রাজধানীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকার অ্যাপার্টমেন্টগুলোর বাসিন্দাদের কিছু অদ্ভুত নিয়ম নির্দেশনা দেখা যায়। কারা লিফটে উঠতে পারবেন না, অতিথিদের গাড়ি পার্কিংয়ে রাখা যাবে না, ছাদে কাপড় মেলা যাবে না। সারা মাস জেনারেটরের সার্ভিস চার্জ দেওয়া হলেও দিনের বেলা বিদ্যুৎ গেলে সাত তলাতেও হেঁটে উঠতে হবে। নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে না পারলেও ফ্ল্যাটের সহযোগিতাকারী ব্যক্তিদের জন্য এসব নিয়মকে শ্রমিক শ্রেণির প্রতি অবজ্ঞা হিসেবে উল্লেখ করেছেন সমাজ বিশ্লেষকরা। তারা বলছেন, নিজেদের ‘ক্লাস সচেতনতা’ একটা শ্রেণির প্রতি পরবর্তী প্রজন্মকে আরও বেশি অসংবেদনশীল করে তুলবে।
আরও পড়ুন: গণপূর্তমন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত চলবে
ধানমণ্ডির একটি আবাসিক ভবনে লিফটের সামনে লেখা, ‘অ্যাপার্টমেন্টের কোনও কোনও ড্রাইভার, গৃহকর্মী এবং খণ্ডকালীন গৃহকর্মী অ্যাপার্টমেন্টের রীতি রেওয়াজ ভুলে, অথবা না জেনে প্রায়ই ফ্ল্যাটের সাহেব, বেগম সাহেবা অথবা পরিবারের অন্যান্য সদস্যরা লিফট ব্যবহার করার সময় লিফটে উঠে পড়ে, এতে অনেকেই অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন। অ্যাপার্টমেন্টে বসবাসকারী পরিবারগুলোর সাহেব অথবা বেগম সাহেবরা লিফট ব্যবহার করার সময় সব ড্রাইভার, গৃহকর্মী ও খণ্ডকালীন গৃহকর্মীকে লিফট ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হলো।’
ধানমণ্ডির আরেকটি ভবনে লিফটের সামনের নোটিশে দেখা যায়, ‘কাজের বুয়া/হকার/সুইপার লিফটে ওঠা নিষেধ।’
রাজধানীর অ্যাপার্টমেন্টগুলোয় নিরাপত্তার বিধান না থাকলেও নিয়মের কমতি নেই।যে কেউ একটা ধমক দিলেই রেজিস্ট্রার খাতায় নাম না লিখে নির্দিষ্ট ফ্ল্যাটে যেতে পারেন বটে, কিন্তু যত নিয়ম সব প্রাত্যহিক সহযোগিতাকারীদের জন্য। ফ্ল্যাটের গৃহস্থালি কাজে সহযোগিতা করেন যিনি, ড্রাইভার, ঘরে ঘরে সংবাদপত্র পৌঁছে দেন যে হকার নিয়ম কেবল তাদের বেলা। এমনকি ঘরের ময়লা নিয়ে যায় যে শিশুটি তাকেও সিঁড়ি বেয়েই নামতে হয় ময়লা নিয়ে। ময়লা ফেলার মাসিক বিল নিতে এসে উপরে ওঠার সময়ও লিফট তার জন্য নিষিদ্ধ।
লালমাটিয়া নিবাসী জান্নাতুল ফেরদৌসী বলেন, আমাদের পরিচিত কিছু বাসায় আমরা এটা দেখেছি কিন্তু আমাদের অ্যাপার্টমেন্টে এমন নোটিশ নেই।
আরও পড়ুন: যে কারণে লোকসান গুনছে সরকারি চিনিকলগুলো
এদিকে বিল্ডিং এর নীচে যথাযথ পার্কিং নেই বলে যখন বাণিজ্যিক এলাকার ভবন গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন আবাসিক ভবনের গেটে লেখা- অতিথির গাড়ি বাইরে রাখুন। সেই বাইরেটা মানেই সামনের রাস্তার অর্ধেক।
এতে সাধারণের চলাচলে যেমন অসুবিধা হয়,তেমনি কখনও কখনও যানজটের সৃষ্টি হয়। নগরের বিভিন্ন জায়গা ঘুরে দেখা গেছে, ফ্ল্যাট বাড়ির ফটকে অতিথিদের গাড়ি ভেতরে না ঢোকানোর নিষেধাজ্ঞা। বাড়ির সামনে গাড়ি পার্কিং করতে বলা হয়েছে। বনানীর বীর উত্তম আবদুল হক সড়কের দুই পাশের প্রতিটি বাড়ির সামনেই গাড়ি পার্কিং করতে দেখা গেছে। এতে সড়ক সরু হয়ে এসেছে। সাধারণ পথচারীদের সড়কের ওপর দিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। রিকশা ও অন্যান্য গাড়ি চলাচলে তখন বেধে যাচ্ছে যানজট। এই সড়ক ছাড়াও বনানীর অন্যান্য সড়কের চিত্রও একই।
সামাজিক উন্নয়ন পেশাজীবী আব্দুল্লাহ আল মামুন মনে করেন, এটা মূলতঃ সামন্তবাদী চিন্তাধারার প্রতিফলন। সমাজের শ্রেণিকরণের ধারাগুলোও এ থেকে স্পষ্ট। এর ভেতর দিয়ে সমাজের কিছু ধনবান ও শিক্ষিত (পাশ করা অর্থে) জনগোষ্ঠীর সামাজিক চরিত্র ও মানবিক দীনতার প্রকাশ পায়।
তিনি আরও বলেন, সিদ্ধান্তগুলো এই ভবনের কিছু বাসিন্দা মিলে নেন এবং ব্যক্তিগত নিরাপত্তা ও আরাম আয়েশের স্বার্থে বাকিরা তা বেশ উপভোগ করেন। আমি প্রভাবশালী ব্যক্তিদের ভবনে দিনের পর দিন এ ধরনের নোটিশ দেখেছি, যেখানে অনেক নীতিনির্ধারক, সুশীল নেতা ও বুদ্ধিজীবী থাকেন। আমরা জানি, বৈষম্য বিলোপ আইন বলে একটা আইনের মাধ্যমে সকল নাগরিকের সমান মর্যাদা প্রতিষ্ঠার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। কিন্তু শুধু আইন দিয়ে সমাজের এ ব্যাধি সারবে না। আরও শঙ্কার দিক হলো, পরের প্রজন্ম ছোটবেলা থেকে এ ধরনের একটি অমর্যাদাকর ও বৈষম্যমূলক সামাজিক অপচর্চার ভেতর দিয়ে এবং এটাকেই স্বাভাবিক জেনে বড় হচ্ছে । ফলে আগামীতে সমাজে মানুষের মর্যাদাবোধ নির্ধারণ করে দেবে মানবিক মূল্যবোধ নয়, বরং অন্যকিছু । আমি মনে করি, অচিরেই সরকারের উচিত এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়ে একটা স্থায়ী সমাধান করা ।
আরও পড়ুন: পাকিস্তানকে নাক না গলানোর আহ্বান পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর
রাজনৈতিক নেতা ও অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বাকী বিল্লাহ বলেন, একটা দেশে সামগ্রিক সংবেদনশীলতা বা বোধবুদ্ধির স্তর কী ভয়ানকভাবে ক্রমহ্রাসমান তা ভেবে পীড়িতবোধ করেছি। পুরো সমাজ ও রাষ্ট্রে বোধের একটা চরম সংকট চলছে। লুটপাটের যে রাজনৈতিক অর্থনীতির নানা রূপ আমরা দেখছি, এটা তার অন্তর্গত আরেকটি রূপ। এই রূপ আমাদের সামনে কথিত উন্নয়নের যে বাগাড়ম্বর তার আসল চিত্রটি হাজির করছে। রাষ্ট্র ও সমাজে ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন হলে মানুষের মধ্যে অগ্রসর বোধ তৈরি হয়। কিন্তু এই বিজ্ঞপ্তির ভাষা এবং সাম্প্রতিক সময়ে এরকম আরও কিছু ঘটনায় আমরা বুঝতে পারি-আগের অবস্থান থেকে আমরা আরও অনেক পিছিয়ে গেছি।
এপিএইচ/