X
শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪
৩ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

কেন অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা!

রাফসান জানি
২০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৩৫আপডেট : ২০ জানুয়ারি ২০১৭, ১৩:৩৫

অপরাধে জড়াচ্ছে কিশোররা এলাকাভিত্তিক একাধিক গ্রুপ তৈরির খবর পাওয়া যাচ্ছে ঘন ঘন। কে কোথায় আসতে পারবে, কে পারবে না, কার ক্ষমতা কত বেশি, কে কার সিনিয়র, কে জুনিয়র এ নিয়ে কিশোরদের মধ্যে হরহামেশাই হচ্ছে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও হাতাহাতি। কখনও তা রূপ নিচ্ছে হত্যাকাণ্ডে। কিশোরদের বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পরার প্রবণতা আগে থাকলে এর পরিমাণ সম্প্রতি অনেকাংশেই বেড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তন এবং মূল্যবোধের অবক্ষয়কে এর অন্যতম কারণ হিসেবে মনে করছেন তারা।

কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পরার পেছনে বিভিন্ন উন্নত প্রযু্ক্তি পণ্যের ব্যবহার, বিদেশি সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্টতা ও তা অনুকরণ, সমাজে মূল্যবোধের অবক্ষয়, সামাজিক প্রেক্ষাপটে পারিবারিক অনুশাসন কমে যাওয়াকে দায়ী করা হচ্ছে।

সম্প্রতি উত্তরায় এলাকাভিত্তিক কিশোরদের গ্রুপিং বা গ্যাংবাজির শিকার হয়ে প্রাণ হারিয়েছে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থী আদনান। পূর্ব শত্রুতার জের ধরে ছুরিকাঘাতে তাকে খুন করা হয়। সেখানে রয়েছে উঠতি বয়সীদের বেশ কয়েকটি গ্রুপ। এসব গ্রুপের মধ্যে চলে মাদক সেবন, মারামারি। এলাকায় চলে শো-ডাউন, অস্ত্রের প্রদর্শনী। তারা বিভিন্ন স্কুল বা কলেজে পড়াশোনা করে। উত্তরাভিত্তিক এসব গ্রুপের সদস্যরা বেশির ভাগই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। পরিবারের অগোচরেই তাদের অনেকে জড়াচ্ছে বিভিন্ন অপরাধে।

অপরদিকে গত ১৮ জানুয়ারি তেজকুনি পাড়ায় প্রতিপক্ষের ছুরিকাঘাতে খুন হয় আব্দুল আজিজ নামের এক কিশোর ওয়ার্কশপকর্মী। এলাকায় কিশোরদের গ্রুপিং ও সিনিয়র জুনিয়র সমস্যার জেরে খুন করা হয় আজিজকে। এই গ্রুপিংয়ে যারা জড়িত তাদের অধিকাংশ নিম্নবিত্ত পরিবারের। খেটে খাওয়া শ্রমিক। কাজ করে তেজগাঁও ও কারওয়ান বাজারের বিভিন্ন ওয়ার্কশপে। এ ঘটনার পর জানা গেছে, হত্যাকারী হিসেবে আটক আরেক কিশোর সায়মনের চাকুর আঘাতে মৃত্যু হয়েছে আজিজের। তবে তারা দুজনই একই গ্রুপে চলতো। কিন্তু সমস্যা ছিল তারা একে অপরকে মান্য করতো না। কে কার বড় ভাই এই নিয়ে দ্বন্দ্ব ছিল। আর এই দ্বন্দ্বের জের ধরেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয় আজিজ।

একালাভিত্তিক গ্রুপিংয়ের মাধ্যমে কিশোরদের অপরাধে জড়িয়ে পরার কারণ হিসেবে যুগের পরিবর্তনকে দায়ী করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক জিয়া রহমান।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা মূলত একটা সময়ের ট্রানজেকশনে আছি। সব দেশেই এমন সময় যায়। যখন কিশোর অপরাধ বেড়ে যায়।’

বর্তমান সময়ের কিশোররা উন্নত প্রযু্ক্তির মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে আকৃষ্ট হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমাদের দেশের কিশোররা বর্তমানে অনেক উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করছে। তারা এর মাধ্যমে পশ্চিমা সংস্কৃতির প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে এবং সেই সব সংস্কৃতি নিজেদের মধ্যে ধারণ করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু এই জায়গায় তারা ব্যর্থ হচ্ছে। যে সংস্কৃতি তারা গ্রহণ করতে চাচ্ছে সেটা পুরোপুরি নিতে পারছে না। অন্যদিকে যারা নিচ্ছে তারাও এটার সদ্ব্যবহার করতে পারছে না। যার ফলে সমাজে এর একটা কুপ্রভাব পড়ছে। বাড়ছে কিশোর অপরাধ।’

তিনি বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে ছেলেদের মধ্যে একটা প্রবণতা ছিল তারা লম্বা চুল রাখতো। আবার সেনা শাসনের সময় দেখা গেছে, এলাকাভিত্তিক ছোট ছোট গ্রুপ রয়েছে। তারা নিজের কাছে চাইনিজ কুড়াল, চাপাতি রাখতো। এগুলো ছিল তখনকার সময়ে কিশোরদের প্রবণতা। তবে তখন এগুলো হতো রাজনৈতিক ছত্রছায়ায়। আর বর্তমানে কিশোর অপরাধে জড়ানোর পেছনে অন্যতম আরেক কারণ হলো পুঁজিবাদি অর্থব্যবস্থার মাধ্যমে প্রচুর টাকার মালিক হচ্ছে অনেকে। আর এতে করে ছোট ছোট ছেলে মেয়েদের হাতে চলে আসছে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি অর্থ। সেই অর্থ তারা বিভিন্ন অপকর্মে ব্যয় করছে।’

অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, ‘পারিবারিক শাসন অনেকটাই কমে আসাও এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী। অধিকাংশ পরিবারে দেখা যায় বাবা-মা দুজনই চাকরি করেন। ফলে সন্তানের প্রতি তাদের যে রোল প্লে করার কথা সেটা হচ্ছে না। এতে করে সন্তানরা সহজে বিপথগামী হয়ে উঠছে।’

একইভাবে কিশোরদের অপরাধে জড়ানোর পেছনে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ কমে যাওয়াকেও দায়ী করছেন অধ্যাপক জিয়া রহমান। তিনি বলেন, ‘এখন এলাকা ভিত্তিক সামাজিক কার্যকলাপ নেই বললেই চলে। যা আছে তাতে কিশোরদের অংশগ্রহণ করার ‍সুযোগ খুব কম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছে না, খেলার মাঠ কমে এসেছে। সামাজিকভাবে অনুষ্ঠানের আয়োজন না থাকায় কিশোররা সাইবার জগতে বুঁদ হয়ে আছে। তারা সেখান থেকেই যা শিখছে তা প্রয়োগ করতে গিয়ে বিপথগামী হচ্ছে। এই প্রযু্ক্তি শুভ ব্যবহার আমরা তাদের শেখাচ্ছি না। ফলে অপরাধ বেড়ে চলছে।’

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী পরিচালক মো. নূর খান মনে করেন, সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের কারণে এ ধরনের অপরাধ বাড়ছে।

তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কিশোরদের মধ্যে এখন গ্রুপের একটা প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। এটা হচ্ছে এখনকার ট্রেন্ড। কিশোর অপরাধ আগেও ছিল। কিন্তু মাঝখানে একটা সময় তা ছিল না। এখন আবার শুরু হয়েছে।’ এর পেছনে সমাজের সর্বস্তরে অস্থিরতাকে দায়ী করেছেন নূর খান। তিনি বলেন, ‘সমাজের প্রতিটা স্তরে নীতি-নৈতিকতার অবক্ষয় হচ্ছে। এর ফলে সমাজ থেকে কিশোররা যা দেখছে তাই শিখছে। ফলে কিশোর অপরাধ বর্তমানে বেড়েছে।’

কিশোরদের অপরাধ থেকে দূরে রাখতে হলে সামাজিক আন্দোলনের কোনও বিকল্প নেই বলে মনে করেন নূর খান। তিনি বলেন, ‘কিশোররা সমাজ থেকে যা দেখবে তাই শিখবে। সে কারণে সমাজে নীতি নৈতিকতার চর্চা বাড়াতে হবে। সামাজিকভাবে নৈতিকতার অবক্ষয় রোধ করতে হবে। তাহলেই সমাজ থেকে কিশোর অপরাধ দূর করা সম্ভব হবে।’

/আরজে/এফএস/

আরও পড়ুন- 


তনু হত্যাকাণ্ডের ১০ মাস: এখনও ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অপরাধীরা

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
শরীফার গল্প ফেরাতে প্রতিবাদ করবে উদীচী
শরীফার গল্প ফেরাতে প্রতিবাদ করবে উদীচী
জাভিকে বরখাস্ত করতে যাচ্ছেন বার্সা প্রেসিডেন্ট
জাভিকে বরখাস্ত করতে যাচ্ছেন বার্সা প্রেসিডেন্ট
ইসরায়েলে অস্ত্র বহনকারী জাহাজকে  নোঙর করতে দেয়নি স্পেন
ইসরায়েলে অস্ত্র বহনকারী জাহাজকে নোঙর করতে দেয়নি স্পেন
প্রধানমন্ত্রী পুলিশের সুযোগ-সুবিধা অনেক বৃদ্ধি করেছেন: আইজিপি
প্রধানমন্ত্রী পুলিশের সুযোগ-সুবিধা অনেক বৃদ্ধি করেছেন: আইজিপি
সর্বাধিক পঠিত
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সিলেটে বছরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
জাহাজে ওঠার পর কোরআনের সুরা শুনিয়ে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হয়
জাহাজে ওঠার পর কোরআনের সুরা শুনিয়ে দস্যুদের নিবৃত্ত করা হয়
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
এমপিও আবেদন সরাসরি অধিদফতরে পাঠানো যাবে না
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে আসতে পারে আইনি ব্যবস্থা
ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সনদধারীদের বিরুদ্ধে আসতে পারে আইনি ব্যবস্থা
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি বিতর্ক
শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছুটি বিতর্ক