জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমকে উদ্দেশ করে গালাগালের একটি অডিও ফাঁস হয়েছে। সোমবার (১৮ সেপ্টেম্বর) জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় প্রেসক্লাব কার্যালয়ে কুরিয়ারে করে পাঠানো একটি বেনামি খামে উপাচার্যকে গালিগালাজের অডিও ক্লিপ থাকা একটি ডিভিডি, সহকারী উপাচার্য বরাবরেএক ছাত্রীর সই করা পাঁচ পৃষ্ঠার একটি আবেদনপত্র ও একটি উড়োচিঠি পাওয়া যায়।
চিঠিতে বলা হয়, অডিও গালাগাল করেছেন নৈতিক স্খলনের দায়ে অভিযুক্ত পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মাহমুদুর রহমান জনি। জনির অনুগ্রহেই অধ্যাপক নূরুল আলম উপাচার্যের চেয়ারে বসেছেন বলে মন্তব্য করা হয় ওই অডিওতে। এছাড়া পাঁচ পৃষ্ঠার আবেদনপত্রের বিষয়ে বলা হয়, প্রক্টরের সহযোগিতায় ৪৩ ব্যাচের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের ভুক্তভোগী এক ছাত্রীকে দিয়ে জোরপূর্বক এই দায়মুক্তিপত্র লেখানো হয়েছে।
‘যৌন নিপীড়ক জনিকে বাঁচাতে তৎপর উপাচার্য, নেপথ্যে...’ শিরোনামে উড়োচিঠিতে প্রেরকের পরিচয় না থাকলেও চিঠির নিচে ‘ধন্যবাদান্তে: প্রক্টরিয়াল বডির একজন সদস্য’ উল্লেখ করা হয়।
৫২ সেকেন্ডের অডিও ক্লিপের শুরুতে বলতে শোনা যায়, ‘বাট ইউ ফরগেট, আই ওয়াজ ওয়ান্স আপন এ টাইম, আই ওয়াজ দ্য এক্স প্রেসিডেন্ট অফ বিএসএল—জেইউ। আমি হয়তো ধরা খাবো, ধরা খাবো না— এমন বলছি না। কিন্তু ধরা খাওয়ার আগে আমি চার-পাঁচটা মুখ শেষ করে দেবো। অ্যান্ড ভিসিকে আমি একজনকে দিয়ে রিচ করেছিলাম, ভিসি বলছে যে আমি ওকে বহিষ্কার করে দিচ্ছি, সাসপেন্ড করে দিচ্ছি। ওকে আইনের আশ্রয় নিতে বলো।’
অডিও ক্লিপের ৩২ সেকেন্ডের পর বক্তা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমকে উদ্দেশ্য করে গালিগালাজ করতে থাকেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট অনেকেই অডিও ক্লিপের কণ্ঠটি শিক্ষক জনির বলে নিশ্চিত করেছেন। তবে অডিও ক্লিপটি নিজের বলে অস্বীকার করেছেন মাহমুদুর রহমান জনি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এ ধরনের কোনও কথা আমি বলিনি। ভিসি স্যারকে গালিগালাজ কেন করবো? আর উপাচার্যকে চেয়ারে বসানোর এতো ক্ষমতা আমার নেই।
জনির মাধ্যমে উপাচার্যের আসনে বসেছেন এ মন্তব্যের বিষয়ে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক নূরুল আলমের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।
এদিকে বেনামি সেই খামে গত ১৬ জানুয়ারি উপাচার্য বরাবর পাঠানো ৪৩ ব্যাচের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের এক ভুক্তভোগী ছাত্রীর স্বাক্ষরিত পাঁচ পৃষ্ঠার আবেদনপত্রের কপি পাওয়া গেছে। ‘ইতোপূর্বে ২৪ নভেম্বর ২০২২ তারিখে আপনার বরাবর আমি যে লিখিত দরখাস্ত দিয়েছি তা প্রত্যাহার প্রসঙ্গে’ শিরোনামের ওই আবেদনপত্রের ৪ নম্বর পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা হয়, ‘জনি আমাকে প্রক্টর অফিসে নিয়ে যান এবং প্রক্টর স্যারের কাছে পরামর্শ নেওয়া হয় কীভাবে দরখাস্ত লেখা যায়। প্রক্টর স্যার কিছু পয়েন্ট বলে দেন এবং গুছিয়ে লিখতে বলেন। আরেকজন সহকারী প্রক্টর মহিবুর রৌফ শৈবাল সেখানে উপস্থিত ছিলেন। লেখার সময় কিছু সাংবাদিক প্রক্টর অফিসে চলে আসে তাই আমাকে বের করে নিয়ে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয় শৈবাল স্যারের গাড়িতে। এরপর বাকি লেখা সম্পন্ন করা হয়। পরেরদিন প্রক্টর স্যারের বাসায় আপনার (উপাচার্য) অনুমতিতে জমা দিয়ে আমি লন্ডন চলে যাই।’
প্রক্টরের উপস্থিতিতে জোর করে দায়মুক্তিপত্র লেখানোর বিষয়ে জানতে চাইলে মাহমুদুর রহমান জনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এটি আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। যেখানে আমার দায়’ই নেই সেখানে দায়মুক্তিপত্র কেন লেখাবো?
প্রসঙ্গত, গত বছরের ২১ নভেম্বর মাহমুদুর রহমান জনির সঙ্গে একই বিভাগের সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত এক নারী প্রভাষকের একটি অন্তরঙ্গ ছবি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন স্থানের দেয়ালে প্রকাশিত হয়। এরপর তার বিচার দাবিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের একাংশ আন্দোলনে নামেন। পরে গত বছরের ৮ ডিসেম্বর ছাত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের অভিযোগে জনির বিরুদ্ধে প্রাথমিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়।
এদিকে চলতি বছর জানুয়ারিতে একই বিভাগের ৪৩তম ব্যাচের ভুক্তভোগী আরেক ছাত্রীকে বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে জনির পক্ষে ‘দায়মুক্তিপত্র’ লেখানোর অভিযোগ ওঠে। ৯ ফেব্রুয়ারি ওই অভিযোগের ঘটনায় সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর স্মারকলিপি দেয় বাংলাদেশ মহিলা পরিষদ।
মহিলা পরিষদের চিঠির পর জনির বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে তা জানতে চেয়ে ১ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় বরাবর চিঠি দেয় বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন (ইউজিসি)। এরপর আগের কমিটির প্রতিবেদন পূর্ণাঙ্গ হয়নি জানিয়ে গত ১৩ মার্চ পুনরায় স্পষ্টীকরণ কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন। এ কমিটি তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিলে গত ১০ আগস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সভায় তার বিরুদ্ধে স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠন করা হয়।
এদিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের চলমান রীতি অনুসারে শিক্ষকদের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের প্রাথমিক সত্যতা মিললে অভিযুক্তকে সাময়িক বরখাস্ত করে স্ট্রাকচার্ড কমিটি গঠিত হয়। তবে শিক্ষক মাহমুদুর রহমান জনির ক্ষেত্রে সেটি করা হয়নি।