হলে বলবে তোমরা একটু বসো, মেনির মাকে পানি খাওয়ানো হয়নি। পানিটা দিয়ে আসি... আমাদের থাকার মশারিতে কত ফুটো আর মেনির মাকে নিজের শাড়ি কেটে কী সুন্দর মশারি বানিয়ে দিল সেদিন।

আজ সকাল থেকে আম্মা একবারও আসেনি এদের কাছে। বেলা আর একটু বাড়লে আমি আর বাবা মেনির মাকে নিয়ে যখন রওনা হব তখন আম্মা এসে মেনিকে জড়িয়ে ধরে ডুকরে কেঁদে ওঠে। মেনি এদিকে তাকায় ওদিকে তাকায়। তার কাজলা চোখদুটো টলমল করে পানির মতো।

আসমারে দেইখো বলে বাবা আমাকে নিয়ে রওনা দেন। আমি আর বাবা ওদেরকে নিয়ে হাঁটছি। আমাদের ভালোবাসা আমরা হাটে নিয়ে বিক্রি করে দেব আজ।

হেঁটে হেঁটে অনেকদূর চলে আসি। মাঝেমধ্যে মেনি দাঁড়িয়ে পড়ে। আবার একদৌড়ে অনেকদূর সামনে চলে যায়। তার গলায় আমার বেঁধে দেয়া ঝুনঝুনিটা ঝুনঝুন করে বাজে।

ক্লান্ত হয়ে গেলে আমরা গাছের ছায়ায় বসে একটুখানি জিরোই। মেনির মাকে বাঁশের পাতা ছিঁড়ে দেই। আমি মেনির গলা জড়িয়ে বসে থাকি।

তারপর আবার হাঁটি।

হাঁটতে হাঁটতে আমার মনে হয়, ইস্ আজকে হাটে যদি মেনির মা বিক্রি না হতো। আবার সঙ্গে সঙ্গেই মনে হয় বিক্রি না হলে কালকে আমরা আসমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারব না। আমি বুঝতে পারি একজন মানুষ একটা জিনিস একই সঙ্গে দুইরকমভাবে চাইলেই কখনো পায়না।

কত বিচিত্র জীবনের সংকট! কত অদ্ভুত মানুষের চাওয়া, পাওয়া অথবা না পাওয়াগুলো।

আর এইরকম একটা টানাপোড়েন, একটা নিদারুণ বেদনা পৃথিবীতে একমাত্র মানুষই পারে বহন করতে,পারে আমি, বাবা, মা, আর আসমার মতো মানুষরা।

/জেড-এস/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
দাম কমেছে সবজি-মাংসের, তবু পরিস্থিতি অস্বাভাবিক
দাম কমেছে সবজি-মাংসের, তবু পরিস্থিতি অস্বাভাবিক
শর্তে একমত হতে পারেননি, বায়ার্ন ছাড়ছেন টুখেল
শর্তে একমত হতে পারেননি, বায়ার্ন ছাড়ছেন টুখেল
ইসরায়েলকে থামাতে হবে, আইসিজিতে দক্ষিণ আফ্রিকার আবেদন
ইসরায়েলকে থামাতে হবে, আইসিজিতে দক্ষিণ আফ্রিকার আবেদন
থানচির দুর্গম পাহাড়ি পাড়ায় আগুন, নিয়ন্ত্রণে এনেছে বিজিবি
থানচির দুর্গম পাহাড়ি পাড়ায় আগুন, নিয়ন্ত্রণে এনেছে বিজিবি
সর্বাধিক পঠিত
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
জাহাজে ওঠার পর কোরআনের সুরা শুনিয়ে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হয়
জাহাজে ওঠার পর কোরআনের সুরা শুনিয়ে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হয়
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে আসতে পারে আইনি ব্যবস্থা
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে আসতে পারে আইনি ব্যবস্থা
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নতুন সচিব
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে নতুন সচিব