X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৭ বৈশাখ ১৪৩১

বাতাসের বিষে ধুঁকছে শিশুরা

জাকিয়া আহমেদ
২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৯:০৩আপডেট : ২২ ফেব্রুয়ারি ২০১৭, ১৯:১০

হাসপাতালের বিছানায় শিশু সাগর

১২ বছরের সাগর হৃদপিণ্ডে ছিদ্র নিয়ে হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ১৭ দিন আগে। গত সপ্তাহে তার অপারেশন হয়েছে। সাগরের দাদি মেহেরুন্নেছা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, জন্ম থেকেই সাগরের এ সমস্যা ছিল, তবে ইদানিং সমস্যাটা আরও বেড়ে যাওয়ায় তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।এরপর সাগরের অসুস্থতা নিয়ে কথা বলতে গিয়ে জানা যায় আসল কারণ, সে ইটের ভাটায় কাজ করতো। চিকিৎসকরা বলেছেন, ইটের ভাটায় কাজ করার কারণে হৃদপিণ্ডে ইনফেকশন হয়ে গিয়েছিল তার। ইট ভাটার কালো ধোঁয়া ও অন্যান্য রাসায়নিক পোড়ানো বাতাসের বিষে আক্রান্ত হয়েছে সে।

চিকিৎসকরা বলছেন, ঋতু পরিবর্তনের এই সময়টাতে ঢাকার বাতাসে ধূলার পরিমাণ এতো বেশি থাকে যে, বলা হয় বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে বিষ। একইসঙ্গে বিভিন্ন কল-কারখানার কালো ধোঁয়া, রাসায়নিক পদার্থও বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে, মিশছে নানা রাসায়নিক পদার্থ। এর ফলে মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন সব বয়সী মানুষ। বিশেষ করে অন্তঃসত্ত্বা নারী ও শিশুরা।গত ১০ বছরে শিশুদের এসব রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার প্রায় ৩ গুণ বেড়েছে।

রাজধানীর হৃদরোগ ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালে ঘুরে দেখা যায়, সেখানে শিশুরোগীদের সংখ্যা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। আর এদের মধ্যে বেশিরভাগই এসেছে ব্রংকাইটিস, অ্যাজমা, নিউমোনিয়া, হাঁপানি, হার্টের ইনফেকশন নিয়ে। হৃদরোগ হাসপাতালের বহির্বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগে এই হাসপাতালের বহির্বিভাগে ৩০ থেকে ৩৫ জন শিশুরোগী ভর্তি হতো। বর্তমানে এ সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৫০ থেকে ৫৫ জনে। প্রায়দিনই শিশুরোগীরা হাসপাতালে আসছে এ ধরনের অসুখ নিয়ে, ভর্তি হওয়া শিশুদের সংখ্যাও কম নয়। একই অবস্থা ঢাকা শিশু হাসপাতাল ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেও। 

শিশু হাসপাতালের বর্হিবিভাগ সূত্রে জানা যায়, প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ জন আসছে, যাদের মধ্যে ১০ থেকে ১৫ জন হাসপাতালে ভর্তি হচ্ছে। আর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালেরও একই অবস্থা। হাসপাতালের বহির্বিভাগের একজন দায়িত্বরত কর্মী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এ হাসপাতালেও প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০টি শিশু নিউমোনিয়া, ব্রংকাইটিস, অ্যাজমা, হাঁপানি, হৃদরোগসহ নানা রোগে আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে আসে।

হাসপাতালে দাদি মেহেরুন্নেসার সঙ্গে শিশু সাগর

হৃদরোগ হাসপাতালের শিশু বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঋতু পরিবর্তনের এই সময়টাতে বাতাসে ধূলার পরিমাণ বেশি থাকে, এ কারণে যেসব শিশু এমনিতেই অসুস্থ তাদের অসুস্থতার মাত্রা এই সময়টাতে আরও বেড়ে যায়, আর হৃদপিণ্ডে ছিদ্র নিয়ে যেসব শিশু জন্মায় তাদের ইনফেকশন হয়ে যায় এবং সেটা খুব অ্যালার্মিং। একইসঙ্গে তাদের হাঁপানিতে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনাও তৈরি হয়। একসময়ে ডায়রিয়ার যে প্রকোপ ছিল শ্বাসতন্ত্রজনিত রোগ সেটিও ছাড়িয়ে গেছে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

হার্টের অসুখে আক্রান্ত বাচ্চাদের বিদ্যালয়ে যাওয়া অন্তত এই সময়ে কিছুদিনের জন্য হলেও বন্ধ করে রাখা উচিত অভিভাবকদের। কারণ, ধুলো এবং রাসায়নিক পদার্থ থেকে তাদের ইনফেকশন হতে পারে। উন্নত দেশগুলোতে শিশুরা রোগাক্রান্ত হলে তাদের স্কুলে পাঠানো হয় না, কিন্তু পরীক্ষা, পড়াশোনার চাপের কারণে বাবা মা শিশুকে স্কুলে পাঠাতে বাধ্য হন, কিন্তু এটা হওয়া উচিত নয়। ছয়মাস থেকে দুইবছর পর্যন্ত শিশুদের ব্রংকাইটিস ভয়ঙ্কর বায়ুবাহিত একটি রোগ মন্তব্য করে ডা. আব্দুল্লাহ শাহরিয়ার বলেন, এটা যদি কোনও হার্টের রোগীর হয় তাহলে সেটা আরও খারাপ হয়ে যায়। আর এখন এসব রোগের চিকিৎসা দীর্ঘমেয়াদি হয়ে গিয়েছে, প্রতিটি পরিবারের চিকিৎসা খরচ বেড়ে যাচ্ছে।

গ্রিন লাইফ হাসপাতালের শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ডা. রাকীবউদ্দিন আহমেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, শিশুদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকে, আর শহরের দূষিত বাতাসের কারণে শরীরে অক্সিজেনের সঙ্গে বিষাক্ত সিসা মিশে যাচ্ছে। শ্বাসকষ্ট, নিউমোনিয়া, চর্মরোগসহ নানা রোগে তারা আক্রান্ত হচ্ছে, যেটা বিগত কয়েক বছরের তুলনায় অনেক বেশি।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রতিদিন ঢাকার রাস্তায় যোগ হওয়া নতুন নতুন গাড়ির পাশাপাশি রয়েছে পুরনো যানবাহন, যেগুলো থেকে ক্রমাগত নির্গত হচ্ছে কালো ধোঁয়া। উন্নত দেশগুলোতে বাতাসে ব্ল্যাক কার্বনের পরিমাণ ১৫ শতাংশ হলেও ঢাকার বাতাসে সেটা ২০ শতাংশ।

পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের সভাপতি আবু নাসের বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ২০১৪ সালের এই সময়টাতে বাতাসে একিউআই (এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স) ছিল ১৭২, অপরদিকে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে সেটা ছিল ৩৬১। বিগত কয়েক বছর ধরেই বছরের এই সময়টাতে ঢাকার বাতাস ক্রমাগত দূষিত হয়ে চলেছে। সালফার ডাই অক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, হাইড্রোজেন সালফাইড, কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রেট এসব সাধারণ ক্ষতিকারক পদার্থের পাশাপাশি রয়েছে সিসা, আর্সেনিক, ম্যাঙ্গানিজসহ মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকিতে ফেলা রাসায়নিক পদার্থ।

ঢাকার বায়ু দূষণ যদি সহনীয় মাত্রায় কমিয়ে আনা যায় তাহলে ব্যক্তিগত ও সরকারি চিকিৎসা ব্যয় কয়েক কোটি ডলার বাঁচানো যেত, শ্বাসকষ্টজনিত রোগে আক্রান্তের সংখ্যা কমে যেত ৮ থেকে ১০ কোটি এবং শ্বাসকষ্টজনিত রোগে মৃত্যুর হার কমে আসতো বলেন তিনি।

আবু নাসের খান বলেন, বছরের এপ্রিল মাস থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত বৃষ্টিপাত হয় বলে বাতাস দূষিত হওয়ার সুযোগ কমে যায়, কিন্তু নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত দূষিত বাতাসের পরিমাণ বেড়ে যায় ভয়াবহভাবে। আর সেই সঙ্গে এখন রাজধানী ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে যোগ হয়েছে অনিয়ন্ত্রিত ও অপরিকল্পিত ইটভাটা, রাসায়নিক কারখানা, রাস্তা মেরামত, ভবন নির্মাণকাজ, বর্জ্য অব্যবস্থাপনা এবং নতুন-পুরাতন মোটর যানবাহন।

/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
অষ্টম শ্রেণির স্কুল বাড়াতে চায় সরকার
অষ্টম শ্রেণির স্কুল বাড়াতে চায় সরকার
‘একটা দল মাথা-মুণ্ডু নেই, আজ এরে বহিষ্কার করে কাল আবার ওরে’
‘একটা দল মাথা-মুণ্ডু নেই, আজ এরে বহিষ্কার করে কাল আবার ওরে’
ভোলায় মাদ্রাসায় ও চট্টগ্রামে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দুদকের অভিযান
ভোলায় মাদ্রাসায় ও চট্টগ্রামে সাব-রেজিস্ট্রি অফিসে দুদকের অভিযান
আনারসের পাতা থেকে তৈরি হবে সিল্ক জামদানি শাড়ি
আনারসের পাতা থেকে তৈরি হবে সিল্ক জামদানি শাড়ি
সর্বাধিক পঠিত
ট্রাকের চাকায় পিষে দেওয়া হলো ৬ হাজার কেজি আম
ট্রাকের চাকায় পিষে দেওয়া হলো ৬ হাজার কেজি আম
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
চুয়াডাঙ্গা জেলায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
চুয়াডাঙ্গা জেলায় ইতিহাসের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা
সিস্টেম লস কমাতে সার্বক্ষণিক ম্যাজিস্ট্রেট চায় পেট্রোবাংলা
সিস্টেম লস কমাতে সার্বক্ষণিক ম্যাজিস্ট্রেট চায় পেট্রোবাংলা
এক ফ্রেমে এত ‘সুন্দরী’, স্মৃতিকাতর সকলেই!
এক ফ্রেমে এত ‘সুন্দরী’, স্মৃতিকাতর সকলেই!